Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রামমোহন রায়-এর তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদিন

কণিষ্ক চৌধুরী

 



প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিক্ষক

 

 

 

আঠেরো শতকের শেষ পর্বে বড় হয়ে ওঠা রামমোহনের চিন্তাধারা কোন পথে এগিয়েছিল তার একটা স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাবে তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদিন-এ। তুহফাৎ-এর প্রকাশ ১৮০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে। রামমোহনের বয়স তখন ৩১-৩২ বছর। রচনাটির ভূমিকা আরবি ভাষায় রচিত। আর মূল রচনাটি ফারসি ভাষায়। ভূমিকাতে তিনি অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞান ও আরোহ পদ্ধতির সাহায্যে যে সিদ্ধান্ত করেছেন তা বিস্ময়কর। তাঁর চিন্তাধারা বোঝবার জন্য রামমোহনকে উদ্ধৃত করা যাক:

কোনও সম্প্রদায়ের লোককে দেখতে পাই যে তাঁরা অন্যের ধর্ম্মমতের সঙ্গে নিজের মতের মিল নেই বলে অন্যের মতকে এই বলে অগ্রাহ্য করতে চান যে তাঁদের সম্প্রদায়ের পূর্ব্বপুরুষেরা যা বলে গেছেন, তা নির্ভুল। কিন্তু তাঁদের এই পূর্ব্বপুরুষেরাও তো অন্যান্য মানুষের মতই অন্যায় বা ভুল করতে পারেন। সুতরাং যদি বলা হয় যে এরূপ মতাবলম্বীরা সকলেই হয় অভ্রান্ত, অথবা ভ্রান্ত, তাহলে সেটা খুব অসঙ্গত হয় না। এখানে প্রথম ক্ষেত্রে— অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী সকলেই অভ্রান্ত ধরলে— দুটি পরস্পরবিরোধী মত স্বীকার করতে হয়, যা তর্কশাস্ত্রানুমোদিত (principle of non-contradiction) হতে পারে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে—অর্থাৎ সকলেই ভ্রান্ত ধরলে— কোনও বিশেষ বিশেষ ধর্ম্মে ভ্রান্তি রয়েছে বলা যেতে পারে, কিম্বা সকল ধর্ম্মেই সাধারণভাবে ভ্রান্তি রয়েছে বলা চলে। বিশেষ বিশেষ ধর্ম্মের উপর ভ্রান্তি আরোপ করলে অকারণেই একটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এবং তাও ন্যায়শাস্ত্রানুমোদিত (principle of sufficient reason) নয়। সুতরাং কোনও বিশেষ পার্থক্য না করে বলা যায় যে সকল ধর্ম্মেই সাধারণভাবে কিছু কিছু ভ্রান্তি রয়েছে [ভ্রান্তি সকল ধর্মেরই বৈশিষ্ট্য]।[1]

ভূমিকাটি পাঠ করেই যুক্তি-বুদ্ধি-বোধসম্পন্ন যে কোনও পাঠক বইটির বাকি অংশ পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আর বিস্মিত হবেন সেই যুবকের অগাধ জ্ঞান ও গভীর পাণ্ডিত্য দেখে। সেই সময়ের সেই প্রতিকূল পরিবেশে এই যুক্তিবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সামর্থ্য কতজনের ছিল তা ভাববার বিষয়। জানতে ইচ্ছে করে বর্তমানেও এ সাহস কতজনের মধ্যে আছে। ভূমিকাটি পড়লেই বোঝা যায় গ্রন্থের মূল অংশে তিনি যে পথে হেঁটেছিলেন তা সুস্পষ্ট যুক্তিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই যুক্তিবাদের কথা জেনে নেওয়া যাক রামমোহনের কাছ থেকেই।

 

দুই.

‘তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদিন’-এর অর্থ হল ‘একেশ্বর-বিশ্বাসীদের উপহার’। এই গ্রন্থের শুরুতেই রামমোহন বলেছেন, আদর্শ মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হল বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বস্তুর নানা সার্থকতা (utility) ও তথ্য নিরূপণ করা। নানা ধর্মের বিভিন্ন নীতি বা তত্ত্বের কোনও একটিকে বেশি মূল্য না দিয়ে তার সত্যাসত্য পরীক্ষা করা দরকার। সাধারণের মধ্যে প্রচলিত বা প্রচারিত মতে প্রতি কোনও পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে, তাদের সাধ্যমতো, সেই প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ মতগুলি বিচার করা দরকার— এটাই আদর্শ মানুষের কাজ।[2]

