Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সপ্তপর্ণী

সপ্তপর্ণী | রুমেলা সাহা

রুমেলা সাহা

 

হেমন্তের ধূসর বিবর্ণ, মনমরা প্রকৃতির সঙ্গে নিজের বেশ মিল পায় সপ্তপর্ণ। রাস্তায় ছড়িয়ে পরা পাতারা, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সবুজের বিলুপ্ত প্রভায় যেমন বিষণ্ণ বোধ করে, সপ্তপর্ণও তেমন মায়া বোধ করে তাঁদের দেখে। পাশের বিশাল নিমগাছ থেকে অনবরত পাতা ঝরেই চলেছে। শেষ পাতা ঝরা না পর্যন্ত এমনই চলবে। কঙ্কাল-সদৃশ গাছের নিচে স্তূপাকার ঝরা পাতা। মাঝে মাঝে যখন শুকনো হাওয়া বয়, সেই স্তূপে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কিছু পাতা এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ে নিজের ভবিতব্যকে অস্বীকার করতে চায় যেন। মুচকি হাসে সপ্তপর্ণ, এভাবে কি ভবিতব্যকে অস্বীকার করা যায়…!

সপ্তপর্ণর বই-খাতার দোকানটা পাড়ার একেবারে পিছনদিকে। বেশিরভাগ বাড়িগুলোরই পিছন দিক এটা। কলকাতাকে চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করায় এসব জায়গাগুলোও এখন কলকাতার অন্তর্গত। তবে নামেই, প্রান্তিক মফস্বলের চরিত্র এখনও একই আছে।

দোকানের দুপাশে বড় বড় বাড়ি রয়েছে। জীর্ণ, ক্ষয়াটে সে বাড়িগুলোর দেওয়াল জুড়ে ভাঙনের আঁকিবুঁকি। ক্ষয়ের মধ্যেও সৃষ্টি থাকে। প্রকৃতি এমনভাবেই ভারসাম্য রক্ষা করে। সেই ভাঙা দেওয়াল থেকে ইতস্তত চারাগাছ শৈশবের প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে। অশ্বত্থ, পাথরকুচি, বট, ফার্ন আরও কত গাছ। সবার নাম জানে না সপ্তপর্ণ।‌ তবে পরিচয় আছে সকলের সঙ্গেই। এরাই যে তার সঙ্গী। পাইপভাঙা নর্দমার জল থেকে, রুক্ষ ইটের ফাটল থেকে অবলীলায় বাঁচার রসদ খুঁজে নেয় এরা। একটা নিমগাছ অভিভাবকের মতো এই চারাগুলোকে ছায়া দেয়, প্রখর রোদ থেকে বাঁচায়। শুধু চারাগাছগুলো নয়, এ গাছে বাসা বাঁধে পাখিরা, পিঁপড়েরা। সপ্তপর্ণ দেখে পিঁপড়েদের দৈনন্দিন জীবন। সারিবদ্ধভাবে চলা পিঁপড়েদের যৌথ যাপন বড্ড ভাল লাগে তার।

গলির এই জায়গাটা বড় প্রিয় সপ্তপর্ণর। বিকেলের অস্তরাগ এখানে প্রবেশের পথ পায় না। তবে বিভা ছড়ায়। সেই রহস্যময় না-আলো না-অন্ধকারে, কানাগলির শেষাংশে, সময় থমকে দাঁড়ায়। কিছু যেন ভাবে! তারপর অন্ধকারের টুপির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুটা দূরে একটা লাইটপোস্ট আছে। এ গলির একমাত্র আলোকস্তম্ভ। যত রাত বাড়ে তত সেই হলদেটে মরা আলো সারা পাড়ার ওপর কী যেন এক স্মৃতিমেদুরতার আবেশ ছড়িয়ে দেয়। কুয়াশা পড়ে। কোনও স্বচ্ছবসনা ঘুমপরী তার আঁচলের প্রান্ত বুলিয়ে দেয় নিঝুম এই গলির ওপর।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সপ্তপর্ণ শোনে কুয়াশা পড়ার শব্দ। তার বাড়ির উঠোনে মস্ত একটা ছাতিমগাছ আছে। হেমন্ত জুড়ে ফুল ফোটে তাতে। সারা রাত ধরে সেই ফুলের মাতাল গন্ধ জমাট বাঁধে সপ্তপর্ণর খাটের চারপাশে। তার বুকের ওপর চেপে বসে সেই গন্ধ। সপ্তপর্ণ হাঁসফাঁস করে এই দমবন্ধ করা গন্ধে। পালাতে চায় এই গন্ধ থেকে। কিন্তু কোথায় যাবে… সারাটা বছর সে অপেক্ষা করে থাকে সপ্তপর্ণী বা ছাতিমফুলের জন্য। এই গন্ধের জন্য। বিকেলের সূর্যাস্তের জন্য, সকালের মিষ্টি রোদের প্রথম ঝিলিকের জন্য, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধের জন্য… আরও কত কিছুর জন্য যে তাঁর অপেক্ষা সেটা সে নিজেই জানে না। শুধু জানে অপেক্ষা করতে হয়। চলে যাওয়া সময় আর আগত সময়ের মধ্যে যে সূক্ষ্ম চিড় আছে সেখানে অপেক্ষাই একমাত্র বাহন। যে সময়কে বহন করে।

