পারমাণবিক অস্ত্রের বিভীষিকা

পারমাণবিক অস্ত্রের বিভীষিকা | বাদল সরকার

বাদল সরকার

 

এ কথা নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না যে বাদল সরকার বাংলাভাষায় তথা ভারতীয় ভাষার একজন প্রধানতম নাট্যকার। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলা থিয়েটারকে প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে গেছেন, মানুষের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়েছেন। পাশাপাশি, নানা সময়ে সামাজিক তথা পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষে তিনি ছিলেন সদাসচেতন বিবেকী কণ্ঠস্বর। ১৯৯৮ সালে পোখরানে পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর অন্যান্য অনেক সচেতন নাগরিকের মতো প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন তিনি। এমনকি পরিবেশের ওপর পরমাণবিক বিস্ফোরণের বীভৎসতার কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন নাটকে। বর্তমান লেখাটি পোখরান ২ বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে বাদলবাবুর প্রতিক্রিয়ার পুনরুদ্ধার। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন 'অন্যরীতির নাট্যপত্র অঙ্গন'-এর আগস্ট, ১৯৯৮ সংখ্যার জন্য, বাদল সরকারের নির্বাচিত প্রবন্ধ সঙ্কলনে তা সঙ্কলিত হয়েছে।

 

কল্পনা কর, ভুল করে কয়েকটা অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা পড়ে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে গেল। ভাবতে পারিস?

–এবং ইন্দ্রজিৎ (১৯৬২)

আমি— আমি জানব— সবাইকে জানাব। এবার— কিছু হবে না। এখন— এখানকার মানুষদের— কিছু হবে না। কিন্তু পরে— পরে কোনওদিন— ভবিষ্যতে—

–পরে কোনওদিন (১৯৬৬)

প্রতিরক্ষা কথাটা বড় মজার। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্র আছে তাদের কারও আক্রমণমন্ত্রক নেই। সকলেরই প্রতিরক্ষামন্ত্রক, মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স, কারণ আক্রমণ কেউ করে না, সকলেই প্রতিরক্ষা করে। তারই জন্য আমাদের মতো গরিব দেশগুলো কোটি কোটি টাকা খরচা করে প্রায় দেউলে হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিরক্ষা করতেই হবে। কেউ যদি আক্রমণ না করে তাহলে প্রতিরক্ষার দরকার কেন বোঝা শক্ত।

আমরা কেউ পরমাণু বোমা ব্যবহার করব না, খালি তৈরি করে রেখে দেব। কিন্তু এখন থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রকের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। কারণ অন্য অস্ত্রসম্ভার যেমন তেমন বাড়তে থাকবে, একইভাবে পরমাণু বোমা তৈরির কাজও অনেক বেশি করতে হবে। পরমাণু বোমা জমাতে হবে। কত জমাব আমরা? আমরা কি কখনও আমেরিকা, রাশিয়া অথবা চীন— এদের ধারেকাছে যেতে পারব? সবাই জমিয়ে যাব, কিন্ত কেউ ফাটাব না, এইভাবেই পৃথিবীর মারণাস্ত্রের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একেই উন্নতি বলে বোধহয়।

‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘স্বদেশপ্রেম’ বলে দুটো কথা আছে। এই কথাগুলো শুনতে ভীষণ ভালো লাগে। বলা হয়, তোমার দেশ যদি বিপন্ন হয়, দেশের জন্য প্রাণ দাও। বারবার বলা হয়, তারপরও শুনতে বেশ ভালো লাগে। দেশের জন্য ‘জীবন নাও’ বললে ভালো লাগে না। তাই ‘জীবন দাও’ বলতে হয়। একথা আমার নাটকেও বলেছি। এটা খুব সহজ কথা। কিন্তু সহজ কথা এখন চলবে না। সারা দেশময় যখন পাগলামি তখন যে সহজ কথা বলবে সে-ই হল পাগল।

অথচ এ-দেশের গরিব লোক বারবার বলছে, আমাদের দুটি খেতে দাও। পোখরানের আশেপাশের লোকেরা ১৯৭৪ সাল থেকে বলছে—৩২ কিলোমিটার হাঁটতে হয় হাসপাতালে পৌঁছবার জন্য, আমাদের যে অসুখগুলো হচ্ছে তার চিকিৎসার জন্য একটা হাসপাতাল বানিয়ে দাও। ’৭৪ থেকে ’৯৮ হয়ে গেল, হাসপাতাল বানানো হয়নি। ২০৯৮ পেরিয়ে যাবে, তবু একটা হাসপাতাল বানানো যাবে না হয়তো।