বিভিন্ন ধর্মীয় ভ্রান্তি ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রামমোহন যা বলেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। যে-সময়ের তিনি মানুষ, সে-সময়ে কুসংস্কার, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, অশিক্ষা, কুপ্রথাই সমাজে রাজত্ব করছিল। এইরকম একটি পশ্চাৎপদ সমাজে রামমোহন দাঁড়িয়েছিলেন যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের পক্ষে। তিনি দেখালেন অলৌকিক ধ্যানধারণার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অসত্য ও অন্যায়। তিনি এই অসত্য, অন্যায় ও ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিতে উদ্যোগ নেন। তাঁর বক্তব্য হল: “…ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী নেতারা তাঁদের নাম সহজে অক্ষয় করবার জন্য এবং নিজের নিজের যশ বাড়াবার জন্য, বিশুদ্ধ সত্য (pure truth)-গুলিকে নিজেদের বিশেষ বিশেষ মতের আবরণে ঢেকে রাখেন। সেগুলিকে কোথাওবা অলৌকিকতার (miracles) উপর দাঁড় করিয়ে দেন, কিম্বা মণ্ডলীর অবস্থার উপযোগী মনভোলানো ভাষায়, অথবা নানা ফন্দির ভিতর দিয়ে সত্যের আকারে প্রচার করেন।”[3] আর একটা বড়সংখ্যক মানুষকে নিজেদের আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসেন। ওই অসহায় মানুষগুলিকে বাধ্যতা ও দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলা হয়। ফলে এইসব মানুষ দেখবার চোখ ও উপলব্ধির হৃদয় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে ধর্মীয় নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। “ধর্মীয় নেতাদের হুকুম তামিল করবার সময়ে তারা সত্যিকার মঙ্গল ও সুস্পষ্ট পাপের মধ্যে প্রভেদ করাকেও অপরাধ মনে করে।”[4]

রামমোহন মানুষের মধ্যে প্রভেদের পক্ষপাতী নন। তিনি গোটা মানবসমাজকে একটি বৃক্ষ হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাঁর কাছে মানুষ হল এই বৃক্ষের ভিন্ন ভিন্ন শাখা, অথচ এই অর্থহীন ধর্মবিশ্বাস ও তাদের পাণ্ডাদের জন্যে মানুষ বিভক্ত হয়ে রয়েছে। কেবল তাই নয়, ধর্মীয় মতবাদ ও সম্প্রদায়গত বিশ্বাসের কারণে সাধারণ মানুষ অন্যকে বধ করতে বা নির্যাতন করতে দ্বিধা করে না। পাশাপাশি এই কাজকে নির্যাতনকারীরা পূণ্য বলে মনে করে। এইসব ভক্তমণ্ডলী এটাও মনে করে যে, ধর্মীয় নেতাদের প্রতি আস্থা রাখলে মিথ্যাচার, চুরি, ডাকাতি, ব্যাভিচার-এর মতো নিকৃষ্ট কাজ করলেও তার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এই প্রসঙ্গে রামমোহন আরও বলেছেন যে: “মানুষ তাদের অমূল্য সময় এমন সব পুরাণ কাহিনী পাঠ করে কাটায় যেগুলো বিশ্বাস করাও কঠিন।”[5]

ধর্ম ও ধর্মীয় গুরুরা সমাজের নানাভাবে ক্ষতিসাধন করে। মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে নষ্ট করে, যুক্তিবোধ, ন্যায়বোধ ইত্যাদিকে ধ্বংস করে। তারা এই প্রচেষ্টা চালালেও সব ক্ষেত্রেই যে সফল হয় তা নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তাজগতে অন্ধভক্তি ও মিথ্যা ধারণাকে গেঁথে দিতে পারে না। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে চিন্তাশীল ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব ঘটতে দেখা গেছে। আর যখনই চিন্তাশীল ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এই ধরনের কাজ করতে সচেষ্ট হয়েছেন, তখনই ধর্মগুরু বা ওই ধর্মের অন্যান্যরা এই প্রচেষ্টাকে ‘শয়তানের প্ররোচনা’ বলে চিহ্নিত করেছে। এইভাবে ধর্মীয় গুরু ও তাদের ভক্তেরা বিচার করা, প্রশ্ন করাকে থামিয়ে দিতে চায়। কারণ তাদের মতে সন্দেহ, প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান ইত্যাদি সাংসারিক ও ধর্মীয় জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর।

রামমোহন দেখিয়েছেন কীভাবে সাধারণ মানুষ ধর্মের ভ্রান্ত ভাবনা ও ধর্মীয় গুরুদের খপ্পরে পড়ে। এই প্রসঙ্গে তিনি সামাজিকীকরণ ও -এর কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন:

অপরিণত বয়সে যখন মানুষের বৃত্তিগুলি নমনীয় থাকে, সেই সময়ে নানা ভাব তার মনে সহজে ছাপ ফেলতে পারে। তখন যদি সে তার পূর্ব্বপুরুষদের যত আজগুবি ও আশ্চর্য্যজনক ঘটনার কথা অনবরত শুনতে থাকে, এবং যে সম্প্রদায়ের মধ্যে মানুষ জন্মে বেড়ে উঠেছে সেই সম্প্রদায়ের মতে বিশ্বাস করলে যে কত সুফল পাওয়া যায়, এ-সম্বন্ধে নানা প্রশংসার কথা যখন তার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর মুখে সর্ব্বদা শুনতে পায়, তখন সেইসব মতের সত্যতা সম্বন্ধে তার মনে এমন একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যায় যে সে তার ঐ নবগৃহীত মতে অনেক ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও অন্যমত অপেক্ষা নিজগোষ্ঠীর মতকেই অধিক মূল্য দেয়। এবং দিনে দিনে ঐ মতেই নূতন নূতন আসক্তি ও বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে কোনও কোনও বিশেষ ধর্ম্মমত আঁকড়ে ধরার পর, এবং সেই মতের সত্যাসত্য সম্বন্ধে কোনও অনুসন্ধান না করে নির্ব্বিচারে বহু বৎসর বিশ্বাস করবার পর, সেইসব ধর্ম্মমতের সত্যিকার প্রকৃতি নির্ণয় করতে মানুষ সাবালক হয়েও সক্ষম হয় না।[6]

রামমোহনের বক্তব্যের মধ্যে থেকে যা নিঃসৃত হল:

প্রথমত, শৈশবে মানুষের চিন্তা নমনীয় থাকে। সেই সময়ে তাদের মাথায় যে ভাবনা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে তা দৃঢ় ও শক্তিশালীভাবে তাদের চিন্তার মধ্যে স্থান পেয়ে যাবে। সেই চিন্তা আবার তাদের সামাজিক কাজকর্মকে প্রভাবিত করবে।

দ্বিতীয়ত, পরিবারগুলির মধ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার সহ আজগুবি ও অবাস্তব ঘটনার চর্চা চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ফলে পূর্বপুরুষেরা যে আজগুবি, অলৌকিক ও মানবতাবিরোধী ভাবনাচিন্তা দ্বারা লালিতপালিত হয়েছে, সেই ভাবনাগুলি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে চারিয়ে যায়। আর তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা সম্প্রদায়ের মধ্যে।

তৃতীয়ত, সমগ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ভাবনা ছড়িয়ে পড়ার ফলে শিশুদের মধ্যে ওইসব আজগুবি ও অলৌকিক ভাবনা গড়ে ওঠে। কারণ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের ক্রমাগত এইসব অর্থহীন কথা ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রশংসা শুনতে শুনতে ব্যক্তির মনে নিজ সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মতেরই সর্বশ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে কোনও সন্দেহ থাকে না।

চতুর্থত, নিজ ধর্মের প্রতি যে অগাধ আস্থা ব্যক্তির মনে তৈরি হয় তা নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি অগাধ আস্থা গড়ে তোলে, যা উত্তরোত্তর ওই আসক্তি ও বিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলে।

পঞ্চমত, কোনও ধর্মমতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার ফলে সেই ধর্ম সম্পর্কে সত্যাসত্য বিচার করার শক্তি মানুষ হারিয়ে ফেলে। বয়সের দিক থেকে সাবালক হয়ে উঠলেও চিন্তায় নাবালকত্ব ঘোচে না।

এরপর রামমোহন দেখিয়েছেন যে, ধর্মগুরুরা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য নানা যুক্তির জাল বিস্তার করে এবং সস্তা ও গুরুত্বহীন কথাগুলি নানা মোড়কে পরিবেশন করে থাকে। বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ সেইসব আপাত-চকচকে কথার ও ধারণার জালে প্রতারিত হয়ে নিজেদের বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠ মনে করে ও অন্যের বিশ্বাসকে নিন্দা করে। কিন্তু এসবের মধ্যেও কোনও ব্যক্তি যদি এইসব গুরুবাদী ভাবনার বিরোধিতা করে, তাহলে তার ফল মোটেই ভাল হয় না। রামমোহনের ভাষায়:

যদি… কেউ অসাবধানতাবশতঃ মামুলী ধর্ম্মমতের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করে, তা’হলে তার সমধর্ম্মাবলম্বীরা শক্তিশালী হ’লে, সেই অনভিজ্ঞ, আনাড়ী লোকটিকে হয় শূলে চড়ায় (অর্থাৎ মেরে ফেলে), কিম্বা ততটা সাহস বা সুযোগ না থাকলে বাক্যবাণে জর্জ্জরিত করে।[7]

রামমোহন দেখিয়েছেন, চেলা ও শিষ্যদের উপর গুরুর প্রভাব সীমাহীন। চেলারা গুরুদের কথামতো পাথর, গাছ বা জীব-জন্তুদের উপাস্য দেবতা বলে মনে করে। এই সব উপাস্য বস্তুকে রক্ষা করার জন্য রক্তপাত কিংবা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও চেলারা সবসময় প্রস্তুত থাকে। অর্থাৎ ধর্ম-গুরু-পীর-এর জগতে যুক্তি ও বিচারের কোনও স্থান নেই। আর সেই কারণেই বুদ্ধি এখানে বন্দি। বুদ্ধির-র মুক্তি এখানে অসম্ভব।

 

তিন.

