![sompa](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2022/12/sompa.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
স্টেশনমাস্টারের কলম
“এ পুরস্কার হবে মানবসভ্যতার পক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, সবচেয়ে উপযোগী আবিষ্কারের স্বীকৃতি”— মৃত্যুকালীন ইচ্ছাপত্রে এমনই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। খুব পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিলেন, এ পুরস্কার সম্মানিত করবে তাঁদের, যাঁরা “during the preceding year, shall have conferred the greatest benefit on mankind.” গত শতাব্দীর একেবারে শুরুতে দাঁড়িয়ে সেই ইচ্ছাপত্রের মালিক স্যার আলফ্রেড নোবেল কি আঁচ করতে পেরেছিলেন, পরবর্তী ১০০ বছরে তাঁর নামাঙ্কিত সেই পুরস্কারই হয়ে উঠবে ইতিহাসের এ-যাবৎ সবচেয়ে আলোচিত, আকাঙ্ক্ষিত ও বিতর্কিত সম্মাননা?
সম্ভবত না। জীবৎকালেই নিজের অবিচুয়ারি পড়ার বিরল সুযোগ হয়েছিল স্যার আলফ্রেডের— যা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, মৃত্যুর পরে পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে স্রেফ এক মৃত্যুব্যবসায়ী হিসেবে— যিনি বিস্ফোরক তৈরির উপায় উদ্ভাবন করে সম্পত্তির পাহাড় গড়েছেন। পস্টারিটির দেবতাকে খুশি করতে নিজের জমানো টাকা মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার পরিকল্পনা, অতএব, তাঁর পক্ষে ছিল খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছনোর নয়, বরং কুখ্যাতির কালি মোছার চেষ্টা— স্রেফ পাপস্খালনের প্রাণান্তকর প্রয়াস। কিন্তু, সেই পুরস্কার কালক্রমে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছবে যে, ডিনামাইটের উদ্ভাবকের নাম জড়িয়ে থাকবে ভবিষ্যতের যুগান্তকারী সব আবিষ্কার ও আবিষ্কারকের সঙ্গে— না, অতি বড় সুখস্বপ্নেও এমন অত্যাশ্চর্য এক রিডেম্পশন-মিথের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে পারেননি ভদ্রলোক। বরং মৃত্যুশয্যাতেও আক্ষেপ করে গিয়েছেন, কবরে যাওয়ার পরেও গা থেকে নাইট্রোগ্লিসারিনের গন্ধ বুঝি বা তাঁর আর মোছার নয়।
নিজের বিতর্কিত পরিচয় আড়াল করার জন্য যে উদ্যোগ, তা-ই যে কালক্রমে অজস্র বিতর্কের জন্ম দেবে, সে কথাও কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন স্যার আলফ্রেড? ভাগ্যের কী আশ্চর্য পরিহাস— গুগল বলছে, গত ১২১ বছরের ইতিহাসে নোবেল নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, পৃথিবীর আর কোনও পুরস্কার একক কৃতিত্বে এত বিতর্কের জন্ম দিতে পারেনি।
একেবারে জন্মমুহূর্ত থেকেই তো বিতর্ক। ১৯০১-এ নোবেল পুরস্কারের প্রথম বছরে সাহিত্যে নমিনেশনই পাননি লিও তলস্তয়। সে-বছর তাঁর নমিনেশন জুটেছিল শান্তির জন্য, যদিও পুরস্কার মেলেনি। মজার কথা, সে-বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান সালি প্রুডহোম নামে এক অখ্যাতনামা সাহিত্যিক, যাঁর লেখা তখন, এমনকী পরবর্তীকালেও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ নেই! এর পরেও, ১৯০২ এবং ১৯০৯-এ শান্তির জন্য নমিনেশন পেয়েছিলেন তলস্তয়। তার চেয়েও বিস্ময়ের— ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবারই সাহিত্যে নমিনেশন পেলেও, ‘আনা কারেনিনা’ ও ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’-এর স্রষ্টার কপালে একবারও নোবেলের শিকে ছেঁড়েনি— না সাহিত্যের, না শান্তির!
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক অবশ্য তার পরেও বহুবার হয়েছে। ২০০৪-এ এলফ্রিড জেলিনেকের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে এতটাই জলঘোলা হয় যে, পরিণতিতে রেগেমেগে সুইডিশ আকাদেমির সদস্য ন্যুট আনলুন্ড পদত্যাগই করে বসেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, জেলিনেকের সাহিত্যের কোনও ছিরিছাঁদ নেই, তা আদতে পাতার পর পাতাজোড়া ছাইপাঁশের পাহাড়! ২০০৯-এ ফের বিতর্ক— এবার হের্টা ম্যুলারকে নিয়ে। একঝাঁক মার্কিন সাহিত্যিক সরাসরি অভিযোগ করে বসেন তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য নিয়ে— রোমানিয়ান-জার্মান ঔপন্যাসিক ম্যুলারকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করার মধ্যে তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন ইউরোকেন্দ্রিকতার অভ্রান্ত শিলমোহর। সেখানেই না-থেমে মস্ত প্রবন্ধ ফেঁদে বসেন কেউ-কেউ, ওয়াশিংটন পোস্টে ছাপা হওয়া সে প্রবন্ধ নিয়ে আরও একপ্রস্থ বিতর্ক শুরু হয়। একইভাবে ২০১৯-এ পিটার হান্ডকে-র সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে মস্ত হইচই বাধিয়ে দিয়েছিলেন সলমান রুশদি ও হরি কুঞ্জরুর মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা। তাঁদের অভিযোগ, বসনিয়ার গণহত্যার ঘটনায় স্লোবোদান মিলোসেভিচকে খোলাখুলি সমর্থন জানানো হান্ডকে আসলে আদ্যন্ত এক প্রতিক্রিয়াশীল লেখক। রুশদি-কুঞ্জরুর দাবিকে কার্যত মান্যতা দিয়েই, হান্ডকের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে সরকারিভাবে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল বসনিয়া-হার্জগোভিনা, কসোভো ও তুরস্কের মতো বলকান দেশগুলি।
অবশ্য শুধু তলস্তয়ই নন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার না-পাওয়ার তালিকায় রয়েছে আরও অনেক বাঘা-বাঘা নাম। আন্তন চেখভ, এমিল জোলা, মার্সেল প্রুস্ত, জেম্স জয়েস, অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ, খোর্খে লুই বোর্খেস, এজরা পাউন্ড, জন আপডাইক, আর্থার মিলার, মার্ক টোয়েন, চিনুয়া আচেবে— তালিকা নেহাৎ কম লম্বা নয়।
শুধু সাহিত্যই নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়েও অসংখ্য মেগা-বিতর্কের সাক্ষী থেকেছে গোটা বিশ শতক। হেনরি কিসিঙ্গার থেকে শুরু করে ইয়াসের আরাফত, শিমন পেরেস, ইৎঝাক রাবিন, মিখাইল গোরবাচভ, এমনকী হালের বারাক ওবামা— এঁদের প্রত্যেকেরই নোবেলপ্রাপ্তিতে বিতর্কের দুরপনেয় দাগ লেগে আছে। প্রশ্ন রয়েছে এলেনর রুসভেল্ট, ভাক্লাভ হাভেল, কোরাজন আকুইনোর নোবেল না-পাওয়া নিয়েও।
তবে, ধারে-ভারে-অভিঘাতে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে, নোবেল না-পেয়েও গত ছ-কুড়ি বছরের নোবেল-বিতর্কের ইতিহাসের একেবারে চুড়োয় বসে আছেন এক ভারতীয়। তিনি মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধি। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত টানা তিনবার, ১৯৪৭, এবং ১৯৪৮— মোট পাঁচবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের নমিনেশন পেলেও, কখনওই চূড়ান্ত তালিকায় নাম ওঠেনি তাঁর। তবে, ১৯৪৮-এ নমিনেশন পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। পরিণামে, ‘অন্য কোনও উপযুক্ত প্রার্থী না-থাকার’ কারণে, সে বছর শান্তি পুরস্কার দেওয়া থেকেই বিরত থাকে নোবেল কমিটি।
অবশ্য, মহাত্মা গান্ধিকে নোবেল দিতে না-পারার জন্য প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ করতেও পাক্কা চল্লিশটি বছর সময় নিয়েছিল নোবেল কমিটি। ১৯৮৯-এ চতুর্দশ দলাই লামাকে শান্তি পুরস্কার দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল, এ পুরস্কার এক অর্থে মহাত্মার স্মৃতিরই উদ্দেশে নোবেল কমিটির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। তারও ১৭ বছর পরে, ২০০৬-এ নরওয়ের নোবেল কমিটির তদানীন্তন মহাসচিব গেয়ার লুন্ডস্টাড দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, “১০৬ বছরের নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে মহাত্মাকে নোবেল দিতে না-পারা।” সেই প্রসঙ্গেই তাঁর সেই বিখ্যাত খেদোক্তি, “নোবেল পুরস্কার না-পেলেও গান্ধির তাতে কিছু যায়-আসেনি। কিন্তু, তাঁকে পুরস্কার দিতে না-পারা নোবেল কমিটির সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি।”
নোবেল-লোকগাথার মহাফেজখানা আলো করে বসে থাকা এত অসংখ্য হিরেমাণিক, এত বিচিত্র সব বিতর্ক, সাফল্য ও আশাভঙ্গের কাহিনি আসলে একটাই কথা প্রমাণ করে। তা হল, টাকার অঙ্কে আজকের নিরিখে মামুলি হলেও গুরুত্ব ও সম্মানে নোবেল আজও অনন্য। সে কারণেই, এবারও যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার মাত্রই দিনকয়েক আগে সম্ভাব্য প্রাপকের তালিকায় ভেসে উঠেছিল আমাদের অল্ট নিউজ-এর প্রতীক সিনহা এবং হর্ষ মন্দর ও তাঁর কারবাঁ এ-মোহব্বত-এর নাম, তা ভাইরাল হতে নিমেষমাত্রও সময় লাগেনি।
সাহিত্য বা শান্তির নোবেল পুরস্কার নিয়ে এত আলোচনা হলেও, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল প্রাপকদের নিয়ে বিতর্ক তুলনায় কম, তার একটা বড় কারণ সম্ভবত সেসব বিষয় সাধারণ মানুষের নাগালের অনেকটাই বাইরে। এক তো, বিজ্ঞানের টেকনিক্যাল বিষয়গুলি সম্পর্ক আমাদের ধারণা কম, তার ওপরে পুরস্কারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানচর্চার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আবিষ্কার— যেগুলি আমাদের ধরাছোঁয়ার আরও অনেক বেশি বাইরের। সে কারণেই, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এবারের সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি বিভাগে আমরা চেয়েছি এ বছরের নোবেলপ্রাপকদের পরিচিতি ও তাঁদের কাজের ক্ষেত্রগুলি যথাসম্ভব সহজভাবে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে। এ কাজে আমাদের যৎপরোনাস্তি সাহায্য করেছেন এ সংখ্যার লেখকরা— অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, কৌশিক ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম মণ্ডল, মানস চক্রবর্তী, স্বপন ভট্টাচার্য ও ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য যেভাবে লেখাগুলি তৈরি করে দিয়েছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আশা করব, লেখাগুলি আমাদের পাঠকদের ভাল লাগবে ও তাঁদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। লেখাগুলি পড়ে আপনারা মতামত জানালে আমাদের উদ্যোগ সার্থক হবে।
প্রচ্ছদকাহিনি ছাড়াও আমাদের অন্যান্য বিভাগ যথা গল্প, কবিতা, বিশেষ নিবন্ধ ও ধারাবাহিক রচনাগুলি যথারীতি প্রকাশিত হল।
সপ্রণাম, ইতি।
সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য
এই নোবেল পুরস্কার বিষয়ক ক্রোড়পত্রটি প্রকাশ করে সম্পাদকমন্ডলী ধীমান বঙ্গীয় পাঠকের কৃতজ্ঞতা অর্জন করলেন। এই ক্রোড়পত্র তাঁরা ইতোপূর্বেও প্রকাশ করেছেন। এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অক্ষুণ্ন থাকবে এই প্রত্যাশা রইল।