Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আর্থিক সঙ্কটমোচনে ব্যাঙ্কের ভূমিকা কী, পথ দেখানোর স্বীকৃতি অর্থনীতির নোবেলে

কৌশিক ভট্টাচার্য

 


অর্থনীতির অধ্যাপক, আইআইএম, লখনউ

 

 

 

সম্প্রতি প্রতি বছরের মতন এবারও একাধিক বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনীতিতে এবারের পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকার তিন অধ্যাপক— বেন বার্নানকে, ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ। আমরা জানি যে, অর্থনীতিতে নোবেল নিজে কোনও পুরস্কার দেওয়ার কথা তাঁর উইলে লিখে যাননি। এই পুরস্কার দেওয়া প্রথম শুরু হয় আরও অনেক পরে, ১৯৬৯ সাল থেকে। নোবেলের সম্মানে অর্থনীতিতে এই পুরস্কার দেয় সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিক্স ব্যাঙ্ক। কিন্তু যেহেতু এই পুরস্কার অন্যান্য নোবেল পুরস্কারের সঙ্গেই দেওয়া হয় তাই এর সম্মান ও গুরুত্ব অন্যান্য নোবেল পুরস্কারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

আমেরিকার এই বছরের পুরস্কার প্রাপকদের তিনজনেরই বর্তমান বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। এঁদের মধ্যে বার্নানকে আর ডায়মন্ডের জন্ম ১৯৫৩ সালে, ডিবভিগের জন্ম ১৯৫৫-তে। তিনজনই দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে অধ্যাপনা করে এসেছেন। বার্নানকে শুধু অধ্যাপনাই করেননি, আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান হওয়ার সুবাদে সে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালক হিসেবে কাজও করেছেন বহুদিন।

অর্থনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আর্থিক সঙ্কট। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ এই আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। পৃথিবীজুড়ে এই আর্থিক সঙ্কটের সংখ্যা হঠাৎ করে খুব বেড়ে যায় ১৯৮০ আর ১৯৯০-এর দশকে। পৃথিবীর অর্থনৈতিক ইতিহাসে এই দুটি দশক খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আধুনিক বিশ্বায়নের শুরুটাও এই একই সময়ে। এই বছরের অর্থনীতির তিন নোবেলপ্রাপকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  কাজগুলিও এই সময়ে করা, অর্থনৈতিক সঙ্কটে ব্যাঙ্কের ভূমিকা নিয়ে।

 

১৯৭৩-৭৪ আর ১৯৭৯-৮০-তে পৃথিবীতে দু-দুবার খনিজ তেলের দাম বাড়ে এবং বেড়ে সত্তর দশকের গোড়ার দামের প্রায় চতুর্গুণ হয়ে যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে এই তেল বেচে সেই সময় সবচেয়ে বেশি লাভের মুখ দেখে আরবদেশীয় শেখরা। তারা তাদের লাভের টাকা সিধে ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাঙ্কে জমা করে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখা দরকার— হঠাৎ করে কোনও ব্যাঙ্কে অনেক টাকা জমা পড়লে সেটা কিন্তু ব্যাঙ্ক-পরিচালকদের কাছে যথেষ্ট চিন্তার কারণ। আমানতকারীদের টাকা ঠিকমতন খাটাতে না-পারলে কোনও ব্যাঙ্কই তাদের ঠিকমতন সুদ দিতে পারে না। ইউরোপ এবং আমেরিকার বড় ব্যাঙ্কগুলি তাই নিজেদের সুবিধের জন্য তাদের দেশের সরকারগুলির মাধ্যমে অনুন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর চাপ দেওয়া শুরু করে তাদের নিজেদের দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য।

এই বাজার উন্মুক্ত করার ব্যাপারটি আসলে করা উচিত ধীরে ধীরে, খুব সতর্কতার সঙ্গে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী এই কাজটিকে আগুন নিয়ে খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সাবধানতার সঙ্গে এই কাজ করলে দেশ উন্নতির পথে এগোবে, কিন্তু বেপরোয়াভাবে করলে বিপদ প্রায় অনিবার্য। ১৯৮০ আর ১৯৯০-এর দশকে পৃথিবীর বহু দেশ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় উপদেষ্টাদের কথা মেনে দ্রুত এই কাজ করতে গিয়ে প্রবল আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়।

অর্থনীতিতে এই আর্থিক সঙ্কট ব্যাপারটি অনেকটা ঘূর্ণিঝড়ের মতন। ঘূর্ণিঝড়ের যেমন একটি কেন্দ্র বা চোখ থাকে, আর্থিক সঙ্কটেরও তেমনই একটি কেন্দ্র রয়েছে এবং এই কেন্দ্রে থাকে দেশের ব্যাঙ্কগুলি। এবারের নোবেলপ্রাপকদের প্রধান অবদান অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা নিয়ে। এঁদের মধ্যে ডায়মন্ড আর ডিবভিগ তত্ত্ব দিয়ে দেখিয়েছেন, ব্যাঙ্কের উদ্ভাবন কীভাবে একটি অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের জমানো টাকাপয়সা আমরা নিজেরাই খাটাতে পারি, কিন্তু তাতে অসুবিধে অনেক। এমন কোনও সংস্থা যদি থাকে যা আমাদের সঞ্চয়কে ঠিকভাবে ঠিক জায়গায় আমানত করবে, তা হলে সঞ্চয়কারী এবং আমানতকারী— উভয়েরই সুবিধে।

প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তেই অল্পবিস্তর ঝুঁকি থাকে। ব্যাঙ্কের কাজটিই এমন যে, ব্যাঙ্ক নিজে তো ঝুঁকি নেয়ই, এর সঙ্গে যাঁরা-যাঁরা যুক্ত তাঁরা সকলেই যথেষ্ট ঝুঁকি নেন। ডায়মন্ড-এর একটি বড় কাজ অর্থনীতিতে ঝুঁকির পরিমাপ ও ভূমিকা নিয়ে। ব্যাঙ্কের কাজে ঝুঁকি কমানোর জন্য সঞ্চয়কারী চাইবেন তাঁর নিজের ইচ্ছে-অনুযায়ী যখন খুশি যাতে তিনি তাঁর সমস্ত টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিতে পারেন। কিন্তু একইসঙ্গে সব সঞ্চয়কারী যদি এমন ভাবেন তা হলে যে কোনও ব্যাঙ্কের, এমনকী খুব ভাল ব্যাঙ্কেরও পতন অনিবার্য। একটি দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক যেহেতু ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে টাকাপয়সা ও অন্যান্য আর্থিক সম্পদের আদানপ্রদান করে, একবার কোনও ব্যাঙ্ক থেকে এরকম গণ-উত্তোলন (bank-run) হলে তা প্রায়ই এক ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে সংক্রামক ব্যাধির মতন নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক চালান যাঁরা, তাঁরা কোনওভাবেই এই ধরনের গণ-উত্তোলনের বাড়াবাড়ি চান না।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে আর তৃতীয় দশকের শুরুতে আমেরিকার অর্থনীতি এক প্রবল সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। এইসময় বিভিন্ন ব্যাঙ্কের থেকে জনতার গণ-উত্তোলন সঙ্কটবৃদ্ধিতে একটি বিশাল বড় ভূমিকা নিয়েছিল। বার্নানকের একটি বড় কাজ হল ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যে, সেই সময়ে ঠিক কী করলে এই সঙ্কট ঘটত না। বার্নানকের মতন বাকি দুজনও এই ব্যাপারে বিভিন্ন নিয়মকানুনের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখেছেন। তিনজনেই নিয়মিত ব্যাঙ্ক পরিদর্শন করার কাজটির ওপর জোর দিয়েছেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, এই তিনজনের মধ্যে বার্নানকে যখন আমেরিকার অর্থনীতির একজন প্রধান চালকের ভূমিকায়, সেই সময় সারা পৃথিবীব্যাপী এক বিশাল আর্থিক সঙ্কট আসে, যার শুরু নিঃসন্দেহে আমেরিকাতে। অনেকেই তাই এই সঙ্কটের জন্য বার্নানকেকে দায়ী করেন। বার্নানকের সঙ্গে অন্য দুজনের কাজ নিয়েও তাই প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নকর্তাদের যুক্তি অনেকটা এইরকম— অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে এত কাজ করে সেই অর্থনৈতিক সঙ্কটকেই যদি রোখা না-যায় তা হলে আর এত গবেষণা করে লাভ কী?

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি নিয়ে আবহাওয়াবিদরা বা ভূমিকম্পের উৎপত্তি নিয়ে ভূতাত্ত্বিকেরা প্রচুর গবেষণা করেছেন। তা সত্ত্বেও এখনও অবধি আমরা একেবারে নিখুঁতভাবে এগুলির উৎপত্তি নিয়ে আগে থাকতে কিছু বলতে পারি না। কিন্তু তত্ত্ব দিয়ে আর তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এসব ব্যাপারে বেশ কিছু চলরাশির (variables) ভূমিকা রয়েছে কি না, সেটা কিন্তু অনেকটাই সঠিকভাবে বলতে পারেন। এই তিন অধ্যাপকের গবেষণাও অনেকটা এই ধরনের। আর্থিক সঙ্কটের আভাস কোন-কোন চলরাশির মধ্যে রয়েছে সেই ব্যাপারটি তাঁরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বাকি গবেষকদের নজরে এনেছেন। আর্থিক সঙ্কট রুখতে গেলে কী কী কাজ করতে হবে সেই ব্যাপারেও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে।

