আমি মণিপুর, আমি রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি চাইছি

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

 


কেন এই উদাসীনতা? কেন তা হলে এতদিন গ্রেফতার করা হয়নি দুষ্কৃতীদের? সেদিন যাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তাঁরা এতদিন চুপ করে থেকে আচমকা ত্রাতার ভূমিকায় নেমে নিন্দায় মুখর হচ্ছেন কেন? কী রাজনৈতিক অভিসন্ধি এর পেছনে? বারবার কেন অপেক্ষাকৃত দূর্বলকেই রাজনীতির ঘুঁটি বানানো হবে, হতেই থাকবে! আর কতদিন, কত যুদ্ধে, কত দাঙ্গায় মেয়েদের নগ্ন করা হবে?

 

সেই ৭৮ দিন ধরে ঠিক কী কী হচ্ছিল? আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় রংবাজি, ঢংবাজি, ছবিবাজি, কবিতাবাজি করছিলাম। বর্ষাকাল নিয়ে রোমান্টিক, আদুরে পোস্ট নামাচ্ছিলাম। ছবি, রিল্‌স, ভিডিও। খিচুড়ি, ইলিশমাছভাজা খাচ্ছিলাম। বিভিন্ন গ্রুপে জিনিসপত্র কিনছিলাম। লেখাপত্র পড়ছিলাম। বিতর্কে অংশ নিচ্ছিলাম। পঞ্চায়েত ভোটের পূর্ব ও পরবর্তী গ্রামবাংলার ভবিষ্যৎ সন্ত্রাস ও অশান্তি বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে-লিখতে, পড়তে-পড়তে টক শো-য় গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচাতে-চেঁচাতে পরস্পরের দিকে থুথু, ঢিল, পাটকেল ছুড়ছিলাম। অথবা সেসব দেখতে না-চেয়ে চ্যানেল পালটে অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের ফাইনাল অথবা সিরিয়াল বা ওটিটি-তে নতুন সিরিজ দেখছিলাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে ক্রমশই যুযুধান প্রতিবেশীর ঘরে আগুন জ্বলতে ও নিভতে দেখে নির্বিকার পুজোর ছুটিতে কাশ্মির বেড়ানোর বুকিং সারছিলাম। বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে শিল্পীদের দুর্দশায় সই জোগাড়ে নাম লেখাচ্ছিলাম। দেশের মাটি থেকে চন্দ্রযান প্রবল পরাক্রমে ছুটে যাওয়ার মুহূর্ত উদযাপন করছিলাম সগর্বে। জগৎসভায় ভারতবাসী হিসেবে নিজেদের মাথা উঁচু হয়ে ওঠার গর্বে সে কী রোমাঞ্চ।

না, ইত্যাকার নানাবিধ ব্যস্ততায় কোনও অপরাধ সংঘটিত আমরা করিনি। কারণ, এগুলো বেঁচে থাকার স্বাভাবিক সাধারণ কার্যপ্রণালীরই অংশবিশেষ। বেঁচে থাকার লড়াই লড়তে-লড়তে, ভাত ছাদ আর পোশাকের নিশ্চয়তায় এইসমস্ত কিছুই আমাদের দাবি আর অধিকার। দেশ নামে যে ভূখণ্ডকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ভাবতে আমরা ভালবাসি, রক্তের ভিতরে আবেগ অনুভব করি, সেই মানচিত্রেরই যাবতীয় গর্বের সম্মানের আলো শরীরে মেখে, মাথা তুলে একাত্মতা বোধ করতে ভালবাসি ভারতবাসী হিসেবে— আমাদের চিন্তায় জাগরণে বোধে আর স্মৃতিতে। এই ৭৮ দিন সময়কালের মধ্যেই, এই গত ৭৮ দিনের মধ্যেই, এই মানচিত্রের মধ্যেই আমার, আমার মায়েদের, আমার মেয়েদের শরীর থেকে কাপড় খুলে মাঝরাস্তায় তাদের বিবস্ত্র করে প্যারেড করাচ্ছিল আমাদের ভারতেরই একটি রাজ্যে কয়েকটি দ্বিপদ প্রাণী, যারা এই দেশেরই নাগরিক।

হ্যাঁ, যখন এই দেশ থেকে পৃথিবীর অভিকর্ষের সীমা ছাড়িয়ে চাঁদের দিকে ছুটে যাচ্ছিল মহাকাশযান, আমরা দেশাত্মবোধক আবেগে জারিত হয়ে ভাবছিলাম, এই-ই তো পরমক্ষণ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পুনরুদ্ধারের— ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, সেই দেশের মাটিতেই, প্রকাশ্য দিবালোকে ভীত-সন্ত্রস্ত-অসহায় আতঙ্কিত মেয়েগুলোর নিকটাত্মীয়দের হত্যা করে তাদের কতগুলি বর্বরের হাতে তুলে দিয়েছিল সেই মানুষেরা, যারা আইনগতভাবে তাদের রক্ষক। অসহায়কে সুরক্ষা দেওয়া, আক্রান্তকে ন্যায়বিচার দেওয়া বা অপরাধীর হাত থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে যাদের রাষ্ট্র নিযুক্ত করেছে পারিশ্রমিক দিয়ে। সেই বর্বরের দল অতঃপর প্রাণের ভয় দেখিয়ে সেই মেয়েগুলোকে প্রকাশ্য দিবালোকে যে নারকীয় নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করে, তা ক্যামেরাবন্দি হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। মেয়েগুলির পরিচয়সমেত। কিন্তু দেশবাসীর কাছে তা গোপন থাকে ৭৮ দিন! মণিপুরদুহিতার এই অবমাননা জাতীয় অপমান ও লজ্জা হয়ে উঠতে সময় নেয় ১৮৭২ ঘন্টা!

একটি রাজ্যে তিনমাস ধরে অশান্তি ও দাঙ্গার আগুন জ্বলতে থাকলেও তা সেই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও দুটি গোষ্ঠীর পারস্পরিক অসহনীয়তার ফলাফল বলে রাষ্টের অদ্ভুত নিরাসক্ত আচরণ একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের স্তম্ভিত করে। এই অশান্তির আগুন নেভানোর দায় তবে কার? সংখ্যালঘু কুকিদের দোষী প্রতিপন্ন করে মেইতেই সম্প্রদায়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত রেখে চলা রাষ্ট্রের কি সত্যিই দায় থাকে না শক্ত হাতে রাশ টেনে এই অসন্তোষের আগুন স্তিমিত করতে উদ্যোগ নেওয়ার? খবরে প্রকাশ, মণিপুরে এমন অসংখ্য ঘটনা নাকি পুলিশে নথিভুক্ত হয়েছে, যার কোনও ন্যায়বিচার তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি প্রশাসনের তরফে। এ কথা জানিয়েছেন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত স্বয়ং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী! প্রশ্ন ওঠে, কেন হঠাৎ প্রায় আড়াই মাস পর এই ভিডিওটি ভাইরাল করা হল? ইন্টারনেট কানেকশন স্তব্ধ করে দেওয়া মণিপুরে এই রেকর্ডিং করা হয়েছিল কোন উদ্দেশ্যে? সাধারণ মানুষের কাছে না-পৌঁছলেও পুলিশ-প্রশাসন, গোয়েন্দা বিভাগ বা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কি খবর ছিল না এই বিষয়ে? রাজ্যপাল জানিয়েছেন, খবর তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন কেন্দ্রের কাছে। জাতীয় মহিলা কমিশন জানিয়েছেন, খবর ছিল তাঁদের কাছেও। একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিকে তাঁরে সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের আর্জিও জানিয়েছিলেন।

তারপরেও কেন এই উদাসীনতা? কেন তা হলে এতদিন গ্রেফতার করা হয়নি দুষ্কৃতীদের? সেদিন যাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তাঁরা এতদিন চুপ করে থেকে আচমকা ত্রাতার ভূমিকায় নেমে নিন্দায় মুখর হচ্ছেন কেন? কী রাজনৈতিক অভিসন্ধি এর পেছনে? বারবার কেন অপেক্ষাকৃত দূর্বলকেই রাজনীতির ঘুঁটি বানানো হবে, হতেই থাকবে! আর কতদিন, কত যুদ্ধে, কত দাঙ্গায় মেয়েদের নগ্ন করা হবে? হ্যাঁ, নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে কোনও মানুষকে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে তার গোপনীয়তা টেনে ছিঁড়ে সারা পৃথিবীর সামনে উলঙ্গ করে রাজপথে হাঁটানো ও সহনাগরিকদের তাতে ইন্ধন জোগানোর ঘটনাই তীব্র অভিঘাত তৈরি করে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী— নারীর প্রতি এই আচরণে মিশে থাকে এক দখলদারির উল্লাস ও বিকৃতি, যা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে আরও কদর্য হয়ে ওঠে। মানুষের পোশাক পরিহিত মানুষ নামক কয়েকটি প্রাণী ইচ্ছেমতো স্পর্শ ও নিপীড়ন করে রাস্তায় হাঁটাচ্ছে কয়েকটি নারীকে, যাদের মাথায় বন্দুক ধরে গা থেকে তারা খুলে নিয়েছে পোশাক, আর তারপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে— এই ভিডিও দেখেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, সারা পৃথিবী জুড়ে। শোনা যাচ্ছে গ্রেফতার হয়েছে একজন। কিন্তু কোন শাস্তি এই প্রবণতা বন্ধ করতে পারে, জানা নেই কারও।

শুধু রাষ্টের কাছে প্রশ্ন রাখা ছাড়া, জবাবদিহি চাওয়া ছাড়া আমাদের যেহেতু কিছু করার নেই আর, তাই জবাবদিহিই চাইছি। দেশ এগিয়ে যাক উন্নয়ন-বিকাশ-প্রগতির গালভরা জ্বালানিতে ভর করে। চাঁদের মাটিতে উড়ুক নিশান। কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে এই ভূখণ্ডে নাগরিকদের সাধারণ চাহিদাগুলো পূরণ করলেও আপনারা দেশপ্রেমের কাজই করবেন— এটুকু মাথায় রাখুন। যে দেশের মাটিতে সব মানুষের লজ্জাবস্ত্র সংস্থান করে ওঠার দায় রাষ্ট্র নেয় না, সেখানে একজনের থেকেও তা কেড়ে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়া চলবে না। ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশের ভিতর দাঙ্গা সন্ত্রাস জিইয়ে রেখে, তা যে কোনও প্রান্তেই হোক না-কেন, তা থেকে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জনপ্রতিনিধিদের কিছু দায়িত্ব থাকে— এ কথা বিস্মৃত হলে মানুষও নিজের দায়িত্ব একদিন না-একদিন বুঝেই নেবে। সে দায়িত্ব ভোটবাক্সের বাইরের— ভোটবাক্সের নিয়ম মেনে না-চলা দায়িত্ব। ভারতের মতো দেশে যে বিভিন্নতা স্বাভাবিক ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সেই বিভিন্নতাকে বিচ্ছিন্নতা হিসেবে টিকিয়ে রেখে নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়ার খেলা যতদিন চলবে, ততদিন বারবার সফ্‌ট টার্গেট হবেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণি, তা সে শ্রেণির চরিত্র যা-ই হোক। সারা পৃথিবীর সামনে বারবার নগ্ন হওয়ার আগে দলমতনির্বিশেষে সমাজের প্রতিনিধিরা কি সচেতন হবেন না আরও? আর যদি সচেতন না-ই হন, তবে কোন কড়িতে তার চরমমূল্য চোকাতে হবে তা-ও কি হিসেবের মধ্যে রাখবেন তাঁরা?

আমি মণিপুর— আমি রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি চাইছি…


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. প্রতিটি বাক্যে সহমত। আমরা ক্রীতদাস হয়ে আছি। কিচ্ছু বলার নেই।কিচ্ছু না।

আপনার মতামত...