Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গোটা দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিভাজন রুখতেই হবে

সৌমিত্র বসু

 


বিজেপি সরকার সরে গেলেও আরএসএস হিন্দু রাষ্ট্রের লড়াইকে কখনওই বন্ধ বা দুর্বল করবে না। তাই তারা নেমেছে সেই মেইতেই মায়েদের দেশ থেকে উৎখাত করতে, যারা এতদিন ধরে লড়াইয়ের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের কিছু বীজ বপন করেছিল।

 

 

মণিপুরে নারীকে বিবস্ত্র করার ঘটনা এখন দাবানলের মতো অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। একমাসের মধ্যে এমন সব জায়গাতে নারীকে বিবস্ত্র করার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, যে জায়গাগুলোর মধ্যে কোনও জনসম্পর্ক নেই, সেখানেও এই একইরকম ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। মালদার আদিবাসী গ্রামের কোনও মানুষ কস্মিনকালেও মণিপুর দেখেনি, খুব বেশি হলে মেদিনীপুর শুনে থাকতে পারে।

কিন্তু অন্যদিকে এদের মধ্যে একটা খুব বড় সম্পর্ক আছে। প্রতিটি এলাকা হয় বিজেপিশাসিত কিংবা কোনও এক সময়ে বিজেপির অনুপ্রবেশে প্রলুব্ধ হয়ে এলাকার কিছু মানুষ বিজেপির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ বিজেপি অনুপ্রবেশে সাধারণ কথাবার্তায় ‘অপর’ জাতিগোষ্ঠীর ওপরে রাগ আর ঘৃণার ফলশ্রুতিতে এইভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার একটা উপায় এটা। এই বিষয়টি যে মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, পুরোপুরি সংগঠিত, তা ক্রমশই প্রকাশ্য হচ্ছে মানুষের কাছে। মানুষ জেনে গেছে অপরাধী যুথ বা mob-এর কাজ এগুলো, অর্থাৎ এই প্রকরণটি স্বতঃস্ফূর্ত নয়, শেখানো, এবং ঠান্ডা মাথায় সংগঠিত। এই আচরণ কোথা থেকে এসেছে? এসেছে আর্য সংস্কৃতি থেকে। মহাভারতে আমরা দেখেছি, দ্রৌপদী নিজেই অনার্য অর্থাৎ ‘কলুষিত’ হয়েও আর্য বর্ণবিভাজনের পুরীষ আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। আর সেই ‘রাজকীয়’ আর্যরাই একদিন তাকে অপমান করবে ঠিক করল (দ্রৌপদীর আর্য স্বামী জুয়াখেলায় তাকে বাজি ধরে হেরে গিয়ে তাকে বেচে দিল)। আর্যদের ক্ষাত্রধর্মের মধ্যে রাজধর্মে বেনিয়াবৃত্তি ন্যায়সম্মত। স্ত্রী-পুত্র, মাতাপিতা সবাইকে বেচে দেওয়া অপরাধ বলে কখনও গণ্য হত না, তাদের রাজধর্ম সর্বদা রাজা-শ্রেষ্ঠী নির্ধারিত। নারীপণ্য পুঁজিবাদের বহু আগে থেকেই এই আর্য সংস্কৃতির প্রধান অভিমুখ। অতএব তারা সদ্য আর্যধর্মে ‘উন্নীত’ দ্রৌপদীকে বেচে দিতে এক দণ্ডও অপেক্ষা করল না। দাসী হিসেবে বেচে দেওয়া যে আসলে তাকে যৌনদাসী করে দেওয়া– সেটা সম্যক জেনেও তারা এই কাজ করা থেকে পিছপা হল না। রাজমহিষীকে উলঙ্গ করে যৌনদাসীতে পরিণত করা রাজধর্মর কোনও বিপ্রতীপ কাজ বলে মনে হয়নি, কারণ তাদের ধর্মীয় নৈতিকতাতে এ কাজ নিষিদ্ধ ছিল না। আর্য অসভ্যতার উত্তর-আধুনিক রূপ ‘হিন্দুত্ব’ (postcolonial কিন্তু সময়ের বিচারে post-colonial নয় বরং সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন নয়া-ঔপনিবেশিক বা নিও-কলোনিয়াল)। তাই ভারতের যেই যেই বিন্দুতে হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশ ঘটছে, সেখানেই পুরুষতন্ত্র অপেক্ষায় থাকছে অধিকৃত নারীকে বিবস্ত্র করবার জন্যে।

