Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গান্ধির গোসেবা ও আরএসএসের গোরক্ষা, বিস্তর ফারাক

গান্ধির গোসেবা ও আরএসএসের গোরক্ষা, বিস্তর ফারাক | সুমিত দাস

সুমিত দাস

 

১০০ বছর আগে গোরক্ষকরা গোহত্যা বন্ধের দাবিতে আইন চাইলেন। গান্ধিজি বললেন— না। নিজে গোসেবার ট্রেনিং নিলেন। আজীবন গোসেবা করলেন। একই সঙ্গে গোমাংস প্রসঙ্গে ভিন্নমত ও রুচির সহনাগরিকের প্রাচীর হয়ে গণতন্ত্রের প্রতীক হলেন। বিভিন্নতাই ভারত, জানতেন বাপু।

যে-বর্ষায় আমাদের জার্সি গরুটা সাপের কামড়ে মরল, সারা রাত বাছুরটা কেঁদেছিল। আমাদের বাড়িময় কান্নাকাটি শুরু হল ভোরে। যৌথ পরিবারের ‘প্রথম পুরুষ ও কর্তা’, জেঠু অশৌচ রাখলেন। মাথা ন্যাড়া করে শ্রাদ্ধ করলেন। বকনা বাছুরটা একদিন একজন এসে নিয়ে গেল। বাড়িতে গাভীর মৃত্যু— অনাচারের কারণ নয়তো! নাকি পাপ? ভদ্রলোক গয়ায় গিয়ে পিণ্ডিও দিয়ে এলেন। বাছুরটির বাড়ি ছাড়ার শোক কিন্তু ফিরে এল না! অথচ, জার্সি গাইয়ের গল্প ফিরত। কাকারা খড় কাটতেন। মা দেখভাল করতেন। আর তখন আমাদের সকাল-বিকাল বাটি ভরা দুধ। ওদিকে, বাছুর বিয়ানোর পর প্রথম দুধ মধ্যপাড়ার পুকুরে ফেলা হয়েছিল। বাছুর পায়নি। বকনা বলেই একটু বেশি মাত্রায় ওর মাতৃদুগ্ধের অধিকার কাড়া হত!

বছর চল্লিশ আগের গল্প। আমাদের ধানশহরের প্রান্তের কলোনিতে এবাড়ি-ওবাড়িতে তখন গরু আছে। কেউ দেনার দায়ে গরু বেচছেন, তো কেউ একটু অর্থ জমিয়ে নতুন গাইগরু কিনে পাড়ায় ঢুকছেন হেসে। গরু চুরিও হত মাঝেমধ্যে। গৃহস্থের সমৃদ্ধি খোয়া গেলে বিপন্নতা বাড়ে। একবার এমনই এক বাড়ির গরু মাঠ থেকে বাড়িতে না ফেরায় দামোদরের ওপারের দুই মুসলমান যুবককে মেরে পাড়া ঘোরাল কয়েকজন। গরু ফিরল। তবুও যারা মারল, তাদের কেউ কিছু বলেছিল বলে মনে পড়ছে না। অথচ, গোয়ালে গাই বকনা বাছুর বিয়োলে মার খাওয়া যুবকদের ডেকে এনে দরদাম করে বকনা-বিদায় হত।

সকালে পাকা রাস্তা বরাবর আসত খড়ের গাড়ি। জমি থেকে গোলায় যেত ধান, সরষে, খেসারির ডাল— সবই গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে ইট, বালি, সিমেন্ট সাপ্লাইও দেখেছি। নয়ের দশকের মাঝামাঝি— দূর নদীপার থেকে রোগী নিয়ে গরুর গাড়ি আমাদের পাড়ায় এসেছে। মিউনিসিপ্যালিটি যখন ক্রমেই প্রান্ত গিলে বড় হচ্ছে, আমাদের আশেপাশে গরু কমল। নদীপারে, জমির আলে তখনও গরু ঘাস খায়। বকনা বলদ হয়ে গাড়ি টানে। গরু পাল দেওয়ার জায়গা তখনও অনেক। লোহার বেড় দেওয়া কাঠের চাকা বানানোর মিস্তিরির গ্রামীণ সংসারে তেমন অভাব নেই। আমাদের কাছের বিস্তীর্ণ ধানমাঠ, যেখানে গরু চড়াতে, বর্গায় সেখানে মুসলমান বড় কৃষকের জমি পেলেন নিতাই চাষি। সে জমিতেও নয়ের দশক এল। আমাদের ক্রিকেট-ফুটবল মাঠসহ কয়েকটি পাড়া গজাতে গজাতে হাওয়া হয়ে গেল সিংহভাগ গোয়াল। যাঁরা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিকভাবে গরুর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা চলে গেলেন একটু দূরে।

এ তো ভারতেরই গল্প। ‘গাই হামারি মাতা’— গাইগরু ‘গোমাতা’ হয়ে হিন্দু বাঙালির উঠোনের পাশে ছিল। আজও আছে। মুসলমানের গাভীও দুধই দিত৷ আজও দেয়। কিন্তু ‘ব্যায়েল’, মানে, বলদখানি? বাংলায় বর্গার পর জমির গড় আকার বেশ খানিকটা কমল। ট্রাক্টর বাড়ল। তাছাড়া, জমিতে লাঙল দিতে বা গরুর গাড়ি টানতে ডজন-ডজন বলদ লাগত না কোনও কালেই। তবে, ভাগচাষি বা ছোটচাষির বলদই ভরসা ছিল। ফলে, গোমাতার ঠিকানা আর বলদের অস্তিত্ব আলাদাই ছিল।

সাধারণত প্রজননের ফলাফলে বলদ ও গাইগরুর জন্মহার ৫২:৪৮। বলদ সামান্য বেশি জন্মায়। শৈশবে-কৈশোরে বাছুরের জন্মকালে বড়দের চোখেমুখে বিভাজন দেখেছি। বকনা জন্মালে বিরক্তি বাড়ত, তবে নতুন দুধের ধারায় গাভীটি দিত দুধ, যা কারও জন্য আয়ের উৎস। বাকি সব স্কুল-পাঠ্যের রচনায় দুটি শিং, একটি লেজ— একই থাকত। গরু নদীর ধারে থাকলেও যা, নদী গোয়ালের পাশ দিয়ে বইলেও তাইই।

গাই, হিন্দিতেও গাই। ‘মাতা তো বটেই’। তবে, ব্যায়েল বা বলদ মাতা নয় কিন্তু! দুধ ছাড়া মা হওয়া অসম্ভব। গরু পশুটির প্রতি মানুষের, বিশেষত ভারতের অমুসলিম ও অখ্রিস্টান, নাস্তিক, কখনও কখনও দলিত-আদিবাসী ব্যাতিরেকে বাকিদের মৌলবাদও ভয়ঙ্কর। বলদ গোয়াল ছাড়া করতে পারলে বাঁচে, চামড়ার জিনিসপত্র ব্যবহার করে, অথচ খেলেই দোষ। আপাতত ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করলাম না, কারণ, শহর কলকাতার আনাচে-কানাচে বিফস্টেক, বিরিয়ানি বা কালাভুনার টেবিলে অমুসলিম-অখ্রিস্টান যাদের দেখেছি, তারা ‘গর্ব সে কহো হিন্দু’ নন। বরং অনেক বেশি মানুষ। রাঁধুনি ও দোকানদারদের বলতে শুনেছি— ‘এরা না খেলে কলকাতার বিফ-হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে!’

গোমাতা, গাভী, দুধ, সর্বোপরি গোরক্ষক ও গোরক্ষকের হাতে খুন ভারতীয় মূলধারার রাজনীতিতে ফিরেছে বিজেপির কল্যাণে। ফিরেছে বলছি, আসলে বহুকাল ধরে ছিলই। সুপ্ত। ২০১৪ সালের পর ২৮ জনের মৃত্যু, এর মধ্যে ২৪ জন মুসলমান, আহত ১২৪, অধিকাংশই বিজেপিশাসিত রাজ্যের ঘটনা। এই ঘটনা-প্রবাহের মাঝে গোরক্ষকদের দেশ সারাবিশ্বে গোমাংস উৎপাদনে তৃতীয়। সারা বিশ্বের ১৩ শতাংশ গরুর চামড়ার উৎপাদক। এসব কিছুর মধ্যে গোরক্ষকদের ভয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া গরুর সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে গত জানুয়ারিতে। সিংহভাগই বলদ। আর উত্তরভারতের জাতীয় সড়ক, বড়-ছোট রাস্তায় গরু-দুর্ঘটনায় ৯০০-র বেশি মানুষ মরেছে। এ তথ্য ছাপিয়ে রাজ্যে-রাজ্যে গোরক্ষকদের গোশালায় শয়ে-শয়ে গরু অনাহারে মরেছে। বিজেপির বসুন্ধরা রাজের জমানায় শুধুমাত্র রাজস্থানের হিঙ্গোনিয়ায় মরেছে ৭৪ হাজার গরু। তাবৎ ঘটনায় বহুরূপে সম্মুখে সেই গোরক্ষক। গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির ঘটনায় জড়িত, যারা ধরা পরেছে, তারা কেউ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, কেউ বজরং দল, বা কেউ তখনও পর্যন্ত স্থানীয় গর্বিত গোরক্ষক। গোশালায় গরু বাঁচানোর কথাও ছিল তাদেরই! গোরক্ষার পাশে ‘গোসেবা’ হিসেবে চিহ্নিত একটা শব্দও ছিল। যা আজকাল শোনা যায় না প্রায়। মহাত্মা গান্ধি গোরক্ষকদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গোসেবার পক্ষ নিয়েছিলেন।

একবার সবরমতি আশ্রমে একটি বাছুরের পা ভাঙে। বাছুরের অসহ্য যন্ত্রণার উপশমে পশু চিকিৎসকের নানা চেষ্টা যখন ব্যর্থ, বিষণ্ণ গান্ধিজি বাছুরটিকে মারার অনুমতি দেন৷ কিছু গোরক্ষক ঘটনাটিকে গোহত্যা বলতে শুরু করে। এবং, তারা বাপুকে চিঠিও লেখেন৷ তিনি বলেন, ‘পীড়ায় ক্লিষ্ট পশুর মুক্তি হিংসা নয়। যেমন চিকিৎসার জন্য অপারেশন খুন বা হিংসা নয়, তেমনই।’ গান্ধির আশ্রমে গরু ছিল। ছিল গোসেবার দায়িত্ব। গোরুর পরিচর্যা যাতে যথাযথ হয়, তার জন্য মোহনদাস আর মদনমোহন মালব্য দু-সপ্তাহের ট্রেনিংও নিয়েছিলেন।

গোমাতা, গোরক্ষা, গরুগুজব, গরুপিটুনির এই সময়কালে গান্ধিজির বক্তব্যেও সমকালের প্রতিফলন আছে। ভুখা, কৃষিজীবীর দেশে জন্মদাত্রীর চেয়েও গরু অর্থে ‘গাই’ গুরুত্বপূর্ণ বলেছিলেন বাপু। দুধ, লাঙলটানা, গরুর গাড়িতে যাতায়াত, তেলির তেল নিংড়ানো বলদ— শতবর্ষ আগে গ্রামীণ মানুষের উৎপাদন, যাপন-সংস্কৃতির আনাচেকানাচে এই চতুষ্পদ। নিজেকে ঘোষিত ধার্মিক, নিরামিষভোজী জানান দেওয়া গান্ধিজি ১৯২১ সালে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লিখলেন— ‘গাই করুণার কাব্য, এই সৌম্য পশু মূর্তিমান করুণা। এটি কোটি কোটি ভারতীয়ের মা। গরুর মাধ্যমে মানুষ সমস্ত জীবজগতে নিজস্ব তারতম্য স্থাপন করেছে। গরু পূজনীয়, এর কারণও স্পষ্ট। ভারতেই গরু মানুষের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে কামধেনু বলা হয়। কেবল দুধই নয়, গরুর জন্যই কৃষি সম্ভব হয়েছে।’ সত্যিই তো। ১০৩ বছর আগের কথা। রাস্তায় গরু-গুজবে পিটিয়ে মারা গোরক্ষকরা এমন কৃষি-ভারত দেখেছে নাকি? যেখানে জমিতে মাটির নিচ থেকে জল তোলা থেকে লাঙল দেওয়া, সর্বত্র গরুর ব্যবহার ছিল! তখনও কসাই ছিল। গোমাংসভোজী আদিবাসী, দলিত, মুসলমান ছিলও। ছিল চামড়ার কারবার। আবার দেবজ্ঞানে গরুর পূজাও ছিল। গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়ার লেখায় সাফ বলেছিলেন— ‘বেঁচে থাকতে গরু সর্বস্ব দেয়, মরার পরেও কাজে আসে। জন্মদাত্রীর পক্ষেও তা সম্ভব নয়।’ এই তো সহজে গরুর উপকারিতা বা উপযোগিতা বর্ণনা। আসলে, মোহনদাস যখন ইয়ং ইন্ডিয়ায় লিখছেন, তখনও গোরক্ষার প্রবল দাবি ছিল। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা গোরক্ষায় কঠোর আইন চাইছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল।

১৯২৫-এ তিনি বললেন— ‘আমার ধর্ম আমায় শেখায়, যারা আমার ভিন্নমত, তাদের নিজের আচরণ দিয়ে বোঝানো- যে গোহত্যা পাপ।’ এবং, ‘গোরক্ষার অর্থ কেবল গরু হত্যা বন্ধ করাই নয়, সমস্ত নিরীহ অবলা জীবের রক্ষা।’ একটা কঠিন সময়ে, গোরক্ষার নামে হানাহানি করতে চাওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কীই-বা বলতে পারতেন গান্ধিজি? হয়তো অনেক কিছু, কিন্তু, ঘুরিয়ে বলে ফেললেন, আচরণই ধর্ম, আর ভিন্নমত ও রুচি থাকবে, তাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত! তাই তিনি এ-ও বলেছেন, ‘গোরক্ষা হিন্দুদের ধর্ম হলেও, অহিন্দুদের ওপর বল প্রয়োগ করা ধর্ম হতে পারে না। সংখ্যালঘু মুসলমানকে জোর করে নিষেধাজ্ঞা মানতে বাধ্য করা সংখ্যাগরিষ্ঠের বোকামি বা অন্যায়।’

৪৭-এ শ্রমের বদলে অর্থের সঙ্গে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের কাছে খাদ্য-পানীয় ও আশ্রয় দাবি করলে, বাপু বলেন, ‘যারা মাছ-মাংস খান, তাঁরা মাছ-মাংসের দাবি করুক।’ ওই বছর ২৫ জুলাইয়ের প্রার্থনাসভায় তিনি বলেন— ‘গোহত্যা আইন দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব না। ভারতে যা আমার ধর্ম, তা অন্যেরও ধর্ম হবে, এ কেমন করে হয়!’ গোমাংসের রপ্তানি তখনও ছিল। তবে, জাহাজে আস্ত গরু পাঠানো হত। তিনি প্রশ্ন করেন— ‘নিজের হাতে গরু কাটতে না পারলেও, বড় বড় হিন্দু অস্ট্রেলিয়া বা অন্যত্র গরু পাঠায়। ভারতে গরুর সংখ্যা বেশি, সেখান থেকে চামড়ার জুতো তৈরি হয়ে আসে। আসলে মানুষ ধর্ম কী, তা বোঝে না। আর আইন দিয়ে গোহত্যা বন্ধ করতে চায়।’

চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ও রুচি আসলে বিভিন্নতায় আক্রমণ। মৌলবাদ। গান্ধিজি এটা বুঝতেন, অবস্থান নিতেন৷ বদলে যাওয়া সময় ও অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতে গরুর সংখ্যা ২০ কোটির বেশি। গাই-বলদ নির্বিশেষে প্রতি ৭ জনে একটি করে গরু। বিশ্বের ৩৩ শতাংশ গরু ভারতে থাকে। দুধ উৎপাদনেও প্রথম। যা সারা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ২৪ শতাংশ। গত এক শতকে, বিশেষত স্বাধীনতার পর তিলে তিলে বদলে গেছে গ্রামীণ ভারত। এই ছয় ও সাতের দশকেও মূল ধারার হিন্দি সিনেমার লাইফলাইন ছিল গরু। এখন কৃষি ও গ্রামীণ উৎপাদন যন্ত্রনির্ভর। গেরস্থের সঙ্গে গরুর দূরত্ব বেড়েছে। গাই-গরুর বেশিমাত্রায় প্রয়োজন হলেও, বলদ ও বৃদ্ধ পশুর ঠিকানা কী? উত্তরভারতের মতো রাস্তার দখল?

আসলে, শতবর্ষ আগে মোহনদাসের জীবদ্দশায় গোরক্ষকদের চিন্তা ও আদর্শ যা ছিল, আজও তা বদলায়নি। বরং উল্টে, একটা এমন রাজনৈতিক সময় এল, যা গোরক্ষকদের পক্ষে। গণপিটুনি যেন পূণ্যার্জনের দৌড়। গান্ধির গোসেবা ছিল দায়িত্বের। দায়বদ্ধতার। একই সঙ্গে বিভিন্নতার ভারতে খাদ্য নিয়ে তাঁর অবস্থান ছিল গণতান্ত্রিক। ফারাক ছিল। ফারাক থেকে গেল। থাকবেও। কারণ, শিকড়েই বহুত্ব ছাড়া ভারত সম্ভব নয়। নানা বিতর্ক আজও বয়ে নিয়ে চলা মোহনদাস ওটুকু ঠিক জানতেন।