Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিঃস্ব গরবিনীর কাছে

অভীক রায়  

 

জলের সঙ্গে নুড়িপাথর খেলছে আপন মনে
বন্ধুত্ব কাকে বলে, ওরা কি তা জানে?
স্রোতের তোড়ে হারিয়ে যাওয়া ঠুনকো জীবন মায়া
পাথর ক্ষতে রইল পড়ে রিক্ত স্মৃতির ছায়া
বাদলদিনের অঝোরধারার প্রেমেই কি সে ঋণী?
হতাশ হাওয়ার শূন্যগর্ভে নিঃস্ব গরবিনী।

জীবনের বহমানতাই তার প্রাণভোমরা। বহমানতা ব্যতীত সে রুদ্ধ এবং বদ্ধ। জীবনপটের বিভিন্ন ঘটনা, তার সঙ্গে জড়িত আবেগ, আশা, আকাঙ্ক্ষা তার চলার পথের ছন্দ। সেখানে ভাঙা-গড়া ওঠা-পড়া যেমন থাকে তেমনই থাকে হঠাৎ সুখ বা আচমকা কোনও বিপর্যয়। জীবন পুনরায় আবার নিজের পথে চললেও বদলে যাওয়া খাতে যেমন থাকে সুখস্মৃতির আবেশ, তেমনই আবার কোনও মানসিক অভিঘাতের ক্ষতের চিহ্ন পড়ে থাকে জীবনপথের পাথরের গায়ে। কাছে গেলেই নাকে মুখে ঝাপটা মারে নীরব হতাশা ও অবরুদ্ধ হাহাকারের উষ্ণ বাষ্প। যেন বলতে চায়, প্রাণপ্রাচুর্যে, নুপূরের তানে আমি তো ছিলাম গরবিনী। কে ফিরাবে বলো আমার সে গরিমা?

শীতকালের শেষে এমনই এক নিঃস্ব গরবিনীর নাম বোধহয় জয়ন্তী। সে-সময়ে তাকে দেখে কোনও এক আনকোরা কবি হয়তো উপরের ওই লাইনগুলি লিখেছিলেন। আমরাও আজ চললাম সেই জয়ন্তীর সান্নিধ্যে। 

 

ডুয়ার্স পেরিয়ে

গড়ে ৩০ কিমি চওড়া এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৫০ কিমি, পশ্চিমে তিস্তা নদী থেকে পূবে ধানসিঁড়ি নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ ডুয়ার্স নামে পরিচিত। দুয়ার বা দরজা থেকে ডুয়ার্স কথাটি এসেছে। ভুটান পাহাড়ে যাওয়া ও আসার জন্য এরকম আঠেরোটি রাস্তা ছিল। এই আঠেরোটি দুয়ারের মধ্যে এগারোটি পশ্চিমবঙ্গের বা বাংলা দুয়ার, আর সাতটি অসম দুয়ার। ভৌগোলিকভাবে পূর্বে ধানসিঁড়ি নদী থেকে পশ্চিমে মানস নদী পর্যন্ত অসম ডুয়ার্স আর মানস থেকে পশ্চিমে তিস্তা পর্যন্ত বেঙ্গল ডুয়ার্সের অন্তর্গত। তবে বর্তমান রাজনৈতিক সীমানায় পশ্চিমে তিস্তা থেকে পূর্বে রায়ডাক নদী পর্যন্তই বেঙ্গল ডুয়ার্স।

বাংলার এগারোটির অন্যতম একটি হল বক্সা দুয়ার। বহু রাজনৈতিক উত্থানপতনের সাক্ষী এই ভূখণ্ড। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কামতা বা কামরূপ রাজ্য থেকে, বাংলার সুলতানি শাসনের স্পর্শ পেরিয়ে অষ্টাদশ শতকের ভুটানি অনুপ্রবেশ ও তৎপরবর্তী ১৮৬৫ সালের ব্রিটিশ অধিগ্রহণ।

বর্তমানে বক্সা, আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকে অবস্থিত। তবে এখানে আসতে হলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চলটি অতিক্রম করতে হয়। 

শিলিগুড়িতে মিনিট পনেরো বিশ্রাম নেওয়ার পর একটু জল খেয়ে, ধাতস্থ হয়ে আমাদের কাঞ্চনকন্যা এগিয়ে চলল তার পথসাথীদের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের প্রান্তিক জংশনের উদ্দেশে। সারা রাতের দুর্দমনীয় গতির ধকল শেষ। এবার খানিক স্বস্তিতে, শান্তি করে আপন মনে, গজগমনে ফের পথ চলা পাহাড়, বনের মধ্যে দিয়ে। সরু পথে লম্বা শরীরটা যখন জঙ্গলের ভেতর ঢুকছে, মনে হচ্ছে যেন মস্ত এক ময়াল সাপ গুড়ি মেরে এগোচ্ছে তার গন্তব্যে। আর বনের গাছপালা, দূরে পাহাড়শ্রেণি, পথের পাশে হঠাৎ খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়, এবং পাহাড়-বনের কোলে যাদের আদিগন্ত বিস্তার, সেই গরবিনী বিখ্যাত সব নদীরা তাকে স্বাগত জানাচ্ছে দুহাত তুলে। এ-পথে তার নিত্যদিনের যাওয়া-আসাই রয়েছে এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মূলে। সেবক, লাটাগুড়ি, চাপরামারির গাছেদের হাত নেড়ে, রাস্তার দুপাশের বিস্তীর্ণ চা-বাগানের হাওয়া গায়ে মেখে, আমাদের কন্যা কাঞ্চন বক্সার অভিমুখে ধাবমান। শুধু ফেব্রুয়ারির শেষে পড়ে থাকা প্রায় শূন্যগর্ভ তোর্সা, জলঢাকা, কালজানি এসে সকরুণ আহ্বান জানাল একবার বর্ষায় তাদের সঙ্গে দেখা করার। তাদের বর্ষার রূপ কাঞ্চন দেখেছে। আমরা দেখিনি। এইবার হল না। মেঘের দিনে দেখতে হবে তিস্তা, তোর্সা, কালজানিকে। ওরা হয়তো বলতে চায়, তখন দেখো, গরবিনীর আসল রূপ।

