গোয়েবলসের কেরালা নির্মাণ

অয়নেশ দাস

 



গদ্যকার, বিজ্ঞাপন কর্মী

 

 

 

 

দ্য কেরালা স্টোরি সেই প্রোপাগান্ডার অংশ, যে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নাজ়ি জার্মানির মতো আজকের ভারতেও প্রতিটি হিন্দুকে বোঝানো চলছে যে তার সবচেয়ে মারত্মক শত্রুটি হল পাশের বাড়ির মুসলমান। দ্য কেরালা স্টোরিকে উপহাস করলে বা সহজভাবে দেখলে বা লিবেরাল দৃষ্টিকোণ থেকে হালকাভাবে নিলে আমরা ভবিষ্যৎকে বুঝতে ভুল করব

 

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি ততদিনে দ্য কেরালা স্টোরি নিয়ে পাঠক অনেক কিছুই জেনে গিয়েছেন। তাই প্রথমে একটু পেছন থেকে শুরু করি। সালটা ১৯৪০। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার হয় একটি জার্মান ছবির। নাম জুড য়ুস। ইংরেজি করলে হয় য়ুস দ্য জ্যু। প্রিমিয়ারের পর থেকেই ছবিটি প্রবল রিসেপশন পেতে থাকে। জার্মানি জুড়ে দর্শকের উন্মাদনায় ভাসতে থাকে ছবিটি। একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানে ছবিটির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সত্তর মিলিয়ন জনসংখ্যার তখনকার জার্মানিতে কুড়ি মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অন্তত একবার করে ছবিটি দেখেছিল। তা পাঠক ভাবতেই পারেন, কেরালা স্টোরি নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎ ১৯৪০-এর জার্মান ছবি নিয়ে পড়লাম কেন! কারণ আছে। কেন না নাজ়ি জার্মানিতে তৈরি এই ছবিটির সঙ্গে আজকের ভারতে নির্মিত দ্য কেরালা স্টোরির এক ভয়ঙ্কর যোগসূত্র বর্তমান। বস্তুত সেই সব নিয়েই আমার এই লেখার প্রচেষ্টা।

তো শুরুতেই জুড য়ুস সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার এবং প্রথমেই একটা তথ্য দিয়ে দেওয়া ভাল। টেরা ফিল্মসের প্রযোজনায়, তখনকার দিনের এক খ্যাতনামা জার্মান পরিচালক ভিট হারলানের পরিচালনায় জুড য়ুস ছবিটি নির্মিত হয়েছিল যার নির্দেশে তার নাম জোসেফ গোয়েবলস। হিটলারের মন্ত্রীসভার মিনিস্টার ফর পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা। পাঠক এবার নিশ্চই কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন। জুড য়ুস-এর প্লট এখানে সবিস্তারে আলোচনা নিশ্চয়ই বাহুল্য হয়ে যাবে। তবে খুব সংক্ষেপে মূল ন্যারেটিভটা না বললেও আবার হবে না।

ছবিটি মূলত তিনটি চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়। একজন হল ডিউক অফ উর্টেমবার্গ, আরেকজন হল ইহুদি কুসীদজীবি বা মানিলেন্ডার জোসেফ য়ুস ওপেনহাইমার এবং তৃতীয়জন এক জার্মান যুবতী ডরোথি স্টার্ম। অর্থসঙ্কটে নিমজ্জিত জার্মান ডিউককে ধারে অর্থপ্রদানের জালে জড়িয়ে ফেলে য়ুস। নিজের ইহুদি বেশবাস ছেড়ে দাড়ি কামিয়ে পরিচ্ছন্ন খ্রিস্টানের ছদ্মবেশে সে ডিউকের প্রাসাদে নিজের জায়গা করে নেয়। ক্রমশ উর্টেমবার্গের জার্মান প্রজাদের প্রতি নিষ্ঠুর করে তোলে ডিউককে এবং একইসঙ্গে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে ওই অঞ্চলে ইহুদিদের ওপর বলবৎ শতাব্দীপ্রাচীন নিষেধাজ্ঞাটিকেও তুলিয়ে নেয়। এই অবধি নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে ছবিটির খলনায়কটি কে! তবে য়ুস-এর অপরাধ এখানেই থেমে থাকে না। আসল অপরাধটি ঘটে যখন অপবিত্র ইহুদি য়ুস, ডরোথি স্টার্মকে ক্রমাগত যৌন প্রণোদনায় প্ররোচিত করতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত তাকে ধর্ষণ করে। ডরোথি আত্মঘাতী হয়। শেষে উত্তেজিত জনতা য়ুস-কে চরম শাস্তি দেয় ও ইহুদিদের ওপর নিষেধাজ্ঞাটি পুনরায় বলবৎ হয়। মোটামুটি এই।

