সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে রাজা রামমোহন রায়

কণিষ্ক চৌধুরী

 



শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 

রামমোহন রায়: শাস্ত্র ও যুক্তি: ধর্ম

রামমোহন রায় ‘পরমেশ্বরে’র ওপর আস্থা রাখতেন। ধর্মের প্রতিও ছিল বিশ্বাস। তাঁর এই ঈশ্বর ও ধর্মের প্রতি বিশ্বাস কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ওপর বিশ্বাস নয়। বেশ কিছুটা অন্যরকম। অনেকটাই ইউরোপীয় ডিইস্ট (Deist)-দের মতো।

অনেকে Deism-এর বাংলা অনুবাদ করেন, যুক্তিসঞ্জাত ঈশ্বরবাদ। ডিইস্টদের মতে, একেবারে সৃজনের আদিলগ্নে ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক মোক্ষম ঠেলা দিয়ে সরে পড়েছেন। তারপর থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজের নিয়মেই চলছে। ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের আর প্রয়োজন পড়ছে না।[1] রামমোহন রায়ের অবস্থানটিও এইরকমই। কারণ তিনি সৃষ্টি ও স্রষ্টার ভূমিকা সহ ইহজগৎকে বুঝতে চান কার্য-কারণ সম্পর্ক ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে। তাই তিনি অলৌকিকতাকে পরিহার করেন, অর্থহীন ও কুৎসিত আচার-রীতিনীতিকে পরিত্যাগ করেন, মধ্যস্থতাকারীদের অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন আর যুক্তির সর্বপ্রাধান্যকে স্বীকার করে নেন।

যুক্তিবাদ তাঁর চিরসঙ্গী। আর তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি সম্পর্কে তিনি মোহমুক্ত। তিনি কোনও ধর্ম তৈরি করেননি বা ধর্মের প্রচার করেননি। ধর্ম তাঁর কাছে একান্তই ইহজাগতিক স্বার্থ-সাধনের উপায় মাত্র। জীবনের একেবারে শেষে, রামমোহন তাই ধর্মকে কুসংস্কারের সঙ্গে তুলনা করেন। একটি খবরের দিকে নজর দেওয়া যাক। এটি প্রকাশিত হয় ৮ অক্টোবর ১৮২৯-এ কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া গ্যাজেট-এ। কলকাতার প্রথম লর্ড বিশপ মিডলটন ভেবেছিলেন যে। রামমোহন রায় গোপনে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে যিশুখ্রিস্টের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ রামমোহন রায় যিশুর বাণী ও উপদেশগুলি সংগ্রহ করে ইংরাজি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেন এবং প্রকাশ করেন।[2] তাছাড়া বন্ধুবর উইলিয়াম অ্যাডাম-এর সাহায্যে বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার কাজও শুরু করেন। এসব দেখে কোনও কোনও খ্রিস্টান মিশনারির মনে হয়েছিল যে, রামমোহন হয়ত গোপনে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। লর্ড বিশপ মিডলটন এই ধারণার বশবর্তী হয়েই রামমোহনকে অভিনন্দন জানান। তার উত্তরে রামমোহন বলেন: “My Lord, you are under a mistake. I have not laid down one superstition to take another.”[3] বাংলায় তর্জমা করলে যা দাঁড়াবে তা হল এইরকম: “মান্যবর, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি একটি কুসংস্কার (বা অন্ধত্ব)-কে ফেলে অন্য আরেকটি কুসংস্কার (বা অন্ধত্ব)-কে গ্রহণ করিনি।”[4]

ধর্ম সম্পর্কে রামমোহন রায়ের মতামতটি বোঝার প্রয়োজনে প্রথমে কয়েকটি প্রচলিত ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত ভুল-ধারণার ভুলগুলিকে উল্লেখ করতে হবে। তারপরে আসবে তাঁর ধর্মচিন্তার অনন্যতার নানা দিক-দিগন্ত।

প্রথম ভ্রান্তি: রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন।
দ্বিতীয় ভ্রান্তি: তিনি ছিলেন শাস্ত্রানুরাগী।
তৃতীয় ভ্রান্তি: তিনি ছিলেন বেদান্তবাদী।
চতুর্থ ভ্রান্তি: তিনি প্রকৃত হিন্দু ও হিন্দুত্বের অনুসরণকারী।
পঞ্চম ভ্রান্তি: বর্ণ-জাতভেদের বিরুদ্ধে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এছাড়াও ব্যক্তিজীবনে তিনি বর্ণ-জাতভেদ মেনে চলতেন।

 

দুই.

রমেশচন্দ্র মজুমদার[5], রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়[6] সহ অধিকাংশ স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইতে এটা লেখা আছে যে রামমোহন রায় ১৮২৮-এ ব্রাহ্ম সমাজ তৈরি করেছিলেন। আর এরই সঙ্গে যুক্ত থাকে যে ব্রাহ্মধর্মের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা।[7] এই মতই বর্তমানে সর্বত্র প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত। এই অবধি পড়ে কারও মনে হতেই পারে রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনকারী যদি হনও— তাহলেই বা সমস্যা কোথায়? এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে? এ-প্রশ্নের উত্তরে দুটি কারণের কথা বলতে হবে। প্রথমত, তথ্য দুটি ভুল। দ্বিতীয় কারণটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। রামমোহনকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্রাহ্মধর্মের স্রষ্টা হিসেবে দেখানোর মধ্যে দিয়ে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা চলে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বেদান্ত চর্চা শুরু হয়েছিল যা গোটা শতক জুড়ে চলেছে। বিবেকানন্দের হাতে তা একটা পরিণতি লাভ করেছে। অর্থাৎ রামমোহন রায়ের মতো একজন শ্রেষ্ঠ মনিষী বেদান্তের গুরুত্ব বুঝেছিলেন, তা চর্চা করেছিলেন এবং সেই অনুসারে ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এইভাবে ঔপনিবেশিক ভারতে বেদান্ত চর্চার ধারাবাহিকতা, বৈধতা ও শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে। বেদান্ত-ব্যবসায়ীদের কাছে এই প্রচেষ্টা তাই মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

বেদান্ত-ব্যবসায়ীদের এই দাবির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কারণ রামমোহনের বেদান্ত চর্চার একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ ছিল, যার সঙ্গে বেদান্ত-ব্যবসায়ীদের একেবারেই মেলে না। তাই তারা সুযোগ বুঝে রামমোহনকে খোঁচা মারতে বা ছোট করতে ছাড়ে না। সেই কারণেই রামমোহনের বেদান্ত চর্চা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালানো দরকার। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে হবে তাঁর ধর্ম সংক্রান্ত ধারণার আদিপর্বটিকে।

 

তিন.

কৈশোরেই প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য আচার-আচরণ সম্পর্কে রামমোহনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি লক্ষ করেছিলেন বৈষ্ণব ও শাক্তদের মধ্যেকার বিশ্বাস ও আচারগত পার্থক্য। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরিবারের মধ্যেই হয়। তাঁর মা তারিণী দেবীর পিতৃকুল ছিল শাক্ত-ধর্মাবলম্বী। আর বাবা রামকান্ত রায়ের পারিবারিক বিশ্বাস বৈষ্ণব ধর্মমতে। এই দুই ধর্মমতের মধ্যে বিরোধ এতটাই যে, বৈবাহিক সম্পর্ক প্রায় ঘটত না বললেই চলে। কিন্তু তারিণী দেবী ও রামকান্তর ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটল। এই বিবাহ নিয়ে একটি গল্প আছে। সেটি শোনা যাক। রামকান্তর বাবা ব্রজবিনোদ রায় মুর্শিদাবাদের নবাবি প্রশাসনের একজন বড় মাপের রাজকর্মচারী। কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি হুগলির রাধানগর গ্রামে তাঁর বাকি জীবনটা কাটান। ব্রজবিনোদ যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তাঁকে গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়া হল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে শ্রীরামপুরের চাতরা গ্রামের শাক্ত মতাবলম্বী শ্যাম ভট্টাচার্য ব্রজবিনোদের কাছে একটি বিশেষ অনুরোধ নিয়ে হাজির হন। অনুরোধটি হল, ব্রজবিনোদের সাত ছেলের যেকোনও একজনের সঙ্গে শ্যাম ভট্টাচার্যের মেয়ে তারিণীর বিয়ে দেওয়া। ব্রজবিনোদ ভারি সমস্যায় পড়ে গেলেন। শাক্তের সঙ্গে বৈষ্ণবের বিয়ে— এ অসম্ভব। ধর্মীয় আচার-আচরণ, বিশ্বাস— সব দিক থেকেই বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈব ধর্মের মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ। সম্পর্কটা একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক, লাঠালাঠির সম্পর্ক। অন্যদিকে আবার শ্যাম ভট্টাচার্যের অনুরোধ ও কাতর প্রার্থনাকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না। তাই তিনি তাঁর তিন ছেলেকে ডেকে পাঠান এবং তাদের সামনে শ্যাম ভট্টাচার্যের প্রস্তাবটি রাখেন। ব্রজবনোদের দুই ছেলে এমন বিয়েতে অসম্মত হলেও রামকান্ত বাবাকে কথা দেন এবং তারিণী দেবীকে বিয়ে করেন।[8]

