Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হিংসা আর অবিশ্বাসের চূড়ায় মণিপুর

মনিরুল হক

 


মনে রাখতে হবে আরএসএস দেশের সর্বত্র একই কায়দায় কাজ করে না। মণিপুরে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তাদের অবলম্বন মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকার হিন্দু সংস্কৃতি ও সেই এলাকার মানুষের জাত্যাভিমান। উপত্যকার কাংলেইপাক রাজাদের রাজত্বের ইতিহাস, তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, তাঁদের যুদ্ধদক্ষতা ও রাজ্যবিস্তারের গর্বকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হচ্ছে আরএসএস-এর সৌধ। আর এ কাজে তাদের কুশীলব ইম্ফল উপত্যকার মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষ!

 

মণিপুরে প্রত্যক্ষ হিংসা শুরু হয়েছিল ৩ মে। প্রায় দু-মাস হতে চলল সে হিংসা তো কমেইনি বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। হিংসা, মানুষ খুন, সম্পত্তি ধ্বংসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মানুষে-মানুষে অবিশ্বাস। সম্ভবত এই মুহুর্তে ইম্ফল উপত্যকায় আর কোনও ‘কুকি’ মানুষ নেই এবং পাহাড়ি ‘কুকি’ এলাকায় কোনও ‘মৈতেই’ মানুষ নেই। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী, মণিপুর কন্যা শ্রীমতি বীনালক্ষী নেপ্রাম বলেছিলেন- ‘Hills cannot live without the Valley and the Valley cannot live without the Hills’. আজ দু-মাস হতে চলল, সেই Hill এবং Valley-র মধ্যে কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। অবিশ্বাসের বাতাবরণ চূড়ান্ত। মজা দেখছে সরকার।

 

হিংসায় উন্মত্ত মৈতেই মহিলাদের বৃহদংশ

আমরা জানি, যে কোনও সংঘর্ষ বা যুদ্ধে সম্পদহানি হয়। সে সম্পদ কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী অথবা সরকার বা দেশেরও হতে পারে। আবার সংঘর্ষ বা অরাজকতায় প্রাণহাণিও হয় অসংখ্য। শিশু, যুবক, বয়স্ক, বৃদ্ধ এভাবেও সেইসব সংঘর্ষ-কবলিত মানুষকে ভাগ করা যায়। আবার এই ক্ষতি যুযুধান দুই পক্ষেরও কারও বেশি বা কম হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে আমরা বুঝব, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মহিলারা। তাদের সে অসহায়তা, সে মৃত্যু, সে ক্ষতি হয় বহুমুখী। মহিলারা নিজেরা এটা ভালভাবেই জানেন। তাই মণিপুরের ক্ষেত্রেও দেখেছি, সংঘর্ষের প্রথম দিনগুলিতে মৈতেই মহিলারা কুকি মানুষদের জীবন বাঁচাচ্ছেন, রাস্তায় নেমে দাঙ্গাবাজদের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন আবার অন্যদিকে কুকি মহিলারা মায়ের স্নেহে মৈতেই মানুষকে আগলে রাখছেন, খাওয়া-পরা দিচ্ছেন, নিরাপদ জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সংঘর্ষ-খুন-অবিশ্বাস বাড়ছে আর আমাদের বিস্ময় বাড়িয়ে আগের সেই মহিলারাই দাঙ্গাবাজদের সমর্থক হয়ে উঠছেন, তাদের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠছেন, দাঙ্গায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে বিজেপির চালিকাশক্তি আরএসএস এবং তার কুৎসিত মণিপুরি সংস্করণ Meitei Lipun, Kanglei Yaol Kanba Lup এবং Arambai Tenggol-এর উগ্র উন্মত্ত প্রচার ও সংঘর্ষে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের জন্য মহিলাদেরও প্ররোচিত করার জন্য। আমি তিনটে ঘটনার উল্লেখ করছি যা থেকে বোঝা যাবে মহিলাদের কীভাবে সংঘর্ষ এবং খুনের পক্ষ অবলম্বন করছেন!

১) মণিপুর সংঘর্ষের শুরুতেই পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে হাজার হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও লক্ষ লক্ষ গুলি-বারুদ লুট করে মৈতেই উগ্রপন্থীরা। পরে সেই ঘটনার তদন্ত করতে গেলে সিবিআই অফিসারদের ঘিরে ফেলে মহিলারা এবং তাঁরা ফিরে আসতে বাধ্য হন।

২) গত ২৪ জুন ইস্ট মণিপুর জেলার ইথাম গ্রামে সংঘর্ষ, সাধারণ মানুষ খুন, সেনাবাহিনীর জওয়ান খুন প্রভৃতি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ১২ জন Kanglei Yaol Kanba Lup জঙ্গিকে অস্ত্রশস্ত্র-সহ আটক করে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। খবর পেয়ে হাজার হাজার মহিলা ঘটনাস্থলে এসে জওয়ানদের ঘিরে ফেলে জঙ্গিদের ছেড়ে দিতে বাধ্য করে।

৩) দুজন মৈতেই মহিলাকে কুকিদের চর সন্দেহ করে মৈতেই জঙ্গিদের হাতে আটক করতে মৈতেই মহিলারাই এগিয়ে আসে। মৈতেই মন্ত্রী সুশীন্দ্রবাবু সেই দুই মহিলাকে উদ্ধার করলে তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর মন্ত্রকের অধীনে থাকা শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তিও পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এই অপকর্মেও মৈতেই মহিলারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

এর আগে বিভিন্ন ঘটনায় মণিপুরি মহিলাদের আমরা যে সব ভূমিকায় দেখেছি সে সব ছিল সদর্থক, ইতিবাচক এবং মানবতার পক্ষে যুগান্তকারী। আর আজ, মণিপুরি মহিলাদের দিক থেকে যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে তা যথার্থই এক ‘উলট পুরাণ’।

 

মণিপুরে আরএসএস-এর কৌশল

মনে রাখতে হবে আরএসএস দেশের সর্বত্র একই কায়দায় কাজ করে না। মণিপুরে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তাদের অবলম্বন মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকার হিন্দু সংস্কৃতি ও সেই এলাকার মানুষের জাত্যাভিমান। উপত্যকার কাংলেইপাক রাজাদের রাজত্বের ইতিহাস, তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, তাঁদের যুদ্ধদক্ষতা ও রাজ্যবিস্তারের গর্বকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হচ্ছে আরএসএস-এর সৌধ। আর এ কাজে তাদের কুশীলব ইম্ফল উপত্যকার মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষ!  মৈতেইরা এখানে প্রতিষ্ঠিত, সবচেয়ে মান্য। সুযোগ-সুবিধা বলতে যা বোঝায়, তা মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি ভোগ করেন। ভারতীয় সমাজে ‘উচ্চ ঘর’, ‘উচ্চ সম্প্রদায়’ -এর মানুষরা নিজেদের ‘সর্বস্তরে উচ্চ’ বলেই মনে করেন। মৈতেইরা সেই ‘উচ্চ’ মানুষ। অনেক হিসেব নিকেশ করে আরএসএস দেখেছে, জনসংখ্যা অনুযায়ী মৈতেইদের এলাকায় জমি কম আর অ-মৈতেইদের এলাকায় জমি বেশি। এই জনসংখ্যা-জমির অনুপাতকেই আরএসএস ‘হাতিয়ার’ বানিয়েছে। ভাবখানা এমন, বাসস্থান তৈরি এবং অন্যান্য প্রয়োজনে জমির হাহাকার পড়ে গেছে। যেন সমতল ইম্ফলের মানুষজন পাহাড়-জঙ্গলে বিশেষত কুকি এলাকায় বাস করার, ব্যবসা করার জন্য, চাষবাস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন! (আমরা যদি কলকাতার বাস-ব্যবসা ছেড়ে সুন্দরবনে, বিশেষত ঘোড়ামারা দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য সর্বদা মরিয়া হয়ে উঠি সেই রকম আর কি!)। আর মণিপুরের পাহাড়-জঙ্গলের জমির অধিকাংশই অকৃষিযোগ্য, বসবাসের অনুপযোগী। এছাড়া আছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবে হ্যাঁ, অধিবাসী হিসাবে জমির অধিকার শুধুমাত্র ST সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের।

অতএব?

অতএব- দাও মৈতেই মানুষের ST তকমা।
অতএব- উস্কানি দাও মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষকে।
অতএব- কাজে লাগাও বিচারব্যবস্থাকে।
অতএব- কাজে লাগাও প্রশাসনকে।
অতএব- কাজে লাগাও রাজ্য সরকারকে।
অতএব- কাজে লাগাও কেন্দ্রীয় সরকারকে।
অতএব- কাজে লাগাও বিজেপি দলকে।

এতেই হবে। যদি না হয়? তাহলে দরকার আরও সহায়ক শক্তি। আরএসএস-বজরং দলের কু-আদর্শে তৈরি আছে-

Meitei Lupin
Arambai Tenggol
Kanglei Yaol Kanba Lup

এবং আরও সব ছোট-বড় সন্ত্রাসী দল।

‘অ্যাকশন’ করবে এরাই।

 

মৈতেই সম্প্রদায়ের ST তকমা দাবির বাস্তবতা

আগেই বলেছি মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজেদের ‘উচ্চ জাতি’ ‘উচ্চ ঘর’ বলেই মনে করতেন এবং এখনও করেন। তাদের এই ST তালিকাভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে বিশিষ্ট ও প্রবীণ নাগা নেতা Niketu Ivalu (Nephew of A Z PHIZO) বলেছেন-‘… Now they decided to go lower down, to those people, they looked down upon, just to have more facilities and privileges, will that solve problem to them? Or will make others more helpless, the minority groups? Why should somebody from a higher level of social standing, which they have been very proud of for so many years, now come down? Is that a motivation, a thinking good enough for the meity’?

এ প্রশ্ন তো সবার।

তবে মৈতেই/সানামাহিদের মধ্যে কিছু মানুষ Mangba (যার অর্থ Unclean বা অপরিচ্ছন্ন) বলে পরিচিত আছেন। তারা কিন্তু আগেই SC পরিচয় পেয়েছেন। মৈতেইদের মধ্যে OBC এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর সুবিধাও অনেকে পাচ্ছেন। গত শতাব্দীর ৫০-৬০ এর দশকেও ‘উচ্চ’ মৈতেইরা ‘নীচ’ ST হতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। তাদের বেশিরভাগই উপজাতি নাগা-কুকি-মিজো সম্প্রদায়ের ST মানুষ সম্পর্কে ‘Hao Thu’ এই অবমাননাকর শব্দ প্রয়োগ করে আনন্দ পেতেন। এখন আরএসএস-এর প্রচারে উদ্দীপ্ত হয়ে সেই মৈতেইরাই ‘Hao Thu’ হতে চাইছেন!

মণিপুরের ইতিহাসে এও এক ‘উলট পুরাণ’।

 

লক্ষ্য কি সংবিধানের 371C ধারা?

হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে বহু ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক প্রভৃতির প্রচলন আছে। আছে একই ধর্মে হাজার ভাগ, আছে শত শত জাতি-উপজাতির অবস্থান। সবাই এক দেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রত্যেক মানুষ, গোষ্ঠী, জাতি, উপজাতি, রাজ্যের অবস্থান, ভাবনা-চিন্তা, আশা-আকাঙ্খার বিস্তর ব্যবধান। আমাদের রাষ্ট্রনায়করা এই বৈচিত্র‍্যের মূল্য বুঝতেন তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে, কোনও কোনও জনগোষ্ঠী, কোনও এলাকা বা রাজ্যের স্বার্থ দেশের সংবিধানের মাধ্যমেই সুরক্ষিত করে গেছেন। এইরকম উদ্দেশ্যেই সংবিধানের 371C ধারায় মণিপুর রাজ্যকে কিছু রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে।

এই 371C  মণিপুর রাজ্যের জন্য একটা কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।  বলা হয়েছে – “Constitution and Functions of a Committee of the Legislative Assembly of Members of that Assembly Elected from the Hill Areas”.  এই ধারা অনুসরণ করে ১৯৭২ সালে মণিপুর বিধানসভায় পাস হয় The Manipur Legislative Assembly (Hill Area Committee) Order, 1972. (মনে রাখতে হবে মণিপুর ১৯৭২ সালেই রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে)। এই নির্দেশিকার উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়- ” To safeguard the interest of the people of the hill area”.  এই নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা আছে যে, অর্থ বিল ছাড়া বিধানসভায় পেশ করা যে কোনও বিল-ই, যদি তা Hill Area-র বা ST-র আওতাভুক্ত হয়, তবে  Hill Area Council-কেও সেই বিল বিবেচনার জন্য দিতে হবে এবং Hill Area Council তা অনুমোদন করলেই তা আইনত গ্রাহ্য হবে, অন্যথায় নয়।

এছাড়াও ২০০৬ সালে সংসদে পাশ হয়েছে “The Schedule Tribe and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act. এই আইনের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে, ST তালিকাভুক্ত মানুষদের “Right to hold and live in the forest land”.

এই আইনে এটাও বলা হয়েছে- It not only recognises and vests forest rights but also the occupation of such forest land by schedule tribes. The act evidently restricts the states eminent domain power on tribal land and forest by giving tribal dwellers the right to not only use the forest produce but protect and conserve the forest. 

আমরা সাধারণ বুদ্ধিতে যেটুকু আইন বুঝি, তা দিয়ে যদি উপরের আইন বা আদেশগুলি বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, উপজাতি এলাকায় জমির উপর ST সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের পূর্ণ অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে NON-ST তো দূরের কথা, সরকারও সেই জমির উপর কোনওরকম অধিকার কায়েম করতে পারে না। একমাত্র সংবিধান সংশোধন করে তবেই ওই জমি সরকার দখল করতে পারে। আর পাহাড়ি মানুষ ও পাহাড়ি জমিজমা সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতে পারেন না, যদি Hill Council তা অনুমোদন না করে।

এই যদি বাস্তব অবস্থা হয়, তাহলে মৈতেই সম্প্রদায়ের জন্য পাহাড়ে জমি কেনা বা জমির দখল পাওয়ার কী হবে? এক কথায় বলা যায়- হবে না, এ কাজ সম্ভবপর নয়। হতে পারে একটাই শর্তে- সংবিধানের ধারা বদল করে; মণিপুরে বলবৎ থাকা সংবিধানের 371C ধারা এবং আনুসঙ্গিক অন্যান্য সব ধারা রদ করে। মণিপুরের রাজ্য সরকার কি তার জন্য জমি তৈরি করছে?

 

পরিকল্পিত অশান্তি, আপনি ভয়ে থাকুন

২০১৭ সালের আগে ১৫ বছর কাজ করেছে Okram Ibobi Singh পরিচালিত কংগ্রেস সরকার। তার আগে মণিপুরে অশান্তি ছিল। কিন্তু Ibibi Singh বুদ্ধিমত্তা ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে কুকি জঙ্গিদের নিবৃত্ত করেন, রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু ২০১৭ সালে বিজেপি ক্ষমতা দখলের পরেই মৈতেই সম্প্রদায়ের জন্য পাহাড়-জঙ্গলে জমির দাবি প্রবল হতে শুরু করে। বলা যায়, এর পিছনে বিজেপি, বীরেন সিং, আরএসএস, Meitei Lupin সহ অন্যান্য সংগঠনের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ছিল। তা সত্ত্বেও কুকিরা বা মৈতেইদের বড় অংশ কখনও ভাবেনি যে এই দাবির উপর ভিত্তি করে সারা মণিপুরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে। ওয়াকিবহাল মহল ভালভাবেই জানে মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য পাহাড়ে জমি পাওয়া যাবে না। কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ যতদিন না দুর্বল হবে, যত দিন না তাঁদের নৈতিক ভাবে পরাস্ত করা যাবে, ততদিন কিছুই করা যাবে না। তাই দল হিসাবে বিজেপি এবং বীরেনবাবুর সরকার একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন, যাতে স্বাধীনচেতা কুকি গোষ্ঠীকে পর্যুদস্ত করা যায়। গত কয়েক বছরে মুখ্যমন্ত্রীর গতিবিধি এবং কাজকর্ম দেখলে উপরের কথার সমর্থন মিলবে।

এই সময়কালে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ি এলাকায় এমন কিছু কাজ করেছেন বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেগুলো Hill Council-এ অনুমোদিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কাছে পেশ করাও হয়নি।

যেমন – ২০২১ সালে ৫ জুলাই বনমহোৎসব উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রী Kangpopki জেলার Mangjol গ্রামে যান। সেখানে তিনি আচমকা ঘোষনা করেন ওই এলাকায় অবস্থিত Mount Koubru Range সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হল। উল্লেখ করা যেতে পারে মণিপুর রাজ্য গঠনেরও আগে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রশাসন এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলেও তা বিতর্কিত, এই কারণে তা কার্যকরী করার প্রয়াস আগের কোনও সরকারই নেয়নি। এখন Hill Council আছে যেখানে তাঁর দলের সদস্যরাই বেশি; তাঁর মন্ত্রীসভা আছে, বিধানসভায়ও তাঁরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ কারও সঙ্গে কোনও আলাপ আলোচনা ছাড়াই, কোনও আইনি পদ্ধতি ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ওখানেই ঘোষনা করেন পাহাড় চূড়ায় একটি মন্দিরও স্থাপিত হবে।

এই একটি ঘটনা দিয়েই বোঝা যায়, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং বিশেষ কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়েই চলছেন। আর তাঁর উদ্দেশ্য, তাঁর দল বা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী জানেন না এটা হতে পারে না। সেই সময়েই মণিপুরের বিদ্বজ্জনেরা আশঙ্কা করেছিলেন, অন্যরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তারপর দু-বছরও যায়নি, মণিপুর মুখোমুখি হল এক ভয়াল অভিজ্ঞতার। বনজঙ্গল রক্ষার নামে অসংখ্য গ্রাম উচ্ছেদ করা হল, বসতবাড়ি-গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হল (এটা কি মায়ানমার জুন্টার কাছ থেকে শেখা?), বেদখল সরকারি জমি পুনরুদ্ধারের নামে তিনটে চার্চ ঠান্ডা মাথায় জ্বালিয়ে দেওয়া হল (বাবরি থেকে কাশি, শিক্ষকের অভাব নেই!)। কথায় কথায় কুকি সম্প্রদায়কে হেয় করার জন্য জঘন্য কাজ করে গেছেন বীরেনবাবু। সাথে সাথে উৎসাহ দিয়ে গেছেন “অস্ত্র হাতে কালো জামা বাইক বাহিনী”-কে। তাদেরও প্রস্তুতি তুঙ্গে। ৩ মে উপজাতি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ মিছিল শেষে যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে স্মারকলিপি দিচ্ছে, তখন Non-ST মানুষদের একাংশ শুরু করল গণ্ডগোল। চলল খুন, সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন, চলল গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগানো। সে আগুন এখনও জ্বলছে, থামেনি। কবে থামবে কেউ জানে না। বিজেপি-আরএসএস মণিপুরের মানুষকে মনুষ্যত্বের শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

 

প্রথমেই দরকার শান্তিস্থাপন

প্রায় সবাই একটা কথা বলছেন, দেশে নাকি এমন এক ব্যক্তি আছেন যিনি চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না, কথা বলতেও শেখেননি। যারা বলছেন তারাও জানেন যে তারা ঠিক বলছেন না। আসলে বিপদের সময়, সংঘর্ষের সময়, শান্তিপ্রিয় সব মানুষই চায়, উপযুক্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে সংঘর্ষ থামানোর আবেদন আসুক। একা একটা রীতিও বলতে পারেন। কিন্তু যদি এমন হয়, সেই প্রাতিষ্ঠানিক ওস্তাদ চাইছেন সংঘর্ষ আরও চলুক, তাহলে তো তিনি শান্তির আবেদন করবেন না বরং আপনি শান্তি চাইলেও তিনি কলকাঠি নেড়ে অশান্তির আগুনটা মাঝে মাঝে উস্কে দেবেন!

এরকম কিছু হচ্ছে না তো?

বিজেপি যে কৌশল করে মৈতেইদের কুকিদের বিপক্ষে নামিয়ে দিয়েছিলেন তা তারা এখন বুঝতে পারছেন। তারা হয়তো আশা করেছিলেন বিজেপি তাদের আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেবে কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তারা বুঝতে পারছেন তাদের বোকা বানানো হয়েছে। এখন রাগে হতাশায় তারা রাস্তার মাঝখানে মন-কি-বাত-এর রেডিও ভাঙছেন, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য মন্ত্রীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। অন্তত দশ জন মৈতেই এমএলএ আলাদা গ্রুপ তৈরি করেছেন। অন্য অনেকের মতো তাঁরাও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন।

সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং প্ররোচনামূলক কথা বলেছেন কিন্তু বিজেপি ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দল রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন। বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তি একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার আবেদন জানাচ্ছেন তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও সক্রিয় হওয়ার আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কি রাজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকার কারও থেকে এমন কিছু তথ্য বা আশ্বাস পাওয়া যায়নি যাতে আমাদের মনে হতে পারে যে তারা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঔদ্ধত্য তো সীমাহীন। মণিপুরের সম্মিলিত বিরোধী রাজনীতির প্রতিনিধিদল দু-সপ্তাহ দিল্লিতে অপেক্ষা করেও তাঁর দেখা পায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাম-কে-ওয়াস্তে সর্বদলীয় বৈঠক করলেও বিরোধীদের কোনও পরামর্শ গ্রহণ করেননি আবার নিজেও সমস্যা সমাধানের কোনও রূপরেখার কথা জানাতে পারেননি। অবশ্য বারবার সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ও অন্যান্যরা মণিপুরের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। কংগ্রেস দল আট দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দিয়েছে। তাতে প্রধানমন্ত্রীর মণিপুরে গিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করা, সমস্ত উগ্রপন্থীদের থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা, বীরেন সিং কে সরিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা, সন্ত্রাস কবলিত মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবি স্থান পেয়েছে। কয়েকদিন আগে সোনিয়া গান্ধী মণিপুরে শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সবার কাছে আবেদন করেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী শান্তি যাত্রায় দু-দিনের জন্য মণিপুর এসেছেন। আমরা আশা করছি, মণিপুরে বিজেপির তৈরি করা হিংসা আর অবিশ্বাসের পরিবেশ দূর হবে, মানুষ আবার এক হয়ে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

 

শেষ কথা অথবা শুরু করার কথা

একটা কথা বলে শেষ করতে চাই। তা হল, বিজেপিকে ভারতীয় রাজনীতির আঙিনা থেকে চিরবিদায় দিতে হবে। আগামী বছরে দেশের সাধারণ নির্বাচন। দেখা যাচ্ছে, বিভেদের রাজনীতিতে আবারও তারা শান দিচ্ছে। মণিপুর তথা উত্তরপূর্ব ভারতের অধিবাসীদের বড় অংশ খৃষ্টান। বাকি (হিন্দু) ভারতে দেখানো হবে বিজেপি খৃষ্টানদের রেয়াত করছে না। ভারতীয় সংবিধান নয়, মনু সংহিতা হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি। আসলে ওরা বৈচিত্র্যময় ভারতের অবসান চাইছে। আমরা কি তা সমর্থন করতে পারি? আমি বা আপনি এক ভারতকে জানি। বিজেপি সেই ভারতকে জানে না। তাই আমার-আপনার ভারতের বাঁচানোর জন্য লড়াই এখনই শুরু করতে হবে। আমার-আপনার ভারতকে জিততে হবে।

মনুবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ভারতকে জিততেই হবে।