Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটু জলের সন্ধানে…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

আজ, ১৪ এপ্রিল, জাতীয় জলদিবস। জল নিয়ে আমরা যে মোটেই স্বস্তিতে নেই সে কথা বোধহয় সকলেরই জানা। নীতি আয়োগের রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা করে বলা হয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জিরো গ্রাউন্ড লেভেলে পৌঁছবে দেশের ২১টি শহরের জলস্তর। ভৌমজল উত্তোলনের চলতি হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ এই দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ পানের জলটুকুও পাবে না

 

২০০৯ সাল। অফিসের এক জরুরি কাজে তড়িঘড়ি মুম্বাই ছুটে যেতে হল। পরিচিত এক বন্ধুকে সে-কথা জানাতেই হইহই করে উঠল— ‘চলে আয়, চলে আয়! আমার এখানেই উঠবি কিন্তু।’ ‘তথাস্তু!’ দুর্গানাম নিয়ে পৌঁছে গেলাম মুম্বাই। কলকাতায় বসে কাজটাকে যত কঠিন মনে হচ্ছিল, এসে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল অত জটিলতার কিছু নেই। দুদিনেই কাজ হাসিল করে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছি। আমার খাতিরে বন্ধু দুদিন ছুটি নিয়েছে। ‘নাটক দেখতে যাবি? কলকাতার একটা দল এসেছে। অবশ্য কুশীলবেরা সবাই স্কুলপড়ুয়া।’ নাটক নিয়ে আমার দুর্বলতা অনেকদিনের। রাজি হয়ে গেলাম।

ওরলির নেহরু সায়েন্স সেন্টারে নাটকের আসর পাতা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম নির্দিষ্ট থিম নিয়ে নাটক করবে ভারতের চারটি প্রান্তের— পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ— মোট আটটি দল। শুরু হল কলকাতার দলের নাটক। স্মৃতি থেকে নাটকের প্রথম দৃশ্যের সংলাপগুলো হাজির করার চেষ্টা করি। কলঘরের দৃশ্য। কুশীলব বৃদ্ধা ঠাকুমা ও তাঁর নাতি বোম্বা। শাওয়ার খুলে স্নান করছে বোম্বা, সঙ্গে উদ্দাম নাচ ও গান…

বোম্বা: উ… উ… উলাল্লা… উ… উ… উলাল্লা…
ঠাম্মা (একরাশ বিরক্তি নিয়ে): বলি ও বোম্বা, এত জল নষ্ট করিসনে বাপু! সেই কখন থেকে কলঘরে ঢুকেছিস, এখনও বাইরে এলি না! আমার জপ-তপ-আহ্নিকের আজ বারোটা বাজল। কখন আমি চান করব, পুজো-আচ্চা করব? এই বাসি শরীরে ওসব শুদ্ধ কাজ হয়? বোম্বা… অ্যাই বোম্বা, আর জল নষ্ট করিসনে বাবা!
বোম্বা (বাথরুমের দরজাটা একটু ফাঁক করে মুখ বের করে): ঠাম্মা! ঠান্ডি ঠান্ডি পানি মে মুঝে নাহানা চাহিয়ে, পানি কিসকো মিলে না মিলে ম্যায় কেয়া সমঝিয়ে! (দরজা বন্ধ করে গান চলতে থাকে) উ… উ… উলালা, জুড়াই শরীরের জ্বালা!

[জল পড়া বন্ধ হয়। অবাক হয়ে বোম্বা শাওয়ারের দিকে তাকায়। তারপর অসহায় কণ্ঠে বলে]

বোম্বা: ঠাম্মা, পানি কাঁহা গয়া? ও ঠাম্মা, পানি কাঁহা গয়া?
ঠাম্মা: কোথায় আবার যাবে? পানি চলা গয়া!
বোম্বা: ঠাম্মা, প্লিজ আমাকে ওয়ান বাকেট জল দাও। আমার সারা শরীরে সাবানের ফেনা। বাইরে বের হব কী করে?
ঠাম্মা (তীব্র রাগে): আর বেরিয়ে কাজ নেই! সব্বাঙ্গে ক্ষার মেখে এখন ভূতেশ্বরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো! (ভেঙিয়ে) ওয়ান বাকেট জল দাও… ওয়ান বাকেট কী রে হনুমান, ওয়ান প্যাকেট জলও আর ঘরে মজুত নেই। আজ আমার নারায়ণকে খাওয়াব কেমন করে? আমায় মার্জনা করো ঠাকুর! উঁঃ… গানের কী ছিরি! (আবার ভেঙিয়ে) উ… লালালা! নারায়ণ… নারায়ণ…
বোম্বা: ঠাম্মা, আমাকে এই অবস্থায় ফেলে যেও না… ঠা-ম-মা… ঠা-ম-মা…

সুধী পাঠকবৃন্দ, আপনারা কি ওপরের সংলাপগুলো পাঠ করে ভেতরে ভেতরে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়েছেন? খুব স্বাভাবিক। একের পর এক অণুদৃশ্যের সমন্বয়ে এই নাটক দর্শকদের আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে যখন শেষ হয় তখন মঞ্চ জুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা। ঠাম্মার সেই সংলাপ— এক বাকেট কি, এক প্যাকেট জলও ঘরে মজুত নেই— এক গভীর শূন্যতাবোধের ভাবনায় সকলকে আচ্ছন্ন করে রাখে। একদিকে তৃপ্তি অন্যদিকে আশঙ্কা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে আসি। আমার আজকের জলকথা সেই দেড় দশক আগে দেখা নাটকের উৎসসূত্র থেকেই নিঃসারিত।

 

জলবার্তা

ছোটবেলা থেকে কথাটা শুনে শুনে আমরা সকলেই কমবেশি অভ্যস্ত— জলের মতো সোজা। কিন্তু আজ যখন জল নিয়ে গুটিকয়েক মনকথা কইবার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি তখন টের পাচ্ছি আগামী পৃথিবীর জল-ভাবনা আর মোটেই সোজাসাপ্টা পথে বইছে না। জল নিয়ে আমাদের আরও গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। গত ২২ মার্চ সারা বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জল দিবস। এই উপলক্ষে সমবেত বিশ্বনেতৃত্বের সামনে সংযুক্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল জোয়ান আন্তোনিও গুত্রেয়াস কতগুলো মূল্যবান কথা বলেছেন। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান পেয় জলের সঙ্কটকে সামনে রেখে তিনি বলেছেন—

আমাদের মানবজাতির বিকাশ ও অস্তিত্ব নিবিড়ভাবে পার্থিব জলভাণ্ডারের সঙ্গে জড়িত। ২০৩০ সালের মধ্যে সুস্থিত উন্নয়নের লক্ষ্যকে এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে বিশুদ্ধ পানীয় জলের জোগান সুনিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। জল মানুষের মানবিক অধিকার। সভ্যতার সুরক্ষায় জলের প্রয়োজনীয়তাকে আমরা কোনওভাবেই অস্বীকার করতে পারি না কেননা জল হল মানবিকতার শোণিতধারা। পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ জলের অভাব এবং উপযুক্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি আজকের পৃথিবীর অন্যতম গভীর সমস্যা। একদিকে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির দ্বারা মূল্যবান জলসম্পদের যথেচ্ছ, অনৈতিক ব্যবহার লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সঞ্চিত জলভাণ্ডারকে নিঃশেষিত করে চলেছে, অন্যদিকে পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির আওতায় থাকা বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ দু ফোঁটা বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে তিলে তিলে মৃত্যুকে আহ্বান করতে বাধ্য হচ্ছে। পার্থিব সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই অসমতা, এই বৈপরীত্যকে দূর করতে না পারলে মানুষের মধ্যে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য আরও বাড়বে যার পরিণতি কখনওই সুখকর হবে না। আজকের এই সভাস্থলে উপস্থিত রাষ্ট্রীয় নেতাদের এই সমস্যা দূরীকরণে গভীরভাবে ভাবতে হবে যাতে জলসম্পদের সঙ্গে জড়িত অতি-জোগানের সমস্যা; ঝড় ও বন্যাজনিত কারণে এবং জোগানের বিপুল ঘাটতিজনিত সমস্যা; খরা, ভৌমজলের ঘাটতি এবং অতি-দূষিত পানীয় জলের ব্যবহারজনিত বাধ্যবাধকতার বিষয়ে আমরা সমবেতভাবে এক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। এই সমাবেশ থেকে আমাদের বৈশ্বিক জলভাবনার ক্ষেত্রে গুণগত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতেই হবে কেননা এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই হয়তো গড়ে উঠবে আগামী পৃথিবীর টেকসই জলজীবন।

ভাষণে কতগুলি গম্ভীর বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে খুব স্বাভাবিক কারণেই। পৃথিবীর সকল প্রাণের বিকাশ ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জলের অপার গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেও আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করেছি আমাদের পরিবেশের অতুলনীয় তন্ত্রকে। মানুষের স্বাস্থ্য, সুস্থতা, জৈবনিক যাপন, আমাদের নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি— কৃষি, শিল্প, শক্তি উৎপাদনব্যবস্থা, আমাদের টেকসই, সম্পন্ন জীবনযাপন— সবকিছুর সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এই প্রাকৃতিক প্রাণধারা। অথচ আমাদের অপরিণামদর্শী অজ্ঞতা আমাদের অত্যন্ত সীমিত জলভাণ্ডারকে নিঃশেষ করে ফেলছে। আজ আমাদের পৃথিবী এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি। সমস্যার কারণগুলিকে একটু বড় প্রেক্ষাপটে আলোচনা করে দেখা যাক। তার আগে এক নজর বুলিয়ে নিই এই সময়ের বৈশ্বিক জলসঙ্কটের সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলিকে।

 

সবুজ গ্রহে জল অফুরান, তবে…!

পৃথিবীতে জল নেই, এ-কথা কোনও অতিবড় নিন্দুকের মুখেও উচ্চারিত হবে না। বরং সামান্য তথ্য সামনে তুলে এনে বলা হবে— আমাদের পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ জুড়েই অবস্থান করছে নীলাম্বুরাশি। তাহলে? এমন হাহাকার কি সত্যিই অমূলক? বিলাসী আক্ষেপ? আসুন জলমুদ্রার অন্য পিঠটাকে ঘুরিয়ে দেখি। কী হল? বিস্ময়ে, আতঙ্কে চোখ কপালে উঠল বুঝি? স্বাভাবিক। কেননা যে বিপুল জলভাণ্ডারের কথা একদম গোড়াতে বলেছি, তার মধ্যে এক শতাংশেরও কম জল হল মিঠা জল বা ব্যবহার্য জল— এক গ্লাস জলের মাত্র এক ফোঁটা। অথচ এই জলের উপর নির্ভরশীল বর্তমান পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ প্লাস পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীকুল প্লাস পৃথিবীর সমস্ত প্রকার উদ্ভিদরাশি! কী! হিসেবটা মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে? পরমা প্রকৃতি লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি বছর ধরে নিজের গর্ভে পেয় জলের যে বিপুল ভাণ্ডার তিল তিল সঞ্চয়ের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন তা আজ নিঃশেষিতপ্রায়। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তার একটা সিংহভাগ অংশ আমাদের কার্যক্রমের দৌলতে অব্যবহার্য, দূষিত হয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবী আজ ধূসর মরুভূমির রূপ পেতে চলেছে। এত কিছুর পরেও আমরা যদি নিশ্চেষ্ট, উদাসীন হয়ে থাকি তাহলে আমাদের বিনাশকাল যে সমাগত তা নিয়ে বোধহয় নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন হয় না।

 

জলসঙ্কট— এক নজরে

পৃথিবীর স্বাভাবিক জলচক্রের নিয়মানুগ অভ্যস্ত চলনছন্দটাই আজ বিলকুল কেটে গিয়েছে। নতুন এক চক্ত পাক খাচ্ছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে— তৃষ্ণাচক্র। আর এরই পিছু পিছু এসে হাজির হয়েছে সাইকেল অফ পভার্টি বা দারিদ্র্যচক্র।

সংযুক্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘জল অনুসন্ধান কমিটি’র রিপোর্ট অনুযায়ী—

এই তথ্যগুলি থেকে সমগ্র বিশ্বের জলসমস্যার যে আভাস আমরা পাই তা যে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয় তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না।

 

জলজট

এই সময়ের পৃথিবীর ঘনায়মান জলসমস্যার পেছনে একাধিক কারণ নিহিত রয়েছে যা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। কেননা কৃষি-উৎপাদন থেকে জনস্বাস্থ্য সবকিছুর ওপরেই জলের পর্যাপ্ত জোগানের বিষয়টি সুগভীর প্রভাব ফেলে। সমস্যার মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত করতে পারলে সমাধানের সমান্তরাল উপায়গুলিকে চিহ্নিত করা হয়তো সহজ হবে। এরপর থেকে পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ পেয় জলের ভাণ্ডারকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার কথা আমরা ভাবার চেষ্টা করব।

 

জলবায়ুর পরিবর্তন

আমাদের পৃথিবীর জলবায়ুর ভারসাম্যের পরিবর্তনই হল বৈশ্বিক জলসমস্যার মূল কারণ। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার সূত্রে জানা গিয়েছে যে পৃথিবীর বিশেষ কিছু অঞ্চলে— যেমন আফ্রিকার সোমালিয়ায় দশকব্যাপী খরা এবং আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রবল মৌসুমী বর্ষণ ও বন্যা— জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি কুফলগুলি স্থায়ী সমস্যার চেহারা পেতে চলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার বিষয়টি যত গুরুতর হচ্ছে তত প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগানে বাড়ছে ঘাটতি। অনিয়ন্ত্রিতভাবে অরণ্য হননের ফলে তৈরি হচ্ছে হিট আইল্যান্ড বা তাপদ্বীপ যার প্রভাব কেবলমাত্র সেই উৎসন্ন অরণ্যপরিসীমাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে এমনটা নয়, সংলগ্ন অঞ্চলেও তার নেতিপ্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতগতিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অব-সাহারা আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষিজমি আজ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরার দরুন ভূমিমানের অবনমন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আবার এর বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাব পৃথিবীর উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে যেখানে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পেয় জলের ভাণ্ডারগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের নোনা জলের প্রভাবে। জলবায়ুর পরিবর্তন আহ্বান করছে জলসঙ্কটকে।

 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়

ইউনিসেফ এক সমীক্ষায় জানিয়েছে যে সাম্প্রতিককালে পৃথিবীতে যত সংখ্যক প্রাকৃতিক বিপর্যয় নথিভুক্ত হয়েছে তার ৭৫ শতাংশ ঘটনার পেছনে রয়েছে জলঘটিত বিপর্যয় অর্থাৎ খরা বা বন্যার মতো ঘটনা। এই দুই কারণেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পেয় জলের সম্ভাব্য উৎসগুলি বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলের অভাবে ডায়েরিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসের মতো জলবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ে, আক্রান্ত হয় মানুষ বিশেষ করে শিশুরা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপন্ন হয়। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এমন ঘটনা ঘটতে থাকার অর্থ হল পৃথিবীর আবহিক বাতাবরণের পরিবর্তন। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে সিরিয়া, লেবাননে জল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমন বিপর্যয় জলসঙ্কটকে তীব্র করে।

 

যুদ্ধ ও সংঘাত

যুদ্ধ সভ্যতার এক বড় অভিশাপ। যুদ্ধ ও পারস্পরিক সংঘাতের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবীয় পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই সময়ে চলতে থাকা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে যথেচ্ছ মারণাস্ত্রের ব্যবহার ইউক্রেন সহ সমগ্র বিশ্বের আবহমণ্ডলকে কলুষিত করছে। পানীয় জলের চিরায়ত উৎসগুলিও তার থেকে রেহাই পায়নি। আফ্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা গোষ্ঠী-সংঘর্ষের কারণে মধ্য আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলসম্পদ অবচয়িত হচ্ছে নানাভাবে। প্রতিপক্ষকে ভাতে মারার প্রকৌশল জলসঙ্কটকে তীব্র করে।

 

বর্জ্য জল

পৃথিবীর বর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বর্জ্য বা অব্যবহার্য জলের পরিমাণ। মানুষে নিত্যব্যবহার্য জলের একটা বড় অংশ আসে বিভিন্ন পৃষ্ঠীয় উৎস থেকে। আর সেই পরিচিত উৎসগুলিকে আমরা নানাবিধ বর্জ্যের আস্তাকুঁড় বানিয়ে ফেলেছি। গঙ্গানদীর জল আজ পানের তো দূরের কথা, স্নানেরও অযোগ্য। যমুনার জলে দ্রবীভূত অ্যামোনিয়ার মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে সেই জল পরিশোধন করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে গৃহস্থালী বর্জ্য জলের প্রায় ৫০ শতাংশ এবং সমগ্র ব্যবহৃত জলের ৮০ শতাংশ অপরিশোধিত অবস্থায় পুনরায় বাস্তু-পরিবেশে এসে মিশ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে গোটা বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ এই দূষিত জল ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে অন্যতর কোনও জল ব্যবহারের সুবিধা না-থাকার কারণে। পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ জলভাণ্ডার আজ কলুষিত। এর ফলে বিভিন্ন জলবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ভুক্তভোগী দেশগুলিতে।

 

জলের অপচয়

বোম্বার ঘটনাটা স্মরণ করি। জলের অপচয়ের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এভাবেই নানা খুচরো কাজে আমরা পেয় জলের অপচয় করে চলি। বিশিষ্ট জল সংরক্ষণ বিশেশজ্ঞ সফিকুল ইসলামের হিসাব অনুসারে পৃথিবীর ছোট-বড় শহরগুলিতে যে পরিমাণ জল ব্যবহৃত হয় তার ৩০-৪০ শতাংশ জল অপচয় হয় কেবলমাত্র সচেতনতার অভাবে। তাঁর হিসাবে প্রতিটি পরিবার সপ্তাহ পিছু ১৮০ গ্যালন বা প্রায় ৭০০ লিটার এবং বছরে ৯৪০০ গ্যালন বা ৩৫৬২৬ লিটার পেয় মিঠাজল অপচয় করে। গোটা দুনিয়ায় বার্ষিক অপচয়িত জলের পরিমাণ ৯,০০,০০০,০০০,০০০ গ্যালন বা ৩৪০৭০৪৯০০০,০০০,০০০,০০০ লিটার! জোহানেসবার্গের মতো সপ্তাহে একদিন করে জলহীন ড্রাই ডে পালন করলে কেমন হয়?

 

জল সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব

জল মানুষের অধিকার। তবে যথোপযুক্ত জল-পরিকাঠামোর অভাবে অধুনা পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ জলাভাবী থেকে যাচ্ছে। এই সমস্যা এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ দেশেই তীব্রভাবে লক্ষ করা যায়। কার্যকর সরবরাহ অনেক ক্ষেত্রেই না-থাকায় বিপুল পরিমাণে জল নষ্ট হয়ে যায়। জল সরবরাহ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য রাষ্ট্রীয় স্তরে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিষয়ে তৎপরতার অভাব রয়েছে। সুলভ প্রযুক্তির সাহায্যে এই সমস্যার আশু নিরসন সম্ভব হলে জলজট অনেকটাই হয়তো কমানো যাবে।

সমস্যার কারণগুলির এখানেই ইতি তেমনটা নয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিসংখ্যানের অভাব, প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার অভাব, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষের অভিবাসন, সমস্ত রাষ্ট্রের মতামত জ্ঞাপনের পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব— এগুলিও জলসমস্যার অন্যান্য কারণ।

সমস্যা আছে। সমস্যা আরও বাড়বে। তাই এখন সমগ্র বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কাজ শুরু হয়েছে— এটা আশার কথা। আসলে জলচেতনাকে তৃণমূল জনস্তরে পৌঁছে দিতে হবে। এই কাজটা যত তাড়াতাড়ি আমরা করতে পারব তত বিলম্বিত হবে পৃথিবীর শেষ জলবিন্দুটির অস্তিত্বরক্ষার লড়াই।

 

ভারতের জলছবি

এবার নজর ফেরানো যাক ভারতের দিকে। জল নিয়ে আমরা যে মোটেই স্বস্তিতে নেই সে কথা বোধহয় সকলেরই জানা। প্রথমে কতগুলো তথ্য দেখে নেওয়া যাক।

এ-ও এক দুষ্টচক্র— ভিশাস সার্কেল। আরও বেশি মুনাফার লোভ-আরও বেশি কৃষি-আরও বেশি জল-আরও বেশি ভৌমজল উত্তোলন-আরও সঙ্কুচিত জলভাণ্ডার-আরও সুতীব্র জলসঙ্কট-আরও বুভুক্ষা-আরও দারিদ্র্য। জলকে ঘিরে এমন দুষ্টচক্র আজ ভারতবর্ষে ক্রমশাই যেন সক্রিয় হয়ে উঠছে। একথা মনে রাখতে হবে, যে সমস্ত প্রাকৃতিক উৎস থেকে আমরা আমাদের ব্যবহার্য জলের জোগান পাই যেমন মৌসুমী বৃষ্টিপাত, হিমবাহ গলন— আজ অনেকটাই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক বাতাবরণের শৃঙ্খলা বদলে যাওয়ার ফলে। সাম্প্রতিক সময়ের বৃষ্টিপাতের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে, বৃষ্টিপাতের বণ্টনে ধরা পড়ছে ব্যাপক ক্ষেত্রীয় অনিয়মিতি, বাড়ছে খরার প্রবণতা। বিশেষ করে আকস্মিক খরা-পরিস্থিতির কারণে শস্যহানির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হচ্ছে জলসঙ্কট। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের হিমায়িত মণ্ডলের ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটায় হিমালয়ের হিমবাহসমূহ আজ দ্রুত গলনের শিকার। ফলে হিমবাহপুষ্ট নদীগুলিতে জলের জোগান সাময়িকভাবে বাড়লেও নদীর জলের প্রবহনমাত্রা হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে জলসঙ্কটের আশঙ্কা। জলের অভাব মেটাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাটির নিচের জলভাণ্ডার থেকে লাগাতার জল উত্তোলন করা হচ্ছে। আসলে সঙ্কটের কালো ছায়া যত প্রলম্বিত হচ্ছে আমরা ততই মরিয়া হয়ে উঠছি জলের জন্য। এ এক নীরব ধ্বংসযজ্ঞ।

ভৌমজলের অসংযমী উত্তোলন ভারতের মহানগরগুলির অস্তিত্বকেও বিপন্ন করছে। আসমানছোঁয়া বহুতলের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে শহুরে জলভাণ্ডারগুলি। নীতি আয়োগের রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা করে বলা হয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জিরো গ্রাউন্ড লেভেলে পৌঁছবে দেশের ২১টি শহরের জলস্তর। ভৌমজল উত্তোলনের চলতি হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ এই দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ পানের জলটুকুও পাবে না। শহর বা নগর মানেই কংক্রিটের মহাসমারোহ-সবুজ মাটির পরিসর কমে যাওয়া-জল পুনঃসঞ্চিত হতে না পারা-জলস্তরের নিম্নগামিতা-বিপন্ন নগরজীবন। সমীক্ষা সূত্রে জানা গেছে আগামী দু-দশক সময়ের মধ্যে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ শহর, নগর জলাভাবের কারণে তাদের বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণরূপে হারাবে। বছর দুয়েক আগের চেন্নাইয়ের ঘটনার কথা হয়তো আমরা ভুলেই গেছি।

আসলে আমরা আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা লাভ করতে শিখিনি। না হলে বহু পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা আমাদের অতুলনীয় জল সংরক্ষণের ব্যবস্থাগুলিকে আমরা বর্জন করব কেন? পূর্বজদের জ্ঞানকে নিছক পুরনো বলে বর্জন করার ফলে সঙ্কট বেড়েছে বহুগুণ। প্রয়াত গান্ধিবাদী সমাজসেবী অনুপম মিশ্র তাঁর লেখা ‘আজ ভি খাড়ে হ্যায় তলাব’ গ্রন্থে জল সংরক্ষণের চিরায়ত দেশজ উপায়গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সূত্রে কমে আসছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। ফলে ক্রমশই জল আরও মহার্ঘ হয়ে উঠছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে পার, তলাব, সাজা কুঁয়া, জোহাদ, পাট-এর মতো বহু প্রজন্ম ধরে ব্যবহৃত জল সংরক্ষণের কার্যকর উপায়গুলিকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে ভারতের অন্যতম জলযোদ্ধা আয়াপ্পা মাসাগির কথা বলা যায়। পেশাগতভাবে ইঞ্জিনিয়ার এই মানুষটি কর্নাটকের গদগ জেলার মতো একটি জলহীন শুখা অঞ্চলে জল সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রথাগত কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এমন কর্মকাণ্ডগুলি বাস্তব পরিস্থিতিকে অনুধাবনের সূত্রে কার্যকর হয়ে উঠেছে। এমন ছোট ছোট আঞ্চলিক প্রয়াসের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে আমরা ভারতের জল-ছবি আরও বর্ণিল, প্রাণময় করে তোলার কথা ভাবব না কেন?

 

একান্ত জলভাবনা

সঙ্কট ঘনায়মান। তাই আমাদের প্রত্যেককেই সজাগ সচেতন হতে হবে জল বাঁচানোর বিষয়ে। সমস্যাটা বৈশ্বিক। তাই এই সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে বিজড়িত আমাদের যাপন, আমাদের অস্তিত্ব। ইংরেজির সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদটিকে স্মরণ করি— চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। বাড়ি থেকেই শুরু হোক বৃহত্তর বদলের আন্দোলন। আমাদের একান্ত চেনা গৃহস্থালি পরিবেশে জল খরচ হয় (অপচয়ও হয়) তিনটি ক্ষেত্র থেকে— টয়লেট বা বাথরুম, রান্নাঘর এবং গৃহসংলগ্ন বাগান, উঠোন। এই তিনটি ক্ষেত্রেই জলের অপচয় রোধ করা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইল পরবর্তী কোনও রচনায়। তবে নিজের পরীক্ষিত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবেক বালতি-মগকে ফিরিয়ে আনা হলে জলের ব্যবহারজনিত অপচয়কে আমরা অনেকাংশে কমাতে পারব। মানুষ অভ্যাসের দাস। তাই প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠব। প্রতি মগ জল ব্যবহারের সময়ে এই ভাবনাকে মনের মধ্যে চাগিয়ে রাখতে পারলে ব্যক্তিগত স্তরে আমরা সকলেই অপচয় কমাতে পারব।

কথায় কথায় অনেকটা দূর চলে এসেছি। এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মে গলা শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণায় খুব কাতর হয়েছি। আচ্ছা একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?