Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সোয়ান্টে পেবো: প্রত্নজিনবিদ্যার পথে হোমিনিড ইতিহাসে আলো ফেলার পুরস্কার

স্বপন ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক 

 

 

 

মেডিসিন তথা শারীরবিদ্যায় এই ২০২২–এর নোবেল পুরস্কার এককভাবে পেলেন সোয়ান্টে পেবো প্রত্নজিনবিদ্যায় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় এককভাবে স্বীকৃতি, বিশেষত নোবেলের মত এত বড় পুরস্কার, আজকাল ব্যতিক্রমই বলতে হবে। কারণ আধুনিক জিনবিদ্যা পুষ্ট হয়ে চলেছে জীব ও ভৌতরসায়নবিদ, প্রযুক্তিবিদ, বায়োইনফরমেটিক্সে বিশেষজ্ঞ কম্পিউটার প্রোগ্রামার, স্ট্যাটিস্টিসিয়ান, ডেটা অ্যানালিস্ট এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা পেশাদারদের অবদানে। পেবোর কাজ, যা প্রত্নজীববিদ্যাকে এই প্রথম এত বড়ভাবে বিশ্বের নজরে আনল তাতে নৃতত্ত্ববিদদের অবদানও সমধিক। যদিও ঘটনা এই যে, প্রত্নতাত্বিক-উপাদাননির্ভর নৃতত্বের তুলনায় ক্রমশ আরও বেশি করে আলো কেড়ে নেওয়া জিননির্ভর নৃতত্ত্বের এই রমরমাকে সনাতন নৃতত্ত্ব-গবেষকসমাজ সবসময় ভালভাবে নিতে পারেনি। তবে তা অন্য গল্প। এই যে এতগুলো বিজ্ঞান-উপবিভাগের প্রয়োগ ও সাফল্য, ফলাফলগুলি ত্রুটিহীন এবং রিপ্রোডিউসিব্‌ল অর্থাৎ বারবার প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপন করার মত মুন্সিয়ানা রাখা— এ কাজ যে কোনও বৈজ্ঞানিকের পক্ষে এককভাবে করা দুঃসাধ্য, প্রায় অসম্ভব।

পেবোর ক্ষেত্রে একথা তো আরও সত্যি। তাঁর দ্বার খুলে দেওয়া গবেষণাপত্রগুলির এক-একটির লেখকসংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তবুও তিনি যে এককভাবে স্বীকৃতি পেলেন তার কারণ তিনি প্রত্নতাত্বিক গবেষণাকে বা আরও ভালভাবে বলতে গেলে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসকে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ফেলে পড়বার উপায় দেখিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে বিশ্বের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে প্রত্নজীববিজ্ঞান আজ উল্লেখযোগ্য চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। একটা ডিসিপ্লিনের জনক তিনি এই অর্থে যে তাঁর প্রদর্শিত পথে এবং উপাদানে এই সমস্ত গবেষণা গতি পেয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। পেবোর ছাত্র, ইয়োহানেস ক্রাউস, যিনি নিজেও এই চর্চায় এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এবং পেবোরই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের এখন ডিরেক্টর, বলেছেন— “Who else would you give it to?” প্রত্নজীববিজ্ঞানকে স্বীকৃতি দিতে গেলে আর কাকেই বা দিতে পারেন আপনি? আরও অনেকেই এখন এই বিষয়ে গবেষণা করছেন, কিন্তু  “but they are largely his scientific progeny”— তাঁদের সবারই তিনি জনক, বিজ্ঞান-পিতাস্বরূপ। পেবোর স্বীকৃতি যতটা না এককভাবে একটি কাজের তার চেয়েও বেশি বিজ্ঞানের একটা ডিসিপ্লিনের যা উৎস-মানুষকে আজকের দর্পণে দেখতে চায়।

 

পেবোর জন্ম ১৯৫৫ সালে স্টকহল্‌মে। মা কারিন পেবো-র পদবিতে পরিচিত হয়েছেন তিনি। যদিও তিনি পিতৃপরিচয়হীন নন। পেবো ১৯৮২-তে শারীরবিদ্যাতেই নোবেলপ্রাপ্ত সুইডিশ বিজ্ঞানী সুনে বার্গস্ট্রমের সন্তান। প্রত্নজীববিদ্যায় আসার অনেক আগে থেকেই তাঁকে টানত ইতিহাস, বিশেষত মিশরের প্রত্নইতিহাস। তেরো বছর বয়সে মার সঙ্গে মিশর ভ্রমণে গিয়ে মিশরের প্রত্নসম্পদ বিস্ময় উদ্রেক করেছিল তাঁর এবং তারই ফলস্বরূপ উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইজিপ্সিওলজিতে ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হয়ে যান, ইচ্ছে মমি নিয়ে গবেষণা করবেন। কোর্সে গিয়ে বুঝলেন সেখানে মমি কম, আদতে বিজ্ঞানই কম বরং লিপিচর্চার দাপট বেশি। সে পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে আসেন মেডিসিনে, প্র্যাকটিসিং ডাক্তার হওয়ার বাসনায়।

১৯৮৬-তে ডক্টরাল ডিগ্রির জন্য পেবো উপসালাতে কাজ করেছেন অ্যাডেনোভাইরাস সংক্রমণ ও মানুষের রোগ প্রতিরোধতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক উদ্ধারে, কিন্তু মিশরকে মাথা থেকে সরাতে পারেননি। বহুদিন ধরেই একমাত্র কার্বন ডেটিং এবং পারিপার্শ্বিক প্রত্নতাত্বিক নমুনা ব্যবহার করে মমির বয়স বিশ্বাসযোগ্যভাবে নির্ধারণ সম্ভব বলে বিশ্বাস করা হত। প্রাচীন দেহাবশেষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করাটা কোনও বড় ব্যাপার নয় কেননা হাড়, চুল বা দাঁত থেকে তা সংগ্রহের সুযোগ আছে এমনকি ধূলায় হয়েছে ধূলি— এমন নমুনা থেকেও তা পাওয়া সম্ভব, কিন্তু ব্যাপার যেটা প্রণিধানযোগ্য তা হল সেটাকে ‘বিশুদ্ধ’ অবস্থায় পাওয়া। ইজিপ্সিওলজিস্ট ব্যারি কেম্প তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থ Antient Egypt: Anatomy of a Civilization-এ সংশয়হীনভাবে জানিয়েছিলেন ইজিপ্টের রহস্য ডিএনএ তথ্য ছাড়া প্রকৃতভাবে উদ্ধার করা অসম্ভব।

জিনবিদ্যায় কয়েকখানা ল্যান্ডমার্ক ঘটনা ঘটেছে সত্তরের দশকে যা অনেক আপাত-অসম্ভবকে সম্ভব ভাবতে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। ১৯৭৭-এ ফ্রেডেরিখ স্যাঙ্গার প্রথমবার ডিএনএ-কে ‘পড়বার’ পদ্ধতি সামনে আনলেন— যার কেতাবি নাম ডিএনএ সিকোয়েন্সিং। আমাদের সকলেরই কমবেশি ধারণা থাকার কথা যে ডিএনএ বস্তুটা মোটামুটি বোরিং একটা ব্যাপার যার মধ্যে বৈচিত্র্য বলতে চারটে মাত্র বেস— অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন। সংখ্যায় অবশ্য তারা লক্ষ লক্ষ এবং তাদের সঠিক সজ্জাক্রম জেনে নেওয়াটাই ‘পড়া’ বা সিকোয়েন্সিং।

দ্বিতীয় যে ঘটনা জিন-গবেষণার গতি-প্রকৃতি আমূল বদলে দিয়েছে তা হল পিসিআর প্রযুক্তি। করোনার কল্যাণে আমরা PCR বর্ণত্রয়ের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত হয়েছি। কারি মুলিসের এই আবিষ্কার (পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) ১৯৮০-তে তাঁকে নোবেল এনে দেয় এবং জীববিজ্ঞানে ও চিকিৎসায় অনুসন্ধানের গতিপ্রকৃতিই বদলে দেয়। কণামাত্র ডিএনএ-কে খুব কম সময়ের মধ্যেই বিশেষ যন্ত্রে, বিশেষ রাসায়নিকের সাহায্যে পরিমাণে বহুগুণ বাড়িয়ে নেওয়ার এই প্রযুক্তিতে অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি— এই ভয় আর রইল না। কয়েক হাজার বছর আগের মানুষের দেহ থেকে যদি ডিএনএ মেলেও বা, তা হবে অতি সামান্য পরিমাণে। অত কমে গবেষণা হওয়া মুশকিল। পিসিআর এসে যাওয়ায় সে বাধা দূর হয়ে যায়।

আর একটা আবিষ্কার সত্তরের গোড়ার। সেটা হল জিন কাটার কাঁচি আর জিন জোড়ার আঠা। দুটোই রাসায়নিক পদার্থ যা ব্যাকটেরিয়াতে আছে। রেস্ট্রিকশন এন্ডোনিউক্লিয়েজ হল ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে পাওয়া একটা এনজাইম যা ডিএনএ-কে সুনির্দিষ্ট জায়গায় কেটে দিতে পারে। লাইগেজ হল ওই ব্যাকটেরিয়াতেই লভ্য আর একটা এনজাইম যা দুটি কাটা ডিএনএ খণ্ডকে জুড়ে দিতে পারে। এই দুই বস্তুই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দরজা উন্মুক্ত করে দিল। ফল হল এই যে, মানুষের ডিএনএ-খণ্ডকে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে জুড়ে দিতে পারা গেল। শুধু তাই নয়, এই হাঁসজারু ডিএনএ-কে জীবিত ব্যাকটেরিয়ার কোষে রীতিমত লালনপালন করাও সম্ভব হল। একে বলে ক্লোনিং।

এই তিন আবিষ্কারের সমন্বয়ে প্রাচীন দেহাবশেষ থেকে অতি সামান্য হলেও ডিএনএ সংগ্রহ করা, সেটাকে পিসিআর করে পরিমাণে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে নেওয়া, তাকে খণ্ড খণ্ড করে ক্লোন করা এবং সিকোয়েন্সিং করে প্রতিটি খণ্ডকে ‘পড়ে’ ফেলা কার্যত অসম্ভব নয়, যদিও পেবোর কথায়— অবাক হয়ে ভাবলাম ইজিপ্টের মমিতে কেউ এমনটা চেষ্টা করে না কেন?

নিজের পিএইচডি-র কাজ করছিলেন ইমিউনোলজিতে, মমিপ্রেম তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ডিএনএ ক্লোনিং-এর দিকে। ভয় পাচ্ছিলেন তাঁর গাইড রেগে যাবেন, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে রাত জেগে কাজ করে মমির টিস্যু থেকে ডিএনএ আহরণ করে সেটা ক্লোন করে ফেললেন। ১৯৮৫-তে তাঁর এই কাজ নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত[1] হল ঠিকই,  কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ল। কারণ ‘সফট টিস্যু’ থেকে আহৃত এই ডিএনএ যে খাঁটি, অর্থাৎ গবেষকের নিজের বা সংগ্রাহকের ডিএনএ বা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকের ডিএনএ তাতে যে মিশে নেই তা কী করে বোঝা গেল? বোঝা তো গেলই না বরং দেখা গেল মমির ক্লোন করা ডিএনএ-তে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আধুনিক মানুষের ডিএনএ ভেজাল হিসেবে মিশে আছে। প্রচুর সতর্কতা নিলেও এটা হওয়ারই কথা। কেননা মাটি থেকে, যে মানুষ মমিটিকে নাড়াঘাঁটা করছে তার থেকে এবং ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকের পচন মমিরও হচ্ছে— তার থেকেও কিছু ডিএনএ এখানে তো মিশতেই পারে এবং সেটাকে এড়িয়ে বিশুদ্ধতার সন্ধান করা তখনকার প্রযুক্তিতে অসম্ভব ছিল।

 