বাহান্নটা বসন্ত এভাবেই কেটে গেল সপ্তপর্ণর। একইরকম, বৈচিত্র্যহীন নিস্তরঙ্গ জীবন। পিতলের কলসিতে সময়ের শ্যাওলা জমে যেমন সবজে রং ধরে, তেমনই তার মনেও সবুজের ছাপ পড়েছে। তার ভাঙাচোরা মুখে, কালের আলপনা আঁকা বলিরেখার আনাচেকানাচে কিছু গুঁড়ো গুঁড়ো বিষণ্ণতা জমে থাকে। তার নিষ্পৃহ চোখের তারায় জীবন ঘুমিয়ে থাকে। অযত্ন লালিত দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে যখন সে কথা বলে, হয়তো ক্রেতার  প্রশ্নের উত্তরে কোনও জিনিসের দাম বলছে, তখন তার কথাগুলো শ্রোতার কান পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই বাতাসে মিশে যায়। খুব খেয়াল করে শুনলে বোঝা যায় সে কী বলছে।

অথচ সপ্তপর্ণ কিন্তু খুব কথা বলে। তার প্রত্যেকটা কাজের পেছনে যুক্তি থাকে। বিনা কারণে সে কিছু করে না। তবে তার এই কথা, তীব্র যুক্তি, বাদানুবাদ এগুলো আর কেউ শুনতে পায় না। সে নিজের সঙ্গে কথা বলে। মনে মনে। অনবরত।

এই ন্যাড়া নিমগাছ, বিবর্ণ ফাটলওয়ালা বাড়ির দেওয়াল, ঝুলে ভরা জানালা, দোকানের বই-খাতা, সবই সপ্তপর্ণর কথা বলার সঙ্গী। কত আলাপচারিতা, কত বাকবিতণ্ডা। সাধারণ লোকেরা এসব বোঝে না। তারা ভাবে, মানুষটা খুব একা। কিন্তু এই একাকিত্বেরও যে একটা নেশা আছে, সেটা সবার বোঝার বিষয় নয়। কেউ কেউ এই নেশাতেই বিভোর হয়ে থাকে। তার জীবনে মা ছাড়া আর কোনও নারী নেই। ছিল না কোনওদিন। এমনকি এই না-থাকার অভাববোধও কখনও হয়নি তার।

সপ্তপর্ণ ছোটবেলা থেকেই মুখচোরা, লাজুক। সমবয়সিদের সঙ্গেও তার তেমন মেলামেশা ছিল না কোনওদিন। বন্ধুরা সপ্তপর্ণকে বলত, বোকা। বয়স্করা বলত সরল সোজা। কেউ কেউ আড়ালে বলত পাগল মায়ের পাগল ছেলে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পরে সে মানিয়ে নিয়েছে। তার জগৎ অন্যদের জগৎ থেকে আলাদা।

বাবাকে মনে পড়ে না সপ্তপর্ণর। কিছু বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ এবং সেখানে থাকা একটি মানুষকে সে নিজের বাবা বলে জেনে এসেছে। বাবা সেনাবাহিনিতে কাজ করতেন। সেখানকার পেনশনটুকুই ছিল মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের অন্যতম রোজগার। যখন সে কৈশোরে তখন থেকেই আস্তে আস্তে মায়ের মানসিক অসুস্থতা শুরু হল। বরাবরই মায়ে-পোয়ে সংসার। কিন্তু মায়ের মানসিক অসুস্থতার পর থেকে তারা আরও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ এই পর্যায়টুকুর মধ্যে তার মা পুরোপুরি পাগল হয়ে গেল। মা সারাদিন বিড়বিড় করে কী সব বলত। সেসব কথার বিন্দুবিসর্গ কেউ বুঝতে পারত না। গায়ে একদম পোশাক রাখত না। নিজের মূত্র, বিষ্ঠা জানালা থেকে রাস্তার পথচারীদের গায়ের দিকে ছুড়ে মারত। মাকে সামলাতে সামলাতে কলেজটাই শেষ হল না সপ্তপর্ণ। সে ছোট থাকতেই তাদের বাড়ির একটা কোণে এই ছোট্ট খাতাবইয়ের দোকানটা মা শুরু করেছিল। সারাদিন মাকে আগলে বিকেল থেকে এই দোকানেই বসা শুরু করল সে। পরের দিকে মা আর কিছুই মনে রাখতে পারত না। এমনকি সপ্তপর্ণ যে তার ছেলে সেটাও একদম ভুলে গেছিল। তার সঙ্গে তার বাবার চেহারার নাকি খুব মিল। এই কথাটা পাড়ার অনেকেই তাকে বলেছিল। আর সেখানেই হত সবচেয়ে বড় ভুল। মা তাকে তার বাবা মনে করত। অনেকদিন রাত্রেই, সপ্তপর্ণ ঘুম ভেঙে দেখত, তার মা তাকে আলিঙ্গন করে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু সেই আলিঙ্গনে মাতৃস্নেহ থাকত না। বিছানা থেকে ছিটকে উঠে পড়ত সে। মাকে ঘরে তালাচাবি দিয়ে আটকে রাখতে হত। যৌবনের প্রারম্ভেই এমন বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হওয়ার জন্যই হয়তো নারীজাতির প্রতি একটা অদ্ভুত নিস্পৃহতা তৈরি হয়েছিল তার। মা যখন মারা যায় তখন তার বয়স মধ্য-তিরিশ।

মায়ের অসুস্থতার জন্য তাকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। পরের দিন যখন সপ্তপর্ণ মাকে হাসপাতালে দেখতে যায় তখন শোনে, তার মাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। সেই ঘরে গিয়ে সপ্তপর্ণ এক নতুন দৃশ্য দেখে। মায়ের মতো সেখানে অনেক রুগি জীবন্মৃত অবস্থায় এক একটা বেডে শুয়ে আছে। বা শুইয়ে রাখা হয়েছে। অসংখ্য মেশিনের সঙ্গে সংযুক্ত এক-একটা শরীর। সপ্তপর্ণের মনে হল এই কৃত্রিম জীবনদায়ী যন্ত্রগুলো আসলে মৃত্যুকে প্রলম্বিত করছে। জীবন যখন শুরু হয় তখন তাতে অনেক আশা, অনেক সৌন্দর্য, অনেক শুভকামনা, এবং এক ঐশ্বরিক জীবনীশক্তি থাকে। কাজেই শুরুর মতো শেষটাও শ্রদ্ধার সঙ্গে, বিনয়ের সঙ্গে, সুন্দরভাবেই হওয়া উচিত। যাঁরা এভাবে মৃতবৎ শুয়ে আছেন তাঁরা কি অনুমতি দিয়েছেন তাঁদের পার্থিব দেহটাকে এইভাবে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখতে? জীবিত থাকা মানে যেখানে জীবনীশক্তি আছে। একটা বয়সের পর এভাবে জোর করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ না-হতে দিয়ে জীবিত থাকা, ভাবতে কষ্ট হল তাঁর।

সপ্তপর্ণ হাসপাতালের এই ঘরটাতে অনেকগুলো কৃত্রিম হৃৎস্পন্দনের মাঝে কোথাও কোনও জীবনীশক্তি খুঁজে পেল না।

খুব শান্তভাবে ডাক্তারদের জানাল সে চায় না তার মায়ের মৃত্যুকে আরও প্রলম্বিত করা হোক। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেকভাবে সপ্তপর্ণকে বোঝানোর চেষ্টা করল। এমনকি এটাও বলা হল যে সে ছেলে হয়ে তার মাকে খুন করতে চাইছে লাইফ সাপোর্টে না রেখে। সপ্তপর্ণ অনঢ়। শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাল, হাসপাতাল চাইলে তার মাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতেই পারে কিন্তু সে কোনওরকমভাবেই আর‌ কোনও টাকা দেবে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর কোনও তর্কে গেল না। ভেন্টিলেশন থেকে বের করার চার-পাঁচ ঘন্টার মধ্যে তার মাকে মৃত বলে হাসপাতালসূত্রে জানানো হল।

মায়ের মৃতদেহ সৎকার করে বাড়ি ফিরে সপ্তপর্ণর একই সঙ্গে দুরকম উপলব্ধি হল। প্রথমে মনে হল এবার সে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল। তারপর মনে হল আহ কী শান্তি। এই শান্তির উপলব্ধিটার জন্য তার আত্মগ্লানি হলেও হতে পারত। অন্য কেউ হলে হয়তো হত বা। কিন্তু কৈশোর থেকে মা নামক মানুষটির যে রূপ সে দেখেছে, তারপর আর আত্মগ্লানি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।

সপ্তপর্ণর কিন্তু তেমন কোনও বিষাদ নেই। সে যেন পদ্মপাতা, সারা জীবন জলে ভেসে থাকলেও কখনও জল তাকে ভেজাতে পারল না। সে তার নিজের জগতে বেশ আছে। জীবনের কাছে প্রতিটা মানুষের অনেক দাবি, অনেক চাহিদা থাকে। সেগুলো পূরণ না হলে, মনমতো না হলে দুঃখ, কষ্ট, বিষণ্ণতা এসব আসে। সপ্তপর্ণর সেই চাহিদা, সেই দাবি অনেক কম। কোনও কিছু মনমতো না হলে সে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যায়। অভিযোগ বা না-পাওয়ার বেদনা তাকে আর সবার মতো পেড়ে ফেলে না। সে হাসে না বটে, কিন্তু রাগও যে করে না। লোকে প্রথমটা দেখে আর দ্বিতীয়টা দেখতে চায় না বলে দেখে না। সে অন্যদের কাছে এত বেশি একঘেয়ে আর বিরক্তিকর যে সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। তাই উপাধি একটা জুটেই যায়— ও তো পাগল।

দোকান প্রায়ই ফাঁকা থাকে। তার ছোট্ট বই-খাতার দোকানে তেমন ভিড় কখনওই হয় না। এই ভাল, বরঞ্চ বেশি ভিড় হলেই সপ্তপর্ণর অস্বস্তি হয়। একা থাকতে থাকতে মানুষের সঙ্গ আর ভাল লাগে না। সপ্তপর্ণ নিজের সঙ্গে কথা বলে, বিরামহীন।

—তুমি যা করছ সেটা আত্মহত্যা। আত্মহত্যা করা মহা পাপ।
—এটা আত্মহত্যা নয়। আমি যেচে এই রোগ বাধাইনি। আর এই রোগ এখন শেষ পর্যায় ধরা পড়েছে।
—তাতে কী, ডাক্তার তো বলেছে অপারেশন করলে ভাল হয়ে যাবে।
—ভাল হব বলেনি। বলেছে বেঁচে গেলেও যেতে পারি।
—হ্যাঁ, বিনা চিকিৎসায় মরার চেয়ে তো চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া ভাল তাই না?
—আমার যা বয়স তাতে চলে গেলে আফসোস করা যায় না।

তর্কাতর্কি চলতে থাকে।

গত কয়েকমাস ধরে সপ্তপর্ণর মাথায় একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। প্রথমে আমল না দিলেও পরে সেটা তীব্র হতে থাকে। ধরা পড়ে ব্রেন টিউমার। ডাক্তার বলে— ইমেডিয়েট অপারেশন করাতে হবে, নয়তো এটা ফেটে আপনি… বেশি সময় নেই হাতে।

অপারেশন সহ সমস্ত খরচের হিসেব করে সপ্তপর্ণ ঠিক করল সে অপারেশন করাবে না। এর পেছনে অবশ্য যুক্তি আছে। যদি অপারেশন সফল না হয় তবে অনেক ঝক্কি। দেখা গেল, বাড়ি দোকান বিক্রি করে অপারেশন হল, সুস্থও হল, কিন্তু তার পর…! থাকবে কোথায়? খাবে কী? এই বয়সে নতুন করে ঠাঁইনারা হতে মন সায় দেয় না। কাজেই এভাবেই যতদিন চলে চলুক। মরতে তো হবেই, ঠেকিয়ে লাভ কী। আর ভবিতব্যকে কি ঠেকানো সম্ভব!

সপ্তপর্ণ ঠিক করল যাওয়ার আগে সে সব গুছিয়ে যাবে। ভাগ্যের প্রতি তার কোনও অসন্তোষ নেই। বরঞ্চ সে সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন যে, নিজের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ ও সময় জানতে পেরেছে। জীবন যে শেষবেলায় তাকে এই সুযোগটুকু দিল তার জন্য কৃতজ্ঞ সপ্তপর্ণ।

স্থানীয় স্কুলকর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে নিজের বাড়ি আর দোকানটা স্কুলের নামে দান করার ইচ্ছে প্রকাশ করল সে। ঠিক হল আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আইনত ব্যবস্থা করবে স্কুল।

সপ্তপর্ণের একমাত্র ইচ্ছে, পারলৌকিক ক্রিয়াটা যেন ভালভাবে হয়। সে বিশ্বাস করে, চিরন্তন স্বর্গ বা অনন্ত নরক বলে কিছু হয় না। কর্মফল ভোগ করার পর আবার প্রত্যেককে এখানেই ফিরতে হয়। মোক্ষ প্রাপ্ত না হলে এই বন্ধন থেকে নিস্তার নেই। কাজেই পারত্রিক ক্রিয়া যত সুষ্ঠভাবে হয় ততই মঙ্গল। মায়ের পারত্রিক ক্রিয়ার জীর্ণ ফর্দ মিলিয়ে যতটা সম্ভব নিজের শ্রাদ্ধের জন্য জিনিস কিনল। এর আগে কোনওদিন নিজের জন্য এত খরচ করেনি সে। সব সামগ্রী আর আগাম টাকাও পুরোহিতকে দিয়ে রাখল। পুরোহিত অবাক দৃষ্টিতে তাকালে সপ্তপর্ণ আমতা আমতা করে বলল, আমার খুব কাছের এক বন্ধু মৃত্যুপথযাত্রী। সেই সময় আমি হয়তো খুব ব্যস্ত থাকব, তাই আগাম এই সামগ্রী আর টাকা দিয়ে গেলাম। সময়মতো আপনি খবর পাবেন।

পুরোহিতও জানে এই লোকটা পাগল। তার ওপর হাতের টাকার পরিমাণটা অনেক বেশি হওয়াতে সেও আর কিছু বলল না।

নিজেকে কি নিজের বন্ধু বলা যায়! সেটা জানে না সপ্তপর্ণ। তার এই এত বছরের জীবনে কোনও বন্ধু নেই। যদি কোনও বন্ধু থাকত তবে কি সে এভাবে তাকে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে দিত? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস যতিচিহ্নের মতো বেরিয়ে আসে। তাহলে সে তার বন্ধু নয়। আমরা নিজেরা নিজেদের কী হই? বন্ধু না শত্রু? হয়তো সময়বিশেষে জায়গাগুলো বদলে যায়।

ইদানীং মাথাব্যথাটা প্রবল হচ্ছে। পরম মমতায় সপ্তপর্ণ সেটা সহ্য করে। বিশ্বাস করে এই যন্ত্রণার শেষেই তার মুক্তি। অবশেষে সব কাজ সারা হলে সপ্তপর্ণ নিশ্চিন্ত হল। আর তখনই দেওয়ালে টাঙানো মা-বাবার বিবর্ণপ্রায় ছবিটা দেখে চমকে উঠল। তাই তো, শ্রাদ্ধে তো ছবি লাগবে। তার তো কোনও ছবি নেই।

পরেরদিন সকালে পাড়ার স্টুডিওতে গেল সপ্তপর্ণ। স্টুডিওর ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল— সপ্তজেঠু তুমি এখানে?

লজ্জিত সপ্তপর্ণ আমতা আমতা করে বলল— ছবি তুলব।

একটি অল্পবয়সি মেয়ে তার পোশাক আর চুল ঠিক করে দিল। মেয়েটার গায়ে একটা মিষ্টি গন্ধ। সপ্তপর্ণ কাঠ হয়ে বসে রইল ক্যামেরার সামনে। পরেরদিন বিকেলে ছবি ডেলিভারি দেওয়া হবে।

সপ্তপর্ণ চলে গেলে স্টুডিওর ছেলেটা মেয়েটাকে বলল— এর আগে কখনও সপ্তজেঠু স্টুডিওতে আসেনি। এটা ব্রেকিং নিউজ।

মেয়েটা হেসে বলল, দেখো এই বয়সে হয়তো বিয়ের শখ জেগেছে, তাই ছবির দরকার।

—ঠিক বলেছ, তবে এত বড় সাইজ চাইল কেন?
—তোমাদের হবুজেঠিমা হয়তো চোখে কম দেখে, তাই বড় ছবি দিতে হবে।

দুজনেই হাসল, তারপর ছেলেটা বলল, তাহলে ফটোশপে ছবিটা নিয়ে অনেক খাটতে হবে, হাজার হলেও জেঠুর বিয়ের ছবি।

পরেরদিন সকাল থেকেই খুব শরীর খারাপ সপ্তপর্ণর। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না। মাথার ভেতরে খুব যন্ত্রণা, বমি হল কয়েকবার। সন্ধ্যায় অনেক কষ্টে স্টুডিওতে গেল। খামটা হাতে দিয়ে ছেলেটা হেসে জিজ্ঞেস করল— কোনও নতুন খবর আছে নাকি সপ্তজেঠু?

সপ্তপর্ণ কোনও উত্তর না দিয়ে টাকা মিটিয়ে বাড়ি চলে এল। ছেলেটা বিড়বিড় করল— শালা এজন্যই কারও ভাল করতে নেই। ভীমরতি ধরেছে বুড়োর।

কোনওরকমে বাড়ি ফিরল সপ্তপর্ণ। যন্ত্রণায় সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে প্রতিটা রোমকূপ। কম্পিত হাতে খাম থেকে ছবিটা বের করে চোখের সামনে ধরল সে।

ছিটকে গেল যেন। …এ কে…!!!

ছবির মানুষটি তো সপ্তপর্ণ নয়। কালো চুল, এই সাদা মুখ। এটা কে?

অচেনা কারও ছবি এটা। যন্ত্রণায়, হতাশায় হাতের ছবিটাকে ছুড়ে ফেলে দিল সপ্তপর্ণ। তারপরই ভারসাম্য না রাখতে পেরে আলমারির কাঠের পাল্লার ওপর আছড়ে পড়ল। কাচ বসানো পুরনো কাঠের আলমারি। চুর চুর হয়ে কাচগুলো সারা ঘরময় ছড়াল। সপ্তপর্ণ দেখল, সেই প্রতিটা কাচের টুকরোয় এক একটা সপ্তপর্ণ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। অবিকল সে। খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত অখণ্ড সত্তা। সম্পূর্ণ আমি।‌ চারিদিক স্তব্ধ, কোথাও কোনও শব্দ নেই। সপ্তপর্ণ যেদিকে চোখ ফেরায় শুধু নিজেকেই দেখে। আজ আর সে একা নয়। অগুনতি আমির ভিড়ে আজ সত্যি সে একা নয়। সপ্তপর্ণর চারিদিক অন্ধকার করে এল। সেই নিবিড় অন্ধকারে, সেই শব্দহীনতায় সে এক বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করল। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিতে এমনই কোনও মহাজাগতিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যা ব্যাখাতীত, অলোকসামান্য, ঐশীময়… আঃ কী শান্তি।

পাড়ার লোকেরা দুদিন পরে পচা গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দিলে। ময়নাতদন্তের পর পাড়া থেকেই দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা হল। সপ্তপর্ণের কোনও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ না পাওয়ায় পারলৌকিক ক্রিয়া করা হল না। সময়মতো সেই পুরোহিত সব কিছু চেপে গেল এবং এলাকার ‘দাদা’ বাড়ি দখল করল। স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারল না কারণ লিখিত কিছু ছিল না। বাড়ি-দোকান সঙ্গে সপ্তপর্ণী গাছটাও কেটে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হল। কিছুদিন পর সেই ভূলুণ্ঠিত স্তূপ থেকে খুব সন্তর্পণে আর একটা সপ্তপর্ণীর চারা, সবুজ কচি মাথা তুলে অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীকে দেখতে শুরু করল।