Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঋষি সুনক: ভারতে নির্বোধ উল্লাস, নাকি হিন্দুত্বের চেনা ছক

ঋষি সুনক: ভারতে নির্বোধ উল্লাস, নাকি হিন্দুত্বের চেনা ছক | সুমন কল্যাণ মৌলিক

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

বিজ্ঞাপনজগতের সৌজন্যে আজকাল ‘ডবল ধামাকা’ শব্দটা খুব জনপ্রিয়। ঋষি সুনকের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সোশাল মিডিয়ায় (সঙ্গে অবশ্যই মেইনস্ট্রিম মিডিয়া) যে আনন্দ, উল্লাসের ঝড় বইছে তা দেখতে দেখতে পূর্বোক্ত শব্দবন্ধটার কথা মনে এল। একদা যে লালমুখো সাহেবদের দেশ ছিল আমাদের প্রভু, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী কি না ভারতীয় বংশোদ্ভূত! আর শুধু বংশোদ্ভূত হলেও কথা ছিল, তার সঙ্গে এক্কেবারে খাঁটি হিন্দু। এই স্বপ্নের রাজপুত্র ভগবৎ গীতায় হাত রেখে ২০২০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সাংসদ হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন, হৃষ্টপুষ্ট গরুদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ ছবি সোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল। আর এতেও গল্পটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এই ঋষির বিবাহ হয়েছে ইনফোসিস সাম্রাজ্যের কর্তা নারায়ণমূর্তির মেয়ের সঙ্গে। আদর্শ হিন্দু পরিবারের গল্পটা যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনই এই রূপকথার গল্প। তাই এই আনন্দে মেতে ওঠা আমাদের জাতীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। অবশ্য এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এই মাত্রাতে না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কমলা হ্যারিসের নির্বাচিত হওয়ার সময়েও এই ধরনের আবেগের বিস্ফোরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। কমলা হ্যারিসের পূর্বজরা যে গ্রামে থাকতেন সেখানে তো রীতিমত সাতদিনের উৎসব চলেছিল। জনস্মৃতি যেহেতু দুর্বল, তাই বোধহয় সঞ্জীব মেহতার কাহিনি এতদিনে মানুষ ভুলেই গেছে। ২০২০ সালে একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল যার শিরোনাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিনে নিলেন প্রবাসী ভারতীয় সঞ্জীব মেহতা’। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত যে ব্রিটিশ কোম্পানির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিক শাসনের দুঃসহ কথকতা আর সাম্রাজ্যের গর্বিত ইতিহাস, তার মাথায় এক ভারতসন্তানকে বসতে দেখে অনেকে আবার উপনিবেশের উল্টো পুরাণের গল্পও ফেঁদেছিলেন। আজ ঋষি সুনককে ঘিরে যে গণহিস্টিরিয়া তা কিন্তু এই নিবন্ধকারের মতে শুধু কিছু মানুষের নির্বোধ উল্লাস নয়, একই সঙ্গে আছে কৌশলী হিন্দুত্বের গল্প যা এক পরিকল্পনামাফিক নির্মাণ করা হচ্ছে।

আমরা যদি ঋষি সুনকের জীবনে একটু চোখ ফেরাই তাহলে যে সমস্ত কথা বলা হচ্ছে তার অনেকগুলোর অসত্যতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর পূর্বজরা অখণ্ড ভারতের গুজরানওয়ালায় বাস করতেন যা বর্তমানে পাকিস্তানে। সেখান থেকে তাঁরা অভিবাসী হয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ পূর্ব আফ্রিকাতে চলে যান। পরে ঋষির মা-বাবা আফ্রিকা থেকে চলে যান ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে। ঋষির জন্ম ব্রিটেনের সাউথস্পাটনে। তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে অত্যন্ত স্বচ্ছল হওয়ায় তিনি ব্রিটেন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। একবার রাজনৈতিক প্রচারে তিনি বলেছিলেন স্কুলজীবনে তাঁর কোনও শ্রমিক পরিবারের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না। ঋষি প্রথম থেকে তাঁর ব্রিটিশ পরিচয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। গোঁড়া কনজারভেটিভ মতাদর্শের সমর্থক হিসাবে তিনি পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কনজারভেটিভ পার্টি অভিবাসীরা কতটা ব্রিটিশ রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত তা বোঝার জন্য ‘টেবিট’ টেস্টের আয়োজন করে। পরীক্ষার বিষয় ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেট খেলা যদি কোনও অভিবাসী যে দেশ থেকে আগত তার সঙ্গে হয় তবে আলোচ্য অভিবাসী কাকে সমর্থন করবে? ঋষি সুনক সেই পরীক্ষায় সফল হয়ে তার ব্রিটিশ হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। ব্রেক্সিট বিতর্কের সময় ইংল্যান্ড দেশের গরিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ব্রেক্সিট থেকে বিদায় যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে প্রথম সারিতে অবশ্যই ঋষি ছিলেন। ব্রিটেনের বর্তমান সংঘাতপূর্ণ ও সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তিনি আজ সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন।

অনেকে এটা মনে করেন যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ যদি কোনও শক্তিশালী দেশ মায় কর্পোরেট কোম্পানির কোনও সর্বোচ্চ পদে যায় তাহলে বোধহয় ভারত বিশেষ কোনও সুবিধা পাবে। এই আশাবাদ যে নেহাৎই বাস্তবতারহিত তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মার্কিন বা ব্রিটেনের বিদেশনীতি বা বাণিজ্যচুক্তির শর্তাবলি কমলা হ্যারিস বা ঋষি সুনকের ‘ভারত কানেকশন’-এর উপর কখনওই নির্ভর করে না। কমলা হ্যারিস মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভারত এমন কোনও সুবিধা পায়নি যা তাকে কূটনৈতিক দুনিয়ায় বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী করেছে। তাই ব্রিটেনে অভিবাসন বন্ধের পক্ষে সবচেয়ে মুখর ও ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের বিশেষ বাণিজ্যচুক্তির স্পষ্ট বিরোধী সুয়েনা ব্রেভারম্যান সুনকের মন্ত্রিসভাতেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পান। এমনিতেই ব্রিটেনের রাজনৈতিক অবস্থা এই মুহূর্তে অত্যন্ত ভঙ্গুর। স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ইকোনমিক প্যাকেজকে কনজারভেটিভ দল ও সেখানকার কর্পোরেট লবি তীব্র বিরোধিতা করার কারণে ট্রাসকে পদত্যাগ করতে হয় ও ঋষি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। লেবার পার্টি সহ ব্রিটিশ জনমতের একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই অকাল নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলের মতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তি না ঘটলে ও বিশ্ববাজারে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম স্থিতিশীল না হলে ব্রিটেন আরও প্রতিকূল অবস্থার সন্মুখীন হবে, তাই সুনকের পদলাভ ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা দেবে, একথা নেহাৎই কষ্টকল্পনা।

এই প্রসঙ্গে একটা সাধারণ সত্যের আমাদের মুখোমুখি হওয়া দরকার। অতীতেও এবং আজও ভারতবর্ষ থেকে বহু গুণী মানুষ অন্য দেশে গিয়ে পাকাপাকিভাবে সে-দেশের বাসিন্দা হয়েছেন অর্থাৎ তারা খুব সচেতনভাবেই এদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এই মানুষেরা অন্য দেশে যাওয়ার পর নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন ও বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন। এমনকি অনেকে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েই বলতে চাই এতে ভারতীয় হিসাবে আলাদা করে গর্বিত হওয়ার কিছু নেই কারণ তাদের এই সাফল্যে ভারত রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই।

আরও আশ্চর্যের হল অন্যদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনও ভারতীয় বংশোদ্ভূত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলেই যে মিডিয়ায় আবেগের বিস্ফোরণ হবে, বিষয়টা অত সোজাসাপটা নয়। সেই দেশের ওজন, ব্যক্তির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন মার্কিন দেশের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেনেটর হলেন ববি জিন্দাল ও প্রমীলা জয়পাল। কিন্তু ববি যেহেতু খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন ও প্রমীলা কাশ্মিরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করেন, তাই এঁদের নিয়ে মিডিয়া নীরব। কজন আমরা জানি আয়ারল্যান্ডের উপপ্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকর এবং পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও কোস্টা ভারতীয় বংশোদ্ভূত? হিন্দু রাষ্ট্র মরিশাসের রাষ্ট্রপতি প্রভীন্দ জুগনাথ ও সুরিনামের চান সানতোজির ব্যাপারেও কোনও আলোচনা চোখে পড়ে না। অথচ ঔপনিবেশিক ভারতে দলে দলে কুলি হিসাবে এই সমস্ত দেশে ভারতীয়রা গিয়েছিল। আর কানাডায় শিখ রাজনীতিবিদরা যতই নজরকাড়া সাফল্য পান না কেন ভারতীয় মিডিয়া বহু আগেই তাঁদের সম্ভাব্য খালিস্তানি বলে দেগে দিয়েছে।

এবারের এই প্রচার-উন্মাদনার একটা বড় উপাদান অবশ্যই হিন্দুত্বের জয়গাথা। একথা সবার স্মরণে থাকবে যে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিজেপির প্রচারের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকছে ‘ওভারসিজ ইন্ডিয়ান’দের কথা, এমনকি দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম মার্কিন মুলুকে সফরে অনাবাসী ভারতীয়দের নিয়ে যে সমস্ত অনুষ্ঠান হয়েছিল তাতে প্রধান সুর ছিল সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মোড়কে হিন্দুত্বের কথা। এই প্রচার ব্রিটেনে আজ এতটাই উচ্চগ্রামে যে দীর্ঘ সময় ধরে পাশাপাশি বাস করা ব্রিটেনের হিন্দু ও মুসলমানরা আজ প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার শিকার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার বৃহত্তর পরিসরের মধ্যে থাকা সমস্ত সংগঠন আজ যে ভারতের ‘সুপার পাওয়ার’ হয়ে ওঠার গল্প ফেরি করছে তার সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু— এই আখ্যান এক রাজযোটকের কাজ করবে প্রচারের দিক থেকে। নরেন্দ্র মোদির ‘হিন্দু ভারত’ আজ শুধু ভারত রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠছে, এই বিশ্বাস মানুষের মনে প্রোথিত করার লক্ষ্যেই ঋষি সুনক সংক্রান্ত গণ-হিস্টিরিয়ার কুশলী নির্মাণ।

ঋষি সুনকের প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র ইতিবাচক প্রভাবটি নিয়ে কোনও সুচিন্তিত আলোচনা চোখে পড়ছে না। সেটা হল ব্রিটেনের মত একটা দেশ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খ্রিস্টান, সেখানে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানমন্ত্রী হলেন। আজকের ব্রিটেন যে বহু বিচিত্র ও ভিন্ন সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সুনকের নির্বাচন। কিন্তু আজকের ভারতের ছবিটা ঠিক তার উল্টো। এখানে কার্যকরী পদে একজন মুসলমান বা খ্রিস্টানকে মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত নই। সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত (ভোটাধিকারবিহীন) সে দাবিও আজ প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতবর্ষে। আজকে ভারতবর্ষে ক্ষমতাসীন দল বিজেপিতে একজন মুসলিম সাংসদ নেই। বেশ কিছু বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী দল জাতীয় কংগ্রেসের নেত্রী নির্বাচিত হন সোনিয়া গান্ধি। তখন সুষমা স্বরাজের বিষোদ্গার ও মস্তক মুণ্ডনের হুমকি আমরা কেউই ভুলে যাইনি। সমন্বয়ের সংস্কৃতির বিজয় হিসাবে ঋষি সুনকের বিজয়ী হওয়াটাকে দেখলে তা হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে পূর্ণ করবে না। তাই সেই আলোচনা নৈব নৈব চ।