Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হিংসায় উন্মত্ত গ্রাম— আমাদের ঐতিহ্য যেমন

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


গণতন্ত্র অভ্যাসের ক্ষেত্রে রাজ্য হিসেবে আমরা তাহলে কেমন খতিয়ান রেখে চলেছি? কার চেয়ে ভাল অথবা কার চেয়ে খারাপ, সেই বিতর্কে না গিয়ে রাজনীতি-সচেতন রাজ্য হিসেবে যদি আমরা নিজেদেরকে দাবি করি, তাহলে বোধহয় হিংসা এবং হত্যার তথ্যগুলি মোটেই সেই দাবিকে সমর্থন করে না। আমরা হিংসা বনাম প্রতিহিংসার রাজনীতিকেই নিজেদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরেছি

 

এখনও অবধি সংখ্যাটা ১৫। ৮ জুলাই পঞ্চায়েত ভোট, তার আগে আজ ৫ জুলাই, ২০২৩। ভোট মিটতে এখনও তিনদিন বাকি রয়েছে। তারই মধ্যে এবারের পঞ্চায়েত ভোটের আবহে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে গোনাগুনতি ১৫। গতকাল রাতে খবর শুনতে শুনতে বাড়িতে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, আর কতদিন যেন বাকি রয়েছে ভোটের? শেষ হলে বাঁচা যায়। স্বগতোক্তি অথবা বিরক্তি, যা কিছুই ভেবে নিতে পারেন। আদতে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলাম। আমরা যারা শহুরে ভালমানুষ, আমরা নিজেদের অস্বস্তির বিষয়গুলিকে বিরক্তি দিয়ে ঢেকে নিতে চেষ্টা করি। কাঁহাতক আর রোজ রাত্তিরেই খবরের চ্যানেলে খুন, জখম, হিংসা, মারামারি, হুমকির একতরফা খবর দেখতে ভাল লাগে? অথচ ভোট-মরসুমে বাংলার যে এটাই দস্তুর। নিরবচ্ছিন্ন হিংসাতেই বাংলার ভোট-উৎসব পালন।

বাংলার এই ট্র্যাডিশন আজকের নয় মোটেও। গণতন্ত্রের উৎসব ও হিংসার উদযাপন, বাংলায় হাত ধরাধরি করে চলেছে অনেকদিন। সরল একটা প্রশ্ন মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। গণতন্ত্রের প্রধান দুইটি স্তম্ভ যদি সরকার ও বিরোধী হয়, এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অভ্যাসের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য যদি হয় সঠিকভাবে, সততার সঙ্গে কাজ করে আসা কোনও একটি পক্ষকে নির্বাচন— তাতে স্বাস্থ্যবান কোনও গণতন্ত্রে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে সরকারের বদল হওয়াটাই সুস্থতার পরিচায়ক। এক সরকার আসবে, আরেক সরকার যাবে, আবার কিছু সময়ের ব্যবধানে ক্ষমতাসীন সরকারপক্ষের ত্রুটিগুলি সামনে আসবে। সেই সময়ে আবার পুরনো সরকার অথবা বর্তমান বিরোধীরা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসবে, অথবা নতুন কোনও বিরোধীগোষ্ঠীর উত্থান ঘটবে। মোট কথা গণতন্ত্র এক চলমান অবস্থা। সেখানে স্থবিরতার উপস্থিতি অনুচিত। সেই হিসেবে দেখতে গেলে, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ভারতের অন্য বেশিরভাগ রাজ্যের তুলনায়, গণতন্ত্রের অনুশীলনের ক্ষেত্রে, স্বঘোষিতভাবে সবচেয়ে বেশি করে আমরা রাজনীতি-সচেতন হয়েও, আমরা বাঙালিরা যে দৃষ্টান্ত রেখেছি তা রীতিমতো লজ্জার উদ্রেক করে। আমরা কোনও একটি পক্ষকে ক্ষমতায় নিয়ে আসি। তারপর সেই পক্ষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতা উপভোগের সুযোগ করে দিই। সবশেষে যখন সেই পক্ষ দুর্নীতি অথবা ক্ষমতার মদোল্লাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, একমাত্র তখনই প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে আমরা তাকে গণতান্ত্রিক পথে সরকারের তখত থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে চেষ্টা করি। এর ফলে তিনটি ধাপে হিংসার উদযাপন আমরা দেখতে পাই। প্রথমত দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পক্ষটিকে সরিয়ে নতুন কোনও পক্ষকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, ক্ষমতাসীন পক্ষের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার তাগিদে জারি হওয়া চূড়ান্ত সন্ত্রাস। নতুন পক্ষ ক্ষমতায় এলে পরে, কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের তরফে আবারও ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রত্যেক নির্বাচনী উৎসবেই সাধারণ ভোটারের উপর নামিয়ে আনা সন্ত্রাস। এরপর, আবারও তাঁদের বিদায়ের সময় আসন্ন হলে পরে শেষ একদফা বদল ঠেকানোর সন্ত্রাস। সন্ত্রাস ও হিংসাকে বাদ দিয়ে আমাদের যেন গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আমরা তিনদফায় সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করি, অথবা করতে চলেছি এইবারেও। প্রথম আমরা দেখি নির্বাচন ঘোষণার পর মনোনয়নপর্ব ও প্রচারপর্বের সময় জুড়ে সন্ত্রাস। এবারে এখনও অবধি যার বলি হয়েছেন ১৫জন। তারপর আসে ভোটের দিনে সন্ত্রাস, ও সবশেষে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস। রক্তের কোনও বিরাম নেই।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরে রাজ্য ও তারও পরবর্তীতে গোটা দেশজুড়েই আমরা নতুন কয়েকটি নির্বাচনী বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে দেখেছি। প্রথম হল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জয়লাভ। বিধানসভা অথবা লোকসভার বৃহত্তর নির্বাচনগুলিতে এই বৈশিষ্ট্য তেমনভাবে পরিলক্ষিত না হলেও, নিচুস্তরের নির্বাচনগুলিতে, যেমন কিনা পঞ্চায়েত ও পুর-এলাকার নির্বাচন, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মনে হয় শাসক দলের তরফে যেনবা কর্মীদের কাছে একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলার পঞ্চায়েত ভোট ২০২৩-এরই হিসেব ধরা যাক। সরকারি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ৭৩০০০ পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে প্রায় ১২ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছে। মনোনয়ন জমার পর ৯ শতাংশেরও বেশি পদপ্রার্থী তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল ৩৪ শতাংশ আসনে। ২০১৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় এসেছিল ২৭ শতাংশ আসনে। এই হিসেবে যদি বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বামপন্থীদের দিকে চোখ ফেরানো যায়, তাহলে দেখা যাবে তাদের ৩৪ বছরের শাসনের ইতিহাসে ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছিল। শতাংশের হিসেবে তারা জিতেছিল ১১ শতাংশ আসনে। অর্থাৎ কিনা বর্তমান শাসকের অধীনে তিনবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই অঙ্কের হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের ক্ষেত্রে তাঁরা ভূতপূর্ব শাসকের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছেন। এখানে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করা ভাল— ২০০৩ সালে বাম আমলে রেকর্ড সংখ্যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১১ শতাংশ আসন জিতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল হুগলি ও মেদিনীপুর। এই দুই জেলার সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই তাদের বিদায়ের সূত্রপাত। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বীরভূম জেলায় ৯০ শতাংশ আসনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। এবারে সেই বীরভূমেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা আসনের সংখ্যা ৯০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ‘মাত্র’ ৩০ শতাংশে। বীরভূমের ৯০ শতাংশের কারিগর বর্তমানে রাজ্য ছেড়ে কেন্দ্রীয় আতিথেয়তায় রয়েছেন।

দ্বিতীয় যে নির্বাচনী বৈশিষ্ট্য আমরা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে লক্ষ করে এসেছি, তা হল নির্বাচন-পরবর্তী দলবদলের রাজনীতি। এর পিছনে শাসক দলের তরফে লোভ দেখানো ও পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দুইয়েরই অবদান রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে শুনেছি, সাগরদীঘিতে জিতে আসা বিরোধী বিধায়ক বায়রন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে নাকি ৪০০টিরও বেশি মামলা সাজিয়ে তাঁকে দলবদলের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করে উঠতে পারিনি। কিন্তু রাজ্যস্তরে এমন ঘটনা, ও কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির মাধ্যমে একেকজন করে বিরোধী নেতার উপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের শিবির-বদল ত্বরান্বিত করার ঘটনা একাধিকবারে আমাদের সামনে এসেছে। বিষয়টা, প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতোই এবারেও যে ভোট মিটে যাওয়ার পরবর্তীতে প্রধান হয়ে উঠবে না, তা বলতে পারি না। কিছুদিন আগে অবধিও এই বিষয়টি নিয়ে মনে হত, নির্বাচিত প্রার্থীর আদর্শগত বিচ্যুতির কারণেই এমন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, এবং সার্বিকভাবে রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত চরিত্রের একমুখী ক্ষমতালোভী বৈশিষ্ট্যটিই এর ফলে আরও বেশি করে সামনে আসছে। কিন্তু দলবদলের খেলার পিছনে আরও জটিল যে লোভ ও সন্ত্রাসের দো-ধার তলোয়ারের গল্প লুকিয়ে আছে, তা কেবল সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই জানতে পেরেছি।

