শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
অর্থশাস্ত্রবিদ অভিজিৎ সেনের প্রয়াণ এই উপমহাদেশে অর্থশাস্ত্র চর্চা-গবেষণা ক্ষেত্রে গভীর বিষাদবহ। ডঃ অভিজিৎ সেন গড়ে উঠেছিলেন অর্থশাস্ত্রচর্চার পরিপার্শ্বে। বাবা সমরেন্দ্রনাথ সেন কৃষি অর্থশাস্ত্রবিদ হিসেবে ভারতের বাইরেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাঙ্কে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। অভিজিতের শ্বশুরমশাই ডঃ অরুণ ঘোষও অর্থশাস্ত্রবিদ এবং যোজনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) তিন দশক অধ্যাপনা ও গবেষণা-তদারকি (অর্থাৎ পিএইচডি সুপারভাইজার) করেছেন। তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে পিএইচডি, একথা জেনেছি অনেক পরে। আবার দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স এটা জেনে চমকিত হয়েছিলাম। দিল্লির অ্যাকাডেমিক মহলে তাঁর পরিচয় ছিল ইকনমিস্টস’ ইকনমিস্ট— সবাই না হলেও জেএনইউর অর্থশাস্ত্রের কৃতবিদ্য বেশ কয়েকজন ছাত্র এমনই বলতেন। জেএনইউ-এর সেন্টার ফর ইকনমিক পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিং (সিইএসপি)-এ তাঁর সহ-শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন অমিত ভাদুড়ি, প্রভাত পট্টনায়ক, উৎসা পট্টনায়ক, জয়তী ঘোষ (পরে অধ্যাপক সেনের সহধর্মিনী)। কিন্তু অমিত ভাদুড়ি ছাড়া অর্থশাস্ত্রে (রাষ্ট্রনৈতিক অর্থনীতির কথা বলছি না) গবেষণাক্ষেত্রে তাঁর মত মৌলিক অবদান আর কারও নেই। কেম্ব্রিজে তাঁর পিএইচডি থিসিস সকলের নজর কেড়েছিল। ভারতের কৃষিক্ষেত্রের কাঠামো ও তার পরিবর্তনে বাজারের ব্যর্থতা ও শ্রমশক্তির নিয়ন্ত্রণ নামে দুই-ভাগে সেই গবেষণাপত্র ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সে ব্যাখ্যায় তিনি শুধুমাত্র প্রাক-পুঁজিবাদী বা বাজার-সম্পর্ক দ্বারা ভারতীয় কৃষি সম্বন্ধে বাম এবং ডান উভয়ের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেননি, যখন জমির মালিকরা তাদের খামারে কাজ করা কৃষকদের শোষণ করত, তখন পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদের কাজের তত্ত্বাবধান করতেও সংগ্রাম করেছিল, প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিকীকরণ সহ উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা প্রকাশ করেছিল— এ ধারণা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছিলেন। সেই থিসিসে তিনি উপসংহারে বলেছিলেন:
But the main result of that section is nonetheless a cautionary one for Marxist analysis— the adverse effects of sharecropping etc. might have been historical in the sense that they have already, and perhaps irreversibly, affected the composition of rural society in a way detrimental to growth. The present problem of fragmentation and pauperization in many parts of India, although the outcome of a history of such arrangements, need not be resolved simply by getting rid of these arrangements. The more critical need in these regions today is perhaps for land consolidation and public investment.
ডঃ সেন ছিলেন খাদ্যশস্য গণবণ্টন ব্যবস্থার প্রবল সমর্থক। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষজনের জন্য জন প্রতি দু টাকা কিলোগ্রাম নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল/গম বণ্টনের সূত্রায়ন তাঁর। বলা বাহুল্য, এতে অর্থব্যবস্থা চাঙ্গা হয়, অন্তত গ্রামীণ ও মফসসল অঞ্চলে মানবশক্তি সহায়ক এই নীতি। বিলাসবহুল পণ্য চাহিদা বাড়ানোর জন্য ভর্তুকি মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়, কারণ এতে লালিত হয় যাকে আমরা বলি কন্সপিকিউয়াস কনজাম্পশন। তিনি সাফ সাফ বলতেন যে রাজকোষের উপর খাদ্য-ভর্তুকির বোঝা অতিরঞ্জিতভাবে দেখানো হয়। একটি সর্বজনীন খাদ্যশস্য বণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস)-র জন্য আর্থিক পরিসর আছে, যা কৃষকদের তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি ২০০০ সালে তাঁর বিখ্যাত C2 পদ্ধতি প্রণয়ন করেন, যা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গণনায় এক সম্পূর্ণ মৌলিক সুপারিশ, যা শুধুমাত্র কৃষকদের নগদ ব্যয়কেই বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করে না, তাতে পরিবার-শ্রম, রেন্ট ও সুদের অভিযুক্ত খরচও ধরা থাকে। ‘স্বামীনাথন রিপোর্ট’ (২০০৬) আসলে তারই পরিবর্তিত সংস্করণ, যা কৃষকদের একটি কেন্দ্রীয় দাবি হয়ে উঠেছিল। তাঁর সুপারিশ ছিল এই যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নির্ধারণের সময় পরিব্যয় (কস্ট) ছাড়াও অন্যান্য বিষয়গুলিকে বিবেচনা করতে হবে যাতে উৎপাদনকারী ও ভোক্তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। দীর্ঘমেয়াদি শস্যনীতির বিশেষজ্ঞদের উচ্চ-স্তরের একটি কমিটি তাঁর সভাপতিত্বে সক্রিয় ছিল, আমাদের দেশের সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস) তারই ফল।
রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা ডঃ সেনের মস্তিস্কপ্রসূত। যখন কৃষি পরিব্যয় ও মূল্য কমিশনের (সিএসিপি) চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন সেই দলিল তৈরি করেন। তিনি কৃষি ও গ্রামীণ অঞ্চলের নীতি ছাড়াও সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিষয়ে তাঁর সুপারিশ করেছিলেন, যা যোজনা কমিশনে প্রশংসিত হয়েছিল। ডঃ মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে অর্ত্থাৎ ইউপিএ সরকারের আমলে (২০০৪-২০১৪) তিনি যোজনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। একটা ধারণা আছে যে বামেদের (পড়ুন সিপিআইএম-এর) সুপারিশেই তিনি যোজনা কমিশনের সদস্য হন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও একইসঙ্গে একই প্রস্তাব এসেছিল। বামেরা ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিলেও তিনি কমিশনের সদস্যপদ ছাড়েননি। তিনি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সদস্য ছিলেন। সেই কমিশনের চেয়ারম্যান ওয়াই ভি রেড্ডি বলেছিলেন যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে অভিজিতের পরামর্শ খুবই প্রণিধানযোগ্য ও গ্রাহ্য হয়েছিল।
যোজনা কমিশনে যোগদানের কয়েক মাস পরে তিনি তাঁর ছাত্র হিমাংশুর সঙ্গে যৌথভাবে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে ভারতে দারিদ্র্য এবং অসাম্য শিরোনামের গবেষণাপত্রে অর্থনৈতিক সংস্কারের পর প্রথম দশকে দারিদ্র্যের তীব্র হ্রাসের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ও তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে সরকারি দারিদ্র্য নিরূপণে পার্থক্যের সমালোচনা করেছিলেন। পিডিএস বণ্টন-স্থানান্তরের (ট্রান্সফার) আকার এবং দারিদ্র্যের উপর এই স্থানান্তরের প্রভাব সম্পর্কে হিমাংশুর সঙ্গে আরেকটি গবেষণাপত্রও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০০৯-২০১০ সালে মোট দারিদ্র্যের অনুপাত (তেন্ডুলকার পদ্ধতি) ছিল ৩০.৬৮ শতাংশ। পিডিএস স্থানান্তর ছাড়া, একই বছরে দারিদ্র্যের অনুপাত ৩৩.৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ বেশি ছিল।
তাঁর প্রয়াণে হিমাংশু (জেএনইউতে তাঁর কেন্দ্রেরই অন্যতম শিক্ষক) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক অসাধারণ উত্তর-সম্পাদকীয় লিখেছেন। তাঁর চেয়েও কিছুটা ভাল লিখেছেন আরেক ছাত্র রোশন কিশোর হিন্দুস্থান টাইমসে। রোশন ঐ দৈনিকে পরিসংখ্যান ও রাষ্ট্রনৈতিক অর্থনীতির বিভাগীয় সম্পাদক। রোশন যথার্থই লিখেছেন, অর্থশাস্ত্রক্ষেত্রে অভিজিৎ সেনের উত্তরাধিকার অনন্য, কারণ তিনি ভিন্নমতকে যথাযথ সম্মান দিতেন। অর্থনীতি এবং নীতিনির্ধারণে তাঁর ধারণাগুলি সর্বদা রাজনৈতিক শুদ্ধতার মতবাদ বা ধারণার পরিবর্তে সত্যতা-অবহিত ছিল। স্বভাবতই বাম এবং ডান উভয়ের ভুল ধারণা হিসাবে যা দেখেছিলেন তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণে তিনি এতই নিপুণভাবে দক্ষ ছিলেন যে কোনও পক্ষই তাঁকে ফেলতে পারত না। অভিজিৎ সেনের অর্থনৈতিক যুক্তিজাল যেন তুলনারহিত ছিল।
তাঁর নেতৃত্বে রচিত ‘দ্য রিপোর্ট অফ দি এক্সপার্ট কমিটি অন দি ইম্প্যাক্ট অফ ফিউচার্স ট্রেডিং অন এগ্রিকালচারাল কমোডিটি প্রাইসেস’ (২০০৮) বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যবৃদ্ধির প্রকৃতি ও প্রবণতা অনুধাবনে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক দলিল, যদিও তথ্যপ্রমাণের অভাবে রিপোর্টটি অসম্পূর্ণ। কারণ কৃষিমূল্যের ওপর ফিউচার ট্রেডিং-এর তথ্য ছিল না। যা ছিল তা এতই অপ্রতুল যে অনুমান বিশ্বাসযোগ্য হওয়া প্রত্যাশিত নয়। অবশ্য রিপোর্টে তিনি একটি সংযোজনী নোট দিয়েছিলেন, যা শিক্ষকদের অবশ্যপাঠ্য। রোশন কিশোরের মতে—
…a must-read for anyone who wants to apply textbook economic wisdom to solving real-world problems in a third-world country.
কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি, দারিদ্র্য, বৈষম্য, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনীতি, গবেষণা এবং নীতি প্রনয়ণে তাঁর অবদান অল্প কথায় প্রকাশ করা কঠিন।
জেএনইউ ছাড়াও তিনি অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছেন ও যথারীতি অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জনকল্যাণের জন্য ২০১০ সালে পদ্মভূষণে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণে এক মেধাবী ও মানবকল্যাণকামী চিন্তককে আমরা হারালাম।