এবার আসা যাক আজকের দ্য কেরালা স্টোরি নামের ছবিটিতে। সুদীপ্ত সেনের পরিচালনায় এই ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন সুদীপ্ত সেন নিজে, সূরযপাল সিং, এবং বিপুল অম্রুতলাল সিং, যিনি আবার ছবির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরও বটে। নন লিনিয়ার ন্যারেটিভে ছবির প্লট মোটামুটি এইরকম। কেরালার কাসারগোডের এক মুসলিম নার্সিং কলেজে হিন্দু-প্রধান তিরুঅনন্তপুরম জেলার এক পরিচ্ছন্ন হিন্দু পরিবার থেকে নার্সিং পড়তে আসে কথাকলিতে দক্ষ শালিনী। সেখানকার হস্টেলে তার রুমমেট হয় আরও তিনজন। প্রথমজন গীতাঞ্জলি, কমিউনিস্ট বাবার কন্যা, দ্বিতীয়জন নাইমা, কোট্টায়াম থেকে আসা একটি খ্রিস্টান মেয়ে আর তৃতীয়জন হল এক মুসলমান মহিলা আসিফা। এই আসিফা হল আসলে আইসিস এজেন্ট যে কিনা অন্য ধর্মের মেয়েদের শঠতার মাধ্যমে ইসলামে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমে তাদের সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে যৌনদাসী হিসেবে পাচার করে। এখানে তিনজন যথারীতি অত্যন্ত হাস্যকরভাবে আসিফার ফাঁদে পড়ে এবং তাদের যে ভয়ঙ্কর ইসলামি ক্রূরতা ও নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হতে হয়, সেই গল্প নিয়েই এই ছবি। ছবিটির এস্থেটিক্স, অভিনয়ের মান নিয়ে যত কম বলা যায় তত ভাল, তাই সে রাস্তাতেই আমি যাব না। আমি বরং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমূলক এই ছবিটির প্রোপাগান্ডার স্বরূপটি চিনতে চেষ্টা করব।

 

দুই.

আজকের ভারতকে আরএসএস যেভাবে বিবিধ কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তার মধ্যে তার সর্বাত্মক আধুনিক প্রোপাগান্ডার ব্যবহার ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বললেও বোধহয় বেশি বলা হবে না। চরিত্রের দিক থেকে যে কোনও অন্যান্য ফ্যাসিস্ট টোটালিটেরিয়ান শক্তির মত হলেও প্রোপাগান্ডার সুচিন্তিত ব্যবহারে ভারতীয় ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে সবচেয়ে যদি কারও মিল থেকে থাকে সে হল হিটলারের নাজ়ি জার্মানি। আরএসএস নির্দেশিত প্রোপাগান্ডার চরিত্র ঠিক ঠিক বুঝতে গেলে তাই আমাদের নাজ়ি জার্মানির প্রোপাগান্ডার ধরনটিকে ভালভাবে বুঝে নিতে হবে।

ঐতিহাসিক কার্ল ডিট্রিশ ব্রেশার-এর মতে— নাজ়ি মতাদর্শের সাফল্যের অন্তর্বস্তুটিকে কেবলমাত্র বোঝা সম্ভব থার্ড রাইখের প্রোপাগান্ডার চরিত্র দিয়ে। একটি যথার্থ ধর্মীয়-মনস্তাত্বিক প্রপঞ্চ নির্মাণের মাধ্যমে নাজ়ি জার্মানিতে সর্বাত্মক আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই প্রোপাগান্ডার শক্তিকে প্রচণ্ডতর করে তোলা হয়েছিল। এবং এই প্রোপাগান্ডার শক্তি জার্মানিতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল যে গোটা জার্মান সমাজের চোখে সমস্ত ইহুদি জাতি, সমপ্রেমী এবং কমিউনিস্টদের এমন ঘৃণ্য ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করা গিয়েছিল যে তাদের নিকেশ করায় রাষ্ট্র একরকম যেন জনতার কনসেন্ট লাভ করেছিল।

প্রোপাগান্ডার এই চরিত্র আমাদের দেশেও আজ প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে কাজ করে চলেছে। ফলে আমাদের বুঝতে হবে আমরা আমাদের দেশে কার্যকর ফ্যাসিস্ট শক্তিকে মতাদর্শের দিকে থেকে যতই পশ্চাদবর্তী বলে গাল পাড়ি না কেন তার প্রোপাগান্ডার চরিত্রটি কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক। এমনকি অতি-আধুনিক। নাজ়ি জার্মানির মতোই আরএসএস কিন্তু কনজিউমারিক ব্যবস্থাকে খুব ভাল বোঝে। সেই সময়ের সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির সাহায্য যেভাবে আদায় করেছিল হিটলার-বাহিনি, একইভাবে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রবাহিনিও উদারনীতিকে সেভাবেই পাশে পেয়েছে। তারাও খুব ভাল বোঝে মিডিয়ার প্রচণ্ড শক্তিকে। তফাৎ এই যে ভারতের ফ্যাসিস্ট বাহিনি ৩০-৪০ দশকের গোয়েবলসের থেকে আরও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য পাচ্ছে, এবং সেটা সত্যিই আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়।

 

তিন.

নাজ়ি প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে সিনেমা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। লেনিন সিনেমার প্রচণ্ড শক্তিকে তার শিশু অবস্থাতেও সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন— Of all the arts, film is the most important to us. একেবারে অন্য অবস্থানে গোয়েবলসও এই কথাটা সাঙ্ঘাতিকভাবে বুঝেছিল। ১৯৩৩ সালে, হিটলার যে বছরে চ্যান্সেলর হল সেই বছরেই তার প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবলস জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। সেই বছরেই তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় রাইখ চেম্বার অফ ফিল্মস। বিশেষভাবে নির্মিত হতে থাকে একের পর এক প্রোপাগান্ডা ছবি ও হতে থাকে তাদের জন্য ঢালাও ফান্ড আর পুরস্কারের ব্যবস্থা। আর অন্যদিকে বিরোধী মনোভাবাপন্নরা শুধু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নয়, দেশ ছাড়তেই বাধ্য হয়। এর মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক ফ্রিৎস ল্যাং, রবার্ট সায়োদমাক, ডগলাস সির্ক, বিলি ওয়াইল্ডার প্রমুখ, বিখ্যাত তারকা অভিনেতারা, যেমন, মারলেন ডিট্রিশ, পিটার লোর প্রমুখ। এমনকি তৎকালীন জার্মানির সবথেকে বড় প্রযোজনা সংস্থা UFA-এর প্রধান এরিক পোমারও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

সে যাই হোক, নাজ়ি প্রোপাগান্ডা সিনেমাগুলির নির্মাণভাষ্যের কতকগুলো নির্দিষ্ট অভিমুখ ছিল। সেগুলো একটু নাড়াঘাঁটা করলে আজকের আরএসএস নিয়ন্ত্রিত প্রোপাগান্ডার মিলটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। দুটো খুব স্পষ্ট অভিমুখ। প্রথমত রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে জনতার কাছে মসিহা হিসেবে তুলে ধরা এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রনির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে জনগণের যে গ্রুপ বা গোষ্ঠীগুলি ‘অপর’, তাদের রাষ্ট্র ও জনতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা।

পাঠক খেয়াল করবেন, ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পিএম নরেন্দ্র মোদি ছবিটি প্রথম পংক্তিতে পড়ে। এই ছবিতে যেভাবে মোদিকে এক সিংহহৃদয় মসিহা হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে তার সঙ্গে এস্থেটিক্সের দিক থেকে না হলেও বিষয়গত দিক থেকে তুলনা চলতে পারে ১৯৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত লেনি রিফেনস্টাহ্‌ল পরিচালিত বিখ্যাত ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল-এর। হিটলারের লার্জার দ্যান লাইফ ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নাতীতভাবে ছবিতে ফুটিয়ে তোলাই ছিল এই ছবির বিষয়বস্তু। লেনির ছবিটি শুধু প্রোপাগান্ডা হিসেবে নয়, ক্রিটিক মহলেও যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এমনকি ১৯৩৭ সালের প্যারিস ওয়র্ল্ড এক্সিবিশনে বেস্ট আর্টিস্ট্রির পুরস্কারও পেয়েছিল ডকু ছবিটি।