 

বক্সা-জয়ন্তী

বন্ধুত্বের মায়া ত্যাগ করে, আমাদের কন্যার আলিপুরদুয়ার পৌঁছাতে দেরিই হল। তাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। রাজ্যের একপ্রান্তে, প্রায় জঙ্গল লাগোয়া পরিবেশে এই আধুনিক স্টেশন বেশ ভাল লাগল। আসার পথে জঙ্গলের মাঝে ছিল আরেকজন— রাজাভাতখাওয়া স্টেশন। খানিক বিচ্ছিন্ন, ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন, কাঠের কটেজ আকৃতির এই স্টেশনটি তার নাম ও অবস্থানের জন্যই বিখ্যাত। মনে হয় সতেজ কোনও সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী ইহজগতের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এখানে নিভৃতে ধ্যানমগ্ন। স্টেশনটি আজও মনে করায় রাজার ভাত খাওয়ার গল্প।

১৭৭০ সালে ভুটানের দেবরাজ দ্যেবাধুর ঔপনিবেশিক লালসার বশবর্তী হয়ে ১৩শ কোচবিহাররাজ ধৈরজেন্দ্র নারায়ণকে বন্দি করেন। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় ভুটানরাজ পরাজিত হলে ১৭৭৪ সালের চুক্তি মারফৎ কোচবিহাররাজ মুক্তি পান। এই পথে কোচবিহাররাজকে স্বাগত জানানো হয় অন্ন (ভাত)-সেবা দ্বারা। উনি এই স্থানেই অন্ন গ্রহণ করেন। তাই রাজা-ভাত-খাওয়া।

আমাদের গাড়ি রওনা দিল জয়ন্তী গ্রামের উদ্দেশে। পারমিট করিয়ে, বক্সা টাইগার রিজার্ভের গেট পেরিয়ে মসৃণ পিচরাস্তা আমাদের নিয়ে ঢুকে পড়ল বক্সার জঙ্গলে। এই রিজার্ভ ফরেস্টের পিচরাস্তা, মানববসতি, বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট বক্সাকে ‘নগরী-বন্য’দের ‘অরণ্যধাম’ হিসাবে একটা বাড়তি আকর্ষণ দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির হাওয়ায় পড়ন্ত বিকেলে হিমেল পরশ ভালই। যত চলেছি, দুধারের ঘন জঙ্গল যেন তত আমাদের তার সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে পুরে ফেলছে। যেন বা এক বিরাট সবুজ দৈত্য টুক করে গিলে ফেলল আমাদের ছোট্ট চারচাকার গাড়িটাকে।

এই বিরাট সবুজ দৈত্যের পরিচয় খানিক জানা প্রয়োজন। ৭৬০ বর্গকিমি ব্যাপ্ত এই অভয়ারণ্যে নদী, পাহাড়, গাছপালা, জনবসতি মিলে খানিকটা অভয় হলেও ভয়েরও কারণ আছে। বাঘ, ভারতীয় লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড, গৌর, সম্বর হরিণ ইত্যাদি তো আছেই, এছাড়াও আছে, সারা ডুয়ার্স যার জন্য তটস্থ, সেই মহাকাল। অর্থাৎ এ(দে)শীয় গজরাজ, বা এশিয়াটিক এলিফ্যান্ট। শোনা কথা, ডুয়ার্সের বেশিরভাগ মানুষ হাতিকে মহাকাল নামেই সম্বোধন করেন।

রাস্তায় দেখা এক বার্কিং ডিয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে চলে এলাম জয়ন্তী গ্রামে। ঠিক এখানেই থাকা ও জঙ্গল সাফারি ইত্যাদি করা যায়।

হোমস্টের মালিকের উষ্ণ অভ্যর্থনার পর দুপুরের আহার সাঙ্গ হল। একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশ। রান্নাও তেমনই, যেন কোনও নেমন্তন্নবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া। দোতলা বাড়ির উপরে অতিথি, আর নিচে মালিকের বাসস্থান। প্রথম আলাপেই ওঁরা আতিথেয়তায় আমাদের মুগ্ধ করলেন। ওঁদের কাছেই বক্সা টাইগার রিজার্ভ সম্পর্কে আরও কথা জানা গেল। এ-ও জানা গেল এই এলাকার অর্থনীতি মূলত পর্যটননির্ভর। হোমস্টে-র ব্যবসা আর গাইডের পেশা, এ-ই প্রধান রোজগার। অভয়ারণ্য ঘোষিত হওয়ার পর নদীর পাথর তোলা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবসা অবৈধ। তাই এই মরশুমি রোজগারই একমাত্র রাস্তা। বর্ষার পাঁচ মাস কার্যত বেকার। বর্ষায় জয়ন্তী নদীর এপার ওপার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর রিভারবেড পাথর পরিপূর্ণ হয়ে বসতির সঙ্গে উচ্চতায় সমান (কোথাও কোথাও লোকালয়ের থেকেও উঁচু) হয়ে যাওয়ায় ফি-বছর বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমনই এক ভয়াবহ স্মৃতির সাক্ষ্য আজও বহন করছে জয়ন্তী নদীবক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা জয়ন্তী ব্রিজের কঙ্কালটি।

নাগরিক সুযোগসুবিধা অর্থাৎ ব্যাঙ্ক, রেলস্টেশন, বড় বাণিজ্যকেন্দ্র, বাজার, প্রশাসন প্রায় সবই ৩৫ কিমি দূরের আলিপুরদুয়ার, অথবা ১০ কিমি দূরের রাজাভাতখাওয়া।