বার্নানকের আর একটি মূল্যবান গবেষণা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আর সরকারের মধ্যে অনেকসময় কিছু চুক্তি হয়। আজকাল কোনও গণতন্ত্রে এই চুক্তিগুলি হয় খুল্লম-খুল্লাভাবে— কোনও গোপনীয়তা না-রেখে। এই চুক্তি ঠিক কী ধরনের হলে মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সুবিধে হবে, এই নিয়েও গবেষণা করেছেন বার্নানকে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেডের প্রধান হিসেবে তাঁর আবির্ভাব প্রায় প্রবাদপ্রতিম আর এক ফেড-প্রধান অ্যালান গ্রিন্সপ্যানের পরে। পরবর্তীকালে অবশ্য বোঝা যায় যে, যতখানি প্রশংসা গ্রিন্সপ্যান তাঁর রাজত্বে পেয়েছেন, ততটার সম্পূর্ণ যোগ্য তিনি ছিলেন না। নিজের আমলটিকে সঙ্কটমুক্ত রাখতে পারলেও পরবর্তীকালের সঙ্কটের বীজ লুকিয়ে ছিল গ্রিন্সপ্যানেরই কিছু কাজে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, বার্নানকে কিন্তু ফেড-প্রধান হিসেবেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন।

 

নোবেল পুরস্কার যেহেতু খুব অল্প লোকে পান, তাই এই পুরস্কার সঠিক ব্যক্তিরা পেলেন কি না তা নিয়ে প্রতি বছরই প্রচুর বিতর্ক হয়। অর্থনীতির বেলা এই বিতর্ক তো রয়েছেই, এর ওপরে আবার বাস্তবের অর্থনীতি বা অর্থনীতিবিদ স্বয়ং বা তাঁর সংস্থা আর্থিক সঙ্কটে পড়লেও সমালোচনা হয় প্রচুর। এই তিন অধ্যাপকের গবেষণার পরেও পৃথিবী থেকে আর্থিক সঙ্কট মিলিয়ে যায়নি, বরং ২০০৭-০৮-এ খোদ আমেরিকাতেই যে সঙ্কটটি এসেছে সেটি যথেষ্ট ভয়ঙ্কর। সেজন্য এবারের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কারপ্রাপকরা সত্যিই এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কি না তা নিয়েও প্রতিবারের মতো বিতর্ক শুরু হয়েছে।

নোবেল পুরস্কার নিয়ে তাই আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার। এই পুরস্কার দেওয়া হয় মূলত যাঁরা অধ্যাপনার কাজে যুক্ত, তাঁদের। অধ্যাপনার এই কাজটিতে সাধারণত তাত্ত্বিকরাই বেশি সমাদৃত হন। এই তত্ত্বগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করবার দায়িত্ব সরকারি আমলাদের, এবং এই কাজে প্রয়োজন সঠিক তথ্যের এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যালান ব্লাইন্ডার একবার বলেছিলেন যে, অর্থনীতিবিদরা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা পান সেই সব জায়গায় যেখানে তাঁরা সবচেয়ে কম জানেন, আর সবচেয়ে কম ক্ষমতা পান যেখানে তাঁরা সবচেয়ে বেশি জানেন। ব্যাঙ্ক অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ভূমিকা নিয়ে এখনও অবধি অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির অন্যান্য অনেক বিষয়ের তুলনায় কম জানেন। তাই বলে গবেষণার কাজ তো আর থেমে থাকতে পারে না। বিজ্ঞান নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করে তুলেছে প্রায় চারশো বছর ধরে, ক্রমাগত ঘষামাজার ফলে। আধুনিক গণিতনির্ভর অর্থনীতি বলতে আমরা যা বুঝি, সেই অর্থনীতি কিন্তু এই সময়টুকু পায়নি।

তাই, আমরা যদি নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক ভাবি, তা হলে বাস্তবের অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য অর্থনীতিবিদদের দায়ী না-করে সেইসব সঙ্কট থেকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করাটাই হবে আমাদের উচিত কাজ। বিজ্ঞানের মতন অর্থনীতিও থেমে থাকে না। আজকের নোবেলপ্রাপকদের যে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তা তাঁদের প্রায় চল্লিশ বছর আগের করা কাজের জন্য। চল্লিশ বছর আগে এঁরা যে ভিতটি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন তার ওপরে আধুনিককালে কাজ হয়েছে প্রচুর, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু, সেসব তো অন্য গল্প!