পেবো নেচারের জন্য যখন গবেষণাপত্রটি লিখছেন তখন ওই পত্রিকাতেই ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের অ্যালান উইলসন একটা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জেব্রার ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রকাশ করেন। নেচারে প্রকাশিতব্য নিবন্ধটির প্রুফ পেবো তাঁকে পাঠিয়েছিলেন পড়বার জন্য, উত্তরে উইলসন লেখেন— দয়া করে আপনার ল্যাবে যদি আমাকে নেন তাহলে একত্রে কাজ করার একটা সুযোগ থাকে। পেবো, তখনও ডক্টরেট হয়নি তাঁর, বললেন— সেটা তো সম্ভব নয় স্যার, তবে একত্রে কাজ করার সুযোগ হতে পারে যদি বার্কলেতে আপনার ল্যাবে একটা পোস্ট-ডক করার সুযোগ দেন!

১৯৮৭-তে বার্কলেতে যাওয়াটা পেবোর পক্ষে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত বিবেচিত হয়। এর একটা কারণ যদি এটা হয় যে অ্যালান উইলসন বিলুপ্ত প্রাণীর জিন নিয়ে কাজ করতেন তো অপর কারণটা হল পিসিআর-এর ব্যবহারে পারদর্শিতা। উদ্ভাবক কোম্পানি সিটাস-এর বাইরে পিসিআর-এর ব্যবহার প্রথম হয়েছিল অ্যালানের গবেষণাগারেই। এখানে তাঁরা দুজনে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির ডিএনএ কতটা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন আধুনিক মানুষের সঙ্গে তার ৯৯ শতাংশ জিনগত মিল। কিন্তু জিনের প্রকাশক্রম, জীবনের কোন পর্যায়ে কোন জিনটা প্রকাশিত হবে তা বেছে নেওয়ায় প্রকৃতি তাদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও বেশি অমিল রেখে দিয়েছে। তাঁরা এও দেখলেন যে এই বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে প্রায় দু লক্ষ বছর আগে যখন আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। পেবোর মানুষের বিবর্তনের বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে পড়ার সূত্রপাত এখানেই।

দুর্ভাগ্যবশত উইলসন রক্তের ক্যান্সারে ভুগে মারা যান ১৯৯১-তে এবং প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে বার্কলেতে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেবোর উপরে এসে পড়ে। তিনি লক্ষ্য ফেরান আদি মানব নিয়ান্ডারথালদের দিকে। আদি বলছি বটে, আসলে মাত্র ত্রিশ হাজার বছর আগেও তারা যে ইউরোপে ছিল তার প্রমাণ জার্মানি থেকে পাওয়া তাদের দেহাবশেষে আছে। দেখা যাচ্ছে এরা যখন ছিল তখন আধুনিক মানুষও ছিল। এদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল? কেবল বৈরিতার, নাকি তাদের মধ্যে ভাব-ভালবাসাও ছিল? এই সব প্রশ্নের জবাব ডিএনএ থেকে পাওয়ার সুযোগ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছিল, তবে তার জন্য ‘বিশুদ্ধ’ নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ দরকার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৯৬-তে পেবো বনের স্টেট মিউজিয়ামের কিউরেটরদের রাজি করান ৫০০০০ বছর আগেকার এক নিয়ান্ডারথাল দেহাবশেষ থেকে বাহুর হাড়ের একটা খণ্ড দিতে। সেই হাড় থেকে প্রাচীন সেই পূর্বপুরুষের কিছু কোষ তখনও সংগ্রহ করার মতো অবস্থায় ছিল।

কোষের মধ্যে থাকে নিউক্লিয়াস আর তার মধ্যে থাকে ডিএনএ— একথা আমরা সকলেই জানি এবং এও জানি যে একে বলে জিনোমিক ডিএনএ। তবে, এছাড়াও কোষের আর একটা অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়াতেও ডিএনএ থাকে। কিছু জিন সেও বহন করে এবং মাইটোকন্ড্রিয়া-বাহিত কিছু বংশানুক্রমিক ধর্ম মাতা থেকে সন্তানে প্রবাহিত হয়। এই নিরিখে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-র কিছু নিজস্বতা যেমন মানুষে আছে, তেমন মাছেও আছে, জিরাফেও আছে, নিয়ান্ডারথাল মানুষেও থাকবার কথা। পেবো এই মাইটকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-র বেস সজ্জাক্রমকেই পড়বার উদ্যোগ নিলেন।