ধর্ম, রাষ্ট্র ও শাসনপ্রণালী কীভাবে গড়ে উঠেছে— তার উত্তরে রামমোহন বলেন, মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তি (social instinct)-র কারণেই মানুষ একত্রে বসবাস করে। এই একত্রে বসবাসের জন্য তাদের কতগুলি স্থায়ী নিয়ম গড়ে তুলতে হয়। যে সামাজিক নিয়মগুলি গড়ে ওঠে তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে সহমত ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। অর্থাৎ সম্পত্তি অধিকারের নিশ্চয়তা, নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি সংক্রান্ত বোঝাপড়া। রামমোহন লিখেছেন:

এইগুলিকে ভিত্তি করেই কি সুদূর দ্বীপবাসী, কি সমুন্নত পর্ব্বতবাসী, সকল দেশের লোকরাই তাঁদের নিজ নিজ উৎকর্ষতা ও বুদ্ধি অনুসারে আপন আপন ধর্ম্মের অর্থ ও উৎপত্তি সূচক পদাবলী সৃষ্টি করেছে। এবং তা’র উপরই বর্ত্তমান জগতের নানা রাষ্ট্র ও শাসনপ্রণালী গড়ে উঠেছে।[8]

এই বাক্য দুটির তাৎপর্য অসীম। কারণ এখানে রাষ্ট্র ও শাসনপ্রণালীকে কোনও ঐশ্বরিক বা দৈবিক কারণে সৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। বরং মানুষেরই সৃষ্টি হিসেবে দেখানো হয়েছে। মানুষ তার সামাজিক প্রয়োজনেই তৈরি করেছে রাষ্ট্র। মতটি স্পষ্টতই একটি সেকুলার ভাবনার প্রকাশ। শুধু এখানেই তিনি থামেননি। আরও অনেক দূর এগিয়েছেন। ধর্ম ও ধর্মীয় নিয়মগুলির আবির্ভাবকেও এই সেকুলার দৃষ্টিতেই বিচার করেছেন। তাঁর মতে ধর্ম ও ধর্মীয় নিয়ম আসলে মানুষের ইহজাগতিক প্রয়োজনে মানুষ কর্তৃক গঠিত হয়েছে। রামমোহনের সময়ে ভারত বা বঙ্গদেশে এ-ভাবনা বিরল দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে বিরলতম।

এই সেকুলার অবস্থান থেকেই তিনি আত্মা ও পরলোকের বিচার করেছেন। তাঁর মতে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি সত্যের ওপর— (ক) দেহ-পরিচালক হিসেবে আত্মা, এই সত্যের ওপর; এবং (খ) পরলোকের ওপর। অর্থাৎ ভাল কাজ বা খারাপ কাজ-এর জন্য পুরস্কার বা দণ্ডদানের স্থল হল এই পরকাল। যারা সমাজকল্যাণের জন্য আত্মা ও পরলোকের অস্তিত্ব স্বীকার করে ও শিক্ষা দেয়— সেইসব মানুষকে অবশ্যই ক্ষমা করা যায়। কারণ মানুষ অন্যায় ও বে-আইনি কাজ থেকে বিরত থাকে এই পরলোকের দণ্ড ও ইহজগতের শাসকের শাস্তির ভয়েই। এই আত্মা ও পরলোকের সঙ্গে যুক্ত থাকে খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত পবিত্রতা-অপবিত্রতা এবং শুভ-অশুভ ইত্যাদি ধারণা। আবার এর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য কষ্টকর ও নিরর্থক বিধিনিষেধ। রামমোহনের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল, এই কষ্টকর ও অর্থহীন বিধিগুলি সামাজিক উন্নতিকে কেবল বাধা দেয় না, সমাজের অনিষ্টও করে, সাধারণ মানুষকে উদভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে। তাঁর আশা, ধর্মের এইসব অসার বিধিনিষেধ, কুসংস্কার এবং দৈহিক ও মানসিক অশান্তির হাত থেকে মানুষ সমাজকল্যাণের দিকে মুখ ফেরাবে, মানবতা ও যুক্তির পথে হাঁটবে।[9]

সাম্প্রদায়িক ধর্মমতগুলি যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তা দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন যে, প্রত্যেকটি ধর্ম দাবি করে যে তাদের ধর্মমতই সঠিক। সৃষ্টিকর্তা একমাত্র তাদের ধর্মমত পালনের জন্য মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের ধর্মমত যারা মানে না, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে শাস্তি ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ধর্মগুলি “পবিত্রতা ও সরলতার পরিবর্ত্তে কেনলমাত্র পক্ষপাত ও অপ্রেমের বীজ” মানুষের মনের মধ্যে বপন করে।[10] প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ই মনে করে যে, নিজ সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের কাজের সুফল পাবে এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা মৃত্যুর পর তাদের কাজের কুফল পাবে। রামমোহন এই ধারণাকে নস্যাৎ করে বলেন:

…এটা খুবই স্পষ্ট যে তারা সকলেই, কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের অনুবর্ত্তী না হয়েও ইহলোকে যেমন জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর আলোক, বসন্তের আনন্দ, বর্ষার বৃষ্টিধারা, শারীরিক স্বাস্থ্য ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, দেহ ও মনের সৌন্দর্য্য প্রভৃতি এই পৃথিবীতে প্রাপ্য সব স্বর্গীয় আশীর্ব্বাদই সমভাবে ভোগ করছে, তেমনি মানুষ সর্ব্ব-ধর্ম্ম-নিরপেক্ষভাবে একই রকম অসুবিধা, যন্ত্রণা, অন্ধকার ও শীতের প্রকোপ, মানসিক ব্যাধি, আর্থিক অবস্থার দৈন্য, দেহ ও মনের বিকৃতি ইত্যাদি অবস্থাও সমানভাবেই সহ্য করে এই পৃথিবীতে বাস করছে।[11]

একটু অন্যভাবে এবং সংক্ষেপে বলা যায় যে, মানুষ যে-ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেন, ইহজাগতিক সুখ বা অসুখ থেকে সে বঞ্চিত হয় না বা এড়াতে পারে না। সুতরাং সাম্প্রদায়িক ধর্মে বিশ্বাসীরা যা-ই ভাবুক না কেন, তা খুব একটা অর্থবহ নয়।

 

চার.