বলা বাহুল্য যে, এ-বিয়ের ফলে পারিবারিক বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। আর সেটাই ঘটল। ফলে রামমোহনকে প্রত্যক্ষ করতে হল বৈষ্ণব ও শৈবের মধ্যেকার অর্থহীন সংঘাত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন: “তাঁহার [রামমোহন] পিতৃবংশ বৈষ্ণব ও মাতামহবংশ শাক্ত ছিল। সুতরাং বাল্যকাল হইতেই তাঁহাকে ধর্মসঙ্কটে পড়িতে হইয়াছিল।”[9] বিষয়টির উল্লেখ আছে দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর লেখাতেও: “বাল্যে রামমোহন স্বীয় পরিবারের মধ্যেই শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বেষভাব দেখিয়া ব্যথিত ও কৌতূহলী হইতেন।”[10]

রামমোহন লক্ষ করলেন বৈষ্ণব-শাক্তদের মধ্যেকার অর্থহীন বিরোধ, ধর্মের নামে যুক্তিহীন ও অমানবিক আচার-প্রথা, কুসংস্কার ও পুতুলপুজো। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মগুলি সম্পর্কে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ১৬ বছর বয়সেই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে নিজের মতপ্রকাশ করার জন্য এবং প্রবন্ধ রচনার জন্য তাঁকে গৃহত্যাগ করতে হয়। রামমোহন লিখেছেন:

আমার বয়স যখন ষোলো বছর, তখন আমি হিন্দুদের পৌত্তলিকতার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে একটি প্রবন্ধ রচনা করলাম। আমার নিজের বিচার এবং এই প্রবন্ধ আমার ও আমার নিকটতম পরিজনদের মধ্যে ব্যবধান রচনা করল। আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।[11]

ব্রাহ্মণ্য ধর্মগুলি সে-সময় ছিল এইরকমই। একই কু-আচারসর্বস্ব, অসহিষ্ণুতা, ভ্রান্ত বিশ্বাসের সমষ্টি। এর সঙ্গে ছিল পুতুলপূজার ছেলেমানুষি। রামমোহন এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে আরবি ও ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে তিনি যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। এইসব ভাষার সাহিত্য পাঠ করে তাঁর মধ্যে ইসলামের একেশ্বরবাদী ভাবনা গড়ে ওঠে। এরই পরিণতিতে ১৮০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে আরবি ভূমিকা সহ ফার্সি ভাষায় একটি বই লেখেন। নাম ‘তুহফাৎ-উল মুওয়াহিদিন’, অর্থাৎ একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। এই বইটির মধ্যেই তাঁর ধর্ম-সম্পর্কিত ভাবনার একটি পরিচ্ছন্ন ছবি পাওয়া যায়। এই বইয়ের শেষ অনুচ্ছেদে তাঁর রচিত আরও একটি বইয়ের কথা তিনি বলেছেন, যেখানে তিনি ধর্ম বিষয়টি আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁকে উদ্ধৃত করা যাক: “আমার আরেকটি রচনা ‘মানজারুতুল আদিয়ান’ বা ‘নানা ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি।”[12] জাহিদা জাইদির মতে ‘তুহফাৎ’ হল ‘মানজারুতুল আদিয়ান’-এর দার্শনিক ভূমিকা।[13]

৩২ বছর বয়সি রামমোহনের রচিত ‘তুহফাৎ-উল মুওয়াহিদিন’ বহুদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ একটি আশ্চর্য রচনা। এটির তাৎপর্য বোঝার জন্য বইটির মূল ভাবনার দিকে একবার নজর দেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত, রামমোহনের মতে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস মানুষের সহজাত। সকল সৃষ্টির উৎস এক ও অদ্বিতীয় পরমপিতা— এই বিশ্বাস সর্বজনীন। অযৌক্তিক আচার-অনুষ্ঠান, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর উদ্ভট আরাধনা-রীতি মানুষের পরমপিতা সম্পর্কে মৌলিক উপলব্ধিতে বাধা দেয়।

দ্বিতীয়ত, প্রায় সকল ধর্মেই দেহের অতিরিক্ত আত্মা ও স্বর্গ-নরক (পরলোক)-এর ধারণা রয়েছে। রামমোহন এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দেখান যে, ধর্মের নামে চলে উচিত-অনুচিত ধারণার যথেচ্ছ কল্পনা এবং মৃত্যুপরবর্তী শাস্তি ও পুরস্কারের উদ্ভট বিধান। অজ্ঞ-অশিক্ষিত সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করার লক্ষ্যে পুরোহিত ও মোল্লারা এই সব বিধানকে আরও জটিল করে তোলে। রামমোহনের ভাষায়:

