Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রিচার্ড থেলার – আচরণগত অর্থনীতির প্রাণপুরুষ

রিচার্ড থেলার

ড.সুজয় চক্রবর্তী

 

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ড. সুজয় চক্রবর্তীর গবেষণা ও অধ্যাপনার মূল ক্ষেত্র নিরীক্ষামূলক ও আচরণগত অর্থনীতি ও উন্নয়ন অর্থনীতি। ইতিপূর্বে পড়িয়েছেন ড্যালাসের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইআইএম আহমেদাবাদে এবং আইআইটি দিল্লীতে।

 

অক্টোবরের নয় তারিখে অর্থনীতির স্বেরিজেস রাইক্সবাঙ্ক পুরস্কার – বা, চলিত কথায় অর্থনীতির নোবেল প্রাইজ – পেলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক রিচার্ড থেলার – আচরণগত অর্থনীতি, বা বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সে তাঁর অবদানের জন্য। হার্বার্ট সাইমন, ভার্নন স্মিথ, ড্যানিয়েল কাহ্‌নেম্যান এবং রবার্ট শিলার-এর পর আচরণগত অর্থনীতিতে রিচার্ড থেলার পঞ্চম নোবেলজয়ী। মনে রাখতে হবে – রাইনহার্ট সেলটেন, এলিনর অস্ট্রম, মরিস অ্যালেই এবং আলভিন রথ – এঁরা সকলেই উপভোক্তার আচরণ-বিষয়ে কাজ করে থাকলেও, এবং আচরণগত অর্থনীতিকে নিজ-নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও এঁদের কেউই আচরণগত অর্থনীতিতে অবদানের জন্য নোবেল পান নি।

আচরণগত অর্থনীতি বা বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সকে বলা চলে অর্থনীতির একটি প্রশাখা, যা সামাজিক ও জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে মানবীয় সিদ্ধান্তকরণপদ্ধতির বা ডিসিশন-মেকিং-এর আর্থনীতিক নকশা বা মডেল তৈরী ও বিশ্লেষণ করে। এই প্রশাখাটির জন্ম সত্তর ও আশির দশক জুড়ে – মানবীয় সিদ্ধান্তকরণের বিশ্লেষণে ততদিন পর্যন্ত চলে আসা অনমনীয় আর্থনীতিক নকশার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। এই সমস্ত মডেলে ধরে নেওয়া হত ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মানুষটি অধিবিজ্ঞ, প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নিপুণ সুযোগশিকারী, যাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য স্বীয় পার্থিব ধনসম্পদের বৃদ্ধি। ষাটের দশক থেকে অর্থনীতির গবেষক ও মনস্তাত্ত্বিকেরা জন ন্যাশ, জন ফন নিউমান, অস্কার মর্গেনস্টার্ন, লেনার্ড স্যাভেজ প্রমুখের সামষ্টিক অর্থনীতির সিদ্ধান্তকরণ বা ডিসিশন-মেকিং-এর তত্ত্বাবলীর নিবিড় নিরীক্ষণ আরম্ভ করেন। এই নিরীক্ষণ থেকে পাওয়া প্রমাণাদি থেকে বোঝা গেল, মানুষের আচরণ তাত্ত্বিক ভাবীকথনের থেকে একটু ভিন্ন ধরণের। তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে সে স্বার্থপরের মতো কেবলমাত্র নিজের ভালোটুকুই বেছে নেয়, এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সে বেছে নেয় এমন পরিণতি, যেখানে সে তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তির উপরে স্থান দেয় সমষ্টিগত প্রাপ্তিকে – তার প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছু কম পড়বে এ-কথা জেনেও। দ্বিতীয়তঃ, আর্থনীতিক বিচক্ষণতার চলিত অর্থের থেকে অনেক দূরে তার আচরণে মিলেমিশে থাকে তার হাজারো অভ্যাস আর পক্ষপাত, প্রবণতা। তার আচরণে থাকতে পারে চটজলদি সমাধানের ইচ্ছা, অঙ্কের নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজস্ব ন্যায়বোধ, মূল্যবোধ বা সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীলতা, যা তার সম্পদবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্থনীতির নিক্তিতে সদগুণ বলে বিবেচিত হবে না কখনই।

সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে ড্যানিয়েল কাহ্‌নেম্যান, আমোস ত্বের্স্কি, জ্যাক নেটশ, শ্লোমো বেনার্তসি ও হার্শ শেফ্রিনসহ কয়েকজনের সঙ্গে রিচার্ড থেলার সিদ্ধান্তকরণের চলতি মডেলগুলোকে আরও বেশী সমৃদ্ধ করে তোলেন, এবং এই বিষয়ে লেখালিখি নিয়ে শুরু হয় অর্থনীতির আলোচনার এক নতুন ধারা – আচরণগত অর্থনীতি। পরের তিন দশকে থেলারের নিজের গবেষণার মূল ক্ষেত্র হয়ে উঠল সিদ্ধান্তকারীর জ্ঞানীয় সীমাবদ্ধতা বা কগনিটিভ লিমিটেশন, আত্মনিয়ন্ত্রণের সমস্যা, এবং সামাজিক অনুরক্তি বা সোশ্যাল প্রেফারেন্স। বিশেষ করে বলতে হয় তাঁর মানসিক হিসাবরক্ষণ বা মেন্টাল অ্যাকাউন্টিং ও পরিকল্পক – কার্যকর্তা বা প্ল্যানার-ডুয়ার মডেলের কথা। এই দুটি মডেলেই সিদ্ধান্তকরণের সুবিধার জন্য সিদ্ধান্তকারী ব্যবহার করেন কিছু আচরণগত ও অঙ্কের হিসাবের বাইরের শর্টকাট। এর ফলে কখনও তাঁকে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিণতিরও সম্মুখীন হতে হয়। কাহ্‌নেম্যান ও নেটশ-এর সঙ্গে মিলিতভাবে করা একটি কাজে থেলার দেখান, দরকষাকষির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকারী নিজের সমৃদ্ধি ছাড়াও ন্যায্যতাকে গুরুত্ব দেন।

আচরণগত অর্থনীতির ক্ষেত্রে জর্জ শিলারের সঙ্গে মিলিতভাবে থেলারের বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। বাজারে ব্যক্তির আচরণগত পক্ষপাত লোপ পায়, তাত্ত্বিক অর্থবিদ্যার এই সাবেক ধারণার বিরোধীতা করে থেলারের কাজ আমাদের দেখায়, যে বাজারে ব্যক্তিগত পক্ষপাত বা পছন্দ-অপছন্দ শুধু বিরাজই করে না, তা দক্ষ বাজার বা এফিশিয়েন্ট মার্কেট-এর তত্ত্বলব্ধ ভবিষ্যদ্বাণীর থেকে পৃথক ফল দিতে পারে। থেলারের সাম্প্রতিকতম কাজ আর্থিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। ক্যাস সানস্টেইনের সঙ্গে মিলিত গবেষণায় থেলার জানাচ্ছেন, একটি আচরণগত সূত্র, পরামর্শ বা ‘কনুইয়ের মৃদু ঠেলা’ – থেলারের বিখ্যাত nudge — সিদ্ধান্তকরণের পদ্ধতিকে বদলে দিতে পারে। ক্যাফেটেরিয়াতে চোখের সামনে স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রদর্শন খদ্দেরকে তা নিতে প্রণোদিত করতে পারে। কারণ, চোখের সামনে যেটা, সিদ্ধান্তকারীর একটা প্রবণতা থাকে সেটাকেই বেছে নেবার। এই কাজে সে ব্যবহার করে হিউরিস্টিক, বা নিজের থেকে খুঁজে নেবার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। Nudge, বা কনুইয়ের মৃদু ঠেলা তাঁর আচরণকে বদলে দেয় – তাঁর মনোভাব বা অনুরক্তিকে না বদল করেই।

এই nudge-এর ধারণা কিছু পিতৃতান্ত্রিক হলেও স্বভাবতঃ উদারবাদী, কারণ উপভোক্তা এই nudge-কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতন পছন্দ করতে পারেন। অর্থনৈতিক কল্যাণবিধানে উপভোক্তাদের জন্য এই ধরণের পছন্দনির্মাণের কৌশল যুক্তরাজ্য-আদি অনেক দেশেই নেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্য রীতিমত বিহেভিওরাল ইনসাইটস টীম বানিয়ে এই কাজ করছে।