ইতিমধ্যে সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তিতে কম্পিউটারের প্রয়োগ হচ্ছে এবং ভ্রান্তি কিছু কমিয়ে আনা যাচ্ছে। মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে আহৃত ডিএনএ-র সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন হলে দেখা গেল নিয়ান্ডারথাল হোমিনিডরা আধুনিক হোমিনিড হোমো স্যাপিয়েন্স-দের থেকে অনেকটাই আলাদা এবং ৫,৫০,০০০ বছরেরও বেশি আগে থেকেই তারা আলাদা। মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হল ১৬৫৬৯-টা বেস দিয়ে তৈরি একটা অণু। নিয়ান্ডারথালদেরও তাই, কিন্তু ওই একই ডিএনএ-তে তাদের ২৩৫টা বেস অন্য, তারা হুবহু একরকম নয়। প্রায় দেড় শতাংশের মত এই অমিল এই প্রথমবার পোক্ত প্রমাণ দিল যে আধুনিক মানুষ নিয়ান্ডারথালদের থেকে জিনগতভাবে আলাদা। যদিও তারা একই সময়ে পৃথিবীতে বসবাস করেছিল, তবু তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ঘটেছিল কিনা তা এই পর্যবেক্ষণ থেকে বলা সম্ভব ছিল না। তার জন্য জিনোমিক ডিএনএ সিকোয়েন্সটি পড়ে ফেলা প্রয়োজন।

 

জিনোমিক ডিএনএ যাকে বলি, যা নির্ধারণ করে মানুষ কেন মানুষ আর জিরাফ কেন জিরাফ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে মার্জনা চেয়ে রাখলুম), তা কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-র তুলনায় অনেক জটিল এবং অনেক বড়। বড় মানে তার ডিএনএ-তে বেসের সংখ্যাও বেশি— প্রায় সাড়ে ছয় কোটির বিপুল বেস-সমাহার হল মানুষের জিনোম। সেটাকে আগাগোড়া অশুদ্ধতা এড়িয়ে ‘পড়া’র কাজ ২০০৫ সালেই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তা তাজা মানুষের নমুনায়। প্রায় ফসিলে পর্যবসিত নমুনা থেকে জীবাণুর প্রভাব এড়িয়ে তা পড়া ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। বায়োইনফরমেটিক্স প্রয়োগের মুন্সিয়ানা ছাড়া এ অসম্ভবও বটে। বায়োইনফরমেটিক্স হল কম্পিউটারভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি যেখানে গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়, সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়, বিবর্তনগত নৈকট্য, সাযুজ্য বা দূরত্ব নির্ধারণ করা হয় সফটওয়্যারের সাহায্যে। পেবো তার গবেষণাগারে ডেকে নিলেন প্রত্নতত্ববিদ থেকে ইনফরমেশন টেকনোলজির এমন কিছু বিশেষজ্ঞকে যাঁদের মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে উৎসাহ রয়েছে। কম করেও চারশো কোটি বেস যার উপাদান তেমন একটি ডিএনএ, যা আবার সময়ের চাপে অতিভঙ্গুর এবং ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, তেমন একটি সজ্জাক্রমকে নির্ভুলভাবে ‘পড়তে’ পারাটাই পেবোর প্রধান সাফল্য যা আজকের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার গতি-প্রকৃতিই বদলে দিয়েছে।

পদ্ধতির সূক্ষ্মতায় এ আলোচনায় যাব না। কেবল এটুকু বোঝা যেতে পারে যে পড়ার কাজটা প্রথম বেস থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত চারশো কোটিতে পৌঁছে যাওয়া— না, এভাবে হয় না। খণ্ডে খণ্ডে কেটে নিয়ে পড়ার প্রযুক্তি যে ছিলই সেটা আগেই বলেছি। এঁরা মানুষের সিকোয়েন্সকে খণ্ডে খণ্ডে নিয়ান্ডারথাল সিকোয়েন্সের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে গেলেন। প্রতি ১৪০০ বেসের এক-একটি মানব ডিএনএ-খণ্ড মিলিয়ে যাওয়া হতে থাকল আহৃত নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ-র সঙ্গে ‘সিকোয়েন্স ক্যাপচারিং’ পদ্ধতিতে। এতে জীবাণু ডিএনএ-র অশুদ্ধতাও এড়ানো গেল আবার প্রাপ্ত নিয়ান্ডারথাল জিনোমিক ডিএনএ-র চারশো কোটি বেসকে ১৪০০০০০ বেসের একটি একটি করে বহুসংখ্যক খণ্ডে সম্পূর্ণ পড়ে ফেলা গেল।

আধুনিক মানুষের জিনোমিক ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছিল ইতিপূর্বেই যে, আধুনিক স্যাপিয়েন্সদের উদ্ভব ঘটেছিল আফ্রিকা থেকে অন্তত এক লক্ষ বছর আগে। পেবো ও তাঁর সহযোগীরা পৃথিবীর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে আধুনিক মানুষের ডিএনএ নিয়ে তুলনা করলেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত তিনটি নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ-র নমুনার সঙ্গে। দেখা গেল আধুনিক মানুষের ডিএনএ-তে ১ থেকে ৪ শতাংশ এমন সিকোয়েন্স আছে যা নিয়ান্ডারথালদের থেকে আসা এবং এদের মধ্যে যৌনমিলন ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। হোমিনিডদের এই দুই ‘কিসিং কাজিন’-কে সনাক্ত করে বোঝা গেল ১২০০০০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ-এশিয়ার দিকে ছড়িয়ে পড়ার পথে আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাচীনতর নিয়ান্ডারথাল হোমিনিডদের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছিল এবং তার কিছু ‘টেল টেল’ চিহ্ন আমাদের জিনোমে আমরা বহন করে চলেছি আজও। যতটা জিনগত সাযুজ্য থাকলে দুটো জীবকে একই প্রজাতির অন্তর্গত বলে মানা হয় স্যাপিয়েন্স মানব আর নিয়ান্ডারথাল মানবের মধ্যে সেই জিনগত সাযুজ্য যে নেই তা দেখিয়ে দিল পেবোর রিসার্চ। সুতরাং  ভিন্নতর হোমিনিড প্রজাতি হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস নামকরণ এতদিনে একটা মলিকিউলার মান্যতা পেল বলা চলে।

 

২০০৮-এ সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতাঞ্চলের ডেনিসোভা গুহা থেকে একটা অতি-প্রাচীন হাড়ের খণ্ড উদ্ধার হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে। ইতিমধ্যে পেবো জার্মানির লাইপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে প্রত্নজিনবিদ্যার গবেষণাগারের দায়িত্ব নিয়েছেন। নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ নিয়ে গবেষণায় সাফল্যের পরে একই প্রযুক্তিতে এগোলেন প্রথমে মাইটোকন্ড্রিয়াল ও পরে জিনোমিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর পথে। দেখা গেল স্যাপিয়েন্স মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়ার তুলনায় এখানে সাড়ে তিনশোরও বেশি বেস ভিন্নতর। এখানে জিনোমিক ডিএনএ অত্যন্ত সংক্রমণপ্রবণ ও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকলেও প্রায় ৭০ শতাংশ নির্ভুলভাবে পড়ে ফেলা গেল পেবোর নেতৃত্বে। হাড় আঙুলের এবং তা একটি বালিকার, যে এখানে ছিল অন্তত ৪০০০০ বছর আগে। ডেনিসোভা বালিকার জিনোম বেসসজ্জাকে মিলিয়ে দেখা হল আধুনিক মানুষের ৫৩টি জনগোষ্ঠীর এবং নিয়ান্ডারথাল জিনোমের সঙ্গে। দেখা গেল সে না স্যাপিয়েন্স, না নিয়ান্ডারথাল বরং স্বতন্ত্র প্রজাতির অবস্থান দাবি করে তার জিনের গঠন। হোমো ডেনিসোভা নামে পরিচিত হল সে এবং পরবর্তীকালে জানা গেল একই জিনগত গঠনের এই হোমিনিন গ্রুপ থাকত বিচ্ছিন্নভাবে ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত ও পলিনেশিয়ার কোনও কোনও অঞ্চলে। এদের থেকে যে নিয়ান্ডারথালে এবং আধুনিক মানুষে জিন স্থানান্তরণ ঘটেছে তারও প্রমাণ মিলল। আধুনিক মানুষের কিছু কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে, যেমন পাপুয়া-নিউগিনির মেলানেশিয়ানদের ভিতরে, ইন্দোচিনের কিছু কিছু গোষ্ঠীতে, তিব্বতিদের মধ্যে কখনও কখনও ৭ শতাংশ জিনোমই ডেনিসোভানদের থেকে স্থানান্তরিত। প্রায় ৬,৪০,০০০ বছর আগে তারা নিয়ান্ডারথালদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

অর্থাৎ, হোমিনিড মানুষের ডিএনএ-তে থেকে যাওয়া খবর জানাচ্ছে একটা সময় এমন ছিল যখন নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান এবং আধুনিক স্যাপিয়েন্স মানুষ একই সময়ে পৃথিবীর তিনটে অংশে বসবাস করত। হোমিনিডদের উদ্ভবস্থল হল আফ্রিকা এবং সেখান থেকে দুটি ধারা, নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভা মানুষেরা ছড়িয়ে পড়ে যথাক্রমে ইউরোপ ও ইউরেশিয়ার দিকে। উৎস থেকে সবচেয়ে পরে বেরোয় আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স-রা। তাদের একটি ধারা ইউরোপের দিকে আসার পথে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে এবং অপর একটি ধারা এশিয়া-পলিনেশিয়ার পথে ডেনিসোভান মানুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিল। নিয়ান্ডারথালরা মাত্র ত্রিশ হাজার বছর আগে আর ডেনিসোভানরা পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে ছিল। কিন্তু আপাতত আমরাই অধীশ্বর। হোমিনিডদের মধ্যে কেবল আমরাই টিঁকে আছি। তারা আমাদের আদিপুরুষ নয়, বরং সহযাত্রী ছিল বলা যায়। আজ অবলুপ্ত তারা, কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যক মানুষ তাদের কাছ থেকে পাওয়া ডিএনএ-র অবশিষ্ট বহন করে চলেছি। আমাদের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটিতে তার ছাপ আছে। তিব্বতিদের উচ্চতা-অভিযোজনে তার ছাপ আছে। পলিনেশীয়দের ঠোঁটের গড়নে, চওড়া কপালের গড়নে তার ছাপ আছে। পেবোর গবেষণা চিনতে ও আক্ষরিকভাবে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে আমাদের এই ‘কাজিন’দের, এবং কুয়াশাবৃত অতীতের অন্তরাল থেকে যেন আমাদের আসার পথটিকে একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছি আমরা। প্রত্নজিনবিজ্ঞান আরও অনেক রহস্যের উন্মোচন করবে অচিরেই কেননা অতীত নিয়ে জিন গবেষণায় বিশ্বজুড়ে জোয়ার এসেছে। পেবোর নোবেল এই চর্চাটিকে মান্যতা দিল।

 

তথ্যসূত্র:

  1. S Pääbo Nature 314, 644–645 (1985).
  2. Green, R. E. et al. Science 328, 710–722 (2010)
  3. Krause, J. et al. Nature 464, 894–897 (2010)
  4. Ewen Callaway & Heidi Ledford Nature | Vol 610 | 6 October 2022
  5. Andrew Curry  doi: 10.1126/science.adf1103 ।। 3 October 2022


[1] Pääbo, S. Nature 314, 644–645. 1985.