এই প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার যে নারীর উলঙ্গ দেহ পুরুষরতন্ত্রের একটি রাজনৈতিক সামাজিক অভিব্যক্তি যা একটি সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক-সামাজিক শোষণক্রিয়া এবং শোষণপদ্ধতির সাংস্কৃতিক প্রকাশ একেবারে ‘প্রাচ্যের’ নিজস্ব বা আরও বিশেষ করে ভারতীয় (যাকে আজকাল ‘সনাতনী’ হিসেবে প্রশংসিত আর সম্মানিত করা হয়) আর্য পদ্ধতি। আদিবাসীদের মধ্যেকার মূল সংস্কৃতিতে উলঙ্গ নারীশরীরের কোনও সভ্য/অসভ্য বিভাজন ছিল না, এমনকি এক-দেড় শতক আগেও নারীর পোশাক নিয়ে গ্রামীণ মেহনতি মানুষের খুব একটা হেলদোল ছিল না, পরিবারের মধ্যে তো নয়ই, খুব কাছের জ্ঞাতি পরিমণ্ডলেও নয়।

‘আর্য’ শব্দ আর ‘ভদ্র’ শব্দ সমার্থক, যার অর্থই একটা ‘অপর’ বা বিপ্রতীপতা-নির্ভর (এর কোনও ইতিবাচক সংজ্ঞা নেই, বিপ্রতীপতা-নির্ভর, মানে উল্টোটার অর্থেই এর অস্তিত্বের অর্থায়ণ)। ‘অপর’ জনগোষ্ঠী যে বিপরীত এবং সমস্ত গুণাবলীর বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে, তার থেকেই উদ্ভূত সবর্ণ/শূদ্র দ্বানুক বিভাজনের তত্ত্ব, এটাই তো মনুবাদ। অর্থাৎ বিভাজনের এক নৈতিকতাকে বৈধ রূপ দিয়েছিল মনুবাদ বা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, আর তা-ই সনাতনী সমাজে মনু-কৌটিল্যের সংবিধান। পোশাক দিয়ে নারীদেহকে ঢেকে অশ্লীলতার ধারণাকে ভেঙেচুরে শ্লীলতার সংজ্ঞার প্রবর্তন করা হল, তাতে একদিকে যেমন নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখে যৌন-যন্ত্র, প্রজনন-যন্ত্র এবং সেবার যন্ত্র বানিয়ে তোলা হল, অপরদিকে তাকে ‘দেবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তার বাস্তব রক্তমাংসের মনুষ্যরূপকে অস্বীকার করা হল। এই সংবিধানের প্রণয়ন হয়ে গিয়েছিল বহু আগে, সহস্রাব্দ প্রাচীন গুপ্ত রাজত্বে। আজ সেটারই নবায়ন এবং আধুনিকায়ন করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের মধ্যে দিয়ে। হিন্দুত্ববাদ তাই মনুবাদ এবং কলোনিয়াল সংস্কৃতির এক ভয়াবহ মিলন-ফল যার একেকটি চরিত্র পরস্পরকে over-determine বা অতিনিয়ন্ত্রণ করে। কৌতূহলের বিষয়টি হচ্ছে, এর বাস্তবিকীকরণের রূপ দেখা যাচ্ছে যখন একটা ‘বিনির্মিত জাতিসত্তা’ (imagined community) ‘অপর’-এর সঙ্গে ওজুদের [being] প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হচ্ছে, স্বাভাবিক অসামরিক পদ্ধতি দিয়ে যখন প্রতিযোগিতা করা যাচ্ছে না, তখন সামরিক প্রকরণের সাহায্য নিয়েই প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধ দুপক্ষের হয় অর্থাৎ অবশ্যই বিপরীত পক্ষ নিজেরাই নিজেদের প্রস্তুত করে চলেছে এই অসম যুদ্ধের জন্যে। সেই অসমতার একদিকে যেমন আছে রাষ্ট্রের আনুকূল্যে অস্ত্র আর আইন, তেমনি উল্টো দিকে আছে জনসমাবেশ। ঠিক এটাই আমরা দেখছি নাগা-কুকি (কিছুদিন আগে পর্যন্ত এদের আমরা দেখেছি জাত-শত্রু হিসেবে) এবং মিজো বা চিন গোষ্ঠীর মানুষদের ঐক্যের মধ্যে। এক সময়ে এরা কিন্তু ভারত রাষ্ট্র থেকে নিষ্কৃতির