Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডি-লিমিটেশন: মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একসের মাংস এবং শিলচরের গল্প

ডি-লিমিটেশন: মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একসের মাংস এবং শিলচরের গল্প | সঞ্জীব দেবলস্কর

সঞ্জীব দেবলস্কর

 


এই যে খণ্ডায়নের রাজনীতি, এর সর্বশেষ ভার্সন হল সাম্প্রতিককালে অসমের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোর পুনর্গঠন প্রকল্প। বরাক উপত্যকার উপর এটা এক চরম আঘাত। বলা হচ্ছে এ সবই হচ্ছে নাকি খিলঞ্জিয়ার স্বার্থে। আরও সুস্পষ্ট করে শোনানো হল ‘ভারতীয় খিলঞ্জিয়ার’ স্বার্থে। খিলঞ্জিয়ার সংজ্ঞাই অদ্যাবধি নিরূপিত হল না, এখন আবার ভারতীয় খিলঞ্জিয়া বলে একটি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হল বুঝি। তবে এই কথাটির মধ্যে ভয়ঙ্কর ইঙ্গিতটি বেশ স্পষ্ট। বরাকের মানুষকে খিলঞ্জিয়া অভিধা লাভ করতে হলে এ সীমানা পুনর্নিধারণের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করা চাই

 

সিরিল র‍্যাডক্লিফ নামক এক ব্রিটিশ প্রশাসকের হাতে স্বাধীনতার প্রাক্কালে একটি ছোরা দিয়ে বলা হয়েছিল অখণ্ড দেশটির মানচিত্র দেখে দেশের দুইটি অঞ্চলের উপর কাটাছেঁড়া করে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের অবয়ব তৈরি করে দিতে। তিনি তাই করে দিলেন। পশ্চিম ভারতের পঞ্জাব আর উত্তরপূর্ব ভারতে বঙ্গ-অসম নিয়ে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের উপর ছুরি চালিয়ে কাজ শেষ করে ভারতবাসীকে নিজের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব দিয়ে সাহেবেরা সাগর পাড়ি দিলেন। সেদিন পশ্চিম প্রান্তে কী ঘটেছিল সে আরেক কাহিনি, আমরা সেদিকে যাচ্ছি না, তবে পূর্বপ্রান্তে যা ঘটেছিল এর অভিঘাত আজও বাঙালির জীবনে সচল। একটা সজীব জাতিকে এ বিভাজন কেমন করে নিষ্প্রাণ, দুর্বল করে দিতে পারে তার প্রমাণ আজ বাঙালির জাতীয় জীবনে অত্যন্ত প্রকট। জাতিটাকে মনেপ্রাণে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে ভিতরে বাইরে নির্বাসিত, দেউলিয়া করে দেওয়ার যে-উদ্দেশ্য সেদিন বিদেশি শাসক এবং তাদের ধামাধরা স্বদেশি অনুগামীদের ছিল, সেই উদ্দেশ্য আশার অতিরিক্তভাবেই সফল হয়েছে, এটা নিশ্চয়ই আজ ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশীয় উত্তরাধিকারীদের আত্মতৃপ্তির কারণ হিসেবে উজ্জ্বল। প্রথমত, বাঙালি হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে যে চরম মানসিক বিভাজন সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল, যা আজ নতুন চেহারায়, নানাভাবে পল্লবিত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে হিংসা-বিদ্বেষের দর্শনের বিস্তার ঘটিয়ে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেছে। ইতিপূর্বে নানা জায়গায় আমি একাধিকবার লিখেছি যে বাঙালি জীবনে দেশবিভাগ একটি চলমান প্রক্রিয়া, যে-প্রক্রিয়া ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে বাঙালির জাতীয় পরিচিতিকে ঝাপসা করে দিচ্ছে, বাঙালির ভারতীয়ত্বকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। যেখানে ভারতের জাতীয় নেতারা একদিন সোচ্চারে ঘোষণা করেছিলেন ‘বাঙালি আজ যা ভাবছে, ভারত তা ভাবছে আগামীকাল’, সেখানে এ-সময়ের জাতীয় নেতা এবং তস্য অনুগামীরা ভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের বিদেশি, বাংলাদেশি, অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আতঙ্কিত উত্তর-পূর্বের বাঙালিদের প্রতি কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত বলেন, ‘এরা নাগাল্যান্ডে, মণিপুরে নিরাপত্তা চাইছেন কেন, তারা তো এখানকার বাসিন্দা হতে পারেন না!’ ওই একই যুক্তিতে দেশের তাবত তাবত নেতারাও অসমে বাঙালিকে ঘুসপেটিয়া ইত্যাদি বলে যান। নানাভাবে পর্যুদস্ত বাঙালি এর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারছে না। এদের প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে দূর করতে বাঙালির তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণিটির সামনে নানা প্রলোভন দেখানো ছাড়াও এদের মনে হিংসার দর্শনকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বিস্তর কার্যসূচিও চালু রয়েছে। ধর্ম এবং ভাষা ছাড়াও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামাজিক স্তর ও শ্রেণিবিন্যাসের উপর গড়ে ওঠা বিভাজনের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার প্রয়াসও প্রকট।

এরই প্রকাশ দেখা গেল সম্প্রতি অসমে নির্বাচন চক্রগুলোর সীমানা পুনর্নিধারণ প্রকল্পে। যদিও কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে নির্বাচন চক্রের সীমা নির্ধারণের নির্ধারিত সময় ২০২৬ সাল, যদিও সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার জন্য জনগণনার সর্বশেষ হিসাব হাতের কাছে এখনও মজুত করা হয়নি, যদিও অসমের নাগরিকপঞ্জি নবীকরণের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলন্ত, তবুও নির্বাচন চক্রের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে নেওয়ার এখনই বুঝি মোক্ষম সময়। এখানে উন্নয়নের প্রশ্নটি একেবারে অবান্তর। ভিন্নতর এক উদ্দেশ্যে এ সীমা নির্ধারণ প্রকল্প। অন্য সব বাদ দিলেও এ সীমা পুনর্নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাঙালির ভাগ্য বিপর্যয় এবং বঞ্চনার ধারাবাহিক ইতিহাস যার সূত্রপাত হয়েছিল সেই ১৮৭৪ সালে। সেদিন বাংলা প্রদেশ থেকে বাঙালিপ্রধান দুটো অঞ্চলকে বের করে এনে নবসৃষ্ট চিফ-কমিশনার শাসিত অসম প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। সেটা ছিল বিদেশি ঔপনিবেশিক স্বার্থে।

এরপর ১৯০৫ সালে হল বঙ্গভঙ্গ। এতে শুধুমাত্র পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য নিয়েই যে ছিনিমিনি খেলা হয়েছিল তা নয়। গোটা বাংলা-বিহার-ওড়িশা নিয়ে যে-বাংলা প্রেসিডেন্সির বিস্তার ছিল, এর ভিতর বাঙালির একান্ত নিজস্ব যে আরেকটি বিশেষ অঞ্চলও ছিল— গোয়ালপাড়া এবং সিলেট-কাছাড় নিয়ে সুরমা উপত্যকা। অসমের বাঙালি জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

সেদিন যে ‘পূর্ববঙ্গ এবং অসম প্রদেশ’ গড়ে উঠেছিল এতে উজান এবং মধ্য (সঙ্গে নিম্ন অসমের কিছু অংশ নিয়ে) অসমের পাঁচটি জেলা নিয়ে সাবেক অসমের সঙ্গে যে-অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছিল সেগুলো মূলত বাঙালি-অধ্যুষিত (সঙ্গে অন্য জনজাতিও ছিল)। ওই সংযুক্তি যদি না হত, তবে স্বাভাবিকভাবেই শিবসাগর-লখিমপুর-শোনিতপুর-কামরূপ-নওগা নিয়ে মোটামুটি এক-ভাষিক রাজ্য হিসেবেই অসমের স্থিতি হতে পারত। কিন্তু ইতিহাস যে অন্য পথে চলে গেল। অবশ্য অসম যে আদিকাল থেকেই অসংখ্য ক্ষুদ্র-মাঝারি জনজাতি অধ্যুষিত ভূমি হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল, এটাও সত্যি এবং আহোমদের পূর্ব থেকে বসবাসকারী চুটিয়া, বরাহি, কচারি, মরান, বড়ো প্রভৃতি জনগোষ্ঠী তো নিজস্ব সত্তায় আজও বিদ্যমান। (প্রসঙ্গটির উল্লেখমাত্রই থাকুক এখানে) বলছিলাম উত্তরবঙ্গ-গোয়ালপাড়া-বড়পেটা-কোচবিহার সীমান্ত নিয়ে নিম্ন-অসম (সম্প্রসারিত) ঠিক সাবেক অসমের (অসমভূমি) সঙ্গে খাপ খায় না। এ অঞ্চল যে ইতিমধ্যেই মুঘল শাসনাধীন সুবে বাংলার অন্তর্গত অঞ্চলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এবং এ সূত্রে বঙ্গদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের মূলভূমির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিতও হয়ে গিয়েছে। এটাও কিন্তু হয়েছে ঔপনিবেশিক স্বার্থে।

বলা প্রয়োজন, যে-মুহূর্তে আদি অসম ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল— সেই ১৮২৬ সালে, এবং সংযুক্ত হল বাংলা প্রেসিডেন্সির সঙ্গে— তখনই তার নিজস্বতায় স্থিত থাকা আর সম্ভব রইল না। স্বাভাবিকভাবেই এ ভূখণ্ড এবং সংলগ্ন অঞ্চলে ভিন্নতর জনগোষ্ঠীদের নিয়েই অসমের রাষ্ট্রনৈতিক মানচিত্রের বিস্তার ঘটল বাংলাপ্রদেশের সীমানা অবধি। এই যে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অসমের অন্তর্ভুক্তি— এর ফলেই অসমকে ভিন্ন প্রদেশের জনগোষ্ঠীর সংস্থান করে দিতে হল। এবং এখান থেকেই মধ্যযুগের খোলস পরিত্যাগ করে আধুনিক অসমের আত্মপ্রকাশ, এটাই ইতিহাস। আর এখানে ঔপনিবেশিক স্বার্থের সঙ্গে অসমের উন্নয়নের স্বার্থও কেমনভাবে জড়িত হয়ে গেল।

ওদিকে নিম্ন অসমের জনবিন্যাস, সমাজ ও রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় বঙ্গদেশ থেকে আগত জনগণ ছাড়াও উত্তর ভারতীয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাগত জনগোষ্ঠীরও ভূমিকা ছিল। মুঘলদের গৌরবের সঙ্গে বারবার প্রতিহত করলেও তাঁদের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছাড়াও উত্তরবঙ্গের জনজাতি, স্বাধীন কোচরাজ্যের অধিবাসী— এদের নিয়েও বর্ণিত অঞ্চলে সমাজগঠন এবং জনবিন্যাস রচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়ে গেল। তাছাড়াও কামরূপ-কোচ-আহোম রাজসভার আনুকূল্যে আগত জনগোষ্ঠী নিয়ে ইতিপূর্বেই একটা মিশ্রিত সমাজের আত্মপ্রকাশ তো ঘটেই ছিল অসমে। এই যে সাবেক অসমের মৌলিক চরিত্রের রূপান্তর, এ প্রেক্ষিতে অসম শুধুমাত্র একটি-জনগোষ্ঠীর বাসভূমি— এ দাবি কী করে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে? আর ওদিকে ভারতীয় মূলভূমি থেকে পূর্বাভিমুখী প্রব্রজনে কৃষকসমাজ, উনিশ শতকের সরকারি কর্মচারী, আমলা, উকিল মোক্তার, ডাক্তার কবিরাজ, মাস্টার নিয়ে যে সমাজকাঠামো তৈরি হল এতে অসমের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ হল মসৃণ। একদিকে চা শিল্পের আত্মপ্রকাশ, আরেকদিকে খনিজ সম্পদের ব্যবহার এবং একই সঙ্গে রেলযোগাযোগ এসব মিলে অসমের সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে যে পরিবর্তন এল তার ফলে অসমের সঙ্গে অপরাপর প্রদেশের ফারাক ঘুচতে থাকল। এ প্রেক্ষিতের পর্যালোচনা ক্রমে ‘Every non-Assamese is a foreigner in Assam’, বা ‘Assam for Assamese’— এ জাতীয় স্লোগান বাস্তবের সঙ্গে কখনই সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে কি? রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে না আসায় জাতিবিদ্বেষের বাতাবরণ পূর্বাপরই সমানই রয়ে গেছে। আজও তাই। আর সমস্যা তো এখানেই।

মোদ্দা কথা হল, অসম কোনও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামিল হয়নি। স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায়ই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ সংযুক্তি। এর পেছনে রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও পৌরাণিক, অধ্যাত্মিক, লৌকিক ঐতিহ্যের অভিঘাতও ক্রিয়াশীল ছিল। এসব বিবেচনায় অন-অসমিয়ার ন্যূনতম অধিকার দিতে অস্বীকৃতি নিতান্তই বালখিল্য আচরণ ছাড়া আর কী হতে পারে?

