ঈশ্বর পাথরকুচির পাতা, ঈশ্বর অযৌন জনন

মহাশ্বেতা আচার্য, অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

এদেশ তোমার জয়িতা। একান্ত তোমার। মনে হয় কখনও? দেশের প্রতিটা ডিটেইল, প্রতিটা নিখুঁত প্রেমের গল্প— তোমার। প্রতিটা উটকো প্লাস্টিক, বেওয়ারিশ কুকুর, ছাদের মরচে ধরা তারে লেগে একদিক ছিঁড়ে যাওয়া মায়ের শাড়ি, বালিশের ঘ্রাণ— সব, সব তোমার। আর দেশ বলতেই শরীর মনে পড়ে। মাটির শরীর, নারীর শরীর। আর সেখানেই রাষ্ট্র, পুরুষ আর লোভের চকচকে উল্লাসনামা। এবং তখন থেকেই আর এদেশ তোমার নয়। তোমার মা, বাবা, ভাই, তোমার প্রথম প্রেমিক— এদেশ কারও নয়। হাথরাসের ওই মেয়েটা, জয়িতা। কাল তিনজন বেকসুর খালাস। বেকসুর। দোষ নেই। বাকি ছেলেটির ‘কালপেবল হোমিসাইড, নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার’। একটা ওড়না জড়ানো দেশ। দেশের গলায় শ্বাসরোধের দাগ। ক্রমশ বাড়তে থাকা চাপ। আঃ, ছাড়ো, লাগছে। কতটা জোরালো? তুমি কোনওদিন অসম্ভব বজ্রপাতের রাতে একা একটা মাঠে গেছ? দূর থেকে তিন-চারজন পুরুষকে আসতে দেখেছ? গলা শুকিয়ে গেছে, পায়ে কেউ বসিয়ে দিয়েছে একশো মণের একটা পাথর? তুমি দৌড়তে পারছ না! একসময় কাছে এসেও তোমাকে পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা, কেমন অবিশ্বাস্য নির্লিপ্তির ভেতর। অথচ আরেকটা সমান্তরাল পৃথিবীতে ওরাই তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জয়িতা। বহু, বহুদিন পরে তুমি খুলে খুলে দেখাচ্ছিলে আমায়, এই দেখো, জিভ, দাঁত, লালার স্মৃতি। এই পুরুষ, এই লোভ। ইনহি লোগোনে, ইনহি লোগোনে, লে লিয়া দোপাট্টা মেরা। নাহ, আর না। এর চেয়ে অনন্ত ক্লস্ট্রোফোবিক আমি তোমার ভেতর ঢুকে যেতে যাই। তোমার নিজস্ব করিডর, ছোট্ট দুকামরার ঘর, দু-এক পশলা মশল্লাগন্ধের ভেতর ঢুকে যেতে চাই। কারণ এই দুর্গের বাইরে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না। কারণ আমি আজও যথার্থ পৌরুষ নিয়ে জন্মাইনি। তাতে সময়বিশেষের খেদ আছে। তোমার-আমার এমন এক অনন্ত অন্তরীণ চলুক। তুমি বলবে, ডোরবেল বাজছে যে, আমি বলব, বাজুক, খুলব না। ফোন বাজুক, ধরব না। তুমি ডরোথি পার্কার পড়েছ? শেষ বয়সে এক একবার ফোন এলে বা ডোরবেল বাজলেই বলতেন, হোয়াট ফ্রেশ হেল ইজ দিস! ফ্রেশ হেল। সদ্যোজাত নরক। এই নারীজন্ম, নরক। এই দেশের নদী, নদীর ওপর পড়ে থাকা পাতা, তার দুটো দিক, যেদিকে আলো পড়ে সেখানে চুল এলো করে বসে থাকা এক রাজকন্যা, আর যেদিকে আলো পড়ে না, সেদিকে একটি বি-গ্রেড চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, নাটকের আড়ালে দেশের মানচিত্র, পুরাণ, এবং ধর্ষণচিহ্ন— নরক, নরক, জয়িতা। বেঁচে থাকা, দুবেলা দুমুঠো ভাত সংগ্রহের চেষ্টা, প্রথম অক্ষরজ্ঞান, বালিকাবয়স— নরক।

এই জয়িতা, তুমি ঈশ্বর নিয়ে কখনও ভেবেছো? জন্মান্তর নিয়ে?

গত রাতে হিংসা লিখতে বসে একরাশ লজ্জা লিখেছি অমিতাভ। আসলে যেটুকু সলাজ, জানি ওইটুকু কবিতা। বরং কয়েকটা ছোট গল্প বলি। একটি মেয়ে, একা, কুড়ি-বাইশ— বিদেশি বিলাসবহুল বিচ-রিসর্ট, তার শরীরে সাজানো অসংখ্য স্যালাডের টুকরো, শশাকুচি, পেঁয়াজ। সবুজ পাতাগুলো হয়তো কিছুটা ঢেকে দিচ্ছে! ধনকুবেরদের সুরুচি হোটেলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ডিশ। সেই যেমন বহুযুগ আগে হতো, রাজারাজরাদের মানুষ-মানুষ সব দাবার ঘুঁটি। এ আমাদের নতুন হট-প্লেট, কোল্ড স্যালাড। এটা তো সংগঠিত ধর্ষণ নয়, আকস্মিক নয়, কেড়ে নেওয়া নয়। অনেক টাকার খেলা, কনসেন্ট! কনসেন্ট! কতদিন রাতে ঘুম আসেনি, অমিতাভ! ভেবেছি, শরীরজুড়ে ঠান্ডা আগুনে কেউ, সেঁকে তুলছে আমারই মতন অন্য কিছু খাবার। মনে পড়ছে, আমার বন্ধু সোনাগাছির ঘরে ঘরে ঘুরে কেমন যেন ব্যর্থ! ফিরে এসে আমার মেসবাড়ির সামনে এসে জল চাইছে আর বলছে, “ওরা আমাকে উঠোন পেরিয়ে ঢুকতেই দিল না, তুই ঢুকতে দিবি অন্তত?” কী বলবে, সদ্যোজাত নরক? নাকি ও মাথা ঠুকতে গেছিল স্বর্গের দ্বারে— knock knock knockin’ on heaven’s door! কনসেন্ট, অমিতাভ, সেই কনসেন্ট। ‘ওসব’ মেয়েরাও আজ ফিরিয়ে দিতে জানে, স্রেফ এখানেই আমিও আজ জিতে গেছি। অথচ আমি ভেবেছিলাম, দেবদাস ফিরে এলে পার্বতী ঠিকই ফিরিয়ে নেবে; আমি তো দেখেছি সন্ন্যাসী রাজা আর বোদল্যেয়রকে! তবু গত দশ বছর উত্তর পাইনি, কেন সেদিন হঠাৎ ওকে অস্পৃশ্য ভেবে একটু দূর থেকে হাতে একটা গেলাস ধরিয়ে দিয়েছি আর সেই অশুচি মাজতে থেকেছি দিনের পর দিন। ওই গ্লাসে আমার আর জল খাওয়া হয়নি! এখন তাতে ছোট্ট মানিপ্ল্যান্ট, শুভ অশুভ, লক্ষ্মীলাভ… এদেশে যৌনতা সহজ ও সুলভ— তবু তৃষ্ণা, তবু বক্ষজুড়ে এক্সটিক। একটি মেয়ে, একটা মহাদেশের মেয়ে— ধীরে ধীরে এই যুগে এসে মেনে নিচ্ছে ব্যাক-অ্যালি গর্ভপাত, মেনে নিচ্ছে বেআইনি পথ। যত গভীর তোমার প্রবেশ, অমিতাভ, ততই আমার আঘাতের সম্ভাবনা আর ‘নিম্ফোম্যানিয়াক’-এর সেই হুক-মেথডের একাকিত্ব। পুরুষটি শুনতে চায় না, জানতে চায় না ক্লিনিকাল ডিটেলস। তুমি কি আমার হয়ে তাকে জোর করে শোনাবে? ঈশ্বর তো ভার্জিন বার্থ অথবা পাথরকুচির পাতা, ঈশ্বর অযৌন জনন।

যৌনতা নিয়ে কথা বলতে গেলে টেলিফোন রাখি। তারটাকে জড়িয়ে গলায় পেঁচাই। আবার খুলি। আবার জড়াই। টেড হিউজ-এশিয়া উইভিল। টেলিফোনে প্রেম, কাম, উন্মত্ততা। সিলভিয়া শুনে ফেলেছিলেন। টেডের সেই লেখা জয়িতা— ‘ডু নট থিঙ্ক ইওর হাউস ইজ আ হাইড-আউট, ইট ইজ আ টেলিফোন।’ তুমি ঈশ্বরের কথা বলছিলে না? ‘ডু নট থিঙ্ক ইউ স্লিপ ইন দ্য হ্যান্ড অফ গড, ইউ স্লিপ ইন দ্য মাউথপিস অফ আ টেলিফোন।’ আমি এসব ভাবি, আর টেলিফোনের তার পেঁচিয়ে যায় গলায়। টেডের দাঁত, সিলভিয়ার জিভ, আমার গলা— পেঁচিয়ে যায়। একটা থ্রি-সাম উন্মত্ততায় আমার স্বপ্ন পূর্ণতা পায়। কারণ এতকাল যৌনতাকে আমি দেখে এসেছি একটা সামান্য উঁচু পাহাড়ের মতো। একটা পেরেক, দুতিনটে দড়ি, আর হালকা একটা রুকস্যাক দিয়ে সেখানে উঠতেই আমার শ্বাস উঠে আসছে গলায়। শ্বাসের শব্দে, অপ্রত্যাশায় নড়ে উঠছে পাশের ব্লু মেইডেনহেয়ার ফার্ন। আর সে পাহাড়ের সমান্তরালে দুতিনটে প্রজাপতি আর একটা শীর্ণকায় সাদা নদী এপাশ ওপাশ করছে। কখনও পোকাগুলো সামনে, নদীটা পিছিয়ে, কখনও নদীটা এগিয়ে এসে খেয়ে নিচ্ছে ওদের। এসব দৃশ্যপ্রতারণার বাইরে গিয়ে আমি দেখি পাহাড়ের কতটা উঠলাম। পাশে আর কে, কজন? ওদিকে আমার দেরি হয়ে গেছে অনেক। ততক্ষণে অবশ্য বন্ধুরা আগুন জ্বালাচ্ছে ওপরে। ওদের প্রেমিকা, ওদের দোনলা বন্দুকে আমাকে একটা পিগমি জিরাফের মতো লাগে। ওরা ট্রিগার চালায়। মিস। আবার ট্রিগার। মিস। টানা তিনবার কেউ মিথ্যে কথা বলে না। তৃতীয়বার। এবার লাগে। ঘাড়ে। আমি অনন্ত মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দেখি, কাঠিন্য বলে কিছু আর নেই আমার। নেই দৃঢ়তা। এসবে কতটা রূপক, কতটা মেমোয়্যার, তুমি কি বুঝতে পারছ জয়িতা? বার্গম্যানের ‘ফেস টু ফেস’। মেন্টাল ইনফার্মারির ভেতর এক দৃশ্য। লিভ বলছেন আর্লান্ড জোসেফসনকে। ‘জানো, গতরাতে আমার সঙ্গে এক আশ্চর্য হয়েছিল। দুজন পুরুষ আমার দিকে এল। একজন আমার শরীর নিয়ে ছিন্নভিন্ন করল। আমার বুকের ভেতর ওর মুখ, লাল, অসম্ভব লাল একটা মুখ। ভয় পেতে পেতে একটা সময় আমিও ভীষণভাবে চাইলাম ও আসুক ভেতরে।’ আর্লান্ডের প্রশ্ন ছিল, ‘আশ্চর্য কোনটা? তোমার এই চাওয়াটা?’ লিভ বলছেন— ‘না, আশ্চর্য এটাই, আমি চাইলেও, সেই পুরুষ আমার ভেতর ঢুকতে পারল না। চেষ্টা করেছিল, পারল না। এভরিথিং ওয়াজ শাট। অ্যান্ড ড্রাই…’

জয়িতা, অন্য কিছু বলি চলো, অন্য কিছু…

কথার সরণ চাও, অমিতাভ, শব্দের পরিত্রাণ! অথচ সেই লাল মুখ, তাকে আমি কোথায় সরাব? যে রঙে লেখা হয় “রক্তকমলকর রক্তঅধরপুট তাপবিমোচন করুণা কোর তব, মৃত্যু-অমৃত”, সেই রং আমাদের প্রতি মাসের সম্বল— পৃথিবীর ধাত্রীশক্তি। লক্ষ লক্ষ শরীর প্রতি মাসে সাজিয়ে তোলে একটা ঘর, একটা প্রকোষ্ঠ, একটা ডিম, আর কিছু ব্যবহার না হওয়া খুচরো ভুল হরমোন। সাজিয়ে তোলে আঁতুড়-জন্ম-মৃত্যু। তুমি বিশ্বাস করো, এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে মেট্রোতে আছে একরাশ ঋতুমতী মেয়ে। এ সপ্তাহে ঈশ্বরকে ছোঁয়া তাদের বারণ। তবু যাদের সঙ্গে তোমার ধাক্কা লাগে অজান্তে, ভাবো, সেও কি এক আশ্চর্য আইরনিক ভুল নয়? ওদের কারও নির্বাসন, কান্না, লুটিয়ে পড়া তোমরা জানতে পারছ না অথচ দেখো, সেসব যন্ত্রণার কথা ভাবতে ভাবতে তোমার টেলিফোনের তার কেমন যেন বকলেস হয়ে যায়। যতই আমার রাশ আমি ধরিয়ে দিই হাতে, ততই দেখি তোমার শিথিলতা আমাকে বাঁধতে পারে না। তাই স্মৃতি আর সত্যির মধ্যে আমরা একটা আশ্চর্য ব্রিজ গড়ে তুলছি অমিতাভ— যেখানে তুমি জমা রাখছ কিছু ধোঁয়াশা আর আমি রাখছি আলাদা আলাদা কিছু জল আর হাওয়া।

এলিমেন্টস অমিতাভ, এলিমেন্টস। ওই একই জল-হাওয়া দিয়ে তোমার ধোঁয়াশাও তৈরি অথচ তুমি মৌলিকতায় ভেঙে যেতে পারছ না! এখন আয়নার সামনে দিয়ে তোমাকে যতবার ওই বকলেস পরিয়ে আমি হাঁটিয়ে নিয়ে যাব, ততবার তোমাকে ভাবতে হবে ঠিক কীভাবে প্রতিবিম্ব ভাঙে, তোমাকে ভাবতে হবে কীভাবে ব্যবহৃত ডিম ভেঙে তৈরি হয় যমজ সন্তান। শব্দের তলদেশে নেমে এসো, অমিতাভ। চিত্রকল্প ছেড়ে নেমে এসো নগ্ন উঠোনে। মনে করো, আমাদের ‘ভাও অফ চ্যাস্টিটি’, Dogme-95। মনে করো, সেই বাহুল্যহীন, কৌশলহীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের কথা। লার্স ভন ট্রায়ার, শুরুর ম্যানিফেস্টো, যা থেকে উঠে আসবে চূড়ান্ত অবদমিত প্রকরণ, কাম-বাসনা, অনুচ্চার ভেঙে যাওয়া। মনে পড়বে সিদ্ধেশ্বরী দেবী, পূরবী অঙ্গের সাম্রাজ্ঞী, মধ্য-যৌবনে ভালবাসছেন মধ্যগগনের সূর্যসম ফৈয়াজ খানের ভৈরবীর মুখরা। তিন দশক পেরিয়ে এসেও কীভাবে যেন পুড়ে যাচ্ছেন বেনারসের সেই প্রৌঢ়া বাঈ। বলছেন, “তিস সাল হামনে লঙ্গোট বান্ধকে রাকখা হ্যায়।” আর এদিকে দু দশক পরে, ভন ট্রায়ারের নায়িকা এসে বলছেন “even the strongest fails to follow their own manifesto.” অমিতাভ, এভাবেই ম্যানিফেস্টো জিতে যায়, হেরে যায়। ডগমে-৯৫ থেকে যতদূর আজ ট্রায়ারের সিনেমা, আগ্রার খাস খেয়ালের থেকে ঠিক যতদূর আজ পূর্বী-অঙ্গের বসন্তের গান, ঠিক ততদূরেই দাঁড়িয়ে থাকছে তোমার-আমার যৌথ সন্ন্যাস। ওই সন্ন্যাস আর যৌনতায় দুলতে দুলতে আমার মেরি ম্যাগদালিনের মুখ মনে পড়ে। আমি কি অমনভাবে তোমাকে বিদ্ধ হতে দেখতে পারব, হে ঈশ্বর? ক্রুশবিদ্ধ সেই ন ঘন্টার ভেতর গলগথা প্রান্তরে আলো-ছায়া ঠিক কেমনভাবে খেলেছিল আমি নিশ্চিত নই। তবু আমি চাই তোমার মাথার ওপর যেন ছায়াটুকু থাকে, যেন বৃষ্টি আসে ধীরে। ধুলো-কাদার ওপর আমি যেন শুরুতেই অনন্ত লিখে রাখি। তুমি আমার গায়ের আশেপাশে এসে কিছু আঁচড় কাটো, আমিও অল্প দাঁতের দাগ দিই কাঁটার মুকুটের ঠিক নিচে। চিহ্নিত রাখি নিজস্ব নারী ও পুরুষ। ভেবে রাখি— “তবুও কল্কির ঘোড়া সরায়ে মেয়েটি তার যুবকের কাছে/সূর্যালোকিত হয়ে আছে।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. কাল ছিল রাত কালপুরুষের তরে
    নারীর মতো এক আকাশী তারা
    পরানটুকু রাখলো নাভির পরে
    পাগলা দাশুর খেলা ভুবনজোড়া
    সব লিখেছো আলোয় আলোর পর
    তবু দিলাম আমার কালোয় ভ’রে
    এ পাপ আমার এ পাপ তোমার জেনো
    দগ্ধাবে এ আগুন সে ঈশ্বরে !

আপনার মতামত...