এই দিনটা দেখতে পেলেন না গৌরী লঙ্কেশ

শঙ্কর সান্যাল

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

এই নির্বাচনে কংগ্রেসও একটি পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এবং অবশ্যই তাতে সাফল্য পেয়েছে। গোটা নির্বাচনী প্রচারে যখন বিজেপির প্রথম সারির সেনাপতিরা বস্তুতপক্ষে হিন্দুত্ববাদের কার্পেট বম্বিং করছিলেন, তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব অর্থনৈতিক ইস্যু, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রচার করেছেন। বিজেপির চরম হিন্দুত্বের মোকাবিলা করতে গিয়ে এই নির্বাচনে অতি নরম হিন্দুত্বেরও আশ্রয় নেয়নি কংগ্রেস। বরং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ভোটে জিতলে হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তবাহিনি বজরং দল এবং চরম ইসলামি সাম্প্রদায়িক ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ করা হবে

 

দখিনা বাতাস যে চরম দক্ষিণপন্থার প্রতিকূলে, সে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল আগেই। অবশেষে পর্যুদস্ত গৈরিকশিবির। কর্নাটকের কালো মাটিতে পদ্মের চাষ তেমন জমল না। থেমে যেতে হল জাদুসংখ্যার অনেক আগেই। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিন্ধ্যপর্বতের ওপারে সূচ্যগ্র মেদিনীও থাকল না দাঙ্গামোদিশাহী শাসকদের পায়ের তলায়। এই দিনটি দেখার জন্য আমাদের মধ্যে আর নেই গৌরী লঙ্কেশ। হিংস্র হিন্দুত্ববাহিনি কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ।

মানুষ ভোট দিয়েছেন। ২০২৩ সালে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৩.১৯ শতাংশ ভোটারের। কর্নাটকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটা একটা নয়া রেকর্ড। পোলপণ্ডিতদের অভিমত, প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া ভোটের দিন বেশি মানুষকে বুথমুখী করে। অর্থাৎ তথাকথিত “ডবল ইঞ্জিন সরকার” এক দ্বিমুখী প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মুখে পড়েছে, সেটা ভোট-শতাংশেই প্রমাণিত।

এই নির্বাচনে কংগ্রেসও একটি পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এবং অবশ্যই তাতে সাফল্য পেয়েছে। গোটা নির্বাচনী প্রচারে যখন বিজেপির প্রথম সারির সেনাপতিরা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সভাপতি জেপি নাড্ডা ইত্যাদি বস্তুতপক্ষে হিন্দুত্ববাদের কার্পেট বম্বিং করছিলেন, তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব অর্থনৈতিক ইস্যু, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রচার করেছেন। বিজেপির চরম হিন্দুত্বের মোকাবিলা করতে গিয়ে এবারের কর্নাটক নির্বাচনে অতি নরম হিন্দুত্বেরও আশ্রয় নেয়নি কংগ্রেস। বরং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ভোটে জিতলে হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তবাহিনি বজরং দল এবং চরম ইসলামি সাম্প্রদায়িক ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ করা হবে। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে রীতিমতো ঝুঁকির কাজ। বিশেষ করে কংগ্রেসের মতো একটি দলের ক্ষেত্রে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল কর্নাটকে হিন্দুত্বের কার্পেট বম্বিংয়ের তুলনায় অর্থনৈতিক ইস্যু, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মিসাইল অনেক বেশি কার্যকরী হল।

গত ২০১৮ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১০৪টি আসন। কংগ্রেস ৮০টি এবং জনতা দল (সেকুলার) পেয়েছিল ৩৭টি আসন। কংগ্রেস এবং জেডিএস জোট করে সরকার গঠন করে। এরপরেই বিজেপি শুরু করে অপারেশন লোটাস— ঘোড়া কেনাবেচার আদিম খেলা। ফলত এইচডি কুমারস্বামীর সরকার বদলে ইয়েদুরাপ্পার সরকার গঠিত হয়ে গেল রাজ্যপালের কলমের এক খোঁচায়। ২০১৮ সালে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৪৬.৪৩ শতাংশ। কংগ্রেস এবং জেডিএস পেয়েছিল যথাক্রমে ৩৫.৭১ শতাংশ এবং ১৬.৫২ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৮ সালেই কর্নাটকের ৫২.২৩ শতাংশ ভোটার বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরে সেই ফারাকটা আরও বেড়েছে। কংগ্রেস পেয়েছে ৪৩ শতাংশ, বিজেপি ৩৬ শতাংশ এবং জেডিএস ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপির ভোট সরাসরি কমে গিয়েছে ১০ শতাংশেরও কিছু বেশি এবং জেডিএসের ভোট কমেছে ৩ শতাংশের কিছু বেশি। আসনসংখ্যার নিরিখেও ফারাক ব্যাপক। এবার কংগ্রেসের ঝুলিতে ১৩৬ আসন, বিজেপির ৬৫ এবং জেডিএসের ১৯টি আসন।

নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরেই বিজেপি তার যাবতীয় মেশিনারি নিয়ে কর্নাটকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কর্নাটকে ১৯টি জনসভা এবং ৬টি রোড শো করেন। প্রতিটি ভাষণ শেষ করেন “জয় বজরংবলী” হুঙ্কার দিয়ে। ভাষণে টেনে আনেন দ্য কেরালা স্টোরি নামে চূড়ান্ত বিতর্কিত সিনেমাটির প্রসঙ্গও। মণিপুর যখন জ্বলছে, মোদি তখন কর্নাটকে নির্বাচনী প্রচারে। একবারও তোলেননি মণিপুর প্রসঙ্গ। বরং সেই জায়গায় আদ্যন্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন যথাসম্ভব মেরুকরণের। লাভ যে হয়নি, সেটা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট। এমনিতেই কর্নাটকে বিজেপি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেরবার। ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে বিএল সন্তোষের চরম বিবাদ। এরপরে আবার লাগাতার দুর্নীতির কেচ্ছা। মেয়াদের মাঝপথে ইয়দুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে যে সরতে হল, তার পিছনে বিএল সন্তোষের কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ তো আছেই। বাসবরাজ বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেল। ত্রিপুরার মেকানিজম কর্নাটকে খাপে খাপ বসল না। তাই “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না”।

বিজেপি ১৯৮০ সালে জন্ম-ইস্তক ভোটবৈতরণী পার হওয়ার জন্য সার্বিকভাবে নির্ভরশীল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ওপরে। আরও বিশদে বলতে গেলে, সংঘ পরিবার ভারতের বুকে ৩৬৫ দিন, ২৪ ঘণ্টা যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিমগ্ন থাকে, বিজেপি আদ্যন্ত নির্ভরশীল তার ওপরেই। “কোন খেলা যে খেলব কখন/বসে ভাবি সেই কথাটাই”— নাগপুরের ষড়যন্ত্রের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ত্রিপুরার সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে আইপিএফটিকে জোটে রেখেও তিপ্রা মোথাকে ছদ্ম বিজেপি-বিরোধিতায় নামিয়ে জনজাতি ভোটের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া সংঘ পরিবারের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কর্নাটকেও সেই চেষ্টা অব্যহত ছিল। লিঙ্গায়েত, ভোক্কালিগা, ব্রাহ্মণ, দলিত, সংখ্যালঘু— বিভিন্ন সমীকরণে ঘৃণা ছড়িয়ে, আতঙ্ক জাগিয়ে মেরুকরণের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। কিন্তু এবার আর সেই প্রযুক্তি কাজে এল না। যে ভোক্কালিগা ভোট এতদিন জেডিএসের আক্ষরিক অর্থেই পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, সেই ভোটেরও বড় অংশ এবার কংগ্রেসের বাক্সে। কর্নাটকের উপকূল এলাকায় এবার কংগ্রেস বিপুল সমর্থন পেয়েছে। অর্থাৎ রাজ্যের কৃষকসমাজ পাশে দাঁড়িয়েছে। বরঞ্চ উত্তর কর্নাটকে ফল অপেক্ষাকৃত মন্দ। টুমকুর-বেলগাম এলাকায় কংগ্রেস অপ্রতিহত। মহীশূরে হৃত জমি পুনরুদ্ধার হয়তো সবটা হয়নি, কিন্তু তাও অনেকটাই। চিকমাগালুর বিধানসভা কেন্দ্রটি দুই দশক পরে পুনরুদ্ধার করল কংগ্রেস। এই চিকমাগালুরের সঙ্গে প্রায় সমস্ত কংগ্রেস কর্মীরই একটা আবেগ জড়িয়ে আছে। ১৯৭৭ সালে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি কেন্দ্রে জনতা দলের প্রার্থী রাজনারায়ণের কাছে হেরে যান ইন্দিরা গান্ধি। তারপরে এই চিকমাগালুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফেরেন তিনি।

রাহুল গান্ধি ভারত জোড়ো যাত্রা করে দেশজুড়ে বিজেপি-বিরোধিতার একটা অবয়ব যে এঁকে দিয়েছেন, এটা অনস্বীকার্য। বিজেপি ভয় পেয়েছে। বিজয়রথ যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে অপ্রতিহত থাকবে না, এই আশঙ্কা জেগে উঠছে। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করেও লাভ হয়নি। এবার কি তাহলে লোকসানের খাতা খোলার অপেক্ষা? জলন্ধর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে আম আদমি পার্টির জয়লাভও কি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে?

কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পরে রাহুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার মধ্যে দুটি লাইন উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, কর্নাটকে ঘৃণার বাজার বন্ধ হল আর ভালবাসার দোকান খুলে গেল। দ্বিতীয়ত, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের বিরুদ্ধে কর্নাটকে গরিব মানুষের জয় হয়েছে। হ্যাঁ, এই রাহুলকেই আমরা দেখতে চাই।

দুঃখ সেই একটাই, এই দিনটি দেখতে পেলেন না গৌরী লঙ্কেশ আর এমএস কালবুর্গি। হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তরা কবেই চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...