অস্তিত্ব, অতিথি তুমি: মিলান কুন্দেরার আখ্যানবিশ্ব— সপ্তম বর্ষ, তৃতীয় যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

...কুন্দেরার প্রয়াণের পর, তাঁর সাহিত্য নিয়ে একটি সংখ্যার পরিকল্পনা করতে বসে তাঁর উপন্যাস, আখ্যান ও প্রবন্ধের ইতস্তত অপরিকল্পিত পুনঃপাঠ ও এই সংখ্যার সম্ভাব্য লেখকতালিকা নির্মাণ করতে গিয়ে বারংবার টের পেতে হয়েছে এই সত্য যে, সমকালীন বাঙালি তাঁকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে যত চর্চা করেন, তার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তাঁকে তত পড়েন না। ... আমাদের মনে হয়েছে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাদের এই এক মস্ত সুযোগ করে দিয়ে গেলেন তিনি। এমন এক সুযোগ, যখন কুন্দেরার লেখালেখির সঙ্গে বাঙালির অন্তত সামান্য পরিচয় ঘটাতে পারলেও তা হবে এক মস্ত সময়োপযোগী ব্যাপার। সেই ভাবনা থেকেই এই সংখ্যার পরিকল্পনা।...

 

আপাত ঠাট্টা ও তির্যক রসবোধের আড়ালে এক দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্তি— কেবল এইটুকু বললে তাঁর সম্পর্কে আসলে কিছুই বলা হয় না। তরুণ বয়সের কবিতায় কমিউনিজমের প্রতি তাঁর তীব্র প্যাশন কোথাও-কোথাও প্রায় মায়াকভস্কি-সুলভ উচ্ছ্বাসে ভরা, অথচ পরবর্তী জীবনে একের পর এক উপন্যাসে ও আখ্যানে কমিউনিজমের প্রতি তাঁর প্রত্যাখ্যানও প্রায় ততটাই প্রগাঢ়, যদিচ তা স্বভাবসুলভ অনুচ্চকিত শ্লেষ ও বহুস্তর বক্রোক্তিতে পরিপূর্ণ— কেবল এইটুকু পরিচিতির মধ্যেও তাঁকে আঁটানো ঘোরতর অসম্ভব। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মানুষের বেঁচে থাকাকে অভিমুখ দেয় যে মৌলিক প্রশ্নগুলি, তিনি একইসঙ্গে তার উপস্থাপক, অনুবাদক, ব্যাখ্যাতা ও ক্রিটিক— এই পরিচয়ও তাঁর লেখালেখির অতি সামান্য একটি অংশকেই ধরতে পারে। সেরভান্তেস, হাইডেগার, সার্ত্র ও কাফকা-র ভাবনাবিশ্বের এক আধুনিক উত্তরসূরি, যিনি চিন্তায় জটিল, প্রকাশে নৈর্ব্যক্তিক, ভাষাব্যবহারে প্রায়শবঙ্কিম এবং ভাবনার বিস্তারে ঋষিকল্প নিরাসক্তির পরাকাষ্ঠা— না, তিনি, তাঁর সমস্ত নির্মাণ ও নৈঃশব্দ্য নিয়ে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু।

ফলত, তিনি একক। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে সামান্য কয়েকজন লেখক ও আখ্যানকারের হাতে আধুনিক ও আধুনিকোত্তর সাহিত্যের ভাষা ও ভাবনাবিশ্ব গড়ে উঠেছে, মিলান কুন্দেরা সেই নাতিদীর্ঘ তালিকায় প্রথম কয়েকটি নামের একটি। তিনি একক, এ-কথাটি লেখার পরপরই মনে হল— এ-অভিধা আসলে একইসঙ্গে ঠিক এবং ভুল। একক অর্থে যদি এমন কাউকে উদ্দেশ করা হয় যাঁর কোনও পূর্বাপর নেই, তা হলে কুন্দেরা কোনওমতেই একক নন। অথচ, একক কথাটি যদি ইঙ্গিত করে এমন কারও প্রতি যাঁর রয়েছে সম্পূর্ণ একার কলমের জোরে একটি সময়গ্রন্থি ও সাহিত্যবিশ্বের প্রধানতম লক্ষণচিহ্নগুলিকে তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত অনিশ্চয়তাসমেত ধারণ করা ও একইসঙ্গে পরবর্তী অসংখ্য লেখককে সুনিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করার বিরল ক্ষমতা— কুন্দেরা তা হলে এককের মধ্যে একক।

একক, কিন্তু তা বলে সঙ্গীহীন নন। তাঁর লেখা পড়তে-পড়তে আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে চলে তাঁরই সৃষ্ট একাধিক চরিত্র। চলে আগ্নেস (‘ইম্‌মর্টালিটি’), যে “মৃত্যুর কথা না-ভেবেই অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে চলে যায়”; চলে টমাসও (‘আনবেয়ারেব্‌ল লাইটনেস অফ বিইং’), যে “টেরিজা চলে যাওয়ার পর অগ্রপশ্চাৎ না-ভেবেই সোভিয়েত-শাসিত প্রাগ শহরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়”। সঙ্গীহীন নন— কারণ, তাঁর একাধিক উপন্যাসের পাতার পর পাতা জুড়ে দেশত্যাগী মানুষের ভিড়, যারা, ঠিক তাঁর মতোই, দেশ ও দেশহীনতার দুই মেরুর মধ্যে ক্রমাগত পরিক্রমণশীল। এই দেশ ও দেশহীনতার মধ্যে দোলাচল কি কেবল দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ব্যক্তিমানুষের পরিক্রমারই রূপক, নাকি আসলে তা তাঁর চরিত্রদেরই মনোজগতের আশ্রয়হীনতার প্রতীকনির্মাণ— তা নিয়ে অনিবার্য প্রশ্নে আক্রান্ত হতে-হতেই কুন্দেরাকে পড়ে চলতে হয় আমাদের। তাঁকে পড়তে-পড়তেই, আমাদের মনে না-পড়ে পারে না— প্রাগ ও পারির মধ্যে কুন্দেরার নিজের পরিত্রাণহীন পরিক্রমার কথা। কিন্তু, পাশাপাশি তিনি— তাঁর স্বভাবসুলভ ঠাট্টা ও আপাত-নিরাসক্তির মধ্যে দিয়েই যেন বা— আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে থাকেন যে, তাঁর চরিত্ররা আসলে কোনওভাবেই তাঁর সত্তার সম্প্রসারণ নয়— তারা আসলে একটি বিশেষ দেশকালচেতনার মধ্যে স্বাধীনভাবে বিচরণশীল এক-একটি পৃথক সত্তা, যারা একইসঙ্গে সোচ্চারভাবে স্বাধীন; এবং স্মৃতি ও স্মৃতিবিলুপ্তির পারস্পরিকতার মধ্যে নিয়তিতাড়িতভাবে চংক্রমণশীল— সেই অর্থে পরিতাপজনকভাবে পরাধীনও।

কিন্তু, কুন্দেরার সাহিত্যবিশ্লেষণের পরিসর এটি নয়— সে স্পর্ধাও মধ্যমেধার এই পাঠকের নেই। কুন্দেরার প্রয়াণের পর, তাঁর সাহিত্য নিয়ে একটি সংখ্যার পরিকল্পনা করতে বসে তাঁর উপন্যাস, আখ্যান ও প্রবন্ধের ইতস্তত অপরিকল্পিত পুনঃপাঠ ও এই সংখ্যার সম্ভাব্য লেখকতালিকা নির্মাণ করতে গিয়ে বারংবার টের পেতে হয়েছে এই সত্য যে, সমকালীন বাঙালি তাঁকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে যত চর্চা করেন, তার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তাঁকে তত পড়েন না। এ-কথা অবশ্য সুবিদিত যে, বাঙালি যত বলেন পড়েন তার ঢের কম— আরও অনেকানেক সাম্প্রতিক লেখকের রচনাপ্রসঙ্গেই বাঙালির এই শ্রমবিমুখতার কথা প্রাসঙ্গিক। তথাপি, আমাদের মনে হয়েছে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাদের এই এক মস্ত সুযোগ করে দিয়ে গেলেন তিনি। এমন এক সুযোগ, যখন কুন্দেরার লেখালেখির সঙ্গে বাঙালির অন্তত সামান্য পরিচয় ঘটাতে পারলেও তা হবে এক মস্ত সময়োপযোগী ব্যাপার। সেই ভাবনা থেকেই এই সংখ্যার পরিকল্পনা।

মিলান কুন্দেরার সাহিত্য ও তাঁর ভাবনাবিশ্ব নিয়ে এ-সংখ্যায় লিখেছেন একঝাঁক অনতিতরুণ অনতিবৃদ্ধ লেখক, যাঁরা তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার গণ্ডির মধ্যে দাঁড়িয়ে, চোখজোড়া অক্ষম পিচুটি নিয়ে, কুন্দেরাকে পড়েননি; পড়েছেন তাঁদের স্বাধীন ও তর্কপ্রবণ মনোজগতের আলোয়। পড়েছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, তর্ক করেছেন, কখনও বা ভিন্নমত পোষণ করেছেন কুন্দেরার সঙ্গে— আর এভাবেই, এক প্রশ্নসঙ্কুল পাঠপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে, হয়তো বা নির্মাণ করে তুলেছেন কুন্দেরার এক নয়া পাঠও। এমন এক পাঠ, যা তাঁকে পুনরাবিষ্কার করার স্পর্ধা রাখে।

মিলান কুন্দেরার সাহিত্যজগৎ নিয়ে এ-সংখ্যার অনুসন্ধিৎসু ও স্পর্ধাবান নিবন্ধগুলির লেখকরা হলেন শুভদীপ বড়ুয়া, সর্বজিৎ সরকার, কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় ও সায়ন্তন দত্ত। তাঁদের প্রতি আমাদের সনির্বন্ধ ধন্যবাদ। তারই পাশাপাশি, কুন্দেরার ‘সামহোয়্যার বিহাইন্ড’ প্রবন্ধটি বাংলায় তরজমা করে দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন পার্থপ্রতিম মণ্ডল।

এর পাশাপাশি, গল্প, কবিতা, ধারাবাহিক রচনা ও অন্যান্য সকল বিভাগ যথারীতি প্রকাশিত হল। আশা করব, আপনারা মনোযোগ সহকারে সংখ্যার সকল লেখা পড়বেন, এবং তা নিয়ে সুচিন্তিত মতামত জানাবেন।

প্রণামান্তে, ইতি।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...