Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যু: প্রগতিশীলতার নামে অপরাধ ঢাকা চলবে না

মহুয়া সাঁতরা

 


যাদবপুর অন্যরকম, এই আবেগে অন্যায় অপরাধগুলোকে ঢেকে না রেখে, আগে অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকার করে অন্যায়কারীর শাস্তি হোক। অপরাধ করলে পোটেনশিয়াল নোবেল লরিয়েটকেও যে যাদবপুর ক্ষমা করবে না, আগে সেটা কর্তৃপক্ষ করে দেখাক

 

আপনার শুধু কান্না পাচ্ছে? শুধু রাগ হচ্ছে? হাসি পাচ্ছে না? বছরের পর বছর দিনের পর দিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হস্টেলে কী চলে জানা সত্ত্বেও এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেলে সারা পৃথিবী কিছুদিনের জন্য তোলপাড় হয়ে যাওয়ার পরও কেমন করে সব দায় ঝেড়ে ফ্যালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন! এখন এক প্রশাসনিক পদাধিকারী বলেছেন, “মেস কমিটি বেআইনি! এসব নিয়ে আমরা কিছু জানি না।” অথচ বেআইনি মেস তৈরি করে তো টাকা তোলা হয়। কেন জানেন না? না জানাও কি গাফিলতি নয়? মস্তানদের মুক্তাঞ্চল আমরা শুনেছি অনেকবার। কোনওদিন ছাত্রদের গুন্ডামির মুক্তাঞ্চল শুনেছেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে বাতাসে কান পাতুন, শুনতে পাবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলকে বলা হয় কিছু ছাত্র ও প্রাক্তন ছাত্রের মুক্তাঞ্চল। এখানে নিজের ইচ্ছামতো শিক্ষকরাও হস্টেলে ঢুকতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদাধিকারীরা বলেন, হস্টেলে গেলে এমন বাপ-মা-বউ-বাচ্চা তুলে গালি দেয় ছাত্ররা যে তাঁরা হস্টেলে ঢোকার সাহস আর করেন না। প্রায় সবারই মত, মানসম্মান নিয়ে মানে মানে চাকরিজীবনটা কাটাতে পারলে হয়! আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা? তাঁরা একতলা থেকে অন্যতলায় উঠতেই পারেন না। ‘অনুমতি’ নেই!

হস্টেলে সিট পাওয়া যায় না। জানেন না? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যাওয়ার পরেও হস্টেলে জোর-জবরদস্তি থাকেন প্রাক্তন ছাত্ররা, কে জানেন না? তারা বেআইনিভাবে মেস-কমিটি চালায়, টাকা নিয়ে হস্টেলের সিট বিক্রি করে, কে জানেন না? জুনিয়রদের ওপর হস্টেলে সবরকম নির্যাতন আছে, যার পোশাকি নাম র‍্যাগিং। কে জানেন না? কে কবে তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন? কেউ কি টুঁ শব্দটি করেছেন কখনও? এখন চোখে দেখতে পান না এমন ছাত্রছাত্রীরা বলছেন, তাঁদের ওপরেও অত্যাচার হয়। অনেক ছাত্রী সমাজমাধ্যমে লিখছেন যে শুধু হস্টেল নয়, বিভাগেও নানা ধরনের অসম্মানের ব্যবহার লুকিয়ে থাকে। তাঁরা বলতে পারেন না। কেন বলতে পারেন না? কারণ জানালে লাভ হবে না বলে তাঁদের ধারণা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বেশিররভাগ ক্ষেত্রে এই ডিসিপ্লিনের বিষয়টা নিশ্চিত করেছে যে কারও বিরুদ্ধে কোনও নির্যাতন বা অভব্য ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার আর এইসব প্রতিষ্ঠানে স্থান নেই।

যাদবপুরে কেউ কি এর প্রতিবাদ কখনও করেছিলেন?

হ্যাঁ করেছিলেন। ২০১৩ সাল মনে পড়ে? শৌভিক ভট্টাচার্য তখন উপাচার্য। র‍্যাগিং-এর অভিযোগে দুই ছাত্রকে একবছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই সাসপেনশনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল পড়ুয়া ৫২ ঘণ্টা উপাচার্যকে ঘেরাও করে রেখেছিল। পদত্যাগ করে চলে যান শৌভিকবাবু। কেউ প্রতিবাদ তো করেনইনি, উলটে এক বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী কিছু শিক্ষকের মদত ছিল এই ঘেরাও-এ। ছাত্রদের সাসপেনশনও উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল পরে। যাঁরা আজ কান্নাকাটি করছেন তাঁরা কেউ সেই সাসপেনশন উঠিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন সেদিন?

ঠিক তার পরের বছর। ২০১৪ সাল। এক ছাত্রীর ওপর যৌন নির্যাতন, গায়ে মদ ঢেলে দেওয়া সহ নানা অভিযোগের যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে কমিটি যে যে রেকমেন্ডেশন দিয়েছিল তার মধ্যে সিসিটিভি বসানো সহ অনেক কিছু ছিল। তখনই দেখা গেছিল হস্টেলে বহিরাগতদের ভিড়। রেজিস্টার আছে। কিন্তু তাতে কেউ সই করে না। যারা হস্টেলে বাইরে থেকে আসে হস্টেলের সব্বাই তাদের ভয় পায়। কিন্তু কিছু অধ্যাপক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সেদিন কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, সিসিটিভি হল মরাল পুলিশিং! যাদবপুরে এসব চলবে না। যাদবপুরীয় কায়দায় তাঁরা কেউ কেউ আকাশের নিচে ক্লাস নিতে শুরু করলেন। তখনকার উপাচার্য নিজে তাঁর অফিসের সিসিটিভি উঠিয়ে দিয়ে খবরের শিরোনামে এলেন।

কিন্তু কারণটা কী? সব্বাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই গুন্ডামি মেনে নেন কেন? শুধু মেনে নেন না, প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেন। কেন?

কারণ, এক, দশকের পর দশক ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সযত্নে এক আশ্চর্য ও অন্যায়ের বাতাবরণ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে এখানে পাণ্ডিত্য, লেখাপড়া ও এনলাইটমেন্টের চাষ হয়, তার সঙ্গে এসব অন্যায় বেশ মানানসই। মানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়তে আসবেন তাঁরা প্রতিভাবান, এবং তাঁদের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা উচ্ছৃঙ্খলতা অসততা বদমাইশি গুন্ডামি করার লাইসেন্স আছে। নিয়ম-নীতি বলবৎ করতে গেলেই কখনও বলা হবে নীতিপুলিশগিরি করা হচ্ছে, না হয় বলা হবে ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।

দুই, কেউ এর প্রতিবাদ করেননি, করেন না, কারণ তাহলে জনপ্রিয়তা হারাতে পারেন।

তিন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুবছরের প্রগতিশীল আন্দোলনের চাট-মশলা। যে আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মদত দিয়েছে বেশিরভাগ সময়। এই আন্দোলন সবসময় বলেছে সমাজ সংসার যৌনতা সম্পর্কে যদি তোমার ‘ছক’ভাঙা মতবাদ না থাকে, তবে তুমি প্রগতিশীল নও। আর এই ‘ছক’ ভাঙারও একটা নির্দিষ্ট ‘ছক’ আছে।

চার, চরম পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার চাষ। যেটা ভাঙার চেষ্টা তো হয়ইনি, উলটে মদত দেওয়া হয়েছে। এই যে ‘পুরুষ’ প্রমাণ করার ও ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠার ভয়ানক ট্র্যাডিশন সমানে চলছে, এ তো ম্যাস্কুলিনিটি তত্ত্বের পাতায় পাতায় পরিষ্কার লেখা আছে, সে তো সবাই জানেন।

এ তো গেল ছেলেদের হস্টেলের কথা। এই নিষ্ঠুর অত্যাচারের খবর ছেলেদের হস্টেল থেকেই বেশি ভেসে আসে বটে। মৃত্যুও সেখানে ঘটেছে। কিন্তু সম্প্রতি এই ঘটনার পর অনেকে প্রাক্তনী যখন নিজের কথা বলতে শুরু করেছেন, তখন সমাজমাধ্যমে এক যাদবপুরের প্রাক্তন ছাত্রী লিখেছেন কীভাবে মেয়েদের হস্টেলে যৌন নির্যাতন করা হয় নবাগতদের। পিতৃতান্ত্রিকতা যে মেয়েরাও কী কদর্যভাবে বহন করে করে, সে তো আমরা জানি। কেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক উচ্চপদে আমরা কখনও সেভাবে কোনও মহিলাকে পাইনি, পাই না কেন? বিশেষত যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্রীদের বিদ্যায় বুদ্ধিতে বিশ্বজোড়া নাম?

এই তথাকথিত প্রগতিশীলতায় মদত দিতে দিতে বিষয়টা এমন জায়গায় গ্যাছে যে একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন একজন প্রাক্তন ছাত্রের নাম। যাকে বলাই হয় যে সে-ই আসলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চালায়। প্রাক্তন ও বর্তমান কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় না থাকলে এমন কথা শুনতে পাওয়া যায়? সেদিন ছেলেদের হস্টেলে ঘটনাস্থলে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে পিএইচডি করছে ও পাশ করে গিয়ে চাকরি করছে এমন প্রাক্তনীরাও আছে বলে অভিযোগ।

যেকোনও ঘটনা ঘটলে তার সমাধানের চিন্তা দুভাবে করা যায়। এক, আশু পদেক্ষেপ। দুই, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকার। যদি জানতে হয় সে রাত্তিরে ঠিক কী হয়েছিল, তাহলে কর্তৃপক্ষকে তো আগে নিজের কথা কম ভেবে হস্টেলের কর্মচারীদের সত্যি কথা বলার জন্য সাহস দিতে হবে। তাঁদের পাশে থাকতে হবে যে সত্যি কথা বললে তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না। আর নিজেদেরও সত্যিটা বলতে হবে। তারপর আসছে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারের চিন্তা। কোন মানসিকতা থেকে বছরের পর বছর এমন নির্যাতন চালাতে চায় এমন উচ্চশিক্ষিতরা, তার উৎস সন্ধান এবং পদক্ষেপ। শুধু ভাবছি যে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি অঙ্ক নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। এরপর কী করতেন তিনি? পিএইচডি? বিদেশে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যেতেন তারপর? বিরাট অঙ্কবিদ হতেন তো? কী শিক্ষা দিতেন? তার সঙ্গে যারা জীবন কাটাচ্ছে বা কাটাবে তাদের সঙ্গে তিনি কী ব্যবহারটা করেন বা করবেন জীবনভর? এইসব নিষ্ঠুরতার উৎস হিসেবে উঠে আসছে ছোটবেলা থেকে ভয়ানক গার্হস্থ্য সমস্যার মধ্যে বেড়ে ওঠার কথা, ছোট থেকেই লিঙ্গ, সামাজিক লিঙ্গ নিয়ে অপরিষ্কার ও ভুল ধারণার কথা। কেউ বলছেন ছোটবেলা থেকে এই যে সবকিছু এমনকি অত্যাচারও মুখ বুজে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়, মেনে নেওয়াই সাফল্য ও শান্তির উৎস বলা হয়, সেই মানসিকতাই একরাশ স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুরে পড়তে আসা ছেলেটির প্রাণ কেড়ে নিল। সব অত্যাচারের মূলেই পাওয়ার স্ট্রাকচার এবং কোনও অত্যাচারই যে সহ্য করার নয়, এই শিক্ষা আমাদের সমাজব্যবস্থা সাধারণ পারিবারিক কাঠামোয় দেওয়াই হয় না। ঠিকই তো। হয় না। আর মেয়েদের জন্য বরাদ্দ? সে তো আবার আরেক গল্প। আচ্ছা কলকাতা শহরেই আরও বেশ কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলিও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও প্রতিভার জন্ম দিয়েছে। সেখানে তো এরকম বারবার অপরাধ ঘটে না আর যদি বা ঘটে সবাই একযোগে তার প্রতিবাদ করে। যাদবপুরের মতো আবার নানা অংশে ভাগ হয়ে সেই অপরাধকে আড়াল করার জন্য কেউ আন্দোলনে নামে না।

আরও একটা প্রশ্ন। যাঁরা সামাজিক ক্ষেত্রে ও মনস্তত্ত্ব জগতে বড় বড় নাম তাঁদের অনেকেই যাদবপুরের প্রাক্তনী। তাঁরা তো জানেন কী চলে! মাঝেমাঝেই তো এই অত্যাচারের খবর গ্যাঁজলার মতো ওপরে উঠে আসে। তাঁরা কখনও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাজ করার কথা ভেবেছেন?

কাজেই যাদবপুর অন্যরকম, এই আবেগে অন্যায় অপরাধগুলোকে ঢেকে না রেখে, আগে অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকার করে অন্যায়কারীর শাস্তি হোক। অপরাধ করলে পোটেনশিয়াল নোবেল লরিয়েটকেও যে যাদবপুর ক্ষমা করবে না, আগে সেটা কর্তৃপক্ষ করে দেখাক। তবেই আসল ‘ছক’ ভাঙাটা হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত