অগ্নিগর্ভ মণিপুর

সঞ্জীব দেবলস্কর

 


প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট

 

 

 

১৯৪৯ সালে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর মণিপুরে এবারের মতন এত বীভৎস জাতিদাঙ্গা কখনও হয়নি, বর্তমান জাতিদাঙ্গার সুদূরপ্রসারী ফলশ্রুতি হিসেবে ভবিষ্যতে এরাজ্যের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চল নিয়ে এক বা একাধিক উপ-রাজ্য গঠনের আওয়াজ ওঠা হয়তো সময়ের অপেক্ষা। যে-হিংসার বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে সেটা আরও ভিন্নতর ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হলে তা উত্তর-পূর্বের জন্য আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে পারে

 

মণিপুর রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আসছে। সেদিকে যাওয়ার আগে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, ব্লটিং লাগানো সরকারি প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে ভয়াবহ জাতিদাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান কী?

মে মাসের ৩ তারিখ মণিপুর রাজ্যে মৈতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হওয়া জাতিদাঙ্গায় এ যাবত কমপক্ষে ৫৪ জন নিহত হয়েছেন বলে সেনা ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে। তবে ঘটনার ভয়াবহতাই বলছে আসল সংখ্যাটি এর চাইতে অনেক বেশি। গত ৩ মে, বুধবার রাত থেকেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক মিছিলকে কেন্দ্র করে এ অশান্তি শুরু হয়। মিজোরাম সংলগ্ন জেলাশহর চুরাচান্দপুরে ‘অল ট্রাইব্যাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব মণিপুর’ সংস্থাটি মৈতেই জনগোষ্ঠীর তফশিলি জাতিভুক্তির বিরোধিতা করে বের করেছিল মিছিলটি। এখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত, ক্রমে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের ৮টি জেলায়।

এ মুহূর্তে রাজ্যে প্রায় ১০,০০০ সেনাজওয়ান, আধাসামরিক বাহিনি এবং কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনির জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছে; উন্মত্ত আন্দোলনকারীরা বেশ কটি চার্চে আগুন লাগিয়েছে, পুড়িয়েছে কয়েকশো গাড়ি। যারা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের গাড়িগুলোকে স্কুলক্যাম্পাসে ঢুকিয়ে রেখেছেন এদের গাড়িগুলোও রেহাই পায়নি। আর বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব বয়ানেই রাজ্যের একাধিক বিশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রাণও এ হাঙ্গামায় হারিয়েছে, এর মধ্যে রাজ্যস্তরের উচ্চ আধিকারিক, পুলিশ, সেনাবাহিনির কর্মীও আছেন।

ওদিকে বেসরকারি সূত্রে ২৫টি গির্জাবাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর আরেকটি ভিন্নতর বার্তার সঙ্কেত দেয়। ইতিমধ্যেই এদিকে চার্চের দুরভিসন্ধির কথা অর্থাৎ ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’-এর কথাও শোনা গেছে। তবে মণিপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখায় সামাজিক মাধ্যমে আইটি সেল বিষয়টিকে নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারছে না। কিন্তু মণিপুর রাজ্যের বাইরে বিষয়টি ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কাছাড় জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, নাগা, চরৈ, এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি ‘পিস মিশন’-এর সদস্য হিসেবে গতকাল বর্তমান লেখকও কাছাড়ের লক্ষীপুর মহকুমায় বেশ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে গিয়ে আক্রমণের আশঙ্কায় বাড়িঘর, পুঞ্জি, খামার ছেড়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। শরণার্থীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভাষা একটু সমস্যা সৃষ্টি করলেও কাছাড়ের মৈতেই-ভাষী প্রতিনিধিরা খুব অন্তরঙ্গভাবে নিজভাষায় এঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এ ভাষার সঙ্গে শরণার্থীদের ভাষার কিছু কিছু সামঞ্জস্য থাকাতেই এটা সম্ভব হয়েছে। আশ্রয়প্রার্থী কুকি সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনায় তাঁদের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অভিমানের হদিস পাওয়া গেল। ওঁদের জন্য মণিপুর থেকে পাঠানো ত্রাণ সামগ্রীভর্তি গাড়ি ওঁরা ফিরিয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম মণিপুর সরকারের এভাবে পাঠানো কোনও দান তাঁরা গ্রহণ করবেন না। বরং উপোসই থাকবেন। তাঁদের পষ্টাপষ্টি কথা— ‘যারা আমাদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছে না, আমাদের ঘাতকদের আটকাতে পারছে না, যাদের কোনও নেতামন্ত্রী আমাদের খোঁজখবরও করতে এলেন না, তাদের দেওয়া কোনও রিলিফ আমরা নিতে পারব না। ও রিলিফওয়ালাকো জানে দো।’ ওঁদের অভিমানের সঙ্গে আতঙ্কও আছে। ফিরে গেলে ওঁদের জীবন-জীবিকা বা বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওদিক থেকে কেউই কিছু বলেননি। মনের দুঃখে বলছেন— ‘যারা আমাদের আশ্রয়ের স্থল চার্চবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারা আসলে জিসাস ক্রাইস্টকো নেহি, ও লোগ হাম আদমিকো মারনা চাহতা হ্যাঁয়।’ বোঝা গেল এ বিপদের মুহূর্তেও সাধারণ লোকগুলো স্পর্শকাতর বিষয়টিকে নিয়ে যেন কোনও ধর্মীয় হানাহানি শুরু না হয় সেদিকে সচেতন। কিন্তু সবাই কি এরকম ভাবছেন?