১৯৮৩ সালে ভারতের পঞ্চদশ ব্যাঘ্র প্রকল্প রূপে আত্মপ্রকাশ করে বক্সা। ১৯৮৬ সালে বক্সা অভয়ারণ্য তৈরি হয়। শেষমেশ ১৯৯৭ সালে বক্সাকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়। জয়ন্তী, পানবাড়ির কিছু অংশ, দক্ষিণ ও উত্তর রাজাভাতখাওয়ার কিছু অংশ, ও তাশিগাঁও ব্লক নিয়ে বক্সা জাতীয় উদ্যান। দক্ষিণ ও পশ্চিমের সমতলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে বক্সা রিজার্ভ ফরেস্ট, এবং উত্তরের পাহাড়ি ও পূর্বের বেশিরভাগ ব্লক নিয়ে বক্সা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি গঠিত। তবে ব্যাঘ্র প্রকল্প হলেও এখানে বাঘের সংখ্যা শোচনীয়।

জঙ্গল, পাহাড়ের সঙ্গে নদীর যুগলবন্দি— আবেষ্টনীর পর্দা সরে মুখোমুখি হওয়া বিশালত্বের। আমরা সবুজ দৈত্যটার পেট ফুঁড়ে এবার হাজির হলাম জয়ন্তী নদীর তীরে। সামনে ধবধবে সাদা, প্রায় এক কিমি চওড়া ধুলো-ওড়া শুকনো নদীগর্ভ, আর নদীর ওপারে খাড়া দাঁড়িয়ে ভুটান পাহাড়। সমতলে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে কোনও উঁচু পাহাড় দেখলে, মনের মধ্যে শ্রদ্ধা অথবা ভয়ের উদ্রেক হয়। কখনও মনে হয় পিতামহের অপার স্নেহ, আবার কখনও অপরিচয়ের আশঙ্কা। হিমালয়ের ক্ষেত্রে আমার যুগপৎ এই দুটোই হয়। পর্বতের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য তার প্রতি আকর্ষণ জাগায়। আবার অজানা গিরিকন্দর ও তার বিশালত্ব মনে জাগায় আশঙ্কা। যেন এ-ও এক বিশাল গোলকধাঁধায় অনুপ্রবেশ। পথ হারিয়ে নিজেকে হারাবার ভয়।

তবুও ভয় যতই থাকুক, ঢেউ খেলা গম্ভীর ভুটান পাহাড় আর তার সামনে পাথুরে শয্যায় অবসৃত জয়ন্তীর জলের ফেলে যাওয়া শেষচিহ্নের হাতছানি মোটেও উপেক্ষা করা গেল না।

 

লেপচা খা

“এটাকে বলে স্কারলেট মিনি”— টকটকে লাল আর কালোর মিশেলে ছোট্ট একটা অপূর্ব সুন্দর পাখি দেখিয়ে কথাটা বললেন কাঞ্চা প্রধান, লেপচা খা যাওয়ার পথে আমাদের গাইড।

জয়ন্তী থেকে সানতালাবাড়ি হয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গাড়িতে। তারপর জিরো পয়েন্ট থেকে লেপচা খা হেঁটে যাওয়া। সানতালাবাড়ি থেকে জিরো পয়েন্ট ২.৫ কিমি, জিরো পয়েন্ট থেকে বক্সা ফোর্ট ৩ কিমি, আর বক্সা ফোর্ট থেকে লেপচা খা ২ কিমি। এখানে গাইড বাধ্যতামূলক। তাই আলাপ হল কাঞ্চাদা-র সঙ্গে। বহুদিন তিনি এই কাজ করছেন। ভদ্রলোকের অদ্ভুত দক্ষতা পাখি স্পট করার। যাওয়া আসার পথে বেশ কিছু সুন্দর পাখি ওঁর সৌজন্যেই দেখা গেল। জিরো পয়েন্ট থেকে রাস্তা একটু খাড়া হলেও দুরূহ চড়াই নয়। কথা বলতে বলতে আমরা অনায়াসেই এগোতে লাগলাম লেপচা খা-র দিকে। সানতালাবাড়ি থেকে লেপচা খা ছাড়াও যাওয়া যায় রোভারস পয়েন্ট, তাশিগাঁও ইত্যাদি আরও অনেক ট্যুরিস্ট স্পটে। সমতল থেকে পাহাড়ে ওঠা আর পাহাড় থেকে সমতলের দৃশ্য— এই অনবদ্য যাত্রা, চলতে থাকা দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্য মাত্রায় পর্যবসিত করে। ৭৬০ কিমি ব্যাপ্তির মধ্যে বক্সা অভয়ারণ্যের কিছু অংশ সমতলে আর কিছু অংশ পাহাড়ে বিস্তৃত। জানা গেল সমতলে ৬০মি (২০০ ফুট) থেকে পাহাড়ে ১৭৫০মি (৫৭৪০ ফুট) পর্যন্ত এখানে ভূমির উচ্চতা। লেপচা খা বক্সা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির অন্তর্গত।

গাছপালা, পাহাড়ের মাঝে পায়ে-হাঁটা পথ, প্রকৃতির রংশিল্পের প্রতিনিধি হয়ে আসা ছোট-বড় নানান পাখি, পাহাড়ি গ্রাম্যজীবনের টুকরো ছবি আর পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রার কয়েক মুহূর্ত, ছোট ছোট পদক্ষেপের মতোই যেন ছোট ছোট অক্ষরে ভরে দিতে থাকে আমাদের জীবনখাতার কয়েকটি পাতা।

মন ছুঁয়ে যায় ওখানকার মানুষের কষ্টসহিষ্ণুতা। গাড়ি চলাচলের রাস্তা না-থাকায় জীবনযাত্রার প্রায় সমস্ত কিছুই মাথায় বা পিঠে করে পাহাড়ের উপরের গ্রামগুলিতে নিয়ে যেতে হয়।

