Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পঞ্চায়েত নির্বাচন: ঘোরতর সঙ্কটে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া

জয়ন্ত বসু 

 


কেন এমন করছেন রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা দলের কর্তারা, যখন তাঁরা স্পষ্টতই জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নানা কারণেই তাঁদের পাল্লা আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি ভারী? রাজনৈতিক ও তার পিছনে লুকিয়ে থাকা আইনি ও বেআইনি একাধিক কারণে বিরোধীদের সামান্যতম জায়গাও দেব না— এই সর্বাত্মক প্রাধান্যের ভাবনা থেকেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে


পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে, অভিযোগ-পালটা অভিযোগ; ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দাদাগিরি; ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের মদত; মারপিট বা খুনোখুনি— কোনওটাই পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয়, যেমন নতুন নয় পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদালতের হস্তক্ষেপও। কিন্তু এবারের মতো পরিস্থিতি আগে বিশেষ তৈরি হয়নি, যেখানে আদালতকে কার্যত সমান্তরাল প্রশাসকের ভূমিকা নিতে হয়েছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদালতকে শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনি আনার নির্দেশই দিতে হয়নি; কত কেন্দ্রীয় জওয়ান আসবে সেটাও সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিতে হয়েছে। পাশাপাশি, নির্বাচন ঘিরে কলকাতা হাইকোর্ট এক ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসারের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, বিচারপতি এমনও মন্তব্য করেছেন যে, একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত হানাহানি, এত অভিযোগ রাজ্যের পক্ষে লজ্জার।

নির্বাচনের মতো কোনও গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আদালতের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ খুব আকাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু এ রাজ্যে সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মূলত রাজ্য প্রশাসনের গাফিলতি ও ব্যর্থতার কারণেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন, যেটির একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকার কথা, সেটি যেন বকলমে ঘোষণা করেছে যে তারা পক্ষপাতদুষ্ট! নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব নিয়েই একদিনের মধ্যে প্রায় কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই ঘোষণা করে দিলেন যে, নির্বাচন হবে এক মাসের মধ্যে; হাজার হাজার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য সময় দিলেন হাস্যকরভাবে কম। এমন সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন প্রক্রিয়া ঘিরে বিশৃঙ্খলা প্রত্যাশিতই ছিল। বাস্তবেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু তা নিয়ে একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করলেও সে বিষয়ে কমিশন কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে বলে খবর নেই।

আসলে, আমরা যতই ভারতবর্ষকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবি করি, এখানে বহু ক্ষেত্রেই ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের মধ্যে ভেদাভেদের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সেই সত্যই আবার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের অঙ্গুলিহেলনে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো নাচছে তা-ই নয়; কখন কোন দিকে নাচবে, তা-ও শাসকদলের সুস্পষ্ট চিত্রনাট্য অনুসারেই পরিচালিত হচ্ছে। শাসকশিবির মুখে সন্ত্রাসহীন নির্বাচনের কথা বললেও প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ভাঙড়-সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা চলছে, আর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবার বলছেন, মনোনয়নপত্র জমা দিতে না-পারলে আমাদের জানান, আমরা ব্যবস্থা করে দেব।

প্রশ্ন ওঠে, বিরোধীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না-পারলে কেন তৃণমূলের কাছে যাবে? তার জন্য তো প্রশাসন আছে! এই মন্তব্যই প্রমাণ করে, ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা বড় অংশই মনে করেন তাঁরাই প্রশাসন!

আসলে, নির্বাচনে প্রশাসনকে নিজের মতো করে কাজে লাগানোর ঘটনা কংগ্রেস-বাম সব আমলেই ছিল। কিন্তু পদ্ধতির গুণগত এবং মাত্রাগত তফাৎ ঘটে গিয়েছে। আগে রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে জানাতেন তাঁদের কী চাই। কী করে সেটা ঘটবে, তা কমবেশি ঠিক করতেন প্রশাসনিক আধিকারিকরাই। এখন শুধু ‘কী চাই’ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীরা; কী করে এবং কত তাড়াতাড়ি সেটা করতে হবে, তা-ও বলে দিচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আধিকারিকরা তা মেনেও নিচ্ছেন। আর, সেখানেই সমস্যার শুরু। আসলে রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে দেশের অন্যান্য নানান অংশের মতো এই রাজ্যেও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও পরিকাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়ছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাংবিধানিক অধিকার বজায় রাখার পাশাপাশি এ বিষয়টাও আলোচনায় আসা জরুরি।

কেন এমন করছেন রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা দলের কর্তারা, যখন তাঁরা স্পষ্টতই জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নানা কারণেই তাঁদের পাল্লা আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি ভারী? রাজনৈতিক ও তার পিছনে লুকিয়ে থাকা আইনি ও বেআইনি একাধিক কারণে বিরোধীদের সামান্যতম জায়গাও দেব না— এই সর্বাত্মক প্রাধান্যের ভাবনা থেকেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

পাশাপাশি, মনে রাখতে হবে, এই সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে বজায় রাখার ক্ষেত্রে আদালত ও গণমাধ্যমের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই আদালতে কোনও বিচারপতির করা মন্তব্য ও তার সম্ভাব্য সাঁইত্রিশ রকমের ব্যাখ্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে উথালপাতাল ঘটে যাচ্ছে, যদিও, আদতে হয়তো সে বিষয়ে আদালতের নির্দেশ একেবারেই অন্যরকম কিছু বলছে।

মনে রাখা দরকার, নির্বাচন-সংক্রান্ত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কোনও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি টেস্ট ম্যাচ। ফলে, গলার শির ফুলিয়ে প্রাইম টাইমের সান্ধ্য আলোচনায় অযথা চটজলদি শনশনি মচিয়ে টিআরপি সুনিশ্চিত করার বদলে সংবাদ পরিবেশনে দায়িত্বশীল হওয়া দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অনেক বেশি জরুরি। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে গণতন্ত্রের সব স্তম্ভেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে কথা রাজনৈতিক দলগুলির, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের যেমন অন্যদের তুলনায় বেশি বই কম নয়, তেমনই সে দায়িত্ব সমানভাবেই বিরোধীদেরও। এমনকী প্রশাসন এবং সংবাদমাধ্যমও এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।


*মতামত ব্যক্তিগত