যুদ্ধের একটা মনস্তত্ত্ব আছ। যুদ্ধ করছি, যুদ্ধ করে জিতছি, এইটা বলতে, ভাবতে বড় ভালো লাগে। হিন্দি সিনেমায় যত হিরো আছেন তাঁদের মধ্যে কুংফু জানেন না এমন বোধহয় কেউ নেই। একা লড়ে যাব এবং জিতব। মারপিট করে জেতা ব্যাপারটা মহিমান্বিত হয়ে আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে গেছে। তাই যুদ্ধের জিগিরে লোক চট করে ফেঁসে যায়। ছোটবেলা থেকেই জানি, যুদ্ধ মানেই গৌরব, যুদ্ধ মানেই বীরত্ব। নেপোলিয়ন আমাদের কাছে হিরো, আলেকজান্ডার ভীষণ হিরো। এই সব পড়ে বড় হয়েছি। একটা যুদ্ধ বাঁধলে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব করে লাফিয়ে পড়তে চাই। আমরা আবার গণতান্ত্রিক দেশ তো, গায়ের জোরে আমাদের দাবিয়ে রাখাটা মুশকিল। আমাদের ধাপ্পা দিয়ে দাবাতে হবে। কাজেই আমরা নিজেরাই যদি যুদ্ধের নাম শুনলে গৌরব ও বীরত্বের কথা ভাবি তাহলে সুবিধে হয়।

তবে পরমাণু বোমা একটা গুণগত পরিবর্তন এনেছে। এই যুদ্ধে কেউ জিততে পারবে না, এখানে হারজিৎ বলে কোনও কথা নেই। পরমাণু বোমার ব্যবহার মানে শুধু অন্যকে হারানো নয়, নিজেকেও হারানো। পরমাণু যুদ্ধে আমিই হচ্ছি আমার শত্রুপক্ষ। এটাই গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু ভালো করে ভেবে না দেখা, খবরের কাগজ না পড়া, বইপত্র না পড়া, এসব আমাদের এমন চরিত্রগত হয়ে গেছে যে যুদ্ধ বললেই আমরা নেচে উঠি। ভাবি আমরা জিতব, ওদের থেকে আমাদের অস্ত্র অনেক বেশি।

আমি অনেক নাটকে লিখেছি, পরমাণু বোমার ব্যবহার হলে হারজিতের ব্যাপার নেই। কেউ জেতে না। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বলে একটা ব্যাপার আছে। লাহোর, করাচিতে বোমা ফেললে দিল্লি, অমৃতসরও তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত হবে।

অনেকেই আমার নাটক নিয়ে নানা কথা জানতে চাইছে। আমি প্রথম ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম ১৯৫৭ সালে, চাকরিসূত্রে। দু’বছর ছিলাম। যুদ্ধ জিনিশটা যে কী সেটা তখনই খানিকটা মাথায় ঢুকে যায়। কোনও সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়িতে ভাইবোন ক’জন? বেশিরভাগই বলে, ‘তিন ভাই ছিলাম, এক ভাই যুদ্ধে মরেছে’; কি ‘এক ভাই পঙ্গু হয়েছে।’ অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বারো বছর পর আমার যুদ্ধে আহত সহকর্মী অফিসে আসছেন হুইলচেয়ারে চড়ে। মানে, ঘরে ঘরে যুদ্ধের ছায়া। এই অভিজ্ঞতাটা কিন্তু আমাদের নেই। পরমাণু বোমার ব্যাপারটাও ইউরোপে টের পাওয়া যায়। বোমা পড়তে পারে, এবং পড়লে সবাই মরবে, ওদের কাছে এই আশঙ্কটা অনেক বাস্তব। এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল। ১৯৬২ সালে লেখা আমার ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এও এ ই কিছু তথ্য ঢুকে গেছে। ওই যে কথাটা, যে চব্বিশ ঘণ্টা অ্যাটম বোমা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দু’পক্ষ— আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন— চব্বিশ ঘণ্টা এয়ারবোর্ন, এক ঝাঁক বোমারু বিমান নামার আগেই আরেক ঝাঁক উঠছে। তার মানে, ভুল করেও পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা ভয়াবহ মনে হয়েছিল আমার।

‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকটা লেখার একটা ইতিহাস আছে। এটা আমি লিখি ১৯৬৬ সালে নাইজেরিয়ায় বসে। একদিন হঠাৎ একটা বই পড়ি। ফরাসি সাংবাদিকের লেখার ইংরেজি অনুবাদ। বইটার নাম, Formula for Death, E=MC2। ভদ্রলোক প্রচুর গবেষণা করে জাপান আমেরিকা ঘুরে তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেছিলেন। যাঁরা বোমা ফেলেছিলেন, আমেরিকার সেই কর্নেল ফেরেবি, ইথার্লি, পল টিবেটস, চেশায়ার প্রমুখ, তাঁদের সবার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আবার বোমার যাঁরা ভুক্তভোগী, জাপানের সেইসব মানুষের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। বইটা আমায় ভীষণ নাড়া দেয়। মনে হয়েছিল বইটা বাংলায় অনুবাদ করা উচিত। অনুবাদ আমার আসে না। আমি যেটা জানি, সেটা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-তে নাটকের আকারে বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য অন্যান্য বই থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছি। ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকটার মূল কথা হল, আমাদেরও ভাববার দরকার আছে, কারণ পরমাণু মারণাস্ত্র মানুষই বানিয়েছে, বন্ধ করলে মানুষই করবে।

তেজস্ক্রিয় ভস্ম ও তার দীর্ঘকালীন ক্ষতিকারক প্রক্রিয়ার কথা আমি জানতে পারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিয়োজিত দুটি বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট থেকে। আমার এক বন্ধু কলকাতায় আমাকে তা পড়তে দেয়। তখনই জানি এই পৃথিবীকে তেজস্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত করতে সবচেয়ে কম সময় লাগবে চারশ বছর। আর বেশি ধরলে- চব্বিশ হাজার বছর। এসব কথা ‘ভোমা’-য় এসেছে। ‘ভোমা’-র যে দৃশ্যটা- আমি বিশ লাখের একজন—বিশ লাখ বিকলাঙ্গ শিশু জন্মেছে— একথা বার্টান্ড রাসেলের একটা বই থেকে পাই। তিনি তা বলেছিলেন ১৯৬২ সালে। তা ‘ভোমা’-তে ঢুকে গেছে।

যুদ্ধ এবং পরমাণু অস্ত্রের বিভীষিকা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই মাথায় ঘুরত। ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ পুরোপুরি অস্ত্রের ভয়াবহতা এবং উন্মত্ততা নিয়েই। এছাড়াও— ‘ভোমা’, ‘পরে কোন দিন’, ‘খাট মাট ক্লিং’, ‘বাঘ’, ‘চড়ুইভাতি’, ‘নদীতে ডুবিয়ে দাও’, ‘উদ্যোগপর্ব’, ‘বাকি ইতিহাস’— এই সব নাটকের প্রধান বিষয়বস্তু পরমাণু অস্ত্র।

পরমাণু বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন, সস্তা ও নিরাপদ— তিনটি কথাই যে ধাপ্পা, একেবারে মিথ্যে, শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের নামে,  বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পরমাণু শক্তির চর্চা কীভাবে পৃথিবীকে বিষাক্ত করছে, এ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক। সেই কারণেই ‘ক-চ-ট-ত-প’ (১৯৯৩) ছাড়া অন্য কোনও নাটকে বিশেষভাবে এ বিষয়টা ফুটে ওঠেনি। ভবিষ্যতেও হবে কিনা জানি না, কারণ অনেকটা বয়স হয়েছে। তাছাড়া নাটক লেখা বা না লেখা আমার নিজের হাতে কোনওদিনই ছিল না, আজও নেই।

তবে স্বাভাবিক কারণেই এবারের পরমাণু বিস্ফোরণে আনন্দে নৃত্য করতে পারলাম না, আমরা আমাদের সাধ্যমতো সেকথা বলব।


*বানান অপরিবর্তিত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...