আবারও সন্ত্রাসের প্রসঙ্গে ফিরি। অঙ্কের হিসেবে এখনও অবধি বিগত বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায় হিংসার ঘটনার ক্ষেত্রে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন তুলনায় কম রক্তপাত দেখেছে। তথ্য বলছে সন্ত্রাসের ঘটনার ক্ষেত্রে বাম-জমানার ২০০৩ সালের নির্বাচন এখনও অবধি সবচেয়ে হিংসাত্মক নির্বাচন। সেবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট ৭৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তার মধ্যে কেবল মুর্শিদাবাদেই মৃত্যু হয় ৪৫ জনের। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাংলায় প্রাণ হারান ৩৯ জন। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা কিঞ্চিৎ কমে দাঁড়ায় ২৫-এ। সেবারে নির্বাচনের দিন বাংলায় প্রাণ হারান ১২ জন। এবারে ইতিমধ্যেই নির্বাচন-জনিত সন্ত্রাস ও হিংসার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। এখনও ভোটপর্ব, গণনাপর্ব, ও ভোট-পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা।

গণতন্ত্র অভ্যাসের ক্ষেত্রে রাজ্য হিসেবে আমরা তাহলে কেমন খতিয়ান রেখে এলাম? কার চেয়ে ভাল অথবা কার চেয়ে খারাপ, সেই বিতর্কে যেতে চাইব না। কিন্তু রাজনীতি-সচেতন রাজ্য হিসেবে যদি আমরা নিজেদেরকে দাবি করি, তাহলে বোধহয় উপরে রেখে আসা তথ্যগুলি মোটেই সেই দাবিকে সমর্থন করছে না। আমরা হিংসা বনাম প্রতিহিংসার রাজনীতিকেই নিজেদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরেছি। কোন পক্ষ ভাল অথবা কোন পক্ষ মন্দ, সেই বিচারের ভার নির্বাচক জনগোষ্ঠীর হাতেই থাকল, কিন্তু নির্বাচনী হিংসার ক্ষেত্রে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের তরফেই যে প্রত্যক্ষ ও নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দশকের পরে দশক ধরে জারি হয়ে এসেছে, জাতি হিসেবে বা নির্বাচকগোষ্ঠী হিসেবে তাকে সার্বিকভাবে প্রত্যাখ্যান করতে না পারা, আমাদেরই সার্বিক ব্যর্থতা বলে মনে করি। আসলে বোধহয়, গোড়াতে যেমনটা বলে এলাম— এই হিংসা অথবা চুরি-জোচ্চুরি থেকে শুরু করে মারামারি-হানাহানির সবচেয়ে প্রথম ও সবচেয়ে বেশি করে প্রভাব দেখা যায় পঞ্চায়েতে, গ্রামসভায়, জেলা পরিষদে, মিউনিসিপ্যালিটিতে অথবা সমতুল ও শহরকেন্দ্রিক নয় এমন সমস্ত এলাকাতেই। আমরা শহুরে ভদ্দরলোকেরা তখন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা লাশ বা হিংসার ছবি দেখে অস্বস্তি বোধ করি। সেই অস্বস্তি থেকে আসে অবচেতনের অসহায়তা। তার থেকেই জন্ম নেয় এক সাধারণ বিরক্তিবোধ, যা কিনা সামগ্রিকভাবে রাজনীতি বিষয়টাকেই আমাদের ঘৃণার বস্তু করে তোলে। আমরা রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে নিজেদের ব্যর্থতাকেই আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করি। পঞ্চায়েতে এই নিরবচ্ছিন্ন হিংসা ও ভোট-কাড়াকাড়ির দায় আমাদেরকেই তাই প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে বয়ে চলতে হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত