Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পিছনে কোথাও

মিলান কুন্দেরা

 

তরজমা: পার্থপ্রতিম মণ্ডল

ফ্রানৎস কাফকা ও মিলান কুন্দেরা— চেক বৌদ্ধিক জগতের দুই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। মিলান কুন্দেরার উপন্যাস কতখানি ‘কাফকায়েস্ক’ সেই বিতর্কে না-গিয়েও, এ-কথা মেনে নিতে কোনও অসুবিধা থাকে না যে, কুন্দেরাই কাফকার যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। এই একটা শব্দ, ‘কাফকায়েস্ক’, যা দিয়ে শুধু একটা বিশেষ ধারার সাহিত্য নয়, আধুনিক ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব, এককথায় মানুষের পুরো অস্তিত্বকেই অনুভব করা যায়; তা মিলান কুন্দেরার লেখাকে কীভাবে আকার দিয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু সেই বিতর্কে ঢোকার আগে আমাদের পড়া উচিত, কাফকা সম্পর্কে কী ভাবতেন কুন্দেরা। ১৯৮৬ সালে মিলান কুন্দেরার ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ নামে যে প্রবন্ধ সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয় তার পঞ্চম অধ্যায়ে স্থান পায় Somewhere Behind শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। ১৯৭৯ সালে লেখা এই প্রবন্ধটিতে মিলান কুন্দেরা পাঠককে দেখিয়েছেন, ‘কাফকায়েস্ক’ বলতে তিনি ঠিক কী মনে করেন। ‘দ্য কাস্‌ল’, ‘দ্য ট্রায়াল’-এর মতো কাফকার বিখ্যাত উপন্যাসগুলির এমন গভীর পাঠ পাঠককে চমকে দেয়। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, ব্যক্তিজীবনের বিরামহীন বলাৎকার, আমলাতান্ত্রিক সমাজের জাদুবাস্তবতা— চেকোস্লোভাকিয়া তথা গোটা বিশ্বের ইতিহাসে এইসব ভয়াবহতা কীভাবে সময়ের আগেই রূপকের হাত ধরে উঠে এসেছিল কাফকার লেখায়, তার বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রবন্ধটিতে। প্রবন্ধটি নিয়ে অন্য কোনও আলোচনা না-পড়ে সরাসরি এটি পাঠ করাই বোধহয় পাঠককে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করবে। Somewhere Behind শীর্ষক এই প্রবন্ধটির বাংলা তরজমা এখানে প্রকাশ করা হল।

 

এক

আমার বন্ধু জোসেফ স্কোরেস্কি তাঁর এক বইয়ে এক সত্যি ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন। বেশ কয়েকবছর আগে প্রাগ শহরের এক ইঞ্জিনিয়ার লন্ডনে এক কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হন। ভদ্রলোক লন্ডনে যান। সেখানে অনুষ্ঠানে যোগদান করে তারপর দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার কয়েকঘন্টা পর তিনি যখন নিজের অফিসে বসে আছেন, হঠাৎ সামনে পড়ে থাকা Rude Pravo কাগজটির দিকে তাঁর চোখ চলে যায়। Rude Pravo দৈনিকটি চেকোস্লোভাকিয়ার পার্টির মুখপত্র। যে খবরটির দিকে তাঁর চোখ চলে গিয়েছিল তাতে লেখা ছিল: “চেকোস্লাভিয়ার জনৈক প্রকর্মী লন্ডনে এক কনফারেন্সে সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন তা তাঁর সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমির প্রতি কুৎসাব্যঞ্জক। জানা গিয়েছে, ওই প্রকর্মী পাশ্চাত্যেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

একে তো বেআইনি দেশত্যাগ, তার উপর আবার দেশের বিরুদ্ধে কথা বলা— ব্যাপারটা মোটেই ছেলেখেলা নয়। এ-হেন অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি হতে পারে ২০ বছরের কারাদণ্ড। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। কিন্তু এ-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, কাগজের সংবাদটি তাঁর দিকেই আঙুল দেখাচ্ছে। তাঁর সেক্রেটারি অফিসে পৌঁছে তাঁকে দেখে তো ভীষণ আতঙ্কিত। “কী ব্যাপার, তুমি দেশে ফিরে এসেছ!! মাথামুণ্ডু কিছু তো বুঝতে পারছি না— তোমাকে নিয়ে কাগজে কী লেখা হয়েছে দ্যাখোনি?” সেক্রেটারির চোখেমুখে আতঙ্ক ইঞ্জিনিয়ারের চোখ এড়িয়ে যায় না। কিন্তু কী করতে পারেন তিনি? সময় নষ্ট না-করে তিনি প্রথমেই ছুটে যান Rude Pravo-র অফিসে। খুঁজে বের করেন সেই খবরের সাংবাদিককে। সাংবাদিকমশাই মার্জনা চেয়ে জানান, তিনি বুঝতে পারছেন সমস্যাটা বেশ গুরুতর, কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই। তিনি তাঁর সংবাদের টেক্সটটি পেয়েছেন সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে।

ইঞ্জিনিয়ার তখন দৌড়লেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। সেখানে তাঁকে জানানো হল, হ্যাঁ, সত্যিই একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে কোনও দোষ নেই। কারণ, তারা পুরো রিপোর্টটা পেয়েছে লন্ডন দূতাবাসের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। রিপোর্টটা যাতে সে-ক্ষেত্রে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, ইঞ্জিনিয়ার তাদের সেই অনুরোধ করলেন। না, মন্ত্রণালয় তাকে জানাল, প্রত্যাহার করে নেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তেমন কোনও নিয়ম নেই। তবে তাঁর দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাঁর কিচ্ছু হবে না। বিষয়টি নিয়ে আর কোনও পদক্ষেপ করা হবে না।

কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়র ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। তাঁর মনে হতে লাগল, খুব কাছ থেকে তাঁর উপর নজরদারি করা হচ্ছে। তাঁর টেলিফোনে নিশ্চয়ই আড়ি পাতা হচ্ছে। রাস্তাঘাটেও কেউ বা কারা তাঁর পিছু নিচ্ছে। দুশ্চিন্তা তাঁর অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। শেষপর্যন্ত যথেষ্ট ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি বেআইনিভাবে দেশ ছাড়ারই সিদ্ধান্ত নেন। এবং এইভাবেই সে হয়ে ওঠে এক সত্যিকারের দেশত্যাগী।

 

দুই

যে ঘটনাটির কথা আমি এতক্ষণ বললাম (প্রাগ শহরে এটা যদিও খুব মামুলি একটা গল্প) তা এমন একখানি ঘটনা যাকে আমরা অনায়াসে ‘কাফকায়েস্ক’ (‘kafkaesque’) বলতে পারি। ‘কাফকায়েস্ক’ কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিশেষ গদ্য ও গদ্যকারের ছবি। কিন্তু শব্দটার তাৎপর্য এখানেই যে, কল্পিত বা বাস্তব যে ধরনের পরিস্থিতিকে বোঝাতে আমরা এ শব্দটা ব্যবহার করি তা অন্য আর কোনও শব্দ দিয়ে সম্ভব নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানের কোনও শব্দ দিয়েই এর ভাব প্রকাশ করা যায় না।

‘কাফকায়েস্ক’ বলতে তা হলে আমরা কী বুঝব? আমরা বরং এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আলোচনা করি।

এক: আমাদের আলোচ্য ইঞ্জিনিয়ার চরিত্রটি এমন এক কর্তৃত্বের মখোমুখি দাঁড়িয়েছেন যা এক গোলকধাঁধার মতো। সেই গোলকধাঁধার গলিবারান্দা পার হয়ে তিনি কোনওদিন জানতে পারবেন না, কে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ জারি করেছিল। তাঁর অবস্থাটা তাই আদালতে জোসেফ-কে চরিত্রটির মতোই, বা ‘দ্য কাস্‌ল’ উপন্যসের জরিপকারকের চরিত্রটির মতো। আমাদের এই তিনটি চরিত্রই এমন এক জগতে নিজেদের খুঁজে পায়, যে জগৎ এক বিরাট গোলকধাঁধাবৎ প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। যে প্রতিষ্ঠানকে তারা বুঝে উঠতে পারে না, আবার সেখান থেকে পালিয়েও যেতে পারে না।

কাফকার পূর্ববর্তী ঔপন্যাসিকরা অনেকসময়ই প্রতিষ্ঠানকে এমন এক বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন যেখানে ক্রমাগত ব্যক্তি বা জনগণের স্বার্থের সঙ্গে তার সংঘাত ঘটে চলে। কাফকার লেখায় এই প্রতিষ্ঠান হল এক যন্ত্র যা তার নিজের নিয়মকেই শুধু মান্যতা দেয়। কেউই জানে না— কে, কখন এই নিয়মগুলি সৃষ্টি করেছিল। মানুষের ভালমন্দের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলি খুব একটা বোধগম্যও নয়।

দুই: ‘দ্য কাস্‌ল’-এর পঞ্চম অধ্যায়ে গ্রামের মোড়ল ‘কে’-কে তার ফাইলের দীর্ঘ ইতিহাস শোনায়। সংক্ষেপে তা হল: বছর দশেক আগে এক গ্রামবাসী প্রস্তাব দেয় কাস্‌ল-এর জন্যে এক জরিপকারক নিয়োগ করা হোক। অনুরোধটি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। গ্রামের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় একটি প্রস্তাব তখন পাঠানো হয় প্রথম প্রস্তাবটি বাতিল করার অনুরোধ জানিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত, এই দ্বিতীয় দরখাস্তটি এ-অফিস ও-অফিস ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যায়। অনেক বছর পরে সেটার আবার সন্ধান মেলে, ঠিক সেই বছর যে বছরে ‘কে’ তার আমন্ত্রণপত্রটি হাতে পায়। কাজেই ‘কে’-র গ্রামে আসা ব্যাপারটা একটা ভুলের পরিণাম। তার থেকেও যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, এ উপন্যাসের লজিক অনুযায়ী ‘কাস্‌ল’ ও উল্লিখিত গ্রামই যেহেতু একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ, ‘কে’-র অস্তিত্বটাই এখানে একটা মস্ত ‘ভুল’।

কাফকার বিশ্বে এই ‘ফাইল’ একটা প্লেটোনিক আদর্শের মতো। সেটাই একমাত্র বাস্তব। মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব শুধু মায়ার পর্দায় প্রতিভাত একটা ছায়া। জরিপকারক ‘কে’ এবং প্রাগ শহরের ইঞ্জিনিয়ার সেই ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়। বলা যেতে পারে তারা ছায়ার থেকেও নিকৃষ্ট কিছু— বস্তুত তারা হল একটা ফাইলে রয়ে যাওয়া একটা ভুলের ছায়ামাত্র। যাদের ছায়া হিসেবেও বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।

কিন্তু মানুষের জীবন যদি নিছক একটা ছায়া হয়, যদি প্রকৃত বাস্তব হয় তার বাইরে অন্য কোনও কিছু, এমন একটা জগতের কোনও কিছু যে জগৎ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের, বা সেটা কোনও অমানবিক বা অতিমানবিক জগৎ, তা হলে তো আমাদের সরাসরি ঢুকে পড়তে হয় ধর্মতত্ত্বের বিশ্বে। বস্তুতপক্ষে কাফকার প্রথমদিকের সমালোচকরা তাঁর উপন্যাসগুলোকে ধর্মীয় রূপক হিসেবেই দেখাতে চেয়েছিলেন।

আমার মতে এই বিশ্লেষণ আদৌ সঠিক নয়। (কেন-না, সে-ক্ষেত্রে কাফকা যেখানে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত বাস্তব ছবি এঁকেছেন তাকে আমাদের রূপক হিসেবে ধরে নিতে হয়।) তবে এ-হেন ব্যাখ্যারও একটা অন্য তাৎপর্য আছে। কর্তৃত্ব যেখানে ঈশ্বরতুল্য, সেখানে সে তো তার নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব তৈরি করবেই। যেখানে সে এক ঈশ্বরের মতো আচরণ করে সেখানে সে তার নিজের প্রতি একটা ধর্মীয় অনুভূতি বোধ করবেই। এমন জগৎকে ধর্মতত্ত্বের আলোকে দেখা অবশ্যই সম্ভব।

কাফকা ধর্মীয় রূপক লেখেননি। কিন্তু ‘কাফকায়েস্ক’ (উপন্যাস ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই) তার ধর্মীয় মাত্রার থেকে অবিচ্ছিন্ন।

তিন: দস্তয়ভ্‌স্কির রাসকলনিকভ তার অপরাধের ভার বহন করতে পারে না, আর তাই মানসিক শান্তি পেতে সে সাজা পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ‘অপরাধী নিজেই তার শাস্তির প্রার্থনা করছে’— এ হল তেমনই এক পরিস্থিতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমাদের কাহিনির প্রাগের সেই ইঞ্জিনিয়ার শাস্তি পায় পুলিশি নজরদারির কারণে। এই শাস্তিকে খুঁজে ফিরতে হয় এমন এক অপরাধ, যা কেউ কোনওদিন করেনি। এবং সেই ইঞ্জিনিয়ার যার অপরাধ ছিল বেআইনিভাবে দেশত্যাগ, তাকে শেষ পর্যন্ত সেই বেআইনিভাবে দেশত্যাগই করতে হল। বলা যেতে পারে শাস্তি তার অপরাধকে খুঁজে পেল।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি ঠিক কী, তা বুঝতে না-পেরে, ‘দ্য ট্রায়াল’-এর সপ্তম অধ্যায়ে ‘কে’ তার সমগ্র অতীত জীবনকে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়, ‘সমস্ত খুঁটিনাটি ঘটনা সমেত’। নিজেকে অপরাধী ভেবে ওঠার এই যে প্রক্রিয়া— একটা মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি যা নিরপরাধ এক ব্যক্তির মনেও অপরাধবোধের বীজ বপন করে— এভাবেই তা শুরু হয়। অভিযুক্তকে নিজেই তার অপরাধ খুঁজে বের করার কাজে নেমে পড়তে হয়।

‘দ্য কাস্‌ল’ উপন্যাসে আমেলিয়া একদিন কেল্লার এক অফিসারের কাছ থেকে একখানি অশ্লীল চিঠি পায়। রাগে সে চিঠিটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আমেলিয়ার এই হঠকারিতার জন্যে কাস্‌লকে তার সমালোচনা করার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না। ভয় (এই একই ভয় আমাদের ইঞ্জিনিয়ার দেখেছিল তার সেক্রেটারির চোখে) নিজেই তার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। কাস্‌ল-এর কোনও আদেশ বা বিজ্ঞপ্তির প্রয়োজন পড়ে না। আমেলিয়ার পরিবারকে সবাই এড়িয়ে চলতে শুরু করে, যেন তারা কোনও মহামারিতে আক্রান্ত।

আমেলিয়ার বাবা পরিবারের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা একটাই: শুধু যে এই বিচারের প্রণেতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এমন নয়, বিচারটার নিজেরই কোনও অস্তিত্ব নেই। আদালতে আবেদন করতে গেলে, সেখানে ক্ষমা চাইতে গেলে, আগে তো তোমাকে দোষী সাব্যস্ত হতে হবে। বাবা তাই কাস্‌ল-এর কাছে আবেদন করে অপরাধের কথা ঘোষণা করতে। এটা বললে তাই অতিশয়োক্তি হবে না যে, শাস্তি এখানে অপরাধকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই ছদ্ম-অধ্যাত্মবাদী জগতে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি মিনতি করছে, তার অপরাধটাকে স্বীকার করে নেওয়া হোক।

প্রাগে এটা এখন প্রায়শই ঘটে থাকে যে, কোনও ব্যক্তি নিন্দিত হলে ছোটখাটো কোনও চাকরিও তার জোটে না। নিন্দিত সেই ব্যক্তিটি তখন একখানি শংসাপত্রের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে। এমন এক শংসাপত্র যাতে লেখা থাকবে সে কোনও না-কোনও অপরাধ করেছে আর তাই সে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। তা না হলে, যেহেতু প্রাগের আইন অনুযায়ী চাকরি করাটা বাধ্যতামূলক কর্তব্য সেইহেতু নিন্দিত সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও কাজ না করার অভিযোগ উঠবে। এক্ষেত্রেও শাস্তি ঘোষণা হওয়ার পর শাস্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে অপরাধকে।

চার: প্রাগ শহরের আমাদের এই ইঞ্জিনিয়ারের গল্পটি এক হাসির গল্পের মতো। একটা কৌতুকের মতো। ভদ্রলোক আমাদের হাসির খোরাক।

দুজন ব্যক্তি, সাদামাটা চেহারার একদিন সকালে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই ‘কে’-কে চমকে দেয়। জোসেফ কে-কে তারা বলে যে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লোকদুটো জোসেফ কে-র প্রাতরাশটা পর্যন্ত সাবাড় করে দেয়। ‘কে’ একজন দায়িত্বসচেতন আমলা— ফ্ল্যাট থেকে ঘাড় ধরে লোকদুটোকে বের করে দেওয়ার পরিবর্তে সে তার রাতের পোশাকেই আত্মপক্ষ সমর্থনে দীর্ঘ এক ভাষণ দেয়। ‘দ্য ট্রায়াল’-এর প্রথম পরিচ্ছদটি যখন কাফকা তার বন্ধুদের পড়ে শোনান, তখন সবাই, এমনকী কাফকা নিজেও, হাসিতে ফেটে পড়েন।

ফিলিপ রথ একবার ‘দ্য কাস্‌ল’ নিয়ে এক চলচ্চিত্রের কথা কল্পনা করেন। জরিপকারকের ভূমিকাটি তিনি দেন গ্রুচো মার্কস-কে, আর তার দুই অধস্তনের ভূমিকায় চিকো আর হার্পো। তাঁর ভাবনাটি ছিল যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত— কমেডি আর কাফকায়েস্ক দুই অভিন্ন সত্তা।

কিন্তু সেই ইঞ্জিনিয়ার এই কথা ভেবে মোটেই আনন্দ পান না যে, তাঁর গল্পটা লোককে খুব মজা দিচ্ছে। কাচের জলাধারে বন্দি মাছের মতোই সে তার নিজের জীবনের তামাশাতেই বন্দি। তামাশা তোমার কাছে ততক্ষণই তামাশা যতক্ষণ তুমি সেই আধারের বাইরে আছ। কিন্তু কাফকার কাহিনি আমাদের সেই আধারের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। তামাশার নাড়িভুড়িতে, কমেডির ভয়াবহতায়।

কাফকার কাহিনিতে কমেডি, শেক্সপিয়রের নাটকের মতো, ট্র্যাজেডির কাউন্টারপয়েন্ট নয়— ট্র্যাজেডিকে সহনীয় করে তোলার সেটা কোনও মাধ্যম নয়। ট্র্যাজেডিকে সে সঙ্গ দেয় না। বরং ভ্রূণ অবস্থাতেই সে তাকে মেরে ফেলে এবং হতভাগ্য সেই ব্যক্তিটিকে তার একমাত্র সান্ত্বনা থেকেও বঞ্চিত করে। সেই সান্ত্বনাটি হল ট্র্যাজেডির মহত্ত্বের সান্ত্বনা। ইঞ্জিনিয়ার তার দেশভূমিকে হারায়, আর সবাই তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে।

 

তিন

ইতিহাসে এমন একেকটা সময় আসে যখন জীবন কাফকার উপন্যাসের মতো হয়ে ওঠে।

দার্শনিক কারেল কসিক যখন প্রতিবিপ্লবের অপরাধে অভিযুক্ত হন এবং চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরিটি হারান তখন দলে দলে তাঁর অল্পবয়সী মহিলা ফ্যান তাঁর ফ্ল্যাটকে একপ্রকার ঘিরে ফেলে। অথচ কসিকের যে কখনও খুব মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয়তা ছিল, এমন নয়। রাশিয়ার অনুপ্রবেশের পর কসিকের যৌনজীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে তা দেখে উৎসাহিত হয়ে আমি একবার তাঁর প্রেমে পাগল এক হেয়ারড্রেসার মেয়েকে প্রশ্ন করি। কিছুটা মজা করে, কিছুটা সিরিয়াসভাবে সে উত্তর দেয়: ‘সব প্রতিবাদীরাই তো দারুণ হ্যান্ডসাম।’

আমাদের মনে পড়ে যায় ‘দ্য ট্রায়াল’-এর লেনি চরিত্রটির কথা। হাল্ড নামের যে আইনজীবীর অধীনে সে কাজ করে তার মক্কেলদের প্রতি লেনির যে যৌন আসক্তি তাকে সেও ওই একই কথাগুলি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। ম্যাক্স ব্রড আবার এই জায়গাটা উদ্ধৃত করে কাফকার রচনার ধর্মীয় ব্যাখ্যার প্রয়োজনে। ‘কে’ আরও সুদর্শন হয়ে ওঠে কারণ সে তার অপরাধটা বুঝতে শুরু করে। অনুশোচনা তার চেহারায় সৌন্দর্য এনে দেয়। হেয়ারড্রেসার মেয়েটিকে এই তত্ত্ব শোনালে সে নিশ্চয়ই হাসত। ‘প্রফেসর কে’ কোনও অনুশোচনা ছাড়াই সুন্দর।

কাফকার রচনার বিভিন্ন কল্পচিত্র, পরিস্থিতি, এমনকী পৃথক পৃথকভাবে কোনও কোনও বাক্যও প্রাগের বাস্তব জীবনের সঙ্গে কতখানি মিলে যায় তা লক্ষণীয়!

এ-কথা বলে অনেকেই ভাবতে পারেন যে, কাফকার আঁকা ছবিগুলি প্রাগে এতখানি জীবন্তভাবে অনুভূত এই কারণেই যে, তারা কর্তৃত্ববাদী এক সমাজের পূর্বানুমান।

কিন্তু সেই দাবির একটু সংশোধন প্রয়োজন: কাফকায়েস্ক বলতে আমরা যা বলছি তা কিন্তু সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও ধারণা নয়। কাফকার রচনা শিল্পোন্নত সমাজের কোনও সমালোচনা নয়। শোষণ, একাকিত্ব, বুর্জোয়া নীতিবোধ— এককথায় পুঁজিবাদ তার বিষয় নয়। কাফকার বিশ্বে পুঁজিবাদের কোনও উপাদানই নেই। অর্থের বিষয় সেখানে অনুপস্থিত, অর্থের ক্ষমতাও অনুপস্থিত। বাণিজ্য কর্মসংস্থান, সম্পত্তি, মালিকানা, শ্রেণিসংগ্রাম— এসব কিছুই সেখানে নেই।

কর্তৃত্ববাদের যে সংজ্ঞা তার সঙ্গেও ‘কাফকায়েস্ক’ কথাটির কোনও সম্পর্ক নেই। দল, আদর্শ, রাজনীতি, পুলিশ, সেনা সবকিছুই একইভাবে অনুপস্থিত।

আমরা বরং বলব, ‘কাফকায়েস্ক’ হল মানুষ ও তার বিশ্বের মৌলিক সম্ভাবনা। এমন এক সম্ভাবনা, যা ঐতিহাসিকভাবে স্থির করা হয় না, যা আমাদের সঙ্গে চিরকালীনভাবে চলতে থাকে।

কিন্তু এই সংশোধনসমূহ এটা প্রমাণ করে না কেন প্রাগের বাস্তব জীবনের সঙ্গে কাফকার উপন্যাস মিলে যায় বা কীভাবে অল্পবয়সী হেয়ারড্রেসারদের ইচ্ছেগুলো ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসের থেকে উদ্ধৃতি বলে মনে হয়। আবার এটাও কী করে হয় যে, পারি শহরে সেই একই উপন্যাসকে দেখা হয় লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির দমবন্ধকরা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে! তার মানে কি এই ‘কাফকায়েস্ক’ বলতে যে সম্ভাবনার কথা আমরা বলি তা প্রাগ শহরে যতটা বাস্তব, পারি শহরে ততটা নয়?

আধুনিক ইতিহাসে এমন কিছু প্রবণতা আছে যা সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ‘কাফকায়েস্ক’ ব্যাপারটিকে উপলব্ধ করে তোলে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, তার নিজের উপর ধীরে ধীরে দেবত্বারোপের প্রবণতা, সমস্ত সামাজিক ক্রিয়া আমলাতন্ত্রের অধীনে নিয়ে আসা এবং সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে এক বিরামহীন গোলকধাঁধায় পর্যবসিত করা এবং তার ফলস্বরূপ ব্যক্তিকে যন্ত্রে রূপান্তরিত করা।

এই সমস্ত প্রবণতাবিশিষ্ট কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাফকার উপন্যাসকে বাস্তব জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসে। কিন্তু পশ্চিমে যদি তা সহজে পরিলক্ষিত না হয়, তার কারণ এটা নয় যে গণতান্ত্রিক সমাজ সেখানে প্রাগের চেয়ে কম ‘কাফকায়েস্ক’। আমার মতে, তার কারণ সেখানে বাস্তবের অনুভূতিটাই কার্যত হারিয়ে গেছে।

বস্তুতপক্ষে, গণতান্ত্রিক সমাজগুলিও এই অমানবিকীকরণ ও আমলাতান্ত্রিকতার সঙ্গে পরিচিত। গোটা পৃথিবীটাই এই প্রক্রিয়ার রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে। কাফকার উপন্যাস এই বাস্তবকে এক কাল্পনিক, স্বপ্নে দেখা অতিশয়োক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হল এক গদ্যময় বাস্তবে মূর্ত অতিশয়োক্তি।

কিন্তু কাফকাই কেন প্রথম ঔপন্যাসিক যিনি এই ব্যাপারটা, যা তাঁর মৃত্যুর পর এমন নির্মমভাবে ও এমন স্পষ্টভাবে ইতিহাসের যাত্রাপথে সংঘটিত হল, তাকে ধরতে পেরেছিলেন?

 

চার

কাফকার রাজনৈতিক অবস্থানের কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। সেইদিক থেকে, তিনি সবার থেকে আলাদা। সতীর্থ ম্যাক্স ব্রড, ফ্রান্স ওয়েরফেল, এগন আরউইন বা আভাঁ গার্দ আন্দোলনের অন্যান্য পুরোধারা ইতিহাসের অর্থোদ্ধারের দাবি করে ভবিষ্যতের একটা ছবি কল্পনা করার চেষ্টা করেন। অথচ এটা বিস্ময়ের যে, এই লেখকদের কোনও লেখা নয়, বরং তাঁদের অন্তর্মুখী বন্ধুটির লেখা সাহিত্যই আজ রাজনৈতিক বা সামাজিক ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। সেই কারণেই তা বিশ্বের এক বড় অংশে নিষিদ্ধও। অথচ সে বন্ধুটি শুধু তাঁর জীবন আর শিল্প নিয়েই পড়ে থেকেছেন।

আমার এক বন্ধুর পারিবারিক এক ঘটনা দেখার পর আমি এই রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করি। ১৯৫১ সালে প্রাগে স্তালিনীয় বিচার চলাকালীন আমার এই মহিলা বন্ধুটিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এমন কোনও অপরাধের অভিযোগে যা সে কখনও করেনি। শয়ে শয়ে কমিউনিস্টদের তখন এইরকম অবস্থা। সারা জীবন তারা পার্টির সঙ্গে অভিন্ন জীবন যাপন করেছে। সেই পার্টিই যখন তাদের দণ্ডদাতা হয়ে উঠল তখন জোসেফ কে-র মতোই তারা তাদের পুরো জীবন, পুরো অতীতকে, সমস্ত খুঁটিনাটি সমেত, মূল্যায়ন করতে রাজি হল। অদৃশ্য কোনও অপরাধকে খুঁজে বের করত কাল্পনিক অপরাধের কথা স্বীকার করে নিতে। আমার ওই বন্ধুটি নিজের জীবন বাঁচাতে পেরেছিল কেননা সে এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করার সাহস দেখাতে পেরেছিল। বন্ধুটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও সহায়তা না-করায় শেষপর্যন্ত তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কাজেই মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড জোটে। ১৫ বছর পর ভদ্রমহিলা মুক্তি পেয়ে যায়।

মহিলা যখন গ্রেফতার হয় তখন তার এক বছরের এক শিশুসন্তান ছিল। জেল থেকে যখন সে ছাড়া পেল তখন সেই শিশু ১৬ বছরের তরতাজা কিশোর। ছেলের সঙ্গে এবার সে নিভৃতে, অনাড়ম্বর জীবন কাটাতে শুরু করে। এ-হেন ছেলের প্রতি সে যে একটু বেশিরকমই আসক্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য। সেই ছেলের বয়স যখন ২৬ তখন একদিন আমি তাদের দেখতে যাই। গিয়ে দেখি মা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। কারণটা নিতান্তই মামুলি। ছেলে বেলা অবধি বিছানায় শুয়ে আছে বা এই ধরনের কোনওকিছু। আমি তাকে বললাম: “এই মামুলি বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করছ?”

ছেলেই মার হয়ে উত্তর দিল। “না, মা বাড়াবাড়ি করছে না। আমার মা এক অসামান্য, সাহসী মহিলা। সবাই যেখানে ভেঙে পড়েছে, আমার মা একা প্রতিরোধ করেছে। মা চায়, আমি মানুষের মতো মানুষ হই। এটা সত্যি যে, আমি বেলা অবধি ঘুমিয়েছি। কিন্তু মা যে কারণে শাসন করছে সেটা আরও গভীর। সেটা হল আমার মানসিকতা, আমার স্বার্থপর মানসিকতা। মা যা চায়, আমি তা হতে চাই। তুমি আজ সাক্ষী রইলে, আমি তা হব— আজ প্রতিশ্রুতি দিলাম।”

পার্টি মার ক্ষেত্রে যা করতে পারেনি, মা তার ছেলের ক্ষেত্রে সেটাই করতে পেরেছে। সে ছেলেকে বাধ্য করেছে এক অর্থহীন অভিযোগের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে, ‘তার অপরাধকে খুঁজে বের করতে’, সাক্ষীর সামনে স্বীকারোক্তি করতে। আমি এই স্তালিনীয় মিনি-ট্রায়াল হতভম্ব হয়ে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে যে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া কাজ করে, পারিবারিক প্রেক্ষিতেও সেই একই প্রক্রিয়া কাজ করে।

 

পাঁচ

কাফকার সেই বিখ্যাত চিঠি কাফকা যা তার বাবাকে লিখেছিলেন কিন্তু কোনওদিন পাঠাননি সেটাই প্রমাণ করে, এই অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলার পদ্ধতি, যা কাফকার উপন্যাসে একটি প্রধান থিম, তা তিনি শিখেছিলেন তার পরিবার থেকে, পরিবারে দেবত্ব-অর্পিত পিতামাতা ও ছেলেমেয়েদের ভেতরকার সম্পর্কের থেকে। তাঁর ‘দ্য জাজমেন্ট’ ছোটগল্পটি কাফকার পারিবারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এই গল্পে বাবা ছেলেকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে জলে ডুবে মরার কথা বলে। ছেলে এই কল্পিত অপরাধ মেনে নেয় এবং জলে ঝাঁপ দেয়। ঠিক যেভাবে তার পরবর্তীকালে লেখা উপন্যাসে জোসেফ কে-কে দোষী সব্যস্ত করে এক রহস্যময় সংগঠন এবং তার গলা কেটে ফেলা হয়। এই দুই পরিস্থিতির মধ্যেকার অপরাধ ও শাস্তির যে মিল তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে পারিবারিক ‘কর্তৃত্ববাদ’ থেকে কাফকার সামাজিক দৃষ্টিকোণটি তিনি পেয়েছিলেন।

কর্তৃত্ববাদী সমাজ, তার চূড়ান্ত পর্যায়ে, ব্যক্তিগত এবং সর্বসাধারণের মধ্যেকার সীমারেখাটিকে মুছে দেয়। কর্তৃত্ব নিজে যত অস্বচ্ছ হতে থাকে তত সে জনগণের স্বচ্ছতা দাবি করে। কোনওরকম গোপনীয়তাহীন জীবনই হল আদর্শ পরিবারের দৃষ্টান্ত: একজন নাগরিকের পার্টির কাছ থেকে বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনওকিছু গোপন করার কোনও অধিকার নেই, ঠিক যেভাবে একটি শিশুর কোনও অধিকার নেই তার বাবামা-র কাছ থেকে কোনওকিছু গোপন করার। কর্তৃত্ববাদী সমাজ যে কথাটা বলতে খুব শ্লাঘা বোধ করে তা হল: তাদের সমাজ তো আসলে ‘বড় একটা পরিবার’ই।

এ-কথাটা প্রায়ই বলা হয় যে, কাফকার উপন্যাসে যৌথ জীবনের আর মানুষের সঙ্গলাভের এক প্রগাঢ় বাসনা প্রকাশ পায়। যে এই শেকড়হীন ‘কে’ চরিত্রটি আর কিছু চায় না শুধু তার একাকিত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া ছাড়া। এ-হেন ব্যাখ্যা কেবল অতিসরলীকরণই নয়, তা বিষয়ের অর্থটাকেই সম্পূর্ণ বদলে দেয়।

জরিপকারক ‘কে’ মানুষের মন জয় করতে পথে বের হয় না, মানুষের সঙ্গলাভের উষ্ণতা পাওয়ার জন্যে সে লালায়িত নয়, সার্ত্রের ওরেসটেস-র মতো সে ‘মানুষের মধ্যে মানুষ’ হয়ে উঠতে চায় না। সে তার স্বীকৃতি চায় কোনও গোষ্ঠীর কাছ থেকে নয়, এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। তা পাওয়ার জন্যে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়— তাকে তার একাকিত্ব বিসর্জন দিতে হয়। এটাই তার কাছে নারকীয় অস্তিত্ব— সে কখনও একা হতে পারে না। কাস্‌ল থেকে প্রেরিত দুজন সহকারী সর্বত্র তার পিছু পিছু যায়। এমনকী ফ্রিডা-র সঙ্গে যখন সে সঙ্গম করে তখনও সেই দুজন সেখানে থাকে। কাফের কাউন্টারের উপর বসে তারা নজরদারি করে। আর তারপর থেকে তারা কখনও প্রেমিকযুগলের শয্যা থেকে অনুপস্থিত হয় না।

নিঃসঙ্গতার অভিশাপ নয়, নিঃসঙ্গতার বলাৎকারই কাফকার প্রধান প্রতিপাদ্য!

কার্ল রোসম্যানের জীবন সবাই মিলে নরক করে তোলে। তার জামাকাপড় বিক্রি করে দেওয়া হয়। বাবামায়ের একমাত্র ছবিখানি তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। তার ডর্মিটারিতে ছেলেরা সবসময় মারামারি করে, যখনতখন তার গায়ের উপর এসে পড়ে। দুজন দুষ্কৃতি, রবিনসন আর দেলারোশ তাকে বাধ্য করে তাদের সঙ্গে থাকতে। ব্রুনেল্ডার নিঃশ্বাস তার ঘুমের মধ্যে মেঘগর্জন করতে থাকে।

জোসেফ কে-র কাহিনিও শুরু হয় তার প্রাইভেসির বলাৎকার দিয়ে: অপরিচিত ব্যক্তি দুজন তাকে তার বিছানায় গ্রেফতার করতে আসে। সেইদিন থেকে সে আর কখনও একা হতে পারে না। আদালত তার পিছু নেয়, তার উপর নজরদারি করে, তার সঙ্গে কথা বলে। তার ব্যক্তিগত জীবন একটু একটু করে হারিয়ে যায়। এক রহস্যময় কর্তৃত্ব তা গিলে খায়।

কাব্যি করে যারা গোপনীয়তার অবসানের বা ব্যক্তিগত জীবনের স্বচ্ছতার কথা বলে তারা বোঝে না কী ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়াকে তারা লাগামছাড়া করতে চাইছে। কর্তৃত্ববাদের প্রথম ধাপ হল ‘দ্য ট্রায়াল’-এর শুরুতে যা দেখি সেটা: আচম্বিতে তুমি দেখবে তোমার বিছানার পাশে কেউ হাজির। তারা আসবে ঠিক যেভাবে তোমার বাবা বা মা তোমার শয্যার পাশে এসে দাঁড়াত।

অনেকে জানতে চেষ্টা করেন, কাফকার উপন্যাসগুলো তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রকাশ, নাকি বস্তুগত ‘সামাজিক মেশিন’-এর বর্ণনা। ‘কাফকায়েস্ক’ বিষয়টা হয় ব্যক্তিগত, না হয় সামাজিক ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এমন নয়; বরং তা এই দুই ক্ষেত্রকেই তার আওতায় নিয়ে আসে। যা সামাজিক তা ব্যক্তিগতরই মুকুর, যা ব্যক্তিগত তা সামাজিকেরই প্রতিচ্ছবি।

 

ছয়

আমি যখন ‘কাফকায়েস্ক’-র পিছনে এই বিচ্ছিন্ন অভ্যাসগুলোর কথা বলছি তখন আমি যে শুধু পারিবারিক জীবনের কথা ভাবছি তা-ই নয়, আমি বলতে চাইছি সেই প্রতিষ্ঠানের কথা যেখানে কাফকা কাটিয়েছেন তাঁর পুরো প্রাপ্তবয়স্ক জীবন। সেই প্রতিষ্ঠান হল ‘অফিস’।

কাফকার নায়কদের অনেকসময়ই দেখানো হয় বুদ্ধিজীবীর রূপকাশ্রিত প্রতিমূর্তি হিসেবে। কিন্তু আমরা যদি গ্রেগর সামসা-র কথা ভাবি তা হলে দেখব তার মধ্যে বুদ্ধিজীবীর কোনও সঙ্কট নেই। সে যখন একটা গুবরেপোকায় রূপান্তরিত হয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, তার তখন একটাই চিন্তা: নয়া এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় সে কীভাবে অফিসে যাবে। তার পেশা তাকে যে নিয়মানুবর্তিতা আর আনুগত্যের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলেছে সেটা ছাড়া তার মাথায় আর কোনও ভাবনা নেই। সে এক চাকুরিজীবী, এক কেরানি, এক কর্মী। কর্মী, এমিল জোলার লেখার শুধুমাত্র সামাজিক শ্রেণি অর্থে নয়, এক কর্মী যার মানবিক সম্ভাবনা আছে, একটা মনোভাব। এই আমলাতান্ত্রিক বিশ্বে কোথাও কোনও উদ্যোগ নেই, কোনও আবিষ্কার নেই, কাজের স্বাধীনতা নেই, আছে শুধু আদেশ আর নিয়ম— এ বিশ্ব আনুগত্যের বিশ্ব।

এই কেরানি এক বৃহত্তর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের অংশ, যার উদ্দেশ্য ও দিগন্ত সে কিছুই দেখতে পায় না। এ হল এমন এক বিশ্ব যেখানে সমস্ত অঙ্গভঙ্গিই যান্ত্রিক। যেখানে মানুষ যা করে তার অর্থ বোঝে না।

সর্বশেষে, এই আমলাতান্ত্রিক কেরানির কাজ শুধু কিছু নামহীন ব্যক্তি আর ফাইল নিয়ে— এ এক বিমূর্ত জগৎ।

এ-হেন আনুগত্যময় জগতে, এ-হেন যান্ত্রিক ও বিমূর্ত জগতে যেখানে মানুষের একমাত্র অ্যাডভেঞ্চার বলতে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ছুটে বেড়ানো সেখানে উপন্যাসকে এনে ফেলার কাজটা হল মহাকাব্যে যা করা হয় তার ঠিক উল্টো। আর তাই যে প্রশ্ন উঠে আসে— কাফকা কীভাবে এই একঘেয়ে, বিবর্ণ, অকাব্যিক বিষয়বস্তুকে এমন আকর্ষণীয় কথাসাহিত্যে রূপান্তিত করলেন?

এর উত্তর পাওয়া যাবে কাফকা মিলেনাকে যে চিঠি লিখেছিলেন তার মধ্যে: “অফিস কোনও নির্বোধ প্রতিষ্ঠান নয়, মুর্খামির চেয়ে তা অনেক বেশি স্বপ্নসম্ভব জগতের।” বাক্যটি কাফকার রচনার অন্যতম রহস্যের প্রতি দিকনির্দেশ করে। তিনি দেখেছিলেন যা আর অন্য কেউ দেখতে পাননি— মানুষের জীবন, তার অস্তিত্ব ও তার ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক এই প্রপঞ্চের গুরুত্ব শুধু নয়, বরং (আরও আশ্চর্যজনকভাবে) অফিস নামক এই প্রতিষ্ঠানের ভেতর সুপ্ত থাকা কাব্যিক সম্ভাবনা।

কিন্তু এই যে আমলাতন্ত্র আর কল্পনা বা স্বপ্নসম্ভব জগৎকে এক করে ফেলা হচ্ছে, তার অর্থ কী?

প্রাগ শহরের আমাদের সেই ইঞ্জিনিয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। তাঁর ফাইলের একটা ভুল তাঁকে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে ফেলে; তিনি তাই প্রাগ শহরে ঘুরে বেড়াতে থাকেন আক্ষরিক অর্থেই একটা ছায়ামূর্তির মতো। হারিয়ে যাওয়া শরীরকে তিনি খুঁজে বেড়ান। আর যে দফতরগুলিতে তিনি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান সেগুলিকে মনে হয় অজানা কোনও পৌরাণিক কাহিনির গোলকধাঁধা।

আমলাতান্ত্রিক জগতের মধ্যে এই কাল্পনিককে দেখতে পাওয়ার ফলেই কাফকা এমন একটি কাজ করতে পেরেছিলেন যা এর আগে পর্যন্ত কল্পনাতীত ছিল: তিনি আমলাতান্ত্রিক সমাজের এই চুড়ান্ত অকাব্যিক বিষয়বস্তুকে উপন্যাসের কবিতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। একটি মানুষ কিছুতেই তার প্রতিশ্রুত চাকরিটি পাচ্ছে না (‘দ্য কাসল্’ উপন্যাসের গল্প বলতে প্রকৃতপক্ষে এ ছাড়া আর কিছু নয়) এমন একটি অত্যন্ত সাদামাটা কাহিনিকে তিনি একটা মিথ, একটা এপিকের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তাকে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দান করেছেন।

আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটকে এক মহাবিশ্বের মাত্রা দান করে কাফকা অজান্তেই এমন একখানি ছবি সৃষ্টি করতে সফল হযেছেন যার সঙ্গে তার অজানা এক সমাজের আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। সে ছবি হল আজকের প্রাগের ছবি।

কর্তৃত্ববাদী সমাজ আসলে হল একটা একক বৃহৎ শাসনব্যবস্থা; এবং এখানে সব কাজ যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত, সমস্ত জীবিকাতে সবাই তাই তার কর্মচারী। এক কর্মী তাই এক কর্মী নয়, এক বিচারপতি তাই এক বিচারপতি নয়, এক দোকানদার এক দোকানদার নয়, এক পুরোহিত এক পুরোহিত নয়, তারা সবাই হল রাষ্ট্রের কর্মচারী। ‘আমি আদালতের সঙ্গে যুক্ত,’ গির্জার ভেতর পাদ্রি জোসেফকে বলে। কাফকার আইনজীবীরাও আদালতের কর্মী। আজকের প্রাগে এই কথা শুনলে কেউ অবাক হয় না। ‘কে’-র চেয়ে ভাল কৌঁসুলি আর কেউ পাবে না, কেননা এখানে আইনজীবীরা আসামিদের পক্ষে কাজ করে না, তারা সবাই কাজ করে আদালতের পক্ষে।

 

সাত

গভীর ও ভীষণ জটিল এক বিষয়কে একপ্রকার শিশুসুলভ সারল্যে প্রকাশ ক’রে এরকম একশো চতুষ্পদী শ্লোকের এক রচনায় চেকোস্লোভাকিয়ার মহান কবি যান স্কাসেল লেখেন:

কবিরা কবিতা সৃষ্টি করে না
কবিতা ছিল কোথাও আগের থেকেই
কবিতা সেখানে ছিল অনেক অনেক দিন
কবি শুধু তাকে আবিষ্কার করে।

কবির কাজ হল, তাই, একটা দেওয়ালকে ভেঙে ফেলা যার পিছনে অপরিবর্তনীয় কিছু (‘কবিতাটি’) অন্ধকারে লুকিয়েছিল। আর সে কারণেই, হঠাৎ আবরণমুক্ত হয়ে ‘কবিতাটি’ প্রথমেই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

‘দ্য কাসল্’ আমি পড়েছিলাম যখন আমার পনেরো বছর বয়স। সে বয়সে যদিও তার সব অর্থ, ‘কাফকায়েস্ক’ কথার প্রকৃত তাৎপর্য আমি কিছুই বুঝিনি তবুও প্রথম পাঠে উপন্যাসটি আমাকে যেভাবে বিমুগ্ধ করেছিল তেমন আর করবে না। কিন্তু আমি সেই হঠাৎ আলোকের ছটায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম।

পরে, চোখে যখন সেই আলো সয়ে উঠেছিল তখন আমি সেই আলোতে আমার যাপিত অভিজ্ঞতাকে দেখতে শুরু করি; কিন্তু সেই আলো অদৃশ্য হয়ে যায়নি। ‘কবিতাটি’, যান স্কাসেল বলেছেন, অপরিবর্তনীয় অবস্থায় আমাদের অপেক্ষাতে ছিল ‘দীর্ঘ দীর্ঘ সময়’। অবশ্য এই সদাপরিবর্তনশীল জগতে শাশ্বতের ধারণা কি নিছক অলীক নয়?

না, নয়। মানুষ যা যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তার মধ্যে কেবলমাত্র সেই গুণই থাকতে পারে যা মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই ছিল। কাজেই এটা কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে যে সেই পরিস্থিতি, তার ভেতর নিহিত সমস্ত আধ্যাত্মিক অর্থ সমেত, মানবিক সম্ভাবনা হিসেবে ‘অনেক অনেক আগে’ থেকেই বিদ্যমান ছিল।

কিন্তু সেক্ষেত্রে, কবির কাছে ইতিহাস, যা অপরিবর্তনীয় নয়, তার অর্থ কী?

কবির চোখে, তা সে যতই আশ্চর্য মনে হোক না কেন, ইতিহাসের অবস্থানটা কবির নিজের মতোই। ইতিহাস কিছু তৈরি করে না, সে আবিষ্কার করে মাত্র। কোনও নতুন পরিস্থিতি তৈরি হলে, ইতিহাস দেখিয়ে দেয়, মানুষ কী, তার ভেতর এই ‘অনেক অনেক দিন’ কী সুপ্ত ছিল, তার সম্ভাবনাগুলি কী কী।

কবিতাটি যদি আগে থেকেই থেকে থাকে তাহলে কবি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, একথা বলার আর কোনও মানে থাকে না। না, কবি শুধু মানুষের সম্ভাবনাকে পুনরাবিষ্কার করেন, ইতিহাস যা তার সময় এলে একদিন করবে।

কাফকা কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করেননি। তিনি যা ‘পিছনে কোথাও’ ছিল সেটিকে দেখার কাজটি করেছেন। তিনি জানতেন না, দ্রষ্টা হতে গিয়ে তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও হয়ে উঠেছেন। কোনও সামাজিক সিস্টেমের মুখোশ থুলে দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি শুধু সেইসব প্রক্রিয়ার উপর আলোকপাত করেছিলেন যা তিনি তার ব্যক্তিগত ও মানুষের অনুসামাজিক অভ্যাসগুলি থেকে জানতেন। একবারও ভাবেননি, ইতিহাসের বিরাট রঙ্গমঞ্চে একদিন উদ্ভূত পরিস্থিতি তার সেই প্রক্রিয়াগুলোকে বাস্তবায়িত করবে।

কর্তৃত্বের সম্মোহনী চোখ, নিজের অপরাধ খুঁজে বের করার অদম্য প্রচেষ্টা, বহিস্কার এবং বহিস্কৃত হওয়ার ভয়, একমত হতে বাধ্য হওয়া, বাস্তবের ভয়াবহতা আর আমলাতান্ত্রিক ফাইলের জাদুবাস্তবতা, ব্যক্তিজীবনের বিরামহীন বলাৎকার… এই সমস্তকিছু, ইতিহাস যা তার সুবিশাল রসায়নাগারে মানুষকে নিয়ে পরীক্ষা করেছে, কাফকা উপন্যাসে তা করেছিলেন কয়েক বছর আগেই।

কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বাস্তবতা আর কাফকার কবিতার এই সঙ্গমের একটা রহস্যময়তা চিরকাল রয়ে যাবে এবং তা রয়ে যাবে একজন কবি যা করেন তার প্রমাণ হিসেবেই। কবি যা করেন তার পরিমাপ করা যায় না। এবং তা আপাতবিরোধীও। কাফকার উপন্যাসের যে বিরাট সামাজিক, রাজনৈতিক ও ‘প্রফেটিক’ নিহিতার্থ তা লুকিয়ে আছে একটাই বিষয়ের মধ্যে। তা হল, তারা কোনও উদ্দেশ্যপূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। সমস্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য, মতাদর্শগত ধারণা এবং ভবিষ্যদ্বাণীর উদ্দেশ্য থেকে তারা মুক্ত।

বস্তুতপক্ষেই যদি এমন হয় যে ‘পিছনে কোথাও’ লুকিয়ে থাকা ‘সেই কবিতা’কে খুঁজতে গিয়ে কবি কোনও পূর্বস্থিত সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি কবিতার যথাযথ উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করেছেন। সেই আগের থেকে ধারণা করা সত্য বিপ্লবের না মতপার্থক্যের, খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসের না অবিশ্বাসের, তা বেশি ঠিক না কম ঠিক তাতে কিছু এসে যায় না। একজন কবি যিনি পুনরাবিষ্কারযোগ্য সত্য (চোখধাঁধানো আলো) ছাড়া আর কোনও সত্যের জন্যে কাজ করেন তিনি প্রকৃত কবি নন।

আমি যদি কাফকার প্রকৃত উত্তরাধিকারী হয়েই থাকি, যদি আমি এটাকে আমার ব্যক্তিগত উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করি তার কারণ এটা নয় যে অননুকরণীয়কে অনুকরণ করার (এবং কাফকায়েস্ককে আবার আবিষ্কার করার) প্রয়োজনীয়তা আমি বোধ করি। বরং তার কারণ এটাই যে কাফকার চেয়ে উপন্যাসের (উপন্যাসের মধ্যে নিহিত কবিতার) এই চূড়ান্ত স্বাধীনতার বড় উদাহরণ আর কেউ নেই। এই স্বাধীনতার কারণেই ফ্রানৎস কাফকা (বা বিস্মৃতপ্রায় লেখক হারমান ব্রখ) মানুষের অস্তিত্ব (বর্তমান যুগে যার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি) সম্পর্কে এমন অনেক কথা বলে যেতে পেরেছেন যা কোনও সমাজতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কোনওদিন বলতে পারবে না।