স্মরণ করা ভাল, ‘অসম-পূর্ববঙ্গ যুক্তপ্রদেশে’র রাজধানী ছিল ঢাকা (অস্থায়ীভাবে গ্রীষ্মকালে শিলং)। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর বাংলাপ্রদেশ থেকে অসমকে ফিরিয়ে আনা হলেও বাঙালি অধ্যুষিত দুটো (না তিনটি, সিলেট এবং কাছাড়কে আলাদা ইউনিট ধরলে) অঞ্চলকে অসমের সঙ্গে রেখে দেওয়া হল। এটা কার স্বার্থে সে দীর্ধ আলোচনাসাপেক্ষ, তবে বাঙালিদের স্বর্থে যে নয় তা স্পষ্ট। এই সিলেট-কাছাড়কে ধরে রেখে সেই তো ‘নন-অ্যাসামিজ ফরেনার’-এর সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা হল। সেটা না হলে কী হত এ চিন্তা এখন অবান্তর, কিন্তু সেটা হওয়াতে যে বাঙালিদের জন্য এ রাজ্যে সামান্য সংস্থান রাখা আবশ্যক হয়ে উঠল, রাজ্য বিধানসভায় এই তথাকথিত বিদেশিদের জন্য কিছু স্থান ছেড়ে দিতে হল, স্কুলকলেজে তাদের ভাষার সংস্থানও রাখতে হল, চাকুরি, কর্মসংস্থানে এদের অধিকার স্বীকার করতেই হল। এ ছিল বাঙালির ভাগ্য নিয়ে তৃতীয়বারের কাটাছেঁড়া। এটা কার স্বার্থে এ প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়, তবে বর্তমান পরিসরে এর স্থান সঙ্কুলান হবে না। এই তৃতীয়বার রাজ্য পুনর্গঠনে বাঙালির বিড়ম্বনার পুনরাবৃত্তি হল, এবং এখানেই শেষ হল না, এরপরও রয়েছে চতুর্থবারের শবব্যবচ্ছেদ। সেটা হল স্বাধীনতার মুহূর্তে। গণভোটের প্রহসন, বাঙালিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সদিচ্ছা সবকিছুর ফলশ্রুতি হিসেবে অবিভক্ত সুরমা উপত্যকার সিলেট জেলাকে (সঙ্গে করিমগঞ্জ মহকুমার একটি অংশ) পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিয়ে অবশিষ্ট বাঙালিকে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল।

এমতাবস্থায় গাঙ্গেয় সমভূমির সম্প্রসারিত ভৌগোলিক অঞ্চল নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক, সামাজিক, লৌকিক সূত্রে বঙ্গদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাছাড় অঞ্চলটিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক চাপের সঙ্গে সংযুক্ত হল আইনি চাপ। তাছাড়াও রয়েছে বাঙালির অস্তিত্বের বৈধতাকে অস্বীকার করার নানা ধরনের কলাকৌশল, এর মধ্যে আবার রয়েছে ভাষাতত্ত্ব, এবং ঐতিহাসিক তথ্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি, জনসংখ্যার হিসেবে গরমিল বাঁধানো, উপত্যকায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহ এবং বিদ্বেষের বীজ ছড়াবার প্রয়াস। ছয়ের দশকে রাজ্যের বহুভাষিক লক্ষণকে অস্বীকার এবং এক-ভাষিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ফলস্বরূপ বৃহত্তর অসমের মানচিত্র হল সঙ্কুচিত। রাজধানী শিলংসহ পুরো খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় অসম থেকে বেরিয়ে গেল, বেরিয়ে গেল নেফা, লুসাই পাহাড়।[1]

এই যে বিশাল রাজ্যটির খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া, এর পেছনে ওই একই কারণ— অসহিষ্ণুতা, ভাষাবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ। এখন আবার টুকরো হয়ে যাওয়া রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা বন্ধনের কথাও শোনা যাচ্ছে। এটা কীসের বন্ধন? ভালবাসার? ঠিক তা বলা যাবে না। মূলত বাঙালিদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার প্রয়াস। মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুরে বাঙালিদের অবৈধ বলে দেগে দেওয়া এবং এদের উপর পীড়ন চালিয়ে যাওয়া এ বন্ধনের পেছনে একটা ক্রিয়াশীল শক্তি।

এই যে খণ্ডায়নের রাজনীতি[2], এর সর্বশেষ, বলা চলে পঞ্চম ভার্সন হল সাম্প্রতিককালে অসমের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোর পুনর্গঠন প্রকল্প। বরাক উপত্যকার উপর এটা এক চরম আঘাত। বলা হচ্ছে এ সবই হচ্ছে নাকি খিলঞ্জিয়ার স্বার্থে। আরও সুস্পষ্ট করে শোনানো হল ‘ভারতীয় খিলঞ্জিয়ার’ স্বার্থে। অবশ্য খিলঞ্জিয়ার সংজ্ঞাই অদ্যাবধি নিরূপিত হল না। এখন আবার ভারতীয় খিলঞ্জিয়া বলে একটি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হল বুঝি। তবে এই কথাটির মধ্যে ভয়ঙ্কর ইঙ্গিতটি বেশ স্পষ্ট। বরাকের মানুষকে খিলঞ্জিয়া অভিধা লাভ করতে হলে বুঝি এ সীমানা পুনর্নিধারণের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করা চাই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে বিবেচনায় না এনেই বিধানসভার ১৫টি আসনকে কমিয়ে আনা হল ১৩টিতে। ভারতীয় এবং খিলঞ্জিয়া হতে হলে আপনাকে এটা সমর্থন করতে হবে। করিমগঞ্জ শহরকে কাটাছেঁড়া করে বদরপুরের সঙ্গে, আর বদরপুরের একটি অংশকে কাটিগড়ার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে, আপনাকে মেনে নিতে হবে। (খিলঞ্জিয়া) ভারতীয় হয়ে ওঠার এ শর্ত বাঙালির সামনে সৃষ্টি করছে এক ধর্মসঙ্কট। দেখা যাক ধর্মের জয় হয় কি না।

এটা তো পরীক্ষিত সত্য বরাকের রাজনৈতিক ক্ষমতা আর বরাকবাসীর হাতে নেই। যদি সামান্য কিছুও অবশিষ্ট থেকে থাকে এ সম্ভাবনা সমূলে উৎপাটিত করার উদ্দেশ্যে যে এই নির্বাচন কেন্দ্র পুনর্নিধারণ এটা বুঝতে অবশ্য আর কারও বাকি নেই।

এই যে গ্রাম শহরকে কাটাছেঁড়া করা, মানচিত্রের উপর যদৃচ্ছা ছোরা চালিয়ে এক স্থানকে অন্য স্থানে সরিয়ে দেওয়া, এটাও যে আরেক বাস্তুচ্যুতি সেটা বোঝার দায় কে নেবে? আমাদের নির্বাক প্রতিনিধিরা, না হতবাক জনগণ?

প্রাচীন শহরটির ঐতিহ্য এবং সে সঙ্গে এর ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রয়াস এখানে একেবারে দিনের মতো স্পষ্ট। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন তো। মানুষ থাকবেন শিলচরে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিনিধি, নেতা নির্বাচন করবেন ভিন্নতর একটি গ্রাম থেকে। টমাস ফিশার প্রতিষ্ঠিত একশো নব্বই বৎসরের প্রাচীন শহরের ভবিষ্যৎ এবং অবস্থিতি একেবারে অনিশ্চয়তার মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে। কীভাবে? দেখুন— স্থানটি হল শিলচর, এর পোস্ট অফিসটি কোথায়? উত্তর: শিলচর। এখন অমোঘ প্রশ্নটি হল— শিলচরটি কোথায়? উত্তর: উধারবন্দ।

আপনাদের মনে পড়েছে কি মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই একসের মাংসের গল্পের কথা? আশা করি পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। মনে করুন সেই গল্পের প্রেক্ষিতটা। পোষা বেড়ালটি একসের মাংস হাপিস করে দিয়েছে শুনে মোল্লা তাকে খপ করে ধরে দাঁড়িপাল্লায় উঠিয়ে দিলেন। দেখা গেল একসের মাংস খেয়ে নিয়েও বেড়ালটির ওজন পুরো এক সের, তখন হতবাক বিবিকে (মাংসটি হাপিস হয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর ভূমিকা তো স্পষ্ট) নাসিরুদ্দিন জিজ্ঞেস করেছিলন ‘এটা যদি মাংস হয়, তবে বেড়ালটি কোথায়, আর যদি বেড়ালই হয়, তবে মাংসটি কোথায়?’ হাসির কথা নয় মোটেই। এমন একটি দিন আসতেও তো পারে যেদিন আমরাও মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মতোই খুঁজে বেড়াব শিলচরটি কোথায়?

 

(১৭ জুলাই, ২০২৩)


[1] এ প্রসঙ্গে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে মণিপুর, নাগাভূমির বিযুক্তির কথাটাও ভুললে চলবে না।
[2] ‘টুকরে টুকরে’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগে আমার রুচি নেই, ওটা যারা করেন তারাই করতে থাকুন।