অন্য এক কেরালা স্টোরি, নয়ডার সাংবাদিকরা যার খবর দেখান না

লক্ষ্মী প্রিয়া

 

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছিল The News Minute নিউজ পোর্টালে, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩-এ। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জন্য প্রতিবেদনটি অনুবাদ করলেন সাগরিকা শূর

 

চাক্কি চলে যাবার পরও ৫০ বছর কেটে গেছে, কিন্তু শনাভাসের মনে হয় যেন গতকাল। তাঁর মা সুবাইদা শিশু জেফারকে তার ঠাকুমার হাতে তুলে দিয়ে চোখে জল নিয়ে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যান এই আশায় যে তিনি শেষবারের জন্য হলেও চাক্কিকে দেখতে পাবেন। চাক্কি  – যে তাঁর কাছে শুধুমাত্র পরিচারিকাই ছিল না, ছিল পরম বন্ধু। সুবাইদা ফিরে এসে তিন সন্তানের মা হয়ে ওঠেন – চাক্কির ছোট ছেলে, তাঁর কোলের শিশু শ্রীধরন, এবং দুই ছোট মেয়ে, রমানী ও লীলা। সেইদিন, সাত বছরের শনাভাস তিন ভাইবোনকে তাঁর জীবনে গ্রহণ করেন।

থেন্নাদান সুবাইদা ও আব্দুল আজিজ হাজি, কেরালার মালাপ্পুরম জেলার নীলাম্বুরের কালিকাভু গ্রামের এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম দম্পতি। তাঁরা তাঁদের পরিচারিকার তিন সন্তানকে আজীবন নিজেদের সন্তানস্নেহে লালন পালন করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু কখনওই চাননি তাদের ইসলামের আওতাভুক্ত করতে। সুবাইদা কিডনির অসুখে মারা যান, তার দু’ বছর পর তাঁর স্বামী আজিজ হাজি। এই পরিবারের মর্মস্পর্শী কাহিনীই পর্দায় তুলে এনেছেন পরিচালক সিদ্দিক পারাভুর। গত ৯ জানুয়ারি এদ্দুপালির ভনিথা থিয়েটারে সিদ্দিক পারাভুর পরিচালিত ‘এন্নু স্বয়ানথাম শ্রীধরন’ (‘উইথ লাভ, শ্রীধরন’) ছবিটির শুভমুক্তি ঘটে।

 

একটি স্মৃতিচারণ ও একটি সত্যোন্মোচন

২০১৯-এর জুলাই মাসে শ্রীধরনের একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমেই, তাঁর উম্মার (মালায়ালম ভাষায় মা-এর ইসলামিক প্রতিশব্দ) প্রয়াত হবার খবর ছড়িয়ে পড়ে ও কালিকাভুর বাইরের পৃথিবী প্রথম সুবাইদার সম্পর্কে জানতে পারে। “শ্রীধরনের কীভাবে উম্মা থাকতে পারে? কাকে ঠকাচ্ছেন আপনি? এটা কি ভুয়ো প্রোফাইল?” তার ফেসবুকে বন্ধুরা উত্যক্ত করতে থাকে। যদিও শ্রীধরনের কাছে কিন্তু ওমান থেকে তার মাকে দেখতে আসতে না পারার যন্ত্রণা তার এই জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অন্যদের কুরুচিকর ঈঙ্গিত ও সংশয়ে আরও বেড়ে যায়।

পরের দিন সে ঠিক করে, সমাজের সংকীর্ণতার কাছে সে আপোষহীন থাকবে, নিজেকে সে কখনওই সুবাইদার ছেলে ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় বহন করতে দেবে না – এক মুসলিম মায়ের হিন্দু ছেলে। “উম্মা ও উপ্পা (বাবা)-এর নিজেদের তিন সন্তান, জোসিনাও তাদের মধ্যে অন্যতম, সে আমরা ও বাড়িতে যাওয়ার কয়েক বছর পর জন্মায়। কিন্তু আমাদের কখনও ওখানে নিজেদেরকে বহিরাগত মনে হয়নি৷ ওটাই একমাত্র বাড়ি আমার কাছে। আমি শুনেছি উম্মা আমাকে আর জেফারকে একসাথে দুধ খাওয়াতেন”, শ্রীধরন নিউজ মিনিটকে জানিয়েছে। সেকারণেই সে ফেসবুকে নিজের জীবনের গল্পের মাধ্যমে তামাম দুনিয়াকে ভালোবাসা ও সহাবস্থানের একটি মর্মন্তুদ কাহিনী শোনাতে চেয়েছে।

সে লেখে, “এই পোস্ট আপনাদের সংশয় দূর করার জন্য। যখন আমি আমার উম্মার চলে যাওয়ার কথা লিখেছিলাম, আপনাদের কারও কারও মনে সংশয় জন্মেছিল। এমনকি যখন আমি তাকিয়া পরে ছবি দিয়েছি তখনও সংশয় ছিল যে একজন মুসলমানের নাম শ্রীধরন হতে পারে কিনা। আমার মা আমার এক বছর বয়সে মারা যান। আমার আরও দুই বোন আছে। আমার বাবাও ছিলেন। যেদিন আমার মা মারা যান, সেদিনই উম্মা ও উপ্পা আমাদের ওঁদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁরা আমাদের শিক্ষিত করে তোলেন, যেমন তাঁরা তাঁদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে করেছেন। আমার বোনেদের যখন বিয়ের বয়স হয়, উপ্পা ও উম্মাই ওদের বিয়ে দেন। ওঁদের নিজেদের সন্তান থাকা কখনই এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁদের তিন সন্তান। যদিও ওঁরা খুব অল্প বয়সে আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন, কিন্তু কখনওই আমাদের ওঁদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে চাননি। লোকে বলে দত্তক মা কখনওই জন্মদাত্রী মায়ের সমতুল্য হতে পারেন না। কিন্তু উনি কোনওদিন আমাদের ‘দত্তক মা’ ছিলেন না, উনি আমাদের সত্যিকারের মা-ই ছিলেন”, পোস্টটিতে এমনটাই লিখেছে শ্রীধরন।

যাঁরাই তাঁর পোস্ট পড়েছেন, তাঁরাই চমকে গেছেন, শ্রীধরন জানায় “হঠাৎই আমরা অ্যাক্টিভিস্ট ও মিডিয়ার লোকজন, এমনকি সাধারণ মানুষদের কাছে থেকেও ফোন পাচ্ছিলাম, সকলেই পোস্টের পিছনের গল্পটি জানতে আগ্রহী ছিলেন”। “আজকের রাজনৈতিক আবহে যখন ধর্মকেই একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, আমাদের যে এই পরিবারটি আশ্রয় দিয়েছিল এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল, আমাদের নিজস্ব ধর্মমতে আস্থা রাখতে শিখিয়েছিল, এই বিষয়টিই অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য।”

এমনকি শ্রীধরনের ভাইবোনেরা বাইরের পৃথিবীর এ হেন প্রতিক্রিয়ায় খুবই বিস্মিত। “আমরা ভাইবোনের মতো বড় হয়েছি। আমরা কখনও আমাদের পরিবারকে একে অপরের থেকে আলাদা ভাবিনি”, শনাভাস, সুবাইদার গর্ভজাত বড় ছেলে একথা জানান। “অবশ্যই উম্মা যখন রমাণী, লীলা আর শ্রীধরনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন, আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে উনি কী করতে চান। উনি বলেছিলেন এরা এখন থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে, এটুকুই। আমরা কখনও এ নিয়ে প্রশ্নও করিনি। আমাদের বাবা সেসময় গাল্ফে ছিলেন, তিনিও উম্মার এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন।”

 

ধর্মীয় বেড়াজালের বাইরে

শ্রীধরন এখনও সেই দিনটা স্পষ্ট মনে করতে পারেন যেদিন তিনি তাঁর বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন তাঁরা তাঁকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেননি। “তাঁদের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল উদ্বেগ। তাঁরা আমায় জিজ্ঞেস করেন কেউ আমাকে খারাপ কিছু বলেছে কিনা। আমি তাদের নিশ্চিত করবার পর তাঁরা বলেন ধর্ম দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত নয়। তাঁরা বলেন সব ধর্মই আসলে একই কথা বলে – মানুষকে ভালোবাসতে ও সাহায্য করতে, মানুষই আসলে এর ভুল ব্যাখ্যা করে।”

“তাঁরা আমাদের আস্থা রাখতেও শিখিয়েছেন, ধর্ম যাই হোক না কেন। আমি ও আমার বোন মন্দিরে যেতাম, আমাদের কপালে চন্দনের তিলক কেটে ঘুরতাম, এসবই করতাম। তাঁরা আমাদের সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিতেন। তাঁরা আমাদের থেকে এটুকুই আশা করতেন যে আমরা যাতে মিথ্যে না বলি, চুরি না করি, বা অন্যদের আঘাত না করি। আমরাও খেয়াল রেখেছিলাম যাতে এরকম কিছু না করি যাতে ওঁদের সম্মানহানি হয়”, শ্রীধরন বলে।

শ্রীধরন এই বিষয়েও অবগত যে যদি তাকে ও তার বোনকে সুবাইদা দত্তক না নিতেন, তাদের জীবন একদম অন্যরকম হত, বিশেষত তাদের জন্মদাতা পরিবারের জাতের নিরিখে। “আমরা নিচু জাত। যখন আমরা বড় হচ্ছিলাম তখন লোকজন চাইত আমরা চুপ করে থাকি ও তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে প্রান্তিক অবস্থানেই থাকি। তখন এরকমই সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু উপ্পা ও উম্মা আমাদের এটা করতে বারণ করেন। ওঁরা বলেন আমাদের বিনা কারণে কারও কাছে মাথা নোয়ানো উচিত নয়।”

শ্রীধরন আরও বলে, তার নিজের ছেলে হওয়ার পরই সে বাবা-মায়ের সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে। “আজ আমি জানি একটা শিশুকে বড় করা কত শক্ত। সেজন্যই আমি অবাক হয়ে ভাবি ছ’জন শিশুকে বড় করা কতটা কঠিন কাজ ছিল। সত্যি কথা বলতে, আমার জন্মদাতা বাবা মারা যাওয়ার পর, তাঁরা আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের দুই মেয়েকেও আশ্রয় দেন, এটা সবাই জানে না।”

 

রুপোলী পর্দার পথে

পরিচালক সিদ্দিক পারাভুর, যাঁর আগের ছবি ‘থাহিরা’ ৫১ তম ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, গোয়াতে ইন্ডিয়ান প্যানোরমা ফিচার ফিল্ম বিভাগে প্রদর্শিত হয়, তিনি, সুবাইদার বিষয়ে প্রথম জানতে পারেন কনোদত্তিতে অবস্থিত সমাজকর্মী ও বক্তা এ পি আহমেদের কাছ থেকে। “শ্রীধরনের পোস্ট ভাইরাল হবার পরপরই আমি আহমেদের লেখা সুবাইদা ও তাঁর জীবন সম্পর্কে একটি নোট পড়ি, এটি আমায় গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমি তাঁর গল্প আরও মানুষের সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। আমি জানাতে চেয়েছিলাম যে এরকম মানুষ এখনও আছেন যাঁরা এভাবে বাঁচেন। যাঁরা ধর্ম ও সংস্কারের ওপরে ভালোবাসা ও দয়াকে স্থান দিয়েছেন।”

সিদ্দিক সুবাইদার গ্রামে আসার পর সুবাইদা সম্পর্কে আরও মর্মস্পর্শী কাহিনী শোনবার স্মৃতিচারণ করেছেন, “কালিকাভুতে সকলেই তাঁকে চিনতেন ও ভালোবাসতেন। সারাজীবন তিনি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি শুধু তাঁর জন্য ব্যয় করেননি, বরং দুস্থদের সাহায্যার্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁদের জন্য প্রতি বছর জামা-কাপড় ও গয়না কিনেছেন। তাঁর আরও ১২ একর জমি তিনি ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৮ লাখ টাকা – এবং কোনওটাই তাঁর নিজের জন্য নেওয়া নয়। ঘটনাক্রমে, শনাভাস তাঁর নিজের টাকা থেকে সব ঋণ শোধ করেন।” কালিকাভুতে থাকাকালীন তিনি শুনেছিলেন সুবাইদা মারা যাওয়ার পর চার্চের যাজক তাঁর জন্য চার্চ বেল বাজান, যে বেল শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণদের জন্যই বাজানো হত, এমনকি তাঁর জন্য একটি প্রার্থনাসভারও আয়োজন করা হয়।

আহমেদ সিদ্দিককে পরিবারটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর, কাজটি শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি। যখন অভিনেত্রী নির্মলা কান্নান সুবাইদার চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হন, সাংবাদিক ও লেখক এবং এই ছবির প্রযোজক সুরেশ নেল্লিকোডে আজিজ হাজির ভূমিকায় অভিনয় করেন। নীলাম্বুর আঈশা ও শিহাবুদ্দিন পয়থুমকাদাবু ছাড়াও শচীন রায়, বৈভব অমরনাথ, হর্ষ অরুণ, রাজিথা সন্তোষের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

“আজিজ হাজিই প্রথম শটের জন্য ক্যামেরা চালান। ওঁরা এই ভেবে খুব খুশি ছিলেন যে আরও লোকজন সুবাইদার বিষয়ে জানতে পারবে, এটা জানতে পারবে যে তিনি কতখানি পরোপকারী ছিলেন। দুভার্গ্যবশত, আজিজ হাজি পরের বছর কোভিড-১৯ মহামারির সময় মারা যান”, পরিচালক জানান। “মানুষ আদতে ভালোই। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের এ ধরনের গল্পের দরকার তাদের সেই ভালোকে মনে করিয়ে দেবার জন্য। সুবাইদাকে মনে রাখা দরকার, আর তাঁর গল্প বারবার বলতে হবে।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...