প্রকৃতি ও তার রহস্যকে কেন্দ্র করে রামমোহন যা বলেছেন, তা অনন্য। প্রকৃতিকে কীভাবে জানা যায়? রামমোহনের উত্তর হল:

কেবলমাত্র গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্য্যবেক্ষণ শক্তি দ্বারা মানুষ প্রকৃতির নানা রহস্য— যথা ভিন্ন ভিন্ন জীবের ও উদ্ভিদের জন্য বিভিন্ন জীবনযাত্রা প্রণালী ও বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা, গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধির নিয়ম, প্রতিদানের কোনও প্রত্যাশা না করেও প্রাণীদের স্বাভাবিক সন্তান বাৎসল্য, খনিজ, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের বৃদ্ধি ও ক্ষয়ের কারণ প্রভৃতি আবিষ্কার করতে পারে।[12]

প্রকৃতি ও জীবনকে জানার ক্ষেত্রে মানুষের একটি স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। বাঁচবার প্রয়োজনেই এই জানার আগ্রহ থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ শুধু নতুন জ্ঞান সংগ্রহের আনন্দেই জানতে চায়। এটা মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। অপর একটি বিষয় হল কার্য-কারণ সম্পর্ক। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও কার্য-কারণ নীতিকে প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা ও মানবসমাজের জীবনযাত্রাকে জানতে ও বুঝতে পারবে এবং এভাবেই সঠিকভাবে তাদের বুঝতে পারা সম্ভব।

প্রচলিত পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং অভ্যাসজাত সংস্কারের ফলে মানুষ অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞান এবং কার্য-কারণ সম্পর্ক বিষয়ে অভ্যস্ত হয় না। ফলে তারা পরম্পরাগত জ্ঞানকে নির্বিচারে গ্রহণ করে, কোনও প্রশ্ন তোলে না। পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলিকে তারা গাছ, পাথর, মূর্তিকে পূজা করতে দেখেছে বা পূণ্য অর্জনের জন্য কোনও বিশেষ নদীতে স্নান করতে দেখেছে এবং সেই অনুযায়ী তারা ওই বস্তুগুলিকে পূজা করে বা নদীতে স্নান করে তৃপ্ত হয়। কিন্তু কোনও কার্য-কারণ সম্পর্কের অনুসন্ধান করে না বা প্রশ্নও তোলে না বা বাস্তবতার সঙ্গে সেগুলিকে মিলিয়েও দেখতে চায় না।

বছরের পর বছর মানুষের একটি বিরাট অংশ প্রশ্নহীনভাবে নানা ধরনের অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের উপর জীবন কাটায়। তারা পাপ বা অপরাধের হাত থেকে মুক্তি পেতে পুরোহিতদের নির্দেশে নানা ধরনের প্রায়শ্চিত্ত কর্ম করে। এর জন্য তাদেরকে পুরোহিতদের অবশ্যই অর্থ ও নানা দ্রব্য দিতে হয়। এভাবেই নানা দেশে অর্থের বিনিময়ে মানুষ মুক্তি ক্রয় করে। মানুষ এটাও বিশ্বাস করে যে, পুরোহিতদের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। সেই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্তি পায় এই অলৌকিকতার কারণেই। কিন্তু যারা ওই সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, তাদের উপর এর কোনও ফল পাওয়া যায় না। এই বক্তব্যকে নস্যাৎ করতে রামমোহনের বক্তব্য হল:

এই কাল্পনিক বস্তুগুলির যদি সত্যিকার কোনও গুণ থাকত তবে তা ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী সকল জাতের লোকের উপরই সমভাবে ফলপ্রসূ হ’ত, কোনও বিশেষ জাতের বিশ্বাস ও অভ্যাসের মধ্যেই আবদ্ধ থাকত না। কারণ যদিও ফলের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন লোকের সামর্থ্যের তারতম্যের উপর নির্ভর করে, কিন্তু তা’ বলে কোনও বিশেষ মতাবলম্বীর বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। দেখতে পাও না কি, যে কেউ যদি মিষ্টি মনে করে বিষ খায়, তবে বিষেরই ক্রিয়া হয়, আর তা’তে প্রাণ যায়।[13]

এইভাবে তিনি অলৌকিকত্বের মতো কাল্পনিক ধ্যানধারণাগুলিকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি অলৌকিকতা ও অতিপ্রাকৃত নিয়ে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যেগুলির উল্লেখ এখানে জরুরি। তিনি দেখিয়েছেন, ধর্মগুরুরা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য ‘অলৌকিকতা’কে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ ধর্মগুরুদের এই অলৌকিক ক্ষমতার কথায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়।

তা’দের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক যে যখন তা’রা এমন কোনও কিছু দেখতে পায়, যা’র রহস্য তা’দের বুদ্ধির অগম্য, অথবা যা’র কোনও কারণ দেখতে পায় না, তখন তা’রা ইহা এক অলৌকিক বা অতি-প্রাকৃতিক শক্তির ক্রিয়া বলে বর্ণনা করে। এর রহস্য আসলে এই যে জগতের যাবতীয় বস্তুর বর্ত্তমানতাই কোনও না কোনও আপাত কারণের এবং বিভিন্ন অবস্থার (conditions) ও ন্যায়বিধির (modes of justice) উপর নির্ভর করে। সুতরাং আমরা যদি কোনও বস্তুর ভাল ও মন্দের মুখ্য এবং গৌণ কারণ সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করে দেখি, তবেই আমরা বলতে পারি যে ওই বস্তুর সত্তার সঙ্গে সমস্ত বিশ্বই অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত। কিন্তু, যখন অভিজ্ঞতার অভাবে এবং মতের সঙ্কীর্ণতার জন্য কোনও কিছুর কারণ কা’রও নিকট অপ্রকাশিত থাকে, তখন তা’র সুযোগ নিয়ে অন্য যে কোনও মতলবী মানুষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব ঘটনাকে নিজের অলৌকিক শক্তি বলে বর্ণনা ক’রে তা’র দলেই লোককে আকর্ষণ করে।[14]

অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিকতার বিরুদ্ধে রামমোহন একদিকে যেমন কঠোর সমালোচনা করেছেন, তেমনি অন্যদিকে কার্যকারণ সম্পর্ক, বিচার-বিবেচনা, অর্থাৎ যুক্তিবাদের সপক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পরামর্শ হল যে-সকল ঘটনাকে অলৌকিক বলে দেখানোর চেষ্টা হয়, সেগুলির কারণ অনুসন্ধান করা দরকার, খুঁটিয়ে বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন। ইউরোপে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নানা ধরনের বিস্ময়কর আবিষ্কার করেছেন বা আছেন বাজিকরেরা যাঁরা নানা ধরনের হাতসাফাই সহ নানা ধরনের ভেলকিবাজি দেখান। ঘটনা হল, আপাতদৃষ্টিতে এগুলিকে দেখে আশ্চর্য হতে হয় এবং ‘অলৌকিক’ বলে মনে হয়। কিন্তু যাঁরা সুস্থ মনের অধিকারী ও যুক্তিবাদী তাঁরা এগুলিকে খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে ‘অলৌকিক’ বলে কিছুই হয় না। সবই লৌকিক এবং ঘটনাগুলির মূল কারণ বেশ সন্তোষজনকভাবে বোধগম্য। এর মধ্যে দিয়ে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। রামমোহন এক্ষেত্রে যে যে সিদ্ধান্তে এসেছেন তা খুবই তাৎপর্যজনক:

এই সন্ধান পেলে অতিপ্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাসীদের দ্বারা বুদ্ধিমান লোকেরা আর প্রতারিত হবেন না। তবে এ-বিষয়ে আমরা বড়জোর এই বলতে পারি যে কোনও কোনও ব্যাপারে তীক্ষ্ণ গভীর অনুসন্ধান সত্ত্বেও অনেক আশ্চর্য্য ঘটনার কারণটা লোকের অজ্ঞাত থেকেই যায়। সেসব ক্ষেত্রে আমাদের সুযুক্তির উপর নির্ভর করা উচিত; এবং নিজেকে এই প্রশ্নটা করা উচিত যে, এর কারণটার জন্য আমাদের বুঝবার বর্ত্তমান অক্ষমতাই আসলে দায়ী, না, প্রাকৃতিক নিয়মের বহির্ভূত অসম্ভব কোনও মাধ্যমের উপর আরোপ করা যুক্তিসঙ্গত? আমি মনে করি যে আমাদের সুযুক্তি প্রথমোক্ত পন্থা বেছে নেবে। তা’ছাড়া শত শত বছর আগে কোন মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে, বা কেউ স্বর্গারোহণ করেছে, ইত্যাদি অসম্ভব ও অযৌক্তিক ব্যাপারের তথ্যানুসন্ধান করবার এমন কী দরকার পড়েছে?[15]

এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, সেই সময়ে (১৮০৩-৪) ভারতের মতো একটি দেশে এমন যুক্তিবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মানুষও ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের মূল কথা— সব কিছুতেই খুঁজব কারণ/ অন্ধভাবে মানব না,/ বিজ্ঞানকে বই-এর পাতায়/ বন্দি করে রাখব না[16]— রামমোহনের উদ্ধৃত অংশটিতে এই কারণ খোঁজার কথাই বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সকল ধরনের অযৌক্তিক আজগুবি ঘটনাকে তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন, এবং সেগুলি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজটিকেও বাতিল করেছেন।

 

পাঁচ.

অলৌকিক, অযৌক্তিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের কৃপাণ হাতে এগিয়ে এলেন রামমোহন। সাংসারিক বিষয়ে এক বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর কার্য-কারণ সম্পর্ককে বোঝার চেষ্টা, একটি কার্য ও অন্যটি কারণ— এই সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টাই ছিল রামমোহনের অন্যতম লক্ষ্য। রামমোহন লক্ষ করেন সাধারণভাবে মানুষ কার্য-কারণ সম্পর্ককে স্বীকার করলেও ধর্মের ক্ষেত্রে তা করে না। ধর্মের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাস’ প্রধান ভূমিকা নেয়, ফলে এখানে কার্য-কারণ সম্পর্ক বাস্তবে না থাকলেও মানুষের কোনও সমস্যা হয় না। যেমন, তারা প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে দুর্গতি দূর করতে চায় বা অসুখ সারাতে চায়। কিন্তু দুর্গতি দূর বা অসুখ সারানোর ক্ষেত্রে প্রার্থনার কোনও ভূমিকাই নেই। এই প্রসঙ্গে অক্ষয় দত্তের সেই বিখ্যাত ইকুয়েশনের কথা মনে পড়ে:

অক্ষয় দত্তের প্রায় ৫০ বছর আগে ৩১-৩২ বছরের যুবক রামমোহন এই কথাই বলেছেন— প্রার্থনার কোনও ফল নেই।

মানুষ ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণভাবে যুক্তির ধার ধারে না। যদিবা কোনও ক্ষেত্রে তাদের মনে সংশয় বা প্রশ্ন জাগে, সে-ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতারা শিষ্যদের বলেন যে, ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যুক্তিতর্কের কোনও স্থান নেই। ধর্মের ব্যাপারে শুধু বিশ্বাস ও ঈশ্বরের কৃপার উপরেই একমাত্র নির্ভর করতে হবে। রামমোহন তাই প্রশ্ন তোলেন: “যে-বিষয়ের কোনও প্রমাণ নেই, যা’ যুক্তিবিরুদ্ধ, তা’ একজন যুক্তিবাদী কী করে গ্রহণ বা স্বীকার করতে পারেন?”[18]

রামমোহন যুক্তিবাদী পথকেই কেবল গ্রহণ করতে বলেননি, যুক্তিবিদ্যার মধ্যেকার আকারগত বৈধতা ও বস্তুগত সত্যতার প্রশ্নটিকেও উত্থাপন করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন যে, যুক্তিবিদ্যায় অনেকক্ষেত্রেই আকারগত বৈধতা থাকলেও বস্তুগত সত্যতা নাও থাকতে পারে। তিনি একটি উদাহরণের সাহায্যে এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার্কিকরা দেখান সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা যদি একেবারে শূন্য থেকে বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারেন, তবে তার পক্ষে মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করা মোটেই অসম্ভব নয়। রামমোহন বলেছেন, “…বুদ্ধিমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে এই ধরনের যুক্তিতে কোনও ‘তাকুরিব’ বা প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য নাই।”[19] সুতরাং যুক্তির কাঠামোগত বৈধতাকে নয়, বরং বস্তুগত সত্যতাকেই তিনি গুরুত্ব দিতে চান। কারণ তা না করলে অবাস্তব, অসম্ভব ঘটনাকেও ছাড় দিতে হবে যুক্তির আকারগত বৈধতা আছে বলে।

বিভিন্ন ধর্মের নেতা ও গুরুদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে দাবি করা হয়। রামমোহন এমন ধরনের কোনও ক্ষমতাকে স্বীকার করেননি। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য হল বহিরিন্দ্রিয়ের জ্ঞান ছাড়া সুনিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে তিনি দুই প্রকারের ‘তাওয়াতুর’ বা ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেছেন— ক. সুনিশ্চিত জ্ঞান এবং খ. ধর্মমতের বাহন। সুনিশ্চিত জ্ঞান বহিরিন্দ্রিয়ের সাহায্যেই পাওয়া সম্ভব। আর অন্যদিকে ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ‘তাওয়াতুর’ আপ্তবাক্যের উপর, যাকে সন্দেহ করা চলে না। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মতে ‘তাওয়াতুর’ হল এমন সব লোকেদের বর্ণনা যাদের মিথ্যাবাদী বলে মনে করার কোনও প্রশ্নই নেই। রামমোহন প্রশ্ন তুলেছেন যে, এমন সত্যবাদী লোক প্রাচীনকালে কতজন ছিলেন তা বর্তমানকালে সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা বহিরিন্দ্রিয় বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সুতরাং প্রাচীন ধর্মগুরুদের কথায় কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে?

এরই পাশাপাশি রামমোহন এই আপ্তবাক্য বিশ্বাসের ফলে যে অনাবস্থা দোষের আবির্ভাব ঘটে, তাও লক্ষ করে বললেন:

…প্রত্যেক প্রাচীন ধর্ম্মনেতাদের কিম্বদন্তীতে বহু অসামংস্য তা’দের কথার অসারতার প্রমাণ করে। যদি বলা যায় যে প্রথম যা’রা তা’দের নেতাদের অলৌকিকত্বের বিষয় নিজ চোখে দেখেছেন বলে বিবরণ দিয়েছেন সেই বিবরণের সত্যতা তা’দের সমসাময়িক আর একদল লোকের উক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায়, তা’হলে ঐ দ্বিতীয় দলের লোকের উক্তি আবার তা’দের সমসাময়িক আর একটী (তৃতীয়) দলের লোকেদের উক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। কারণ দ্বিতীয় দলের লোকের উক্তির সত্যতাও বিশ্বাস ও প্রমাণসাপেক্ষ। এমনি করে তৃতীয় দলের উক্তির সত্যতা প্রমাণের জন্য চতুর্থ আর একদলকে আনতে হয়। এবং এইভাবে ক্রমশঃ বর্ত্তমানকালের লোক পর্য্যন্ত এসে পৌঁছানো যায়। সুতরাং প্রমাণের পর প্রমাণের জের বংশপরম্পরা অনুসারে টেনে ভবিষ্যতেও চালিয়ে দিতে পারা যায়।[20]

এইভাবে চললে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ানোর কোনও স্থান পাওয়া যাবে না, তাই এই দোষকে ‘অনাবস্থা দোষ’ বলা হয়। সুতরাং এইসব ধর্মগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার দাবি মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নেওয়া যায় না এইসব আপ্তবাক্যগুলিকে। এইভাবে রামমোহন ধর্মীয় নেতা ও গুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য যুক্তি ও বিচারের পথ গ্রহণ করলেন।

 

ছয়.

প্রায় প্রতিটি ধর্মেই ঈশ্বর/আল্লার সন্তান বা দূত (পয়গম্বর)-এর একটি বিরাট ভূমিকা স্বীকৃত। বলা হয় ‘সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা’ ইহজগতে মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য এই সব ধর্মগুরু/নেতাদের সাহায্য গ্রহণ করেন। রামমোহনের মতে, এইসব কথা অর্থহীন। কারণ এটাও বিশ্বাস করা হয় যে সৃষ্টিকর্তা কোনও ‘মধ্যবর্তী’ (intermediate agency)-র ভিতর দিয়ে বা না এসে সরাসরি (প্রত্যক্ষভাবে) তাঁর সৃষ্টিকর্ম করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হল— সৃষ্টিকর্তা মানুষের কাছে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর বাণী পাঠান, না ধর্মীয় নেতা, গুরু, দূত বা পয়গম্বরদের মাধ্যমে পাঠান। রামমোহনের সিদ্ধান্ত:

প্রথমটা সত্য হ’লে মুক্তির পথ দেখাবার জন্য কোনও মধ্যবর্ত্তীর দরকার হয় না। এবং পয়গম্বরের কিছু করবার বা বাণী দেবারও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আর দ্বিতীয়টা হ’লে তো একটার পর একটা করে [পয়গম্বর বা মধ্যবর্তীর] দরকার হয়।[21]

এই মধ্যবর্তীদের যে কোনও প্রয়োজন নেই তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়ার পর তিনি খানিকটা এগিয়ে গেলেন। দেখালেন যে, কোনও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় যে ব্যক্তি (ধর্মীয় গুরু/নেতা)-কে সত্যধর্মের একমাত্র পথপ্রদর্শক বলে মনে করে থাকে, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় তাকেই ভুল পথের নির্দেশ বলে প্রচার করে।[22] সুতরাং ধর্মগুরুদের কোনও প্রয়োজন নেই। আর, এক অর্থে সকল ধর্মগুরুর/নেতার প্রদর্শিত ধর্মীয় পথই অসত্য বা মিথ্যা— এ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, ইসলামের ক্ষেত্রেও সমান পরিমাণে সত্য।

 

সাত.

‘তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদিন’ গ্রন্থের একেবারে শেষভাগে গিয়ে রামমোহন তাঁর নিজস্ব ধর্মমতের উল্লেখ করেছেন। পৌত্তলিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও ইসলামকে তিনি গ্রহণ করেননি। কেন করেননি তা গ্রন্থভুক্ত আলোচনাতে স্পষ্ট। তাঁর বিশ্বাস একেশ্বরবাদে। এই একেশ্বরবাদের ভিত্তি অবিমিশ্র ইহজাগতিকতা।


[1] রায়, রামমোহন। ২০২১: ১১-১২।
[2] পূর্বোক্ত: ১৩।
[3] পূর্বোক্ত: ১৩।
[4] পূর্বোক্ত: ১৪।
[5] পূর্বোক্ত: ১৪।
[6] পূর্বোক্ত: ১৪-১৫।
[7] পূর্বোক্ত: ১৫।
[8] পূর্বোক্ত: ১৬।
[9] পূর্বোক্ত: ১৭।
[10] পূর্বোক্ত: ১৭-১৮।
[11] পূর্বোক্ত: ১৮।
[12] পূর্বোক্ত: ১৮।
[13] পূর্বোক্ত: ১৯।
[14] পূর্বোক্ত: ১৯-২০।
[15] পূর্বোক্ত: ২০-২১।
[16] কবি, সৃজন সেন।
[17] চক্রবর্তী, অজিতকুমার। ১৯১৬:২৪১। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এলাহাবাদ: ইন্ডিয়ান প্রেস।
[18] দ্রষ্টব্য, টীকা ১। ২১।
[19] পূর্বোক্ত: ২২।
[20] পূর্বোক্ত: ২৩।
[21] পূর্বোক্ত: ২৫।
[22] পূর্বোক্ত।