জন্যে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, আজ অস্ত্র তুলে নিচ্ছে মেইতেইদের রুখে দিয়ে ব্যাপক জনসমাবেশের মাধ্যমে ইম্ফল অধিত্যকাতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে। বিজেপি থাকলে ইম্ফলের মাদক প্রক্রিয়াকরণের মূল মাফিয়া-নেতাদের (যাদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং অগ্রগণ্য) একচ্ছত্র ক্ষমতা কমবে না, আর এই প্রক্রিয়াকরণের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র এবং লজিস্টিকসের অর্থ এবং যোগাযোগের পথের ক্ষমতা মেইতেইদের হাতেই থাকবে কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ক্ষমতা তাদেরই হাতে থাকবে। গাঞ্জা [marijuana] এবং আফিমের উৎপাদন এখন বহু দেশেই আইনসিদ্ধ। যতদিন বেআইনি থাকবে ততদিন মাফিয়াদের হাতে প্রচুর অর্থ এবং সেই অর্থে উত্তরপূর্বাঞ্চলকে শাসন করা ভারতের বেনিয়া রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে। এই অবস্থায় মেইতেইরা (এককালে তারা যতই বিপ্লবী কাজ করে থাকুক না কেন) মণিপুরের ৩৮টি ছোটখাটো জাতিসত্তা এবং সমগ্র উত্তরপূর্বাঞ্চলের ১২৮টি ছোটখাটো জনজাতিগুলোর স্বাভাবিক শত্রু, আর তাদের এক বানোয়াট ধর্মীয় সংযোগের কাল্পনিক ঐক্য দেখিয়ে আর্য বর্বর-অসভ্যতার ধ্বজা দিয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলকে দমিয়ে রাখা যাবে। মণিপুরে তাই ‘অপর’ জনগোষ্ঠীগুলোর ঐক্যবদ্ধ লড়াই সারা ভারতের ঐক্যের লড়াই, যা বিভাজনের মধ্যে দিয়ে নয় বরং রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের জনসমাবেশের ঐক্যের মধ্যে দিয়ে union of states গড়ার লড়াই অর্থাৎ ভারত মহারাষ্ট্রের-মহাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। ভারতে সর্বত্র নারীরা এখন সাবঅল্টার্নদের কমন (senso communo, সাধারণ ধারণা বা কমন সেন্স নয়) উপাদান। পুরীষ-পুরুষতন্ত্র তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতায়নের শত্রু হিসেবে নারীদের ক্রমশ বেশি বেশি করে আন্দোলনে যোগ দেওয়া এবং এমনকি নেতৃত্বতে চলে আসাকে ভূত দেখার মতো ভয় পাচ্ছে, তারা কিছুতেই এই নিখিল-ভারতীয় বিদ্রোহী শক্তিকে কোনও রকম জায়গা করে দিতে রাজি নয়। নারী-বিদ্রোহের এই আসন্ন আগুয়ান দৃশ্যমান বাস্তবতা (phenomenon)-কে কোনও রকম ছাড় দিলে এদেশে হিন্দুত্বের আর কোনও দিনই স্থান হবে না। আরএসএস কিন্তু লম্বা দৌড়ের দৌড়বীর। বিজেপি সরকার সরে গেলেও আরএসএস হিন্দু রাষ্ট্রের লড়াইকে কখনওই বন্ধ বা দুর্বল করবে না। তাই তারা নেমেছে সেই মেইতেই মায়েদের দেশ থেকে উৎখাত করতে, যারা এতদিন ধরে লড়াইয়ের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের কিছু বীজ বপন করেছিল। আজ তাদের দিয়েই কুকি মহিলাদের গণধর্ষণের প্রকল্পকে তারা জাতি-লড়াইয়ে নামিয়ে আনল, আর বগাবতের বীজকে উপড়ে ফেলার জন্যেই এই কাণ্ড করল। আরএসএস-এর এই প্রকল্পটাকে ধরতে পারলে এবং ঐক্যবদ্ধ জনসমাবেশ ও গণবিদ্রোহের মধ্যে দিয়েই আমরা ভারত থেকে বিভাজনের প্রকল্প ও দর্শনকে চিরতরে উৎখাত করতে পারব।