নিলাম তত্ত্বের দ্বিতীয় নোবেল

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালায়ে অর্থনীতির অধ্যাপক

 

অকশন থিওরি (Auction Theory) বা নিলামের তত্ত্ব বর্তমানে গেম থিওরির (Game Theory) একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। এই বছরের অর্থনীতির দুই নেবেলপ্রাপক রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) ও পউল মিলগ্রোম (Paul Milgrom) এই নিলামের তত্ত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে অকশন থিওরি-তে কাজ করার স্বরূপ প্রথম নেবেল পান উইলিয়াম ভিকারি, ১৯৯৬ সালে। তাই সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটি অকশন থিওরি-র দ্বিতীয় নোবেল।

কিন্তু কী আছে এই নিলামের তত্ত্বে? ধরা যাক কোনও একটি দুর্মূল্য ছবি নিলাম হচ্ছে। যিনি নিলাম করছেন তিনি চান যথাসম্ভব বেশি দাম পেতে। আর যারা কিনতে চান তারা চান ছবিটি যতটা সম্ভব সস্তায় পাওয়া যায়। তাহলে বিক্রেতার কী করা উচিত? সাধারণ বাজারে যে দামটা অন্তত পেতে চান সেটাতে বিক্রির চেষ্টা করা? কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে কেউ একজন আরও বেশি দিতে রাজি ছিল। কে কত দিতে চায় সেটা তো বিক্রেতা সঠিকভাবে জানেন না। তাই সাধারণ বাজারে বিক্রির চেষ্টা করাটা সবসময় বুদ্ধিমানের কাজ নাও হতে পারে। তাহলে অন্য উপায়টা কী? যদি ছবিটি নিলাম করা যেত তাহলে হয়ত সবচেয়ে যে বেশি যিনি দিতে চান তার থেকে সেই দামটা পাওয়া যেত। নিলামে যিনি সবচেয়ে বেশি দর হাঁকবেন তিনিই জিনিসটি পাবেন। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো যায় যে যার ছবিটির প্রতি মূল্য সবচেয়ে বেশি, সেই বেক্তিই সবচেয়ে বেশি দর হাঁকেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে নিলাম হল একটি ‘এফিসিয়েন্ট মেকানিজম’ (Efficient Mechanism)। অর্থাৎ, জিনিসটি তারই পাওয়া উচিত যিনি জিনিসটিকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেন, এবং সেটিই হচ্ছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে প্রত্যেক ক্রেতা তার নিজের মূল্য জানেন, কিন্তু অন্য কারও মূল্য জানেন না এবং একজনের মূল্যের সঙ্গে অন্য কারও মূল্যের কোনও সম্পর্ক নেই। এই জাতীয় অকশনকে বলা হয় ‘প্রাইভেট ভ্যালু’ (Private Value) অকশন। উইলিয়াম ভিকারি এই জাতীয় অকশনে বিক্রেতা কত পেতে পারেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ গাণিতিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন।

 

কিন্তু যদি এমন হত যে প্রত্যেক ক্রেতার মূল্যের মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে? অর্থাৎ, ছবিটিকে সবাই মোটামুটি একইভাবে মূল্য দেয়, শুধু একটু মূল্যের এদিকওদিক আছে, এবং এটা সবাই জানে। এই জাতীয় অকশন আর ‘প্রাইভেট ভ্যালু’ রইল না, হয়ে গেল ‘কমন ভ্যালু’ (Common Value) অকশন। অর্থাৎ প্রত্যেকের মূল্য আর যোগসূত্রহীন রইল না, একটা বড় অংশ সবার সমান। রবার্ট উইলসন ও পউল মিলগ্রোম ‘কমন ভ্যালু’ অকশন কীরকম হওয়া উচিত এবং কী করলে বিক্রেতা সবচেয়ে বেশি মুনাফা করতে পারবে ও এইক্ষেত্রে ক্রেতাদের কীভাবে দর হাঁকা উচিত তার পুঙ্খানুপুঙ্খ গাণিতিক তত্ত্ব দিয়েছেন। ‘কমন ভ্যালু’ অকশনের একটা সমস্যা হল বিজেতা জেতার জন্য অনেক সময় জিনিসটির মূল্যের থেকে একটু বেশি দর হেঁকে ফেলেন। একে বলা হয় ‘বিজেতার অভিশাপ’ বা ‘উইনার্স কার্স’ (Winner’s Curse)। এই সম্ভাবনার কথা উইলসন ও মিলগ্রোম তাঁদের এক গবেষণাপত্রে গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন।

রবার্ট উইলসন ও পউল মিলগ্রোমের দেখানো তত্ত্বে আজকাল অনেক অকশন ডিজাইন করা হয়। যে সব অকশনে একসঙ্গে একাধিক বস্তু নিলাম হয়, যেমন বিভিন্ন মোবাইল স্পেকট্রাম, খনি থেকে খনিজ পদার্থ তোলার বরাত, টেলিভিশনের সম্প্রচারের বরাত, তৈল খননের লইসেন্স, এবং যেখানে ‘কমন ভ্যালু’ প্রযোজ্য, সেখানে সব থেকে বেশি। তাই ব্যাবহারিক দিক থেকে উইলসন ও মিলগ্রোম-এর নিলাম সংক্রান্ত তাত্ত্বিক গবেষণা নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...