ইম্ফল আর চুরাচান্দপুরে আদিবাসীদের গ্রামবস্তি, পুঞ্জি এবং গির্জার উপর সংগঠিত আক্রমণ হয়েছে, এবং চটজলদি আক্রান্তদের দোষী সাব্যস্ত করার একটি প্রয়াস এই কারফিউ-অধ্যুষিত রাজ্যের হাওয়াতেও ভাসিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। সে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী বার্মামুলুক অর্থাৎ মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনে মণিপুরে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কুকি জনগোষ্ঠীদের দায়ী করার ব্যাপারটিও বেশ অগ্রগতি লাভ করেছে (এর আঁচ পাওয়া যায় মণিপুর-বহির্ভূত সামাজিক মাধ্যমে)।

ঐতিহাসিক কাল থেকে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন এ জনগোষ্ঠীদের আবাস সীমান্তের উভয়দিকেই বিস্তৃত রয়েছে। রাজ্যের প্রধান জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সঙ্কটের ধুয়া তুলে, রাজ্যের জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের কাহিনি ইদানীং বেশ চাউর হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রকৃত ভারতীয় কুকিদেরও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখার প্রবণতা যে আরেকটি সঙ্কটের বার্তা দিচ্ছে, এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যত্রও ঠিক একই ফর্মুলায় একটি বিশেষ ভাষিকগোষ্ঠীকে তাঁদের হাজার বছরের বসবাসের ইতিহাসকে উপেক্ষা করেই বিদেশি, ঘুসপেটিয়া বলে আখ্যায়িত করার ব্যাপারটা বাইরে খুব অজানাও নয়। তবে সে প্রসঙ্গ এখানে থাক।

মণিপুরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংবিধানের ৩৫৫ ধারা জারি হয়েছে। আতঙ্কে প্রায় ১ হাজারেরও বেশি নাগরিক রাজ্য ছেড়ে জিরিবাম জেলা সংলগ্ন আসামের কাছাড় জেলার লক্ষীপুর মহকুমার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। আক্রান্তরা সবাই জনজাতীয়। কাছাড় সংলগ্ন জিরিবামে যদিও কোনও হাঙ্গামা নেই তবুও ওখান থেকেও বিপদের আশঙ্কায় অনেকে লক্ষীপুর মহকুমায় আশ্রয় নিয়েছেন। জিরিবাম থেকে নির্বাচিত মণিপুর বিধানসভার একমাত্র বাঙালি বিধায়ক আসাবউদ্দিন কাছাড়ে আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করে গেছেন, এবং আশ্রিতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য কাছাড় জেলাপ্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।

পূর্ব এবং পশ্চিম ইম্ফল জেলা এবং চুরাচান্দপুরই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রধান রণাঙ্গন। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে নিরাপরাধ জনতা, সরকারি অধিকারিক, ব্যবসায়ী এবং নিরাপত্তা বাহিনির উপর। বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করে নিয়ে যাওয়ার খবরও রয়েছে।

মণিপুরের ৫৩ শতাংশ মৈতেই জনগোষ্ঠীর তফশিলি তালিকাভুক্তি নিয়েই বর্তমান হাঙ্গামা। রাজ্যের অন্যতম নাগা এবং কুকি জনগোষ্ঠী, মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ, যাঁদের বাস মূলত গ্রামাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকায়, তাঁরাই মৈতেই জনগোষ্ঠীর ট্রাইব্যাল স্টেটাসের দাবিকে মানতে পারছেন না। রাজ্যের ১০টি পার্বত্য জেলা জুড়ে ৩ তারিখ ‘ট্রাইব্যাল সলিডারিটি মার্চ’ আয়োজন করেন এঁরাই, যেখান থেকে গণ্ডগোলের শুরু।

তবে জাতিবৈরিতার চোরাস্রোত এ রাজ্যে অনেকদিন থেকেই মাথাচাড়া দিচ্ছিল। বিগত ১০ বছর ধরে মৈতেইরা সিডিউল ট্রাইব হিসেবে বিবেচিত হবার দাবি করে আসছিলেন। বিগত ১৯ এপ্রিল মহামান্য মণিপুর হাইকোর্ট বিজেপিশাসিত রাজ্য সরকারকে মৈতেই জনগোষ্ঠীর তফশিলি তালিকাভুক্তির বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উত্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা ট্রাইব্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রিতে পাঠানোর কথা ছিল এ মাসের ২৯ তারিখ, ঠিক এখান থেকেই এ পর্বের হিংসাশ্রয়ী ঘটনাপ্রবাহের শুরু।

তবে এন বীরেন সিংহের নেতৃত্বে গত ফেব্রুয়ারি বিজেপি সরকারের একটি উচ্ছেদ অভিযান সরকারের জনজাতি-বিদ্বেষী চেহারাটিও স্পষ্ট করে দেয়। এতে মৈতেই ছাড়া অন্যান্য জনজাতির মনে ক্ষোভ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এহেন পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিংহ চুরাচান্দপুর জেলায় এক জনসভায় ভাষণ দিতে গেলে সভাস্থলে অগ্নিসংযোগ এবং আক্রমণ সংঘটিত হয়। চুরাচান্দপুরে উচ্ছেদের ঘটনার চাইতেও পার্বত্য অঞ্চলের বিশাল অংশকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করায় কুকিরা তাঁদের নিজস্ব ভূমি থেকে উৎখাত হয়েছেন। তাঁদের ক্ষোভ এ জন্যেও যে, বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর তাদের আর কোথাও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করে দেননি সরকার। আবার মন্ত্রিসভা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে যে তারা রাজ্য সরকারের বন সংরক্ষণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ থেকে সরে আসবে না। চুরাচান্দপুর থেকে ছয়জন জনজাতীয় বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও কুকিদের উচ্ছেদের ব্যাপারে তাঁরা কোনও ব্যবস্থা গ্রহণে এগোননি। কুকি ছাত্রনেতা ডিজে হাওকিপ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে এই নেতাদের বয়কট করা। মোটামুটি অশান্ত মণিপুরের এই হচ্ছে পরিস্থিতি।

সংবাদমাধ্যমে এ জাতিদাঙ্গার খবর আসতেই থাকবে। এ নিয়ে আর বিশদ বিবরণ না দিয়ে বিষয়টি নিয়ে কী চিন্তা চর্চা হচ্ছে সেদিকেই সামান্য দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।

দাঙ্গার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে এদিকে অরাজনৈতিক এক বৌদ্ধিক সংগঠন বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের অগ্রণী নেতৃত্ব (কাছাড় জেলার সহসভাপতি) বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য মণিপুরে এসব ঘটনার পেছনে একটি জনগোষ্ঠীর ‘আধিপত্যবাদ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশল’ই দেখতে পান। তাঁর মতে, ‘অসমে যেমন অসমিয়াদের নিজ রাজ্যে সংখ্যালঘু হওয়ার আশঙ্কা, ঠিক তেমনই মৈতেইদের মণিপুরে সংখ্যালঘু হওয়ার ভয়।’

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তির পরবর্তী স্তরে জাত্যাভিমানে মৈতেইরা নিজেরাই উপজাতির স্বীকৃতি নেননি। তাঁরা শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থিক দিক দিয়ে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে অনেক সবল বা উন্নত। এটা সর্বজনস্বীকৃত, কুকি-নাগা বা অন্যান্য উপজাতিরা এদিকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এঁদের সাহিত্য-সংস্কৃতির পাঠ নেই বললেই চলে। মৈতেইরা অনেক আগেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সংস্পর্শে এসে সমাজ ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়ে গেছেন, যার প্রভাব তাঁদের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতিকে ভারতীয় অপরাপর প্রাদেশিক সংস্কৃতির সমপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের অন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যেও ক্রমে জাতিসত্তার বিকাশ, রাজনৈতিক সচেতনতার সৃষ্টিও হয়েছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসে তাঁরা আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার সুযোগও লাভ করেছেন এ-ও সত্যি। কেউ কেউ এঁদের নিজস্ব অধিকার সচেতনতার পেছনে মিশনারিদের নঞর্থক ভূমিকার কথাও উচ্চারণ করছেন ইদানীং।

১৯৪৯ সালে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর মণিপুরে এবারের মতন এত বীভৎস জাতিদাঙ্গা কখনও হয়নি, যদিও বন্দুকবাজদের আনাগোনা, উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপ, অন-উপজাতিদের কাছ থেকে প্রোটেকশন মানি আদায়, প্রায় প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক চোরাকারবার, ড্রাগস, অস্ত্রশস্ত্রের আমদানি— এসব ক্ষেত্রে মণিপুর বেশ অগ্রগতি লাভই করেছিল। উত্তরপূর্বের অপরাপর অঞ্চলের মতো মণিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ব্যাপারও একটা ছিল। ওয়াকিবহাল সূত্রে প্রকাশ, বর্তমান জাতিদাঙ্গার সুদূরপ্রসারী ফলশ্রুতি হিসেবে ভবিষ্যতে ভারতীয় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই এরাজ্যের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চল নিয়ে এক বা একাধিক উপ-রাজ্য গঠনের আওয়াজ ওঠা হয়তো সময়ের অপেক্ষা।

মণিপুরের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যেই কুকিরা প্রধান। এঁরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনও বটে। ইতিহাসে এঁদের হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতার কথা রয়েছে। পক্ষান্তরে মৈতেইদের সাহসী, বীর যোদ্ধা বলে সুনামও রয়েছে। তাই দুপক্ষের লড়াই সাংঘাতিক। সরকারি হিসেবেই ৫৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও এর কয়েকগুণ বেশি হতাহতের খবর আছে বলে অনেকেই অনুমান করছেন।

জাতিবিদ্বেষের চোরাস্রোত মণিপুরে বেশ কয়েকটি দশক থেকেই বয়ে চলছে। প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও বলতে হয় গত দুই দশক থেকেই অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ব্রিটিশ আমলের নাগরিক মণিপুর ছেড়ে অসমের কাছাড় ও অন্যত্র স্থায়ীভাবে বসবাস এবং ব্যবসাবাণিজ্যও শুরু করছেন। অ-মণিপুরিরা নিজের জায়গা-জমি মণিপুরি ছাড়া অন্য কারও কাছে বিক্রি করতেও পারেন না। অনেকে জলের দরে জমিবাড়ি বিক্রি করে সরে এসেছেন। এখন উপত্যকার সীমান্ত ছাড়া রাজধানীতে অ-মণিপুরি সমতলবাসীদের সংখ্যা খুবই কম।

এখানে কথাগুলো বলতেই হয়, যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাচার মণিপুরের জনজীবনকে আজকের জায়গায় নিয়ে গেছে সেটা বাঙালি বৈষ্ণবপ্রবর নরোত্তমদাস ঠাকুরেরই কীর্তি। ঊনবিংশ শতক থেকে বাঙালিরা মণিপুরে বসবাস করছে। এ রাজ্যে প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনও তাঁদের কীর্তি, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে শুধু বাঙালি নয় মৈতেইরাও পড়াশোনা করেছেন। পরিস্থিতির চাপে এঁরা সরে আসছেন। কথাটা প্রসঙ্গক্রমে এখানে ছুঁয়ে যেতে হল এ জন্যই, যে যে-হিংসার বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে সেটা আরও ভিন্নতর ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হলে তা উত্তর-পূর্বের জন্য আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে পারে হয়তোবা। ইতিপূর্বে শুরু হওয়া সংঘর্ষ যদিও কতিপয় জনজাতির মধ্যেই সীমায়িত, ভবিষ্যতে সেটা ভিন্নতর ক্ষেত্রে প্রসারিত হতেও পারে। আর নতুন কোনও সংঘর্ষ দেখা দিলে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল বাঙালিদের গায়ে যে এর আঘাত লাগবে না, এর কোনও স্থিরতা আছে কি?


*লক্ষ্মীপুর আশ্রয়শিবিরের ছবিগুলি লেখকের তোলা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...