মাঝরাস্তায় প্রেমাজির চা খেয়ে, একটু জিরিয়ে নিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম। কাঞ্চাদা আমাদের বললেন, বক্সা পশু ছাড়াও ২৮৪ প্রজাতির পাখি, ৪৫০ প্রজাতির গাছ, ১০ প্রজাতির বাঁশ, ১৫০ প্রজাতির অর্কিড, ১০০ প্রজাতির ঘাস এবং ১৩০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদে সমৃদ্ধ। শাল, গামার, শিমূল, মেহগনি ইত্যাদি হল বক্সার প্রধান বৃক্ষ। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে সুপুরিগাছ। ঘন চিরহরিৎ অরণ্যের অন্তর্গত বক্সায় প্রায় সারা বছরই গাছের সবুজ পাতার দেখা মেলে।

গুটিগুটি পায়ে এরই মধ্যে আমরা ৮৬৭ মিটার, বা ২৮৪৪ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে গেছি। এখানকার এই উচ্চতাটা অনেকেরই চেনা। সামনে একটা চওড়া ফুটবল মাঠের গায়েই এক ইতিহাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। বক্সা ফোর্ট। এর উৎপত্তির ইতিহাস খুব পরিষ্কার না হলেও, জানা যায় ভুটানরাজ এটিকে ভুটানের মধ্যে দিয়ে তিব্বত ও ভারতের সংযোগরক্ষাকারী অঞ্চলটির প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে ১৮৬৫ সালে সিঞ্চুলা চুক্তি মারফৎ এই দুর্গ ব্রিটিশদের অধীনে আসে। প্রথমে বাঁশের তৈরি হলেও, ইংরেজরা এটিকে ইট-পাথরে পাকাপোক্ত করে। সে সময়ে বক্সা ফোর্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কয়েদখানা হিসেবেই ব্যবহৃত হত। তারপরেও এটি জেলখানাই ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’ গল্পে এর বিবরণ আছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা কিছু শরণার্থীর ত্রাণশিবির হয় এই দুর্গ। ১৯৮১ সালে এটি জাতীয় সৌধের মর্যাদা লাভ করে। স্বাধীনতার স্বর্ণজয়ন্তীতে এখানে মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রয়েছে। বক্সা টাইগার রিজার্ভের নামটা এই বক্সা ফোর্ট থেকেই এসেছে। কিন্তু বক্সা ফোর্টের নামকরণ আমাদের কাছে আপাতত অজানাই রইল।

রাস্তায় প্রথমদিকে ছিল একটা ভিউপয়েন্ট। আর লেপচা খা গ্রামটা হল নিজেই একটা বড় ভিউপয়েন্ট। গ্রামের উত্তরদিক জুড়ে রয়েছে ভুটান পাহাড়। ওখানেই রোভারস পয়েন্ট, তাশিগাঁও ইত্যাদি জায়গাগুলো রয়েছে। আর দক্ষিণদিকে, এটাই ভিউপয়েন্ট— যতদূর চোখ যায়, ধীরে ধীরে দিগন্তে লীন হয়েছে নিচে ফেলে আসা সমতল। আরও ভাল ব্যাপার হল, ওখান থেকেই প্রায় স্পষ্ট চিহ্নিত করা গেল ডুয়ার্সের বেশ কিছু নদীপথ। জল নেই বলে সূর্যের আলোয় সিল্কের রিবনের মতো চকচক করছে না ঠিকই, কিন্তু দূর থেকে তাদের ফেলে রাখা সাদা ফিতের মতোই মনে হচ্ছে।

সমুদ্রের পারে দাঁড়ালে, তার ব্যাপকতা, বিশালত্ব বিমোহিত করে। তার ঢেউয়ের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, আর অক্লান্ত গর্জন দূর করে মনের সব বিষাদ। অনেকটা তেমনই, পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে দেখা সমতলের বিস্তারও যে মনের বদ্ধ পাখিটাকে উড়াল দেওয়ার প্রেরণা দেবে, তা এখানে না এলে হয়তো কখনও বুঝতেই পারতাম না। বুঝতে পারতাম না, সমুদ্রের ছন্দ না থাকলেও, গদ্য-উপন্যাসের মতোই ব্যাপক ও সুবিস্তৃত এই সমতল।

পাহাড়ের ধারে হঠাৎ একটা সমতলে বেশ কিছু বাড়ি, দোকান, মাঠ, মনাস্ট্রি ইত্যাদি নিয়ে গ্রাম লেপচা খা। ঠিক কতগুলো পরিবারের বাস এখানে তা জানা হল না, তবে বেশিরভাগ যে হোমস্টের সঙ্গে যুক্ত তা বোঝা গেল। গ্রামে ঢোকার মুখেই রয়েছে সারি দেওয়া সাদা রঙের নিশান। সম্ভবত ওগুলো বিগত আত্মাদের স্মৃতির উদ্দেশে লাগানো। খানিকটা এগোতেই মনাস্ট্রি। তার পাশে চোর্তেন। তখন অবশ্য বন্ধ ছিল। এদের সামনে একটা খোলা উঠোন, বা মাঠ। ঠিক তার মাঝে একটা ফার গাছ। সময়টা ছিল দুপুর ১২টার কাছাকাছি। তাই গাছের ঘন ছায়ায় দেখা গেল কয়েকটা সারমেয় নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন। কর্মব্যাস্ততা খুব বেশি চোখে না পড়লেও অলস দুপুরও নয়। ইতিউতি গ্রামের মহিলারা গৃহকর্মে রত। কিছু চায়ের দোকান খোলা। হোমস্টেগুলি বাইরে থেকে বেশ সাজানোগোছানো। গ্রামের ধারে, যেখান থেকে সমতলের দিকে দেখা যায়, আমরা একটা চায়ের দোকানে বসে বিশ্রাম নিলাম। পাহাড়ি গ্রামের মোলায়েম দুপুরে চায়ের আমেজের সঙ্গে জিরোতে জিরোতে শোনা গেল কাঞ্চাদার জীবনকাহিনি।

লেপচা খা থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল। বিকেলে জয়ন্তী গ্রামে ও তার আশেপাশে চলল নবলব্ধ অভ্যাসের কিঞ্চিত অনুশীলন। অর্থাৎ পাখি দেখা। এ-ও এক নেশা বটে। বিকেলের নরম রোদে এক অতি পরিচিত পাখির চ্যাঁচামেচি শুনে, একটি উঁচু শিমুলগাছের উপর চোখ পড়ল। দেখা গেল বন্য টিয়ার ঝাঁক। এদের দেহের মাঝবরাবর গলা থেকে বুক পর্যন্ত কমলা-লাল রঙের পালক। বাকি দেহ সবুজ। বক্সা থেকে ফেরার দিন সকালবেলাও এই কাজ আমরা করেছিলাম। আমাদের দেখা বেশিরভাগ পাখিই আমাদের অপরিচিত।

জয়ন্তী গ্রামের উল্টোদিকে, জয়ন্তী নদীর ওপারে প্রহরীর মতো যে পর্বতমালা দণ্ডায়মান, এরপর আমাদের গন্তব্য সেই গিরিকন্দরের অন্দরে। মহাকালের গুহায়।

 

মহাকাল

ভারতবর্ষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমারোহের স্থানগুলি, বিশেষত দুর্গম পাহাড়ের কোলে যেগুলি অবস্থিত, বেশিরভাগই কোনও-না-কোনও দেবস্থানে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এদেশের ভাবনায় হিমালয় যে দেবালয় সে তো জানা কথা। তাই এই গিরিকন্দরের কোনও দুর্গম গুহায় দেবালয়ের উপস্থিতি একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী। আর সেই গুহার পাথরের আকার যদি হয় সন্ন্যাসীর জটার মতো, তাহলে বাকিটা সহজেই অনুমেয়।

বক্সা পাহাড়ের মহাকাল গুহা এমনই এক তীর্থস্থান। এটি শৈব তীর্থস্থান। জয়ন্তী নদী পেরিয়ে তার গতিপথ বরাবর নদীখাত ধরে এগোলে, ডান পাশের পাহাড়ের উপরেই রয়েছে মহাকালের গুহা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখানে দুটি মহাকালের তীর্থক্ষেত্র রয়েছে। গিরিখাতের কিছু উপরে অল্প উচ্চতায় রয়েছে ছোট মহাকাল। এর বেশ খানিকটা উপরে বড় মহাকাল। ছোট মহাকাল নদীখাত থেকে আনুমানিক ১৫০ ফুট উঁচুতে। বড় মহাকালের দূরত্ব আনুমানিক তিন কিলোমিটার।

বক্সার মহাকাল গুহা পাহাড়ের এমন স্থানে অবস্থিত যে গুহায় প্রবেশের আগে সেখানে পৌঁছানোর বাধা আগে পেরোতে হবে। মহাকাল গুহা বলতে সাধারণত বড় মহাকালকেই বোঝায়। কারণ ছোট মহাকালে গুহা সেই অর্থে কিছু নেই।

জয়ন্তী নদীর এপার থেকে বড় মহাকালের দূরত্ব প্রায় ৫ কিমি। জয়ন্তী নদীখাত বরাবর যেখানে নদীটি পাহাড়ের ভিতর প্রবেশ করছে, সেই মুখ পর্যন্ত গাড়ি করে যাওয়া যায়। তারপর দুদিকে উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নদীখাত বরাবর হেঁটে যাওয়া। এখানে নদীটি সরু হয়ে প্রবেশ করেছে তার পাহাড়ি জন্মভূমির অন্দরে। সমতলের উন্মুক্ত নদীখাত থেকে পাহাড়ি গিরিখাতে প্রবেশ করার সময় মনে হল, দূর থেকে দেখা সমীহ উদ্রেককারী সেই গিরিকন্দরের রহস্যঘন অন্দরমহলে টুক করে ঢুকে পড়লাম। না-জানি কী চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কাতলুং আর সাচি ফু এই দুই ভুটানি নদীর মিলিত ধারাই সমতলে জয়ন্তী। এই পাহাড়, বক্সা পাহাড় নামে পরিচিত। আর নদীখাতের কাতলুং ভারত-ভুটানের সীমানা-নির্দেশক নদী।

ভারত-ভুটানের আন্তর্জাতিক সীমানার কথা এখানে বলার কারণ, মহাকাল গুহা ভুটান রাষ্ট্রে অবস্থিত। কাতলুং নদীবরাবর ভারত-ভুটান সীমানা। সেই সীমানা পেরিয়ে কিঞ্চিৎ পররাষ্ট্র গমন। বিদেশ ভ্রমণের অনুভূতিটা এক্ষেত্রে ঠিকঠাক না-হলেও, অন্যদেশের মাটিতে পা পড়েছে ভাবলেই বেশ রোমাঞ্চ হয়। ভারতের অন্যান্য বড় প্রতিবেশীর তুলনায় নেপাল, ভুটানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত শিথিলতা অনেকটাই মুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে। ভাবি, অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও এমনটা কেন নয়।

যাই হোক, গাড়ি থাকে নেমে আমরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বড় বড় বোল্ডারের পর্দা সরাতে সরাতে। ফেব্রুয়ারি মাসে জয়ন্তীতে জল না থাকলেও, এখানে জলের একটি ধারা তীব্র বেগে বহমান। আমাদের এখন যেতে হচ্ছে নদীর উজানে। আর এখানে নদীখাতে রয়েছে ছোটবড় অনেক বোল্ডার। খানিকটা এগিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রায় দোতলা বাড়িসমান উঁচু বোল্ডারের মাঝখান দিয়ে বাঁশের সাকো বানানো রয়েছে। যেতে হবে তার উপর দিয়ে। ঠিক নিচেই বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। নদীটি কখনও সামনে আসছে, কখনও আবার লুকিয়ে পড়ছে কোনও বড় বোল্ডারের আড়ালে। আর আমাদের অনবরত একপারের বোল্ডার থেকে অন্যপারের পাথরের উপর চলতে হচ্ছে। ফলে, মনে হচ্ছে যেন পাথরের পর্দা সরিয়ে নদীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চলেছি।

আমরা যে-সময়ে ওখানে গিয়েছি, তার দুদিন পরেই ছিল শিবরাত্রি। তাই গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল, নদীর পাড় ও রিভারবেডের উপর ছোটবড় অনেক অস্থায়ী দোকান। সবই আগত তীর্থযাত্রীদের রসদ জোগানের উদ্দেশ্যে। জলখাবারের সঙ্গে সঙ্গে সোমরসেরও ব্যবস্থা রয়েছে দেখা গেল।

দু-পাহাড়ের মাঝখানে নদীখাতের উপর বড় বড় উঁচু বোল্ডারের মাঝখানে কোথাও কোথাও দুই পাথরের ফাঁকে মোটে এক মানুষ চওড়া জায়গা। তার নিচ দিয়ে জলের ধারা তীব্র বেগে বহমান। সেখানেই একটু চওড়া করে বাঁশের সাকো বেঁধে চলার ব্যবস্থা হয়েছে। জানা গেল, বৃষ্টিতে নদীর জল বাড়লে, এই সাঁকোগুলো সব ভেসে যায়। একথা শুনে তখন যাত্রীদের দুর্ভোগের কথাই ভাবতে লাগলাম। নদীর বুকের উপর বাঁশের সাঁকো আর কোথাও কোথাও নিচ থেকে বোল্ডারের মাথায় ওঠার জন্য সরু সরু সোজা শক্ত গাছের ডাল দিয়ে বানানো মই— মহাকালের পাহাড়ে ওঠার আগে এভাবেই আমাদের কাতলুং-এর বন্ধুরতা পার করতে হল। দু-পাহাড়ের মাঝখানে ঢোকার আগেই যাত্রাপথে ফ্লেক্স দিয়ে আসন্ন শিবরাত্রি আর তার অভ্যর্থনায় রয়্যাল গভর্নমেন্ট অফ ভুটানের স্বাগতম বার্তা সম্বলিত ছোট্ট তোরণ চোখে পড়ল। আগেই বলা হয়েছে যে মহাকাল ভুটান রাষ্ট্রে অবস্থিত। জায়গাটি, আমাদের প্রতিবেশী দেশটির চুখা প্রদেশের অন্তর্গত। আর জয়ন্তী গ্রাম, আলিপুরদুয়ার জেলার কালজানি ও কুমারগ্রাম ব্লকের প্রায় সীমানায় অবস্থিত।

যাইহোক, বন্ধুরতা পেরিয়ে এবার আমরা প্রায় ৮০ ডিগ্রি মইয়ের মতো খাড়া বাঁধানো সিঁড়ির সম্মুখীন হলাম। গাইডদাদা জানাল ৭৫টা সিঁড়ি পেরোতে হবে।

পাহাড়ের খাড়া ঢালের গা বেয়ে প্রায় এক হাত করে উঁচু আর ‘পৌনে-এক পায়ের পাতা’ চওড়া এক-একটি সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আক্ষরিক অর্থেই মইয়ে ওঠার মতো করে উঠতে হচ্ছিল। এ-ও এক উপলব্ধি যে ঈশ্বর উপরতলার লোক, আর তার কাছে পৌঁছতে গেলে কঠিন বাধার সিঁড়ি পেরোতে হবে— যেমনটা অন্যান্য ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অভিজ্ঞতা হয় আর কি!

যাত্রীদের সুবিধার্থে খাড়া ঢালগুলোয় সিঁড়ি বানানো। বাকি রাস্তা কাঁচা। তবে পুরো রাস্তাটাই ভীষণ সরু। দুজন কষ্ট করে পাশাপাশি দাঁড়ানো সম্ভব। খাদের দিকে সব জায়গায় রেলিং নেই। গাইডদাদার সাহায্যে আমরা খুব সন্তর্পণে তেরছা করে পা ফেলে এক একটা সিঁড়ি উঠতে লাগলাম। নামার সময়ে আরও বেশি সতর্কতা। কারণ কোনওভাবে পা ফসকালে, বা পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এমনকি আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

সকালে হোমস্টে থেকে শুরু করে গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগল। আমাদের একটা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হচ্ছিল। নিচে নদীখাত আর ওপারে আর একটা পাহাড়। কিন্তু জঙ্গল এখানে ঘন থাকায় দৃশ্যসৌন্দর্য ভালভাবে উপভোগ করা গেল না। তাছাড়া রাস্তা ও পদচারণার উপর বেশ কিছুটা মন সংযোগ করার কারণে ওই ব্যাপারটি খানিকটা উপেক্ষিতই রয়ে গেল।

কংক্রিটের ‘মই’ বেয়ে গুহার কাছাকাছি পৌঁছাবার পর দেখা গেল পাহাড়ের একটা ধাপ থেকে লোহার মই বেয়ে গুহা পর্যন্ত যেতে হবে। পাহাড়ের যে ধাপ থেকে লোহার মই শুরু হচ্ছে, সেখানে ডানদিকে ভান্ডারা দেওয়া হচ্ছে।

মহাকাল গুহা একটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে একটা কোটরের মতো। উঁচু গাছের কোটরে যেমন মই লাগিয়ে উঠতে হয়, এখানেও ব্যাপারটা তেমনই। লোহার মই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছনো গেল মহাকাল গুহায়।

স্ট্যালাগমাইট ও স্ট্যালাকটাইট। একটি ঊর্ধ্বমুখী আর একটি নিম্নগামী। যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে এই ঊর্ধ্বগমন ও অধঃগমনের যাত্রা। আর এই যাওয়া আসার মাঝে তৈরি হয় কত অবয়ব, কত আকৃতি। ব্যাপারটা আসলে জলের সঙ্গে খনিজ পদার্থ মিশে উপরের দেওয়াল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আর নিচের মেঝেতে জমা হয়। মেঝের উপর জমা হতে হতে উঁচু হয়ে ঢিপির মতো হয়। আবার ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়তে পড়তে জমে গিয়ে সন্ন্যাসীর জটার মতো ঝুলতে থাকে। অনেকটা চুঁইয়ে পড়া জল জমে গিয়ে যেমন আইসিক্‌ল তৈরি হয়। এই পুরো ব্যাপারটাই প্রধানত গুহায় দেখতে পাওয়া যায়। একে বলে স্ট্যালাগমাইট ও স্ট্যালাকটাইট ডিপোজিট।

কয়েকশো থেকে কয়েক লক্ষ বছর ধরে গুহার ভেতর এই মিনারেল ডিপোজিট বা খনিজ পুঞ্জীভবন জন্ম দেয় বিভিন্ন আকৃতির। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা স্ট্যালাকটাইটও অনেক আশ্চর্যরকম অবয়ব হাজির করে। সব মিলিয়ে গুহার ভেতরটা দৃশ্যত বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। চুনাপাথরের গুহায় ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়েই মূলত এই স্ট্যালাগমাইট ও স্ট্যালাকটাইট ডিপোজিট তৈরি হয়। এছাড়া অন্যান্য খনিজ পদার্থও থাকে।

মহাকাল গুহাও এরকমই এক প্রাকৃতিক বিস্ময়ের স্থান। এখানে পাশাপাশি তিনটি গুহা রয়েছে। গুহার সামনেটা খানিক খোলা ও চওড়া হলেও, মূল গুহাগুলি একেবারেই ছোট্ট খুপরির মতো। বিভিন্ন আকারের পাথরের সমাবেশে প্রবেশপথ এতটাই সঙ্কীর্ণ যে প্রায় কাত হয়ে, ছেঁচড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা-বেরোনো করতে হয়। তার মধ্যেই দেখা গেল, গুহার ভেতরে মোমবাতি, ধূপকাঠি ইত্যাদি জ্বালিয়ে পূজার আয়োজন হয়েছে। রয়েছেন স্বনামধন্য সন্ন্যাসী। স্ট্যালাগমাইট ও স্ট্যালাকটাইটের বিভিন্ন মানবদেহসদৃশ অবয়বকে দেবদেবীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। তীর্থক্ষেত্রে এটি প্রত্যাশিত। প্রতি নিঃশ্বাসেই বিশ্বাস। অন্যান্য গুহাগুলিতে দেখা গেল ভক্তদের লাইন পড়েছে। ওদিকে আমাদের বিশ্বাস কিঞ্চিৎ কম হওয়ায় আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। গাইডদাদা জানাল, শিবরাত্রির সময়ে এই লাইন নিচে সিঁড়ি ছাড়িয়ে যায়।

ফেরার পথে, পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নদীর রিভারবেড আর তার উপর অস্থায়ী দোকানঘর ও ছাউনিগুলি চোখে পড়ল। তখন মনে হল নদীর জল বেড়ে গেলে বা হঠাৎ হড়পা বান এলে এই সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। যেমনটা আসার সময়ে ওই বাঁশের পলকা সাঁকোগুলোর ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল। বর্ষাকালে বা অতিবৃষ্টি হলে, এই অঞ্চলে সেরকমই পরিস্থিতি তৈরি হয়। নদীর এপার-ওপার কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের জীবনও খানিকটা প্রকৃতির দয়া ও খামখেয়ালিপনার উপর নির্ভরশীল বটে। এমনটাও মনে হচ্ছিল যে হঠাৎ ভূমিকম্প হলে, বিশাল বিশাল বোল্ডারে চাপা পড়া ছাড়াও বোল্ডার পড়ে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে এই এলাকার ভূপ্রকৃতিই বদলে যাবে।

 

নিঃস্ব গরবিনী

সাদা রঙের ছোট ছোট নুড়িপাথরে ভরা প্রায় এক কিমি চওড়া প্রান্তরটির উপর দিয়ে মানুষ, গাড়ি ইত্যাদি এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করছে। প্রান্তরের শেষে দাঁড়িয়ে ভুটান পাহাড়। তার পাদদেশ জঙ্গলে ঘেরা। প্রান্তরের মাঝবরাবর ডাইনে-বাঁয়ে বিস্তৃত দাঁড়িয়ে থাকা মরা গাছের কাণ্ড। পাহাড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে প্রান্তরটি বাঁয়ে পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডাইনে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। আর তার বুকের উপর মানুষ, গাড়ির পায়ে-পায়ে উড়ছে শুকনো ধুলো।

প্রান্তরটির ঠিক মাঝবরাবর, ওই গাড়ি-মানুষের যাতায়াতের ফলে যে পথের রেখা তৈরি হয়েছে, সেখানে খানিক ব্যবধানে এক জোড়া করে মোট দু-জোড়া সিমেন্টের মাস্তুলের ডগা দেখা যাচ্ছে। ওই মাস্তুলগুলোর গা থেকে ঝুলে রয়েছে ভাঙা লোহার রড। জয়ন্তী নদী, আর তার বুকের উপর অধুনা নদীর বয়ে আনা পাথরে প্রায় বুজে যাওয়া জয়ন্তী নদীর ব্রিজ। ইনক্রিপসন সাক্ষ্য দেয়, এটি তৈরি হয়েছিল ১৯০৫ সালে।

বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ানো গেল ওই মাস্তুলগুলির কাছে। আরও খানিকটা ওপারের দিকে এগিয়ে গেলেই সারি সারি মরা গাছের কাণ্ড। কাণ্ডগুলির কয়েকটার আকৃতি খুব অদ্ভুত। যেন কোনও মানুষের মূর্তি, আকাশের দিকে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আরও আছে একাকী শুকনো ডাল, আলাদা দাঁড়িয়ে— বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ। দু-দণ্ড চুপ করে ওইখানে দাঁড়ালে মনে হয়, পায়ের তলার নুড়িপাথর, গাছের দগ্ধ শুষ্ক কাণ্ড, ভাঙা মাস্তুলের মাথা— এদের সবারই অন্তরে রয়েছে অনেক না-বলা কথা। বহুদিনের বহু সুখদুঃখের ইতিহাস। যে হাওয়া এই প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের ছুঁয়ে, সে-ও যেন হাতছানি দিচ্ছে একবার এই তল্লাটের অতীতে উঁকি দিতে।

ইছামতী উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, নদীর পাড়ে পোড়ো ভিটে দেখে সেই ভিটের সঙ্গে জড়িত মানুষজনের সুখদুঃখের অলিখিত ইতিহাসের স্বপ্ন দেখা যায়। এইসব মূক জনগণের ইতিহাসই আমাদের জাতীয় ইতিহাস। রাজাদের কাহিনি নয়।

প্রান্তরের মাঝে, ভাঙা মাস্তুলের গায়ে দাঁড়িয়ে, শুকনো গাছের কাণ্ডগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হল বহু মানুষ নিত্যদিন এখানে আসেন, কিন্তু এর অতীত খোঁজেন ক-জন?

নদী, তা সে বড় হোক বা ছোট, তার সঙ্গে জড়িত থাকে অনেক মানুষ, জনপদ, নগর ইত্যাদির জীবনের ইতিহাস, গল্প, গাঁথা। আবার ওই নদীটিরও কোনও-না-কোনও অতীত কাহিনি থাকে। ভাঙাগড়া, বন্যাখরা নিয়ে নদী নিজেও যেন মানবজীবনের দ্যোতক।

ভুটান পাহাড়ের কাতলুং আর সাচি ফু নদীর মিলিত ধারা জয়ন্তী হয়ে নেমে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের সমতলে। তারপর বক্সা অভয়ারণ্য চিরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে তোর্সা নদীর সঙ্গে। বর্ষাকাল বাদে এই নদীর নিম্নপ্রবাহে জল প্রায় থাকে না বললেই চলে। নদীটি গদাধর নামেও পরিচিত।

ফেব্রুয়ারি মাসের বিকেলবেলায় জলহীন জয়ন্তীর বুকের উপর দাঁড়িয়ে মনে হল, জীবনের দ্যোতনার এক করুণ ছবি সেখানে ফুটে রয়েছে।

ভরা বর্ষায় মেঘ-জলের ভালবাসায় যে ছিল উচ্ছলিত, কল্লোলিত, যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, বর্ষাবিরহে আজ সে নিঃস্ব। শূন্যগর্ভে আলুলায়িত পড়ে রয়েছে সেই গর্বিণী যে কারও তোয়াক্কা না-করেই আপন খেয়ালে ছিল বহমান। ছন্দময় গতি আর যৌবনের লাস্য ছিল যার গর্ব। জীবনের প্রাণভোমরা হারিয়ে আজ সেই রুক্ষ স্মৃতিটুকুই পড়ে আছে তার গর্ভের পাথরের গায়ে। তাই পাথুরে প্রান্তরের বাষ্পে যেন গর্বিণীর হতাশার করুণ আঘ্রাণ। 

মানবজীবন যেমন অনিশ্চিত, তেমনই সেই অনিশ্চয়তার অভিঘাতও অনেক সময় হয় সুদূরপ্রসারী। হঠাৎ সুখের মতো অকস্মাৎ বিপর্যয়ও জীবনের খাত চিরদিনের জন্য বদলে দেয়। ওই দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা মাস্তুল, গাছের শুকনো পোড়া কাণ্ডের নিঃশ্বাসে এখনও মূর্ত হয়ে আছে ’৯৩ সালের অভূতপূর্ব বন্যা। সেই বন্যা ছিনিয়ে নিয়েছিল জয়ন্তী ব্রিজের লোহার কাঠামো। মনে মনে সেই দৃশ্য কল্পনা করলে, শিহরিত হওয়া ছাড়া গতি নেই। নদীধারের জঙ্গলের বড় গাছগুলিও সাক্ষ্য দিচ্ছে ওই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের। মানুষের মতো উপরদিকে মুখ করা দুটো ডাল সমেত একটি গাছের কাণ্ড দেখে হয়তো-বা অনুভব করা যায় তার হাহাকার। কত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে জীবন মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, থমকে যায় জীবনের ছন্দ। সারাটা জীবন দগ্ধ হয়ে মাশুল দিতে হয় সেই ঘটনার। অভিঘাতের ক্ষত লুকোতে হয় জোর করে। তবুও সে একাকী সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে থাকে সমুদ্যত। বিপর্যয়ের স্মৃতি বহন করেই সে বাঁচতে চায়।

আলো আস্তে আস্তে নিভে আসছিল। প্রহরী পাহাড়ের দেওয়াল ধীরে ধীরে সন্ধের অন্ধকারে বিলীন হতে থাকে। নিভে যাওয়া আলোর পটে শুকনো ডাল আর ভাঙা মাস্তুলের কালো ছায়া স্মৃতিতে রয়ে গেল এক করুণ অতীতের চিহ্ন বহন করে। ওখান থেকে ফিরে আসতে আসতে মনে পড়ল সেই আনকোরা কবির লেখা আরও কিছু লাইন—

ধূসর ঊষর প্রান্তজুড়ে ছড়িয়ে আছে স্মৃতি
জলের নুপূর থমকে গেছে, ছন্দে আজ বিরতি
সবুজ ছোঁয়া নীল স্বপ্ন, পাখ-পাখালির গান
দিগন্তেরই ফ্যাকাস রঙে ধীর বিলীয়মান
মাথার উপর বিষাদধারা নিত্যদিনই ঝরে
তপ্ত বাতাস বিদায় জানায় পরকে আপন করে
যাওয়া আসার দৃশ্য পথে লুকিয়ে রেখে ক্ষত
নিঃস্ব ভূমে দগ্ধ কায়া একাই সমুদ্যত।


*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা