অসম মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদের নির্দেশনামা ১ এবং ২

সঞ্জীব দেবলস্কর

 



প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট

 

 

 

বিগত মার্চ মাসের ১৭ তারিখ অসম মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদের পক্ষ থেকে বেরিয়েছিল একটি নির্দেশনামা। নতুন শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের সব ক-টি স্কুলে বাধ্যতামূলক অসমিয়া ভাষা চালু করার এ নির্দেশ। সঙ্গে অবশ্য বলা হয়েছিল রাজ্যের ৬ষ্ঠ তফশিলের অন্তর্গত অঞ্চল এবং বরাক উপত্যকাকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ, অসম রাজ্যভাষা আইন ১৯৬০ (সঙ্গে ১৯৬১ সালের সংশোধনী)-এর ৪ নম্বর এবং ৫ নম্বর ধারায় ওই অঞ্চলে বড়ো এবং বাংলা ভাষার জন্য একটা রক্ষাকবচ রয়েছে, যাকে সরাসরি উল্লঙ্ঘন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এই রাস্তায় না গিয়ে ইতিপূর্বে অবশ্য গত বছর অর্থাৎ, ২০২০ সালের মার্চ মাসে অসম বিধানসভায় চটজলদি একটা আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে, ‘অসমিয়া ভাষা শিক্ষা আইন ২০২০’, এবং এর জোরেই জারি হল ১৭ মার্চ ২০২১ তারিখের ওই নির্দেশনামা। আপাতদৃষ্টিতে ‘অসম রাজ্যভাষা আইনের’ প্রতি মান্যতাও দেখানো হল, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সম্ভাবনাও ঠেকিয়ে রাখা গেল। কিন্তু, দুটো অঞ্চলের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়েও অন-অসমিয়াদের জন্য একটা শর্ত রেখে দেওয়া হল। যারা এম-আই-এল হিসেবে নিজের মাতৃভাষা রাখবে তারা ‘ঐচ্ছিক বিষয়’ হিসেবে আর গণিত, বিজ্ঞান, কমপিউটার, সঙ্গীত ইত্যাদি রাখতেই পারবে না। এদের জন্য বিকল্পহীনভাবেই ঐচ্ছিক হিসেবে অসমিয়ার সংস্থান। তাহলে কোনও ঐচ্ছিক বিষয়ের সুযোগই রাখা হল না এ পাঠক্রমে, শুধু ‘ঐচ্ছিক’ শব্দটি অর্থহীনভাবে এখানে জুড়ে রইল। অথচ যাদের মাতৃভাষা অসমিয়া এবং যারা এ ভাষাকে এম-আই-এল হিসেবে নেবে (নেবে না-ই বা কেন) তারা আবার তালিকায় উল্লিখিত আট-দশটা বিষয় থেকে যে কোনও একটিকে ঐচ্ছিক হিসেবে নিতে পারবে (এটাই তো সঙ্গত)। মজার ব্যাপার হল, যাঁদের মাতৃভাষা অন-অসমিয়া (যেমন বাংলা, মণিপুরি, বড়ো, নেপালি ইত্যাদি) তাদের ওপর কোনও জবরদস্তির ব্যাপার নেই, তবে তারা যদি নিজের ভাষাটাকে ছেড়ে অসমিয়া ভাষা এম-আই-এল হিসেবে গ্রহণ করে নেয়, তখন তাদের জন্য নিজের পছন্দমত ঐচ্ছিক বিষয় নিতে কোনও বাধা থাকবে না। এখানে এটাও অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, যারা মাতৃভাষা এম-আই-এল ছেড়ে অসমিয়াই গ্রহণ করবে (বিশেষ করে যারা বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদিতে যেতে ইচ্ছুক), কোনও নির্দেশ না থাকলেও তো তাদের স্বাভাবিকভাবেই কোর-সাবজেক্ট— যেমন সমাজবিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি ওই ভাষাতেই পড়তে হবে। এটাকে সে অর্থে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বললে ওঁরা না-ও মানতে পারেন, কিন্তু এটা যে বিপাকে ফেলে ভিন্নভাষা গ্রহণে বাধ্য করা— তা কি বলা যায় না? যার এম-আই-এল বা এল-ওয়ান-ই বাংলা নয় তাকে কোন যুক্তিতে অন্য বিষয় ওই ভাষায় পড়তে দেওয়া সম্ভব? এ নিয়ে কিছু সংশয় ধ্বনিত হয়েছিল, বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের পক্ষ থেকে শিক্ষাপর্ষদের কাছে ২৬ মার্চ স্মারকলিপিতে এ নির্দেশনামায় বাঙালিসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করার যে প্রয়াস প্রচ্ছন্ন— তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ঠিক ষোলো দিনের মাথায় বেরোল দ্বিতীয় নির্দেশ, শুরুই এরকম বাক্য দিয়ে: ‘ইন পার্শিয়েল মডিফিকেশন অব দ্য আর্লিয়ার নোটিফিকেশন’ (SEBA/AB/26/2020/4, dt 17th March)। এই আংশিক সংশোধনেই আসল কথাটি বেরিয়ে এসেছে কোন রাখঢাক না রেখেই।

ইতিপূর্বে ১৭ তারিখের নির্দেশ সম্বন্ধে নিবন্ধে আমি (৩১ মার্চ ‘দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ’) দেখিয়েছিলাম আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ওই নির্দেশনামায় সুপরিকল্পিতভাবেই ‘অসম রাজ্যভাষা আইনে’ বরাক উপত্যকার জন্য বাংলাভাষার স্বীকৃত অধিকারের ধারাগুলোকে অবিকৃত রেখেই মাতৃভাষার এই বিশেষ (৫ নম্বর ধারা) অধিকার কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রচনা করা হয়েছে। যথারীতি এবারও সেই একই কথা— ‘বড়ো অঞ্চল আর বরাক উপত্যকা এর বাইরে।’ এই ছাড় দিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন এঁরা। আসলে নির্দেশনামার (১৭ মার্চের) দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের বাক্যগুলোও যে ওই আলাদা দুটো অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, এটা এবারও ইচ্ছাকৃতভাবেই ঝাপসা রেখে দেওয়া হল। একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে কোনও ছাড়ই দেওয়া হচ্ছে না। বড়োদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্য একটু পৃথক, কারণ ইতিপূর্বে বড়োভাষাকে রাজ্যের ‘দ্বিতীয় সহযোগী ভাষা’ বানিয়ে একটু আলাদা করে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা এ মুহূর্তে এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করবেন না সঙ্গত কারণেই, ‘আপাতত’ তাঁরা কোনও অসুবিধায় পড়ছেন না (এও একটা পরিকল্পিত ব্যাপার, তবে আপাতত এ বিষয়টি আলোচনার বাইরে থাকুক্‌)।

যা বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল, এ নির্দেশে বাঙালিসহ অপরাপর অন-অসমিয়া ভাষিক গোষ্ঠীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মাতৃভাষা অনুরাগে অসম রাজ্যে কোনও নিষেধ নেই, তবে একটা ‘জিজিয়া’ দিতে হবে। এটা হচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে সর্বমোট ৬০০ নম্বরের ৬টি পত্রের স্থলে এদের নিতে হবে ৭টি। ১০০ নম্বরের এই ৭ম পত্র অর্থাৎ ঐচ্ছিক অসমিয়া ভাষা (‘আবশ্যিক-ঐচ্ছিক’) আসলে একটা ‘জিজিয়া কর’-বিশেষই। ব্যাপারটি এরকম নয় কি— অসমে থাকবে (যেন অসমটা একটা ‘এক-ভাষী’ রাজ্য) আর আমাদের আধিপত্য মানবে না! প্রথম ভাষা (এম-আই-এল) হিসেবে নিজের মাতৃভাষা রাখতে চাও রাখো, তবে মনে রেখো, এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১০০ নম্বরের অসমিয়া ভাষার পাঠ অত্যাবশ্যক।

এতে কোনও বৈষম্যের অভিযোগ উঠত না যদি একটু বুদ্ধি করে অসমিয়া পড়ুয়াদের জন্যও অনুরূপ একটি বিশেষ পাঠের (৭ম-পত্র) সংস্থান রেখে দেওয়া হত— (বাংলা রাখলে তো সোনায় সোহাগা, যদিও অসমিয়া ছেলেমেয়েদের উপর এটা অহেতুক জবরদস্তি হত বলেই আমি মনে করি)— তবে কেউই ভাষিক আগ্রাসনের অভিযোগ তুলতে পারতেন না। কিন্তু শুধুমাত্র অন-অসমিয়া পড়ুয়াদের জোর করে ভাষাশিক্ষা দিতে অসমিয়া ছেলেমেয়েদের উপর আরেকটি ১০০ নম্বরের বোঝা চাপিয়ে দেওয়াটা কোনও অবস্থায়ই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক রেষারেষিটার দায়ভাগ নির্দোষ পড়ুয়াদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নিতান্তই অনুচিত। একেই বলে শিক্ষার রাজনীতিকরণ।

অন-অসমিয়াদের অবশ্য স্তোক দেওয়া হচ্ছে, এই ৭ম পত্রে মার্কস সামান্য কম পেলেও চলবে। কিন্তু ৪৫ শতাংশের বেশি পেলে একটি বিশেষ শংসাপত্র মিলবে। মার্কশিটেও এটা তোলা হবে। এটাকে বলা যেতে পারে উলটো খুড়োর কল। এ প্রলোভন পড়ুয়াদের বিপরীত দিকে ছুটতে প্ররোচিত করবে। কে এত ঝামেলায় যাবে, মাতৃভাষা ছেড়ে দিলেই তো হয়— এধরনের চিন্তা কোনও প্ররোচনা ছাড়াই অন-অসমিয়াদের মনে প্রশ্রয় পাবে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের চালাকি অনুচিতই নয় কি? এটা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট এসব কর্মের পেছনে ভাষাশিক্ষা নয়, আধিপত্য জাহির করাই মুখ্য। এই শর্ত আরোপনের পেছনে একটা গোপন অভিসন্ধিও একেবারে স্পষ্ট। যেখানে অভিভাবকেরা ছ-টি বিষয় পড়াতে গিয়েই হিমসিম খাচ্ছেন, সেখানে আরেকটি, অর্থাৎ সপ্তম বিষয় নিজের সন্তানসন্ততির উপর চাপিয়ে দিতে ক-জনই আর মন থেকে সায় দেবেন? বাংলার (বা অন্য কোনও স্বীকৃত ভাষার) প্রতি ভালোবাসা বুকের ভেতর রেখেও তাকে পরিত্যাগ করলে একশো নম্বরের একটা অতিরিক্ত চাপ থেকে যে মুক্তি মিলবে এ ভাবনা এক বিরাট সংখ্যক অন-অসমিয়াকে মাতৃভাষাবিহীনতার দিকে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করবে নিঃসন্দেহে। এতে অসমিয়া ভাষা বা অসমিয়া জাতির কী উপকার হবে কে জানে, তবে এ রাজ্যের নব্বই লক্ষ বাঙালি ভাষাহারা, সংস্কৃতিবিচ্যুত, ভেতরে বাইরে রিক্ত, ছিন্ন ছিন্নমূল একটি প্রজাতিতে পরিণত হবে। তবে কিছু বাঙালি (বা অন্য ভাষাভাষী) মাথা নত করে এ অন্যায় বৈষম্যমূলক অসাংবিধানিক শর্ত আপাতত মেনে নিলেও সবাই, সব সময়ে, স্থায়ীভাবে এটা মেনে নেবে, তা কি হবে? আর রাজ্যের গরিষ্ঠসংখ্যক অসমিয়া মানুষই কি এ অন্যায় পদক্ষেপে মন থেকে সায় দেবেন? এত সব করে একটি সমৃদ্ধ ভাষাকে বাঁচানোর এ অদ্ভুত অবাস্তব (অমানবিকও) প্রয়াস দেখে একদিন এই অসমেরই অন্যতম মনীষী, অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি (১৯৬৪) মিত্রদেব মহন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এনে ধরণে যদি আমার ভাষা বচাব লাগে, তেন্তে মোক ভাষা নালাগে।’ ইনিই সেই ব্যক্তি, যিনি অসমিয়া জাতিকে দিয়েছেন সেই মাতৃভাষার বন্দনা গীত— ‘চির চেনেহী মোর ভাষা’।

১৮ এপ্রিল, ২০২১

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4655 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...