Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

অনির্বাণ ভট্টাচার্য | আত্মহত্যাগুচ্ছ

আত্মহত্যাগুচ্ছ

 

 

 ১.

I am companionless;
occasionally, I see a late, suicidal headlight
burn on the highway and vanish,
now the haunted vacancy fills with friends.

Robert Lowell

অলৌকিক এসে গেছে
আর এসেই
ঘরের যা কিছু ধারালো, সরিয়ে একপাশে রেখে
পা টিপে টিপে দেখে নিচ্ছে
ওরা কতটা নিজস্ব আর কতটা দেখনদারি
আঙুল বুলিয়ে বুঝে নেয়
কাগজের ফুল, সেলোফোন, আর বেকেলাইট-ওঠা সুইচের
কে কতটা মরণাত্মক

পাতার নিচের দিকের মতো
বিষণ্ণ এক দিনে
আমি এই সব দেখি আর চা খাই
বলি ওহে সব ঠিকঠাক করছ তো
দেখো, ফাঁকি পেলে মাসোহারায়
দু আনা কম বই জুটবে না বেশি

অলৌকিক বিড়বিড় করে শুনে
তারপর বইয়ের পাতা থেকে টেনে ফেলে দেয়
থোরাজিন, লুকোনো নাম-না-বলা
হলুদ, গোল হ্যালোজেন
তারপর ঘরের আলো কমে এলে
ও নিজেই উঠে আলো জ্বালায়
একটা সিগারেট ধরায়
আর জোরে জোরে পড়ে লাওয়েল, প্লাথ,
সেক্সটন, বেরিম্যান—
‘উই আর ইউজিং আওয়ার ওন স্কিনস
ফর ওয়ালপেপার
অ্যান্ড উই ক্যান নট উইন’।

আমি এসবের মাথামুণ্ডু বুঝি না,
শুধু দেরি হচ্ছে ভেবে
ওকে বের করে দিয়ে সদর ভেজিয়ে উঠে আসি ঘরে
বুকের ঠিক দিকে কতগুলো ফেটাল আঘাতে হেমন্তের
শিশিরের মতো পড়ে থাকে
সাদা মৃত্যু, ভোরে, খুব ভোরে—
সেসব মেলাতে মেলাতে— ইন্টেরাপশন
দেখি সদরে দাঁড়িয়ে আছে অলৌকিক—
মনে পড়ল ওকে ট্যাক্সিভাড়া ধরিয়ে দিতে
বেমালুম ভুলে গেছিলাম

পারবে না
একমাত্র অলৌকিক ছাড়া
আমাদের আর কেউ
বাঁচাতে পারবে না।

 

২.

But Suicides have a special language
Like carpenters, they want to know which tools
They never ask why build

Anne Sexton

যা বলার বলে উঠে গিয়ে আশাবাদ
ছাদের পাইপ বেয়ে চোরের মতো
রোজ নিচে নেমে যায়

ওয়াং কার ওয়াই-এর ছবির মতো
একটা একা রাস্তায় আরও একা নীলচে এক টেলিফোন বুথের পাশে দাঁড়িয়ে
সিকিউরিটি ম্যান ওকে দেখে
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা স্যালিউট ছোড়ে

এইসব পরাবাস্তবের দরকার কী বলো?
পরের সিটিং-এ ওকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে বলে
দরজায় রেখে দিই দুটো মরা ব্লাডহাউন্ড
সিলিং-এর একপাশ থেকে ওপাশে ভাসে হলুদ আলোর প্রলাপ—
জ্যানাক্স, জ্যানাক্স, জ্যানাক্স…

ও এসবে অভ্যস্ত হয়ে একসময়ে উঠে এলে
আমি ওকে ডায়েরি পড়াই
দেখাই মিলেনাকে লেখা চিঠিতে কাফকার আদর—
‘আই ল্যামেন্ট দ্য লাইট অফ দ্য সান’।
তারপর একটা তুলোর বেল্ট দিয়ে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরি
যতক্ষণ না ওর জিভ উঠে আসে তালুতে
যতক্ষণ না ওর শেষ কথার রেশ
ওকে পা দুটো নাড়াতে নাড়াতে থামিয়ে দেয় হঠাৎ

তারপর নিভে আসা সূর্যয়
অনুতাপের লেশমাত্র থাকে না আমার

অন্তত,
বেঁচে থাকার কথা, ও
এজন্মে বলবে না আর।

 

৩.

A sort of walking miracle, my skin
Bright as a Nazi lampshade
My right foot

A paperweight
My face a featureless, fine
Jew linen.

Sylvia Plath

ইদানীং দরজা বন্ধ করার শব্দ
বড় প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে।

তারপর যা হয়
ঘরটা কাছে চলে আসে।

ঘর
নিখুঁত পরিপাটি বিছানায়, নেই
সিদ্ধান্তহীনতার তেমন কোনও ছাপ,
ওখানে চলকে পড়া
সূর্যের নিরন্তর দেহপসার—
বাঃ, চমৎকার।

পাশের ঘরের মৃদু শব্দ
এ-ঘরের দরজা জানলায়
অদ্ভুত কাঁপুনি ধরায়,
একটা কালো মনার্ক বাটারফ্লাই
দেওয়ালের জলে এসে বসে
আমাদের রাজতন্ত্র নেই, থাকা বলতে
ছাতার ভেজা দাগে, চিহ্নিত
জন্মান্তরের সিলুয়েট।

পোকা ওড়ে, একটা চামচিকে
মাঝে মাঝে মরে গিয়ে
খুব রাতে আবারও গোঙায় মানুষের ভাষায়
বিচিত্র, শ্বাস বড় বিচিত্র
আমাদের এই ডেরায়।

ড্রয়ার খুলে খুলে বাসন ভাঙার শব্দে
মাটিতে পড়ে ছোটবেলার জেমস বড়ি
জল দিয়ে গিলে খাওয়া
সেসব বিস্বাদ, তবু যেন লাল, নীল, হলুদ,
নস্টালজিক।

বাড়িওয়ালা মাঝে মাঝে আসেন
বৃষ্টির দুপুরে নীল এক পিওনের মতো ওঁর কাছে
নোটের অঙ্কও
যেন পতঙ্গবিলাস,
মাসপয়লার আগুনে
ওঁর বর্ষাতি শুকিয়ে রাখা অভ্যেস।

নেপালি ছেলেগুলো এক বোতল
বিয়ার পেলে রাজা,
নিজেদের ইকারুস ভেবে সারা রাত ওড়া
ভোর হলে ওদের সাদা ডানায়
টিকটক গুঁড়ো, পাহাড়ি বাচ্চা, তেরঙা
হিন্দুসসিতা হামারা।

পায়রার বিষ্ঠা, রেলিং থেকে দেখা
খাটের কাছে পড়ে থাকা
রুটিতে কাকেদের লোভ
আর দরজা গলিয়ে ধরা বিদ্যুৎ দপ্তরের চিঠিতে
এলিজাবেথ বিশপের মুখ
আমি সাতান্নর লাওয়েলের মতো পড়ি—
আমি মরে গেলে চিঠি লিখবে তুমি?
বলবে, আমার সময়ের নির্জনতম মানুষ
আমি, আমি, আমি?

বহুদিন এ ঘর
কোনও মির‍্যাকল দেখেনি

যাই, কাজে নামি।