অতিমারির সময়ে স্কুলশিক্ষা: বিকল্পের সন্ধান

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

কোভিড অতিমারি ও দীর্ঘ লকডাউন কম-বেশি সবক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ধ্বংসের প্রভাব শুধু টাকা পয়সার মাপকাঠিতে মাপা সম্ভব নয়। বেশ কয়েকটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ আজ স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি। মার্কশিট ও শংসাপত্রে যাই লেখা থাকুক না কেন আদৌ তারা কিছু শিখল কি না সেটা নিয়েই আজ সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে তারা যখন এই শংসাপত্রকে পুঁজি করে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে তখন তারা কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তা আমরা কেউই জানি না। সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল সংক্রান্ত যেকোনও সমীক্ষায় এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। স্কুল ছুট, অপুষ্টি, এমনকি স্কুল উঠে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও এই পরিস্থিতিতে স্কুলশিক্ষা কীভাবে চালু রাখা যায় তা নিয়ে আমরা সহমতে পৌঁছাতে পারছি না। সোশাল মিডিয়ায় শিক্ষকরা কেন বাড়িতে বসে মাইনে পাবেন তা নিয়ে একটা বড় অংশের হাহুতাশ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষকদের একটা ক্ষুদ্র অংশের ‘বসে মাইনে পেতে হলে যোগ্যতা লাগে’ মার্কা নির্বোধ প্রলাপবাক্য ছাড়া সদর্থক কোনও উদ্যোগ নজরে পড়ছে না।

একথা কম-বেশি সবার জানা যে শ্রেণিকক্ষের মাধ্যমে পঠন-পাঠনের কোনও বিকল্প নেই এবং আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে অনলাইন শিক্ষা কখনওই আমাদের দেশে স্কুলশিক্ষায় কার্যকরী হতে পারে না। আবার একই সঙ্গে একথাও ঠিক কোভিডের একের পর এক ঢেউ সাধারণভাবে অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আশঙ্কিত করে তুলেছে। এবছরের গোড়ার দিকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল খোলা হলেও তাতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল নিতান্তই কম। এই মুহূর্তে আমরা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আছি এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে। তাহলে এই পরিস্থিতিতে স্কুলশিক্ষা চলবে কী করে? অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে (যাকে আমরা নিউ নর্মাল আখ্যা দিয়েছি) আমাদের অবশ্যই প্রথাগত ধারণার বাইরে এসে ভাবতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে স্কুলশিক্ষাকে চালু রাখা যায়।

প্রথমে একথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে ক্লাস না-হওয়া জনিত ক্ষতির মাত্রা এই বৈষম্যের দেশে একরকম নয়। যে অভিভাবকরা তাদের আর্থিক সক্ষমতার কারণে বেসরকারি স্কুলে নিজেদের সন্তানদের ভর্তি করতে পেরেছেন তাদের কিছুটা হলেও পড়াশোনা হচ্ছে। বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ রুটিন করে অনলাইন ক্লাস করাচ্ছেন, শিক্ষকরা উপস্থিত, নিয়মিত পরীক্ষা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ খুব ভালো করে জানেন যে এটা যদি না করা হয় তবে অভিভাবকরা মাসমাইনে দেবেন না ফলে শিক্ষাব্যবসাটাই মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের ভাবতে হবে সরকার-পোষিত অবৈতনিক স্কুলশিক্ষার কথা যেখানে বাস্তবত কিছুই হচ্ছে না। এটা ঠিক যে অতিমারির সময় সরকার মিড-ডে মিলের জোগান চালু রেখেছে, বিনামূল্যে বইপত্র দেওয়া হচ্ছে, অ্যাক্টিভিটি টাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু স্কুল খোলা না থাকার কারণে পড়াশোনাটা হচ্ছে না। পূর্বে উল্লেখিত অসুবিধার কারণে অনলাইন শিক্ষাও সরকারের পক্ষে বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে গেলে এই মুহূর্তে গ্রামবাংলায় পড়াশোনা টিঁকে আছে গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারগুলির দৌলতে। আর লকডাউন গরীব মানুষের আর্থিক ক্ষমতা এতটাই কমিয়ে দিয়েছে যে বহু শিক্ষার্থী পয়সা না থাকার কারণে কোচিং সেন্টারগুলিতেও যেতে পারছে না।

অতিমারির সময় স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিগত সময়ে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার প্রশ্নে কিছু আলোচনা হলেও একেবারেই অবহেলিত থেকেছে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি। এইবার এই শ্রেণিগুলির কথা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভাবতে হবে। সাধারণভাবে এ রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলগুলির শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাড়ির দুই থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে এমন স্কুলেই ভর্তি হয়। সময় এসেছে এদের কাছে শিক্ষকদের পৌঁছে যাওয়ার। যদি শিক্ষকরা টিম করে স্কুলকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে (শহরের ক্ষেত্রে পাড়া বা মহল্লা হিসাব করে) অন্তত সপ্তাহে দুদিন করে পৌঁছাতে পারেন তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যোগাযোগটা আবার স্থাপিত হবে। কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেখানে যদি শিক্ষকরা পড়ান, বাড়ির কাজ দেন, তবে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া ভালো হবে। কীভাবে পড়াবেন, ব্ল্যাকবোর্ডের বদলে হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার করবেন কি না, সমষ্টি-পাঠে কী ধরনের উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করবেন, সরকার থেকে দেওয়া প্রজেক্টেরটা নিয়ে যাওয়া যায় কি না, সেসব নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে কিন্তু গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু থাকলে এটা অসম্ভব নয়। দুয়ারে বা পাড়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা পৌঁছাতে পারলে অন্তত এই বার্তাটা যাবে যে পড়াশোনার পাটটা উঠে যায়নি। সরকার যদি এই ব্যাপারে আগ্রহী হন তবে পরিকাঠামো ও অন্যান্য ব্যাপারে পঞ্চায়েত ও পৌর প্রতিষ্ঠানগুলি সক্রিয় হতে বাধ্য হবে। সবক্ষেত্রেই সরকার-নিযুক্ত শিক্ষাবন্ধুরা এই প্রক্রিয়াটিকে সাহায্য করতে পারবেন। মোদ্দা কথাটা হল পরিকল্পনাটা যদি সুচারুভাবে ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে করা যায় তবে বিষয়টা আকাশকুসুম কল্পনা নয়। এই পরিকল্পনাটার একটা অংশে থাকবে অভিভাবকদের বোঝানো যাতে তাঁরা যতটা সম্ভব পারিবারিকভাবেও শিক্ষার্থীদের ওপর নজর রাখেন। দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি অভিভাবকরা চান তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক।

নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বয়স যেহেতু বেশি তাদের ক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত পাঠদান প্রক্রিয়ার কথা ভাবতে হবে। এখানে যেমন পাড়াকেন্দ্রিক স্কুলশিক্ষা চলবে তেমনি টিভি ও রেডিও ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া উচ্চমাধ্যমিক বিভাগের জন্য এই সময়ের জন্য অনলাইন ক্লাসের কথাও ভাবা যেতে পারে যদি সরকার তার দায় বহন করে। গতবছর পরিস্থিতি বিচার করে সরকার শিক্ষার্থীদের ট্যাব কেনার টাকা দিয়েছিল। এবার যদি একাদশ ও দ্বাদশের জন্য ট্যাবের ব্যবস্থা করা যায় শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস করানো যাবে। বলার কথা হল এই জটিল সময়ে নানা ধরনের উপায় অবলম্বন করতে হবে শিক্ষার স্বার্থে। সময় দাবি করছে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সক্রিয়তা এবং তা এখনই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...