সব ধর্মেরই মূলমন্ত্র হল চিদশক্তি বা পরমাত্মায় (চিদশক্তি বা পরমাত্মা বলতে বোঝায় যে আধ্যাত্মিক শক্তি জড়দেহ বা পদার্থের নিয়ামক) এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস (পরলোক বলতে সেই স্থান বোঝায় যেখানে দেহ থেকে আত্মা ছেড়ে যাওয়ার পর ইহলোকের পাপ-পুণ্যের ফলাফল করতে হয়)। পরমাত্মা ও পরলোকের অস্তিত্ব স্বীকার এবং এই দুটি তত্ত্বের শিক্ষণ ও প্রচার সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্যাণকর বলে প্রশ্রয় দেওয়া চলে (যদিও পরমাত্মা ও পরলোক বলতে সত্যি কিছু আছে কি নেই সে ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত), কারণ পরলোকে নির্যাতন এবং ইহলোকে শাসন-কর্তৃপক্ষের হাতে দণ্ডভোগ এই দুয়ের ভয়ে মানুষ নিষিদ্ধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকে। কিন্তু আবশ্যিক এই দুটি তত্ত্বে বিশ্বাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শুদ্ধাশুদ্ধ, শুভাশুভ, পানভোজন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত শত শত নিরর্থক কষ্টসাধ্য ব্রত যার ফলে সমাজব্যবস্থার উন্নতির পরিবর্তে ক্ষতি হয়েছে অনেক, সমাজজীবনে নানারকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের দুঃখকষ্ট ও বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে।[14]

তৃতীয়ত, ধর্মের গুরু ও পান্ডারা তাদের অনুসরণকারী চেলা/শিষ্যদের মনে অহেতুক ভীতি সৃষ্টি করে এবং ধর্মশাস্ত্রের প্রকৃত জ্ঞান থেকে তাদের বঞ্চিত রাখে। এছাড়াও তাদের কাছ থেকে অন্ধ আনুগত্য দাবি করে দাসসুলভ মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। ফলে মানুষ স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিনির্ভর ভালো-মন্দ বিচারে একেবারেই অক্ষম হয়ে পড়ে। তারা তাদের মূল্যবান সময় কাটায় অর্থহীন, উদ্ভট কাহিনিচর্চা করে বা ভয়ঙ্কর সব আচার-অনুষ্ঠান করে। এইসব আচার-অনুষ্ঠানগুলি তাদের চিন্তাভাবনাকে ভোঁতা করে দেয়। যদি-বা কখনও কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে এবং যদি সে অসাবধানতাবশত মামুলি ধর্মমতের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করে, তাহলে সেই ধর্মের মানুষেরা ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে বা বাক্যবাণে জর্জর করে।[15]

চতুর্থত, প্রতিটি ধর্মই মনে করে তার ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং সত্যের একমাত্র রক্ষক। এবং অবশ্যই মোক্ষলাভের একমাত্র সঠিক পথ। যেহেতু নানা ধর্মমতের সত্য ও মোক্ষের ধারণাগুলি পরস্পরবিরোধী, সেহেতু তাদের একটিকে বিশ্বাস করলে অপরগুলিকে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই যাঁরা বলেন— তাঁদের ধর্মই একমাত্র সত্য, অন্য সব ধর্ম মিথ্যা— তাঁরা যুক্তিহীন কথা বলেন। তাই রামমোহন বলেন:

অথচ তাদের সেই পূর্বপুরুষরাও অন্যান্য লোকেরই মতো পাপাচার বা ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে কেউ ছিলেন না। তাই নিজ নিজ ধর্মের ধ্বজাধারী বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর এই লোকেরা ভ্রান্তও হতে পারেন, অভ্রান্তও হতে পারেন। অভ্রান্ত হলে স্পষ্টতই সেক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দুটি মতের সমাবেশ ঘটে যা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়, আর ভ্রান্ত হলে বিশেষ কোনও ধর্মমত, নয়তো সব ধর্মমতই ভ্রান্ত বলে ধরে নিতে হয়। একতরফা বিচারে বিশেষ কোনও ধর্মমতকে যদি ভ্রান্ত বলে ধরে নেওয়া হয় তবে তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাই থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে সব ধর্মমতই ভ্রান্ত।[16]

পঞ্চমত, ধর্মের গুরু ও পান্ডারা ধর্মীয় বিষয়ে যুক্তিতর্ককে একেবারেই অনুমোদন করেন না। বিশ্বাস ও ঈশ্বরকৃপাই মানুষের একমাত্র সহায়। সেই অনুযায়ী সাধারণ মানুষ সামাজিক বা ইহজাগতিক বিষয়ে কার্যকারণ সম্পর্ক মেনে চললেও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তা মানেন না। ধর্মীয় গুরুরা আরও বলেন যে, এই দুনিয়া সৃষ্টিকারী সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার পক্ষে কোনও অলৌকিক কাজ ঘটানো মোটেই অসম্ভব নয়। রামমোহন লিখেছেন:

বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধর্মনায়করা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ভাঁওতা দিয়ে নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে জনসমক্ষে প্রচার করেন এবং সেভাবেই তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মে সাধারণ লোকের বিশ্বাস বাড়াতে সমর্থ হন। কল্পনাপ্রবণ সাধারণ লোকদের স্বভাবই হল যখন তারা বুদ্ধির অতীত কোনও ঘটনা বা ক্রিয়াকর্ম দেখতে পায় অথবা কোনও ঘটনা বা ক্রিয়াকর্মের প্রত্যক্ষ কারণ খুঁজে পায় না, তখন সেগুলি তারা কোনও অলৌকিক শক্তি বা কারণ-সম্ভূত বলে মনে করে। আসল কথা এই যে, এই জগতে বিদ্যমান প্রত্যেকটি পদার্থ পৃথক-পৃথকভাবে কতকগুলি কারণ, পরম্পরা ও নিয়মশৃঙ্খলার অনুবর্তী, এমন-কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেই কারণ, পরম্পরা ও নিয়মগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখতে পাওয়া যায় যে প্রত্যেকটি পদার্থের অস্তিত্ব বিশ্বজগতের একটি পরিকল্পনায় বাঁধা। কিন্তু যখন কেউ অভিজ্ঞতার অভাব বা কল্পনার আধিক্য হেতু বিরলদৃষ্ট কোনও পদার্থ বা ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে অসমর্থ হয়, তখন প্রায়ই নিজ উদ্দেশ্য সাধনে আর কেউ সেই পদার্থ বা ঘটনা তারই অলৌকিক ক্ষমতা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করে এবং অলৌকিক শক্তিধর ও পূজ্যপাদ পরিচয়ে সাধারণ লোকের ভক্তি-শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। বর্তমানে আমাদের এই ভারতবর্ষে অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ও ঘটনায় বিশ্বাস এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে এই দেশের লোকেরা যখনই কোনও অদ্ভুত বা বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হয় যা তাদের পূর্বতন ধর্মনায়ক বা বর্তমান মহাপুরুষদের অলৌকিক ক্ষমতাবলে সম্ভব হয়েছে বলে চালানো যায়, তখনই তারা মনেপ্রাণে তাই বিশ্বাস করে এবং সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ ও বোধগম্য কোনও কারণ থাকলেও তারা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু যারা স্থিরবুদ্ধি ও ন্যায়প্রেমী তাদের কাছে এ কথা গোপন নেই যে এমন অনেক অদ্ভুত জিনিস আছে, যেমন য়ুরোপীয়দের আবিষ্কৃত বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য এবং বাজিকরদের হস্তকৌশল যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য এবং আপাতদৃষ্টিতে যার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে বা অন্যলোকের কাছে সে বিষয়ে শিক্ষালাভ করলে সব-কিছুরই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আরোহী প্রথায় বিচার করবার ক্ষমতাই বুদ্ধিমান লোকদের এইসব অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছলনা থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করতে পারে। এ সম্বন্ধে বড় জোর বলা যায় যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সূক্ষ্মবিচার ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখা সত্ত্বেও কারও কারও কাছে কোনও কোনও অদ্ভুত ঘটনা বা ক্রিয়াকর্মের রহস্য অজ্ঞাত থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধির শরণাপন্ন হয়ে নিজেকে এই প্রশ্নই করতে হবে— দুটির মধ্যে কোনটি যুক্তিযুক্ত, আমরাই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি এবং তার কারণ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছি না কি এইসব ঘটনা প্রকৃতির নিয়মবহির্ভূত কোনও অসম্ভব বা অলৌকিক কারণসম্ভূত? আমার মনে হয় যে আমাদের বিবেকবুদ্ধি প্রথম যুক্তির পক্ষেই সায় দেবে।[17]

ষষ্ঠত, প্রত্যাদিষ্ট বা শাস্ত্রবাক্য বিশ্বাসের যোগ্য নয়, কারণ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে পরস্পরবিরোধী ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। অন্য ভাষায় প্রত্যাদেশ বা দৈবলব্ধ জ্ঞান বলে কোনও কিছুর ভিত্তিতে যে-সব ধর্ম গড়ে উঠেছে— রামমোহন সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে, তাঁর মতে, ধর্মের উপদেশের সঙ্গে ঈশ্বরের দূত বা অবতারদের যুক্ত করা অবাঞ্ছনীয়। তাঁর মতে, মানবপ্রকৃতির মধ্যে সহজাত একটি মৌলিক মননশক্তি আছে। এই মননশক্তির সাহায্যে স্থিরবুদ্ধির কেউ যদি কোনও বিশেষ ধর্মমত গ্রহণ করবার আগে বা পরে বিভিন্ন ধর্মের মূল ও গৌণ তত্ত্বগুলি ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে, তবে নিশ্চিত আশা করা যায় যে সে এইসব ধর্মতত্ত্বের সত্যাসত্য, কোনটি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কোনটিই বা ভ্রান্ত তা নির্ণয় করতে সমর্থ হয়।[18] সুতরাং তাঁর স্পষ্ট কথাটি হল শাস্ত্রবাক্য বা গুরুবাক্য নয়, মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিবোধই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণীয়। তাঁর কাছে যুক্তির স্থান শাস্ত্রের অনেক ওপরে।

সপ্তমত, রামমোহনের বক্তব্য হল ধর্মগুরু ও ধর্মের প্রবক্তাদের ঈশ্বর পাঠিয়েছেন— এ-কথাটি একেবারেই অর্থহীন। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই ধরনের কোনও মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই। রামমোহনের ভাষায়:

ধর্মগুরু বা নবীদের আবির্ভাব ও দৈববাণী প্রচার জাগতিক অন্যান্য ব্যাপারের মতোই ঈশ্বর-সম্পর্করহিত বাহ্যিক কোনও কারণসম্ভূত, অর্থাৎ এইসব কোনও উদ্ভাবকের কল্পনাপ্রসূত। কল্পিত কোনও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্মগুরু না নবীরা প্রেরিত হন না। তা ছাড়া এক জাতি যে ধর্মমতকে সত্যপথনির্দেশক বলে বিশ্বাস করে অন্য জাতির ধারণায় সেই ধর্মমত মানুষকে বিপথে চালিত করে।[19]

অষ্টমত, রামমোহন বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিবাদকে সর্বাধিক গুরুত্বের আসনে বসিয়েছেন। তাঁর মতে এই বিচারবুদ্ধি ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান। “…ঈশ্বর যে প্রত্যেকটি মানুষকে বোধশক্তি ও ইন্দ্রিয়বৃত্তি প্রদান করেছেন তার অভিপ্রায় হল এই যে অধিকাংশ পশুর মতো সে স্বজাতীয় অন্যান্য মানুষের অনুকরণ না করে অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে প্রত্যেক ব্যাপারে ভালমন্দের বিচার-বিবেচনায় নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করবে যাতে ঈশ্বরদত্ত এই বোধশক্তি নিরর্থকতায় না পর্যবসিত হয়।”[20] অর্থাৎ মানুষকে এই স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিবাদকে প্রয়োগ করতে হবে। আর দৈব ঘোষণা ও অন্ধভাবে শাস্ত্রবিধানকে পরিত্যাগ করে, বিচারবুদ্ধিকে প্রয়োগ করে সর্বমানবকে প্রীতিপাশে বদ্ধ করাই হবে উদার মানবজীবনের লক্ষ্য।

নবমত, তিনি যাবতীয় কু-আচার সহ পৌত্তলিকতা (মাটির বা পাথরের পুতুল, গাছ, পাহাড়, পাথর, পশুপাখি, জন্তুজানোয়ারের পূজা)-কে কেবল প্রত্যাখ্যান করেননি, প্রত্যাখ্যান করেছেন সকল ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেই। ‘তুহফাৎ’-এ তিনি বড় কঠোর কথা ব্যবহার করেছেন:

বেশ কিছু লোক আকৃষ্ট হয়েছে তাঁদের [ধর্মপ্রচারক/ধর্মগুরু] দিকে, হতভাগ্য সেই লোকগুলি বোধশক্তিরহিত হয়ে তাদের ধর্মনায়কদের সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে, এমনকি তাঁদের বিধান মানতে গিয়ে সত্যিকার পাপ-পুণ্যের বিচার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে এবং সে সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তোলাও পাপাচার বলে মনে করে। ধর্মের খাতিরে অপর গোষ্ঠীর লোকদের খুনজখম, সম্পত্তিহরণ ও নির্যাতন করাও তাদের ধারণায় মস্ত বড় পুণ্য কাজ, সেই গোষ্ঠীর লোকেরা একই জাতির একই বংশোদ্ভূত হলেও। মিথ্যাচার, বেইমানি, চুরি, ব্যভিচার প্রভৃতি যে-সব নীচ কর্ম অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, ধর্মগুরুদের প্রতি ভক্তি-নিষ্ঠায় অচল থাকলে সেই সব অপরাধজনিত পাপও কাউকে স্পর্শ করতে পারে না এই বিশ্বাসে তারা উদ্ভট কল্পকাহিনী পড়ে সময় কাটায়; তার ফলে পূর্বতন ধর্মনায়ক ও তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মের বর্তমান টীকাকারদের উপর তাদের ভক্তিশ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে দৈবক্রমে কেউ যদি বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে নিজ ধর্মের সত্যাসত্য যাচাই করতে প্রবৃত্ত হয়, পরক্ষণেই ধর্মাশ্রয়ী আর সব লোকের অভ্যাসমত আবার সে পিছিয়ে যায় এই ভেবে যে তার এই প্রবৃত্তির পিছনে রয়েছে শয়তানের কুমন্ত্রণা যার পরিণামে তার ইহকাল পরকাল দুই-ই নষ্ট হতে পারে।[21]

রামমোহন এইভাবে চিন্তার প্রথগত অভ্যাসের বাধার কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হল এই অভ্যাস গড়ে ওঠে কীভাবে? এর উত্তরে তিনি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার কথা বলেন:

আসল কথা এই যে মানুশ শৈশব থেকেই (যে বয়সে যাই শেখানো হয় তাই সঝে গ্রহণ করবার একটা মানসিক প্রবণতা থাকে) আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর মুখে সর্বদাই পূর্বতন ধর্মনায়কদের নানারকম আজগুবি কীর্তিকলাপের কাহিনী এবং যাদের মধ্যে তার জন্ম ও শিক্ষাদীক্ষা তারা যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মের গুণগান শুনে অটল বিশ্বাসে সেই ধর্মমতই আঁকড়ে থাকে এবং যতই অর্থহীন বা আজগুবি হোক নিজের ধর্মমতকে অন্যান্য ধর্মমতের উপরে স্থান দেয়। নিজ ধর্মের প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে সেই ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধাভক্তি দিন দিন আরও বেড়ে যায়।[22]

অর্থাৎ ধর্মীয় সামাজিকীকরণের মধ্যে দিয়ে শিশুর মধ্যে নিজ ধর্ম সম্পর্কে একটা অন্ধভক্তির মনোভাব গড়ে তোলা হয়। আবার আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে দিয়ে এই অন্ধভক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখানে তাঁর চিন্তার মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়— সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাটি নিঃসন্দেহে অনেকটাই এগিয়ে থাকা। সমসাময়িককালে ভারতীয় কোনও লেখকের রচনায় কি সামাজিকীকরণ সংক্রান্ত কোনও আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়? সম্ভবত নয়। যদিও তা অনুসন্ধানের বিষয়।

 

চার.

‘তুহফাৎ-উল মুওয়াহিদিন’ নিঃসন্দেহে সে সময়ের একটি প্রগতিশীল ভাবনার প্রকাশ। বহু-ঈশ্বরবাদ, পৌত্তলিকতা ও কু-আচার প্রথার সর্বব্যাপক প্রভাবের মধ্যে রামমোহনের ‘তুহফাৎ’ ছিল পাহাড়ের মতো। তিনি তাঁর একেশ্বরবাদী অবস্থান থেকে সৃষ্টি ও স্রষ্টার ভূমিকা সহ ইহজগৎকে বুঝতে চান কার্য-কারণ সম্পর্ক ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে। তাই অলৌকিকতা, গুরুবাদ, অবতারবাদ, কুৎসিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বর্জিত হয় তাঁর রচনা। যুক্তি স্থান পায় শাস্ত্রের ওপর।

যুবক রামমোহনের ধর্মভাবনার সূত্র সন্ধান করলে দেখা যাবে নানা উপাদানের প্রভাব। উপাদানগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই নজর দেওয়ার মতো।

প্রথমত, ইসলামি ভাষা-সাহিত্য-ধর্মের প্রভাব। তিনি সমসাময়িককালের প্রচলিত ধর্মের প্রতি রীতিমতো অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। এই অসহিষ্ণুতার প্রধানতম উৎস ছিল কু-আচারসর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মগুলি। তাঁর পারিবারিক অভিজ্ঞতা ভূমিকাও কম ছিল না। আরবি-ফার্সি ভাষা শিক্ষার সুযোগ তিনি ইসলামকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারেন। বহু-ইশ্বরবাদের গোলকধাঁধা থেকে তিনি মুক্তির সন্ধান পেলেন ইসলামের একেশ্বরবাদের মধ্যে দিয়ে। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও ইসলামের একেশ্বরবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন। যদিও তিনি ইসলামকে সমালোচনাহীনভাবে গ্রহণ করেননি।

দ্বিতীয়ত, বইটি পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উত্থাপিত যুক্তি ও প্রমাণগুলি এসেছে ইসলামীয় বৌদ্ধিক প্রবাহের একটি বিশেষ ধারা থেকে। এটি হল ‘ইলম-উল-কালাম’ বা scholastic theology (পাণ্ডিত্যপূর্ণ ধর্মতত্ত্ব)। এই ধারার পণ্ডিতদের বলা হয় ‘মুতকল্লিম’। দিলীপকুমার বিশ্বাসের বিশ্লেষণে পাওয়া যায়:

প্রথমে যুক্তিবাদী ‘মুতাজিলা’ সম্প্রদায়ই ‘মুতকল্লিম’ আখ্যা লাভ করেছিলেন। ইসলামের কট্টর শাস্ত্রপন্থীগণের সঙ্গে কুরাণ-শরীফ সম্পর্কে এঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য ছিল। রক্ষণশীল শরীয়ৎ-বিশ্বাসীরা মনে করতেন কুরাণ নিত্য, ঈশ্বরের অব্যক্ত বাণীর সমষ্টি— এক দিব্য আকর রূপে তা সপ্তম স্বর্গে নিত্য বিরাজমান। এই অনাদি উৎস থেকে জিব্রাইল কুরাণের বাণী মহম্মদের অন্তরে প্রেরণ করেছেন। মুসলমান সম্প্রদায় যে কুরাণ অভ্রান্ত ধর্মগ্রন্থ রূপে অধ্যয়ন করেন, তা কোনও সৃষ্ট বস্তু নয়, উক্ত নিত্য কুরাণেরই বাণীরূপ। এই মতের সমালোচনায় মুতাজিলা সম্প্রদায় বলতেন, কুরাণশরীফ অনাদি ও নিত্য হতে পারে না, এই গ্রন্থ ঈশ্বরের বাণী হলেও তা সৃষ্ট বস্তু (খাল্‌ক)। একে যদি অনাদি ও নিত্য বলা হয় তাহলে অনাদি, অনন্ত, নিত্য পরমেশ্বরের অতিরিক্ত আরেকটি অনাদি ও নিত্য বস্তু স্বীকার করতে হয় এবং তার দ্বারা ইসলামের মূল তত্ত্ব একেশ্বরবাদই খণ্ডিত হয়। মুতাজিলাপন্থীগণ ঈশ্বরের গুণ স্বীকার করেননি, মৃত্যুর পর শারীরিক কিয়ামতে বা স্বর্গে ঈশ্বরের চাক্ষুষ দর্শনলাভের সম্ভাব্যতায় এঁদের বিশ্বাস ছিল না। তা ছাড়া এঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও কিছু মৌলিকতা ছিল: মানুষের পাপ-পুণ্য, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারণের দায়িত্ব মানুষের নিজের, এই তত্ত্ব স্বীকার করে এঁরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ক্রিয়াশীলতাকে কিছুদূর পর্যন্ত মেনেছেন। উত্তরকালীন মরমিয়া সুফীগণের মতো এঁরা গুহ্য তত্ত্বে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। শিয়া সম্প্রদায়ের গুরুবাদকে এঁরা প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছেন। প্রচলিত প্রত্যাদেশবাদের ধারণায় এবং অলৌকিক ক্রিয়াকলাপেও এঁদের আস্থা ছিল না।[23]

রামমোহনের ‘তুহফাৎ’-এর দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি কী পরিমাণে ‘মুতাজিলা’ ধর্ম ও দর্শনভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, ইসলামীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রভাব যে তাঁর ওপর পড়েছিল, এ-কথা অনস্বীকার্য। এখানে দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হল, অলৌকিক ক্ষমতার বিরোধিতা, এবং দ্বিতীয়টি হল আরোহ পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ। বিজ্ঞানের এই দুটি দিক রামমোহন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে।

চতুর্থত, যুবক রামমোহনের ওপর মরমি কবিদের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। সুফি মরমি কবি রুমি, সাদি, হাফিজ প্রমুখ তাঁর প্রিয় কবিদের মধ্যে অনুতম। এঁরা শাস্ত্রীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে বহুলাংশে মুক্ত ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগে এবং ঈশ্বর ও জীবজগতের ঐক্যে। ‘তুহফাৎ’-এর পাতায় তাই এঁদের উদ্ধৃতি বারংবার দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় তাঁদের মানবপ্রেমের গভীর প্রভাব।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]


[1] লাহিড়ী, আশীষ। ২০০৯ : ৪১।
[2] The Precepts of Jesus, the Guide to Peace and Happiness. Calcutta, 1820.
[3] India Gazette. Oct 8, 1829. Calcutta.
[4] আহমদ, সালাহউদ্দিন। ১৯৮৯ : ২৬০।
[5] ২০২২ : ১২৭-২৮।
[6] ২০১৭ : ১৫২।
[7] চট্টোপাধ্যায়, রামানন্দ। ২০১৭ : ১৫২।
[8] Ball. 1995 : 4-5.
[9] শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ। ২০১২ : ৪ : ৩০২।
[10] উদ্ধৃত। বাগচী, নির্মাল্য। ১৯৯৫ : ২।
[11] সম্পা: সেন ও অন্যান্য। ১৯৮৯ : ৪৪।
[12] রায়, রামমোহন। ২০২১ : ৩১।
[13] জাইদি। ২০১৯ : ৯৬।
[14] অনুবাদ: রায়, সুনীলবরণ। ১৯৮৯ : ২৩।
[15] রায়, রামমোহন। ২০১৯ : ১৫।
[16] অনুবাদ: রায়, সুনীলবরণ। ১৯৮৯ : ২০।
[17] পূর্বোক্ত: ২৫-২৬।
[18] পূর্বোক্ত: ২৩।
[19] পূর্বোক্ত: ৩০।
[20] পূর্বোক্ত: ৩৩।
[21] পূর্বোক্ত: ২১।
[22] পূর্বোক্ত: ২১-২২।
[23] বিশ্বাস। ১৯৮৩ : ৫৬।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে রাজা রামমোহন রায় – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...