এর পাশাপাশি ঢেলে তৈরি হচ্ছিল দ্বিতীয় ধরনের ছবিগুলি। যেমন দ্য রথসচাইল্ডস (১৯৪০), দ্য ইটারনাল জ্যু (১৯৪০), রবার্ট উন্ড বের্ট্রাম (১৯৩৯)। একের পর এক ছবিতে ইহুদিদের, কমিউনিস্টদের ‘অপর’ হিসেবে নির্মাণের চিত্রনাট্য লেখা চলছিল। দর্শকের মনে ক্রমাগত এই ‘অপর’ সম্পর্কে বিষ ঢেলে দেওয়া হত। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বিধ্বংসী ঘৃণা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসত জনতা। জুড য়ুস এরকমই একটি ছবি। এবং আজকের দ্য কেরালা স্টোরিও সেই একই গোত্রের। বিবেক অগ্নিহোত্রীর কাশ্মির ফাইলস-ও তাই।

 

চার.

জুড য়ুস ছবিতে অফুরন্ত স্টিরিওটাইপে গেঁথে য়ুস নামের ইহুদি চরিত্রটি নির্মিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে য়ুস-এর চরিত্রটিকে প্রস্তাবনায় রেখে গোটা ইহুদি জাতিটাকেই এক অপরিচ্ছন্ন, শঠ, ক্রূড়, ষড়যন্ত্রকারী জাতি হিসেবে দর্শকের মনে গেঁথে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করা হয়। একইভাবে আসিফা নামের মহিলাটিকে সামনে রেখে ইসলামকে সেইভাবেই নির্মাণ করার চেষ্টা হয়েছে দ্য কেরালা স্টোরিতে। যে উপায়ে নরকের ভয় দেখিয়ে আসিফা তিনটি অন্য ধর্মের মেয়েকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে প্ররোচিত করে এবং তারাও প্ররোচিত হয় তা আপাদমস্তক হাস্যকর হলেও প্রোপাগান্ডাকারীর তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ শেষ পর্যন্ত সাধারণের জনমানসে ইসলামকে স্টিরিওটাইপে গেঁথে চরম শঠ ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটি কিন্তু সফল হয়।

ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডার বয়ান আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক হতে বাধ্য। যে কোনও শীর্ষ ফ্যাসিস্ট নেতা ঐতিহাসিকভাবেই অবশ্যই একজন ‘he’। এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নারীকে অবধারিতভাবে একটি জাতির পবিত্রতা-অপবিত্রতার মানদণ্ড হিসেবে ধরাই দস্তুর। জুড য়ুস বা দ্য কেরালা স্টোরিতে স্বাভাবিকভাবেই তার ব্যত্যয় ঘটে না। চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবারের ভয় থেকে উপজাত দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে দ্য কেরালা স্টোরি তার ইসলামবিরোধী প্লট স্থিত করে অমুসলমান ভারতীয় নারীদেহে। গোটা ছবি জুড়ে ভয়ঙ্কর মুসলমান পুরুষদের কাছে মেয়েদের অসহায়তা প্রতি মুহূর্তে এক নিদারুণ স্টিরিওটাইপের জন্ম দিতে থাকে। ছবিতে এক-আধবার পুরুষদের ধর্মান্তরকরণের উল্লেখ থাকলেও সমস্ত ফোকাস কিন্তু থাকে সেই নারীদেহের ওপরেই। তার সঙ্গে সঙ্গত করে জায়গায় জায়গায় পর্দাজুড়ে চলতে থাকে সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের অস্বস্তিকর গ্রাফিক সিন।

এরকমই একটি সিনে এক মুসলমান স্বামী তার ধর্মান্তরিত অনিচ্ছুক গর্ভবতী স্ত্রীকে টেবিলে পেড়ে ফেলে এবং শাসায় যে স্বামীর ইচ্ছায় তার উপগত হওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। এরপর অনিচ্ছুক স্ত্রীকে সে জোর করে ধর্ষণ করে। একটি ‘শক ভ্যাল্যু’ দৃশ্য হিসেবে ক্যামেরা পুরো প্রক্রিয়াটিকে ক্যাপচার করে যায়। মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ যেখানে ম্যারিটাল রেপ-কে ক্রিমিন্যাল অফেন্স হিসেবে মনে করার ক্ষেত্রে জনমানসে, এমনকি রাষ্ট্রের তরফেও যথেষ্ট বিরোধিতা আছে। তাহলে শকটা কোথায়? শকটা থাকছে আসলে স্বামীটির ধর্মীয় পরিচয়ে। তার মুসলমান পরিচয়ে। যেমন করে নোংরা ইহুদি য়ুস পবিত্রতার প্রতীক জেন্টাইল আরিয়ান রূপবতী ডরোথিকে (গোয়েবলসের নির্দেশে এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেন হারলানের সুইডিশ স্ত্রী, ক্রিস্টিনা সোডেরবাউম, যিনি প্রকৃত আরিয়ান সুন্দরী হিসেবে সিনেমার জগতে বিখ্যাত ছিলেন) বলপূর্বক ধর্ষণ করে। এই গ্রাফিক অস্বস্তিকে সামনে রেখে জুড য়ুস ছবিতে প্রোপাগান্ডার প্রকল্প যেভাবে দাবী করেছে— শয়তান ইহুদি, জার্মান নারীদেহ/পবিত্রতা থেকে নোংরা হাত ওঠাও; তেমনি দ্য কেরালা স্টোরির প্রকল্পটিও যেন দাবী করে— শয়তান মুসলমান, হিন্দু নারীদেহ/পবিত্রতা থেকে নোংরা হাত ওঠাও।

 

পাঁচ.

জুড য়ুস ছবিতে ইহুদিদের জাতীয়তাবিহীন জাতি হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছিল, যাতে করে জার্মান জাতীয়তার ক্ষেত্রে তাদের ‘অপর’ হিসেবে দেখানো সুবিধে। তেমনি একইভাবে সুদীপ্ত সেনের ছবিটিতেও এই নির্দিষ্ট প্রোপাগান্ডার স্বরূপটি প্রকাশিত হয়ে যায় যখন একটি দৃশ্যে একটি পোস্টার দেখানো হয়, যাতে লেখা থাকে— জাতীয়তা হারাম, ইসলামই একমাত্র পরিচয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের কাছে এর থেকে বড় অস্ত্র আর কী হতে পারে!

বিবেক অগ্নিহোত্রীর মতো সুদীপ্ত সেনের ছবিটিতেও কমিউনিস্টদের এক নির্দিষ্ট স্টিরিওটাইপে আক্রমণ করা হয়েছে। এবং এ ব্যাপারেও তাদের পথপ্রদর্শক হল নাজ়ি প্রোপাগান্ডা সিনেমা। ১৯৩৩ সালের ছবি হ্যান্স ওয়েস্টমার-এ কমিউনিজমকে বিজাতীয় জাতীয়তাবোধহীন মতাদর্শ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কমিউনিস্টদের মধ্যে জার্মান জাতীয়তার ছিটেফোটাও নেই। তাদের অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল, তাদের যন্ত্রীরা বাজায় জ্যাজ। ফলে সাধাসিধে জার্মান ওয়েস্টমার কমিউনিস্টদের কিছুতেই জার্মান হিসেবে মেনে নিতে পারে না। ঠিক তেমনিভাবেই মার্ক্স, লেনিন, স্ট্যালিনের ছবি দেখিয়ে কমিউনিজমের বিজাতীয়তা সম্পর্কে আমাদের বারবার সতর্ক করতে থাকে দ্য কেরালা স্টোরি।

আমি জানি না, সুদীপ্ত সেন সত্যিই নাজ়ি প্রোপাগান্ডা সিনেমাগুলি দেখেছেন কি না। কিন্তু তিনি যদি সত্যিই দেখে থাকেন এবং সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে থাকেন তাহলে তা হবে খুবই স্বাভাবিক। এত ছত্রে ছত্রে মিল কাকতালীয় হতে পারে না। এ যেন নাজ়ি প্রোপাগান্ডার ভারতীয় পুনঃপ্রয়োগ।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য আরেকটি নাজ়ি প্রোপাগান্ডা ছবি— হিটলার ইউথ কোয়েক্স। এক কমিউনিস্ট বাবার ছেলে হেইনি ছবির প্রোটাগনিস্ট। বাবা হেইনিকে এক কমিউনিস্ট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেখানে কমিউনিস্টদের অত্যাচারে ও অপরিচ্ছন্ন বসবাসে এবং যৌন কদর্যতায় উত্যক্ত হয়ে হেইনি সেখান থেকে পালায় এবং একটি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন, শৃঙ্খলাপরায়ণ জার্মান ক্যাম্পে থাকতে শুরু করে। শেষ অবধি হেইনি কমিউনিস্ট বাবার মতাদর্শগত ঐতিহ্যকে সরাসরি অস্বীকার করে। দ্য কেরালা স্টোরিতেও কমিউনিস্ট বাবার মেয়ে গীতাঞ্জলি শেষে বাবার মতাদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে এবং মহান হিন্দুত্বের ঐতিহ্যের সঙ্গে তার পরিচয় না ঘটানোর জন্যে কমিউনিস্ট বাবাকে অভিযুক্ত করে। একে কী বলবেন? কাকতালীয়?

 

ছয়.

উমবের্তো একো ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “Ur-Fascism”-এ ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন। তার মধ্যে একটি হল—

The obsession with a plot. Thus at the root of the Ur-Fascist psychology there is the obsession with a plot, possibly an international one. The followers must feel besieged.

এই প্লটের প্রতি অবসেশন বিবেক অগ্নিহোত্রীর কাশ্মির ফাইলস বা সুদীপ্ত সেনের দ্য কেরালা স্টোরি-র মধ্যে অতি মাত্রায় বর্তমান। এবং একো-র কথা কতখানি সত্য তা বোঝা যায় যখন দুটি ছবিই আন্তর্জাতিক প্লটকে পুরোমাত্রায় ব্যবহার করে। বাস্তবের অর্ধসত্যের সঙ্গে ফিকশনালাইজড ন্যারেটিভ দিয়ে সাজিয়ে আন্তর্জাতিক প্লটগুলিকে ভারতীয় ডোমেস্টিক দর্শকের কাছে যেভাবে দুটি ছবিতেই তুলে ধরা হয়েছে তাতে প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য অন্তত একটা পর্যায়ে সফল হতে বাধ্য।

দ্য কেরালা স্টোরিতে খুব চতুরতার সঙ্গে যে আন্তর্জাতিক প্লটটিকে ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ইসলামোফোবিয়া। এর জন্য কেরালা স্টোরিকে আলাদা করে কোনও ন্যারেটিভ আমদানি করতে হয়নি। নিজের মতন করে ছবিটি এই আন্তর্জাতিক নির্মিত ফেনোমেননকে উদয়াস্ত ব্যবহার করে নিয়েছে।

ইসলামোফোবিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরিসর এখানে নেই। খুব সংক্ষেপে বললে বলা যায়, ইউরোপীয় দেশগুলি ও আমেরিকার ডোমেস্টিক ও ফরেন পলিসি ও রাজনীতি, যেখান থেকে ‘ওয়ার এগেইন্সট টেররিজম’-এর পশ্চিমি নির্মাণ, সরাসরি ইসলামোফোবিয়ার ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী। কিন্তু পশ্চিমসৃষ্ট এই ফেনোমেনন আজ আর শুধু ইউরোপ বা আমেরিকার সীমান্তেই আটকে নেই। ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোণে কোণে। তার প্রভাবে ও বিস্তারে ক্রমাগত আক্রান্ত হয়ে চলেছে চিনের উইগার সম্প্রদায়, মায়ানমারের রোহিঙ্গারা। আর এই আন্তর্জাতিক ফেনোমেননের সামনে সবচেয়ে অসহায় বোধহয় আজকের ভারতবর্ষের সাধারণ মুসলমান জনসংখ্যা।

দ্য কেরালা স্টোরি ইসলামকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যে আগাগোড়াই চরম ইসলামোফোবিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মাণ করে চলে। প্রোটাগনিস্ট শালিনীর চোখ দিয়ে দর্শক আফগানিস্তানের মাটিতে ইসলামের রূপ দেখতে থাকে। শালিনীর চোখ দিয়ে আমরা নিরলস প্রত্যক্ষ করতে থাকি ধর্মীয় (ইসলামের) নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ। শবদেহ সেখানে ঘাসের মত উন্মুক্ত প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকে। সিম্বলিক দৃশ্যে দেখানো হয় ভেড়ার গলা কাটার মর্মান্তিক গ্রাফিক দৃশ্য। সিম্বলিজম এক চূড়ান্ত স্টিরিওটাইপকে নগ্ন-উন্মুক্ত করতে থাকে।

ইরান বিপ্লবের পরপরই ১৯৮১ সালে এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছিলেন—

For the general public in America and Europe today, Islam is ‘news’ of a particularly unpleasant sort. The media, the government, the geopolitical strategists, and— although they are marginal to the culture at large— the academic experts on Islam are all in concert: Islam is a threat to western civilisation.

কীভাবে ইসলামের নেতিবাচক ইমেজ নির্মাণকে ক্ষমতাসীনরা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে তাই নিয়ে তিনি আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন—

Those sectors have the power and the will to propagate that particular image of Islam, and this image therefore becomes more prevalent, more present, than all others.

দ্য কেরালা স্টোরি এই আন্তর্জাতিক নির্মাণকেই নিজের প্রয়োজনে উদয়াস্ত ব্যবহার করেছে। উমবের্তো একোর বলে যাওয়া ফ্যাসিস্ট মনস্তাত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশিয়ে স্যামুয়েল হান্টিংটন বর্ণিত ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন’-কে হিন্দুত্বের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভয়ঙ্কর নেতিবাচক ইমেজ নির্মাণে।

 

সাত.

লেনি রিফেনস্টাহ্‌ল-এর ডকুমেন্টারি সাড়া জাগালেও গোয়েবলস বুঝেছিল প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকরী হল অর্ধসত্য-মিথ্যার অপলাপে নির্মিত ফিকশন। এখানেও তাই ঘটেছে। ২০২২ সালে এই একই বিষয় নিয়ে সুদীপ্ত সেন একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন— ‘ইন দ্য নেম অফ লাভ’। তারপরেও এই ফিকশন নির্মাণের প্রয়োজনটি কি গোয়েবলসীয় উপলব্ধি নয়?

মিথ্যা ও অর্ধসত্যের ব্যবহার পরবর্তীতে এই ফিকশন ছবিতে কিভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তার একটা নমুনা দেখা যাক। ইউটিউবে দ্য কেরালা স্টোরির ট্রেলার দাবী করেছিল যে কেরালা থেকে ৩২০০০-এরও বেশি মেয়েকে বলপূর্বক ইসলামে কনভার্ট করা হয়েছে এবং তাদের তাদের আইসিসের রিক্রুট হিসেবে চালান করা হয়েছে। এই ৩২০০০ সংখ্যাটি কোথা থেকে পেলেন সুদীপ্ত সেন। উত্তরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চান্ডির দেওয়া একটি পরিসংখ্যানের কথা বলা হচ্ছে। কী বলেছিলেন উম্মেন চান্ডি? বিধানসভায় চান্ডি যে পরিসংখ্যানটি রেখেছিলেন তা হল, মোট ২৬৬৭ জন মানুষ কেরালায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল ২০০৬ থেকে ২০১২ এই সময়সীমার মধ্যে। এবার ছবির নির্মাতারা কোন চালাকিটা করলেন? নির্মাতারা এই সংখ্যাটিকে রাউন্ড অফ করলেন ৩২০০-তে, তাও আবার প্রতি বছর হিসেবে। সেটাকে ১০ বছরের হিসেবে ৩২০০০ সংখ্যাটা বের করে আনলেন। এবার যখন ছবির কোনও চরিত্র চোখের জলে ভেসে ফ্যাকচুয়াল ফিগার হিসেবে ট্রেলারে দাবী করে তখনই প্রোপাগান্ডার অর্ধেক উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়, কোর্টের স্থগিতাদেশ পাওয়ার আগেই।

বস্তুত এই ছিল নাজ়ি প্রোপাগান্ডার কায়দা। মিথ্যাকে ফ্যাকচুয়াল বলে ইমোশনে ডুবিয়ে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করা, যাতে করে জনতার মনস্তত্বকে গ্রন্থগবদ্ধ করা যায়। ইসলামোফোবিয়ার আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চটিকে কাজে লাগিয়ে আজকের ভারতীয় ফ্যাসিস্টরা এই কাজটাই সফলতার সঙ্গে করতে শুরু করেছে। এবং গোয়েবলসীয় কায়দায় সমস্ত রকম মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই নির্মাণের পুনরাবৃত্তি, এই প্রোপাগান্ডা প্রকল্পের প্রয়োগগত বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের মাটিতে বারবার ইসলামবিরোধী ছবির নির্মাণে লুকিয়ে আছে সেই বৈশিষ্ট্য। ধর্মান্তরকরণ বা ইসলামের মধ্যে কি গোঁড়ামি নেই? কিন্তু সেটা একমাত্র সত্য নয় এবং একমাত্র ইসলামের একার জন্যও প্রযোজ্য নয়। কিন্তু সত্য-মিথ্যার এই তফাত করতে পারার আমাদের এই ক্ষমতাটাই আজ এই সুকৌশলী প্রোপাগান্ডার দ্বারা ভয়ঙ্কররকম আক্রান্ত। আমরা এর সামনে সত্যিই অসহায়। আমরা কি বুঝতে পারছি না, আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমাগত এই দখলদারদের দখলে চলে যাচ্ছে! হানা আরেন্ট নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন নাজ়ি প্রোপাগান্ডার চরিত্র। তাঁর কথায়—

The result of a consistent and total substitution of lies for factual truth is not that the lie will now be accepted as truth and truth be defamed as a lie, but that the sense by which we take our bearings in the real world—and the category of truth versus falsehood is among the mental means to this end— is being destroyed.

গোয়েবলস বুঝেছিল মিথ্যাশ্রিত প্রোপাগান্ডার পুনরাবৃত্তির কী মহিমা। তা হচ্ছে ‘রিপিটেড এক্সপোজার এফেক্ট’। ‘মাস মাইন্ড’-এ শিকড় গাঁথতে গেলে প্রোপাগান্ডার ধরনটিকে হতেই হবে প্রিমিটিভ। হিটলার-বর্ণিত Schweinehund অর্থাৎ মানুষের আদিম অন্তর্মানসকে উসকে দেওয়াই হচ্ছে নাজ়ি প্রোপাগান্ডার লক্ষ্য। যাতে করে মানুষের either-or— এই সরলীকরণের প্রতি যে আদিম অনুরক্তি, তাকে উসকে দেওয়া যায়। এর জন্য ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণিকে হারাতে হলেও পরোয়া করেনি নাজ়িরা। বরং তাকে শত্রু করে ফেলাতেই লাভ ছিল হিটলার বাহিনির। নাজ়ি প্রোপাগান্ডা বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার শুলজ়-ওয়েৎশেঙ্গেন-এর ভাষায়—

Many a one laughed at the propaganda of the NSDAP [National Socialist German Workers’ Party] in the past from a position of superiority. It is true that we had only one thing to say, and we yelled and screamed and propagandized it again and again with a stubbornness that drove the ‘wise’ to desperation. We proclaimed it with such simplicity that they thought it absurd and almost childish. They did not understand that repetition is the precursor to success and simplicity is the key to the emotional and mental world of the masses. We wanted to appeal to the intuitive world of the great masses, not the understanding of the intellectuals.

পাঠক লক্ষ করুন এ এক নিদারুণ সত্য আজকের ভারতরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রেও। আপনি তাদের ছবির এস্থেটিক ও ইন্টেলেক্ট নিয়ে যতই হাসুন না কেন, তারা তাদের অ্যাজেন্ডায় অবিচল। এবং আপনাকে মানতেই হবে তারা কতখানি এ ব্যাপারে সফল।

নাজ়ি প্রোপাগান্ডার প্রস্তাবনাটি ছিল দুটি বাইনারির সম্ভাবনায়— হয় আরিয়ানদের বিজয় অথবা তার ধ্বংসের মাধ্যমে ইহুদিদের জয়। সুদীপ্ত সেনদের হাত ধরে তেমনি বাইনারি তৈরি করা হচ্ছে আজকের ভারতবর্ষেও – হয় হিন্দুত্বের জয়, নয় তার ধ্বংসের মাধ্যমে মুসলমানদের জয়। কাশ্মির ফাইলসের মতোই দ্য কেরালা স্টোরিতেও বারবার সেই বাইনারি এবং মুসলমানদের সম্পর্কে ভয়াবহ স্টিরিওটাইপের সাজেশন দেওয়া হতে থাকে, যতক্ষণ না তা মানুষের যাবতীয় অমনোযোগ ছাপিয়ে তার অন্তর্মানসে শিকড় গেঁথে ফেলে। দ্য কেরালা স্টোরিকে উপহাস করলে বা সহজভাবে দেখলে বা লিবেরাল দৃষ্টিকোণ থেকে হালকাভাবে নিলে আমরা ভবিষ্যৎকে বুঝতে ভুল করব। ঐতিহাসিক বারুচ গিটলিস-এর পর্যবেক্ষণটি আমাদের সমকালেও ভীষণ জরুরি—

Wherever the German turned, he met his most ‘dangerous enemy,’ the Jew, and that while he walked in the street he encountered posters and slogans against the Jews at every square, on every wall and billboard. Even graffiti greeted the German at the entrance to his dwelling: ‘Wake up Germany, Judah must rot!’

দ্য কেরালা স্টোরি সেই প্রোপাগান্ডার অংশ, যে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নাজ়ি জার্মানির মতো আজকের ভারতেও প্রতিটি হিন্দুকে বোঝানো চলছে যে তার সবচেয়ে মারত্মক শত্রুটি হল পাশের বাড়ির মুসলমান। সোচ্চারে তার মগজে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে— জাগো ভারত জাগো, মুসলমান নিপাত যাও।

 

তথ্যসূত্র:


মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...