![atri](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2022/12/atri.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
অত্রি ভট্টাচার্য
রাজনৈতিক কর্মী, বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত
পঞ্চায়েত বললেই এখন আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া ওটিটি-সাম্রাজ্যের মাধ্যমে নীনা গুপ্তা ও রাজপাল যাদবের মিষ্টি কেমিস্ট্রি ও অনবদ্য কমিক টাইমিং এবং জাতিবাদ, খাপ-আদালত ও কাস্তে, পেটো, দেশি পিস্তল ব্যতীত একটুকরো ‘ইউটোপিয়া’সম গ্রামকে বোঝায়। কিন্তু, আমাদের মত চিরখুঁতখুতে, ‘দেশদ্রোহী’ টাইপরা একটু চোখ ঘোরালেই দেখতে পাই লখিমপুর-খেরি থেকে বগটুই, তিরুবন্তপুরম থেকে ডায়মন্ড হারবার— সর্বত্র গ্রামাঞ্চলে এখনও অটুট থেকে যাচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা, ব্রাহ্মণ্যবাদের সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক অনন্যসাধারণ ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’র মডেল।
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলতে হলে, মূলত হিংসা নিয়ে কেন কথা বলছি, এ নিয়ে কেউ রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগও করতে পারেন। কিন্তু, একটু-আধটু সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের পরিসরের বাইরের খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা জানেন বিজেপি-আরএসএসের মদতপুষ্ট আইটি সেল সারাভারতে বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে লাগাতার এক ধরনের প্রচার চালাচ্ছে, সেটা হল এই যে, পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত সকল রাজ্যে ছোটখাটো নির্বাচনগুলিতে (যেমন: পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি) কোনওরকম রাজনৈতিক হিংসা হয় না। এই ন্যারেটিভ, পশ্চিমবঙ্গের উপরে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারার যুক্তিকে দৃঢ় করতে পারে, বাংলার নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামোর নির্বাচনেও কেন্দ্রীয় বাহিনির আনাগোনা দেখা যেতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ নির্বাচনী কেন্দ্রকে ‘শীতলকুচি’তেও পরিণত করা হতে পারে। ইতিমধ্যেই, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনলাইন মনোনয়ন জমা এবং ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনির দাবি তুলে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে বিজেপি।
রাজ্য বিজেপির মতে, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে গায়ের জোরে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেবে শাসক দল। পুলিশও শাসক দলেরও হয়ে কাজ করবে।
এখন দেখতে হবে, যুযুধান তিন প্রধান রাজনৈতিক দল (তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআইএম ও বিজেপি)-এর এই মুহূর্তে অবস্থান কী রকম? শেষ কয়েকদিনে আমরা দক্ষিণি ব্লকবাস্টার ‘নায়ক’-এর অনিল কাপুরের মতো জনদরদি, সর্বদা মানুষের দ্বারে উপস্থিত— এক ক্যারিশমাটিক নয়া অবতারে উত্তীর্ণ হতে দেখলাম তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কখনও তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের প্রাপ্য আবাসন-প্রকল্পগুলির খোঁজখবর নিতে আচমকা হাজির হচ্ছেন গ্রামবাসীদের ভাঙা ঘরে। পরমুহূর্তেই, এলাকার পঞ্চায়েত প্রধানকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে বলে জানাচ্ছেন, রাজনৈতিক মঞ্চ থেকেই। অনেক তৃণমূল-ঘনিষ্ঠের দাবি যে, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত দল এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে নিজেদের ‘কোর্স কারেকশন’ হিসাবে সামনে রাখতে চাইছে। তাই তারা এখন সরকারি স্কিম ও বিভিন্ন পরিষেবাগুলি ঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে নজরদারি করছে এবং নিজেদের ‘কোর’ ভোটব্যাঙ্ক— গ্রামাঞ্চলের ও শহরের মধ্যবিত্তের ও নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে নিজেদের ‘ইমেজ’ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সিপিআইএম-এর কাছে চ্যালেঞ্জটা দ্বিমুখী। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য দল কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট পেশ করেন জেলার নেতৃত্ব। সেখানেই বেশ কয়েকটি জেলার নেতারা জানান, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিচুতলায় ‘মহাজোটের’ আশঙ্কা রয়েছে। তৃণমূলের থেকে ‘মুক্তি’ পেতে বিজেপির সঙ্গে ‘অঘোষিত’ জোটের পথে যেতে পারে নিচুতলার নেতা-কর্মীরা।
বুধবার এই রিপোর্ট পাওয়ার পর বৈঠকের দ্বিতীয় দিনেই দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনওভাবেই বিজেপির সঙ্গে জোট করা যাবে না। শুধু তাই নয় বিজেপির সঙ্গে জোট করলে শাস্তি পেতে হবে। যদিও পঞ্চায়েতের সব ক্ষেত্রে কীভাবে এই নজরদারি সম্ভব, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আঞ্চলিক স্তরের বেশ কয়েকটি নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে ঠেকাতে বিজেপির সঙ্গে বামপন্থীদের সমঝোতার তত্ত্ব সামনে এসেছে। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনেও নিচুতলার সিপিএমের নেতা কর্মীদের মনোভাবে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন জেলা-নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘আগে রাম পরে বাম’ এই তত্ত্বে বামেদের ভোট রামের দিকে চলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নন্দকুমারে সমবায় নির্বাচনে তৃণমূলকে বেগ দিতে পারা রাম-বাম জোট বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের উৎসাহিত করেছে। যেটা ‘নন্দকুমার মডেল’ বলে পরিচিত হয়েছে। পঞ্চায়েতে সেই মডেল অনুকরণের হিড়িক পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে জেলার সিপিএম নেতারা। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন সিপিআইএমের কাছে অ্যাসিড টেস্ট। তাদের হারানো জমি ফেরত পাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ। দেখা যাক, দলীয় কর্মীরা শেষমেশ কমরেড সেলিমের পথে চলবেন, নাকি পুনরাবৃত্তি ঘটবে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের।
সংখ্যালঘু ভোটের বিপরীতে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ভোটব্যাঙ্ককেই তুরুপের তাস হিসাবে দেখছে বিজেপি। সেই অঙ্ক কষেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুকে করা অখিল গিরির অশালীন নারীবিদ্বেষী মন্তব্যকে হাতিয়ার করছে বিজেপি। তাদের তারকা-প্রচারক মিঠুন চক্রবর্তীও পুরুলিয়ায় বিজেপির জনসভা থেকে আদিবাসী জনতার প্রতি এই মন্তব্যকে সমালোচনা করেই বক্তব্য রেখেছেন। রাজ্যের প্রায় ৬৮টি এসসি আসনে ২৪ শতাংশ এবং ১৬টি এসটি আসনে প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ ভোট রয়েছে। যা প্রায় মোট ভোটারের ৩০ শতাংশের মতো। গত ২০২১-এর ভোটে জঙ্গলমহলের আদিবাসী ভোট আবার বিজেপি থেকে তৃণমূলের ঝুলিতে ফিরেছে। আশঙ্কা সেটাই। পঞ্চায়েত তো বটেই, আগামী ২৪-এর লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে জেতা আসন ধরে রাখতে হলে তফসিলি জাতি, উপজাতি বা আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ককে সুরক্ষিত রাখতে হবে বিজেপিকে। তারই স্টেজ-রিহার্সাল দেখা যাবে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে। ভোটে লড়ার জন্য নিচুতলার সংগঠন শক্ত বুনোটে বাঁধতে বুথ কমিটিকেই সব চাইতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই দিকে লক্ষ রেখে বুথ স্তরে স্থায়ী কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে বঙ্গ-বিজেপির উচ্চতর নেতৃত্ব।
এখন রাজ্য সরকারের কাছে ও প্রশাসনের কাছে অনেকগুলি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেগুলির মোকাবিলা তাকে করতে হবে:
এক, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (২০২১)-র রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক রাজনৈতিক হত্যার মামলা দায়ের হয়েছে। এবং, তথ্য বলছে— ১৯৯৯ থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে অন্তত ২০টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচনে রাজনৈতিক হিংসা সব-আমলেই বাংলায় একটি সাংস্কৃতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
দুই, রাজনৈতিক হিংসা যে শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হচ্ছে এমন নয়, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিংসাত্মক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই তৃণমূলের সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। ভাদু শেখের মৃত্যুই তার প্রকৃত অর্থে ‘জ্বলন্ত’ উদাহরণ ছিল। রামপুরহাট-বগটুই তার সাক্ষ্য বহন করছে।
তিন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শয়নে-স্বপ্নে কি এই কথাটাই ঘুরে ফিরে আসা উচিত নয়, যে তিনি আসলে বাম আমলের একটি ‘মিরর ইমেজে’ পরিণত হয়েছেন। কারণ, সেই ঔদ্ধত্য যা দীর্ঘ কয়েক দশক প্রকৃত বিরোধীর অভাবে বামফ্রন্টের হয়েছিল, তাই ফিরে ফিরে আসছে তৃণমূলের নেমেসিস হয়ে। আর, বুথস্তরের পাটিগণিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ঔদ্ধত্য বাড়ছে বই কমছে না।
এইসমস্ত প্রতিকূলতা তারা কাটিয়ে উঠতে পারবেন কিনা, তা সময় বলবে। কিন্তু, গান্ধির ‘গ্রাম স্বরাজে’র বীজ থেকে, যে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ নামক স্বদেশি আইডিওলজির বৃক্ষটির জন্ম, যে ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতিকে, কুটিরশিল্পকে রসদ জোগানোর জন্য নির্মিত হয়েছিল, স্বনির্ভরতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক দীক্ষায় গরিব কৃষকজনতাকে দীক্ষিত করার করার কথা ছিল যে বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার, আজ তা ধর্মীয় সংঘর্ষ, জেলা পরিষদের টাকা লুঠ, এলাকা দখলের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রদর্শন ও রাজনৈতিক লুম্পেন নির্মাণের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এর দায় নেবেন কে? মমতা? দিলীপ? সেলিম?…
হয়তো এদের মধ্যে কেউই নন। কারণ, এরা কেউই এই পরিণতিকে বিন্দুমাত্র ট্র্যাজিক মনে করেন না। কারণ, লজ্জা এদের বস্ত্র নয়। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতায়নের সূত্রটিকে আবিষ্কার ও প্রয়োগ করতে পারে স্বতন্ত্র গ্রামসভা, যা হয়ে উঠবে গ্রামের সাধারণ জনতার কণ্ঠস্বর, লাগামছাড়া শোষণের বিরুদ্ধে একরোখা প্রতিরোধ। গণতন্ত্র শাসকেরা আমাদের থেকে ছিনিয়েই নেবেন, এই দুঃসহ সত্যকে মেনে নিয়ে, নিয়ত অনুশীলন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমাদের, আমজনতাকেই— ‘পার্টি সোসাইটি’র ধারণার অবয়বকে ভেঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে।