Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঋত্বিক ঘটক আজ

অয়ন ব্যানার্জী

 

শিল্পীর কি শিল্পের উপর কোনও দায়বদ্ধতা থাকে? নাকি তার দায়বদ্ধতা তার হৃদয়ের প্রতি? শিল্প হৃদয়কে উন্মুক্ত করার এক মাধ্যম মাত্র?

একবার ঋত্বিক ঘটককে একটি সাক্ষাৎকারে, তিনি সিনেমা কেন করেন প্রশ্ন করা হয়। উত্তরটার সারাংশ কিছুটা এইরকম —

‘আমি নিজের কথাটা সকলকে চিৎকার করে বলতে চাই। আমার নিজের দর্শন, নিজের ভাবনা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই আমার আসল লক্ষ্য। এটার উদ্দেশ্যেই আমি প্রথমে কবিতা লেখা শুরু করি। কিছুদিন বাদেই বেশ বুঝতে পারি, কবিতা আমার দ্বারা হবে না। তখন মন দিই গল্প লেখায়। ‘দেশ’, ‘পরিচয়’, ‘শনিবারের চিঠি’ ইত্যাদি নানা পত্র-পত্রিকা মিলিয়ে প্রায় একশোর উপর গল্প প্রকাশিত হয় আমার। কিছুটা নাম ডাকও হয়। সেই প্রথম বুঝি, সাহিত্যের মাধ্যমে কীভাবে মানুষের একেবারে মনের গভীরে ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু সাহিত্যের এই মন জয়ের গতি যেন খুবই মন্থর। অনেক সময় লেগে যায়, ধীরে ধীরে বহু মানুষের মনে গিয়ে বাসা বাঁধতে। তখন ‘জবানবন্দি’ আর ‘নবান্ন’ দেখে মনে হল, থিয়েটার মানুষের মনে আরও তাড়াতাড়ি প্রভাব ফেলতে পারে। আমার যেন অনেক তাড়া ছিল। তাই গল্প লেখা ছেড়ে দিয়ে শুরু করলাম নাটক। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার মনে হল, এই করেই বা কতজন মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারব আমার বক্তব্য? খুব বেশি হলে দশ হাজার মানুষ দেখবেন আমার শো। বুঝলাম এক লাফে লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছোবার একমাত্র রাস্তা হল সিনেমা। তাই সিনেমা করা শুরু করি। আজকাল লোকে বলছে ধীরে ধীরে টেলিভিশন সিনেমার জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যাবে। যেদিন সেটা হবে, সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে টিভিতে কাজ করা শুরু করব।’

তাঁর উত্তরের শেষ লাইনটা পড়লে, চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। সত্যজিৎ রায়কে বাদ দিলে, যাকে বাংলা চলচ্চিত্রের জনক বলা যেতে পারে, যার ছবি দেখে মণি কল, আদুর গোপালাকৃষ্ণন, মীরা নায়ার ছবি করা শিখেছেন, তিনি সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাওয়ার কথা বলছেন? এ যেন শিল্পীর হাতে শিল্পের বস্ত্রহরণ! অথচ এই অকপট সত্যটাই ঋত্বিক ঘটকের সব চেয়ে বড় পরিচয়। তিনি নিঃসন্দেহে বড় শিল্পী ছিলেন, শিল্পের প্রতি তার নিষ্ঠাও ছিল অনড়, কিন্তু তার কঠিন জীবনের পথে কম্পাস তার শিল্প নয়, ছিল তার মনের গভীরে জমে থাকা দর্শন, যা তিনি চিৎকার করে শোনাতে চেয়েছিলেন সকলকে। সেই হৃদয়ের তাড়নাতেই কখনও পা রেখেছিলেন নাটকের মঞ্চে, কখনও হাতে নিয়েছিলেন কলম, আবার কখনও ক্যামেরা।

তার মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পর ঋত্বিকের ছবির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে গেলে, আগে দেখতে হবে কতটা পাল্টেছে চলচ্চিত্রের ধারা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই যে সব পরিচালক ছবি করেছেন, তারা সবাই তাদের কিছু পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করেই হেঁটেছিলেন। এই পূর্বসূরিদের মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য সোভিয়েত রাশিয়ার পরিচালক সার্গেই আইজেন্সটাইন, এবং তারও আগে মার্কিন পরিচালক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। কীভাবে একটি শটের পর আরেকটি শট জুড়লে একটি দৃশ্য তৈরি হয়, তার সূত্র এদের হাত ধরেই শেখে পরিচালকরা। আইজেন্সটাইনের মন্টাজ থিওরি আজও ছবি করার গসপেল। খুব সহজে তা বুঝতে গেলে ‘মেঘে ঢাকা তারার’ শেষ দৃশ্যটাই ধরা যেতে পারে। আমরা দেখি টিবি আক্রান্ত নীতা তার দাদাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলছে ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’। ঠিক তার পরের শটে ক্যামেরা চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলিকে তাক করে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে দুটি শটের মধ্যে কোনও মিল নেই, কিন্তু পর পর দুটি শট বসালে যেন মনে হয়, নীতার চিৎকার দূর দিগন্ত ছাপিয়ে সেই পাহাড়ের গায়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। ঋত্বিক, সত্যজিৎ দুজনেই বহুবার তাদের শিল্পের পিছনে আইজেন্সটাইনের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন।

তখন বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে যে ছবিই হত, তার শিরদাঁড়া ছিল কিন্তু সেই আইজেন্সটাইনের মন্টাজ থিওরি। এবং আজ প্রায় সাত দশক পরও বেশির ভাগ ছবির ভিত সেই মন্টাজ। তবে গত সত্তর বছরে মন্টাজ প্রয়োগের ধ্যান ধারণার আমূল বদল ঘটেছে। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়েছে মন্টাজভিত্তিক ফিল্ম এডিটিং। এখন পরিচালকরা মন্টাজকে আবেগের মাত্রা নির্ধারণ, বা লোকেশন ফুটিয়ে তুলতেই ব্যাবহার করেন বেশি। সংযোগহীন শট মিলিয়ে দৃশ্য তৈরির প্রথা, এখন প্রায় অচল। তাই বর্তমান দর্শকের কাছে, ঋত্বিকের ছবির এডিটিং কিছুটা সেকেলে ঠেকতে পারে।

বিরল হয়ে উঠেছে সিনেমায় সিমিওটিক্স বা প্রতীকের ব্যবহারও। ‘নাগরিক’-এ রামুর ঘরের দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার বার বার দেখান ঋত্বিক। খোলা মাঠে একটি বাড়ি আর গাছের ছবি আঁকা তাতে। রামুদের টাকার অভাবে ছেড়ে আসা আদি বাড়ি, তার বড় হওয়ার স্বপ্ন, এবং দিনের পর দিন তার চাকরি খোঁজার বিফল চেষ্টা, সবটাকেই প্রতীকী রূপে বোঝাতে ক্যালেন্ডারটি ব্যবহার করেন ঋত্বিক। এখন এতটা পরোক্ষ সিম্বলিজম-এ দর্শক আর মন দেন না। সে কারণেই পরিচালকরা কোনও প্রতীক ব্যবহার করলে সেটিকে ছবির অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। যেমন ইন্সেপশনের সেই লাট্টু, বা পাল্প ফিকশনের মণি-মুক্তোর বাক্স।

তবে বর্তমান দর্শক ঋত্বিকের ছবির যে বিষয় দেখে সব চেয়ে বেশি ভুরু কোঁচকান, তা হল তার চরিত্রদের নাটকীয় অভিনয়। এখন বাস্তবভিত্তিক স্বাভাবিক অভিনয় দেখে অভ্যস্ত দর্শকদের চোখে তা অতিরিক্ত মাত্রায় ড্রামাটিক মনে হতে পারে। তবে ষাটের দশকে সিনেমার উপর থিয়েটারের একটা সরাসরি প্রভাব ছিল। তাই শুধু ঋত্বিক নন, বিলি উইল্ডার থেকে কুরোসাওয়া, সাবর ছবিতেই সেই প্রভাব দৃশ্যমান। এমনকি কুরোসাওয়া জাপানি কাবুকি থিয়েটারের চড়া অভিনয় প্রথাকে, ইচ্ছাকৃতভাবেই বহু ছবিতে ব্যবহার করেন।

ঋত্বিকের ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, যেন কিছুতেই আলাদা করা যায় না তার মানুষ আর শিল্পী সত্তাকে। সব শিল্পীরই কাজের আনাচে কানাচে কোথাও লুকিয়ে থাকে তার জীবনের কিছু প্রতিফলন, কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে। অথচ ঋত্বিকের জীবনটাই যেন তার শিল্পের ছায়া। তার ছবিতে মানুষের দারিদ্র, যন্ত্রণা, অসুখ, স্বপ্নভঙ্গ সবই তাড়া করে বেরিয়েছে তার নিজের জীবনকেও। আর তার ছবির চরিত্রের মতোই, জীবনের সঙ্গে লড়ে গেছেন নতুন আলোর অপেক্ষায়।

৫২ সালে তার প্রথম ছবি নাগরিকের কাজ শেষ হলেও টাকার অভাবে ছবিটির মুক্তি আটকে যায়। ২৫ বছর বাদে ৭৭ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর যেদিন নিউ এম্পায়ারের পর্দায় প্রথম মুক্তি পায় নাগরিক, ঋত্বিকের মৃত্যুর তখন প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে। যে মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন তিনি, সেই মানুষই নিষ্ঠুরভাবে বারংবার বিরূপ হয়েছে তার ছবির প্রতি। পরপর ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার পর প্রযোজকরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। প্রায় এক দশক আর কোনও ছবি পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি ঋত্বিকের। সাঙ্ঘাতিক আঘাত পান শিল্প বিচ্ছিন্ন শিল্পী। যন্ত্রণা ভুলতে ডুব দেন মদ্যপানে। প্রবল অবসাদ গ্রাস করে তাকে। সম্ভবত কিছুটা পেটের দায়ই শিক্ষকতা করতে বাধ্য হন পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। অথচ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও একটিবারের জন্যও দর্শনচ্যুত হননি ঋত্বিক। পেটের দায়ে করতেই পারতেন বাজার মাতানো ফরমুলামাফিক ছবি। কিন্তু সর্বহারা ঋত্বিক সেদিনও বুক চাপড়ে বলেছেন ‘আমি আপনাকে সস্তার আনন্দ দিতে আসিনি। আমার ছবি দেখে যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, বাইরে এসে সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলানোর কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোটেস্ট যদি আপনার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি, তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।

ঋত্বিকের ছবি কি কালজয়ী? এখনকার দর্শক কেন দেখবেন ঋত্বিকের শিল্প? যে কোনও শিল্পীর সাধনাকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। এক তিনি যা দেখছেন সেটিকে শিল্পের রূপ দিতে তার সাধনা। যেমন চিত্রশিল্পী করেন তুলির আঁচড়ের অভ্যাস, কবি শেখেন শব্দ নিয়ে খেলা, পরিচালক ক্যামেরার কারিকুরি। তবে এর আগে আরও এক বিশাল পথ অতিক্রম করতে হয় শিল্পীকে। সেটা তার দৃষ্টির সাধনা। তিনি যা দেখছেন তাকে শুদ্ধ করার পথ। তার হৃদয় উন্মোচনের পথ। বুদ্ধির বিষ শুষে বার করে, নিষ্পাপ মনকে বাঁচিয়ে তোলার তীর্থযাত্রা। যে পথের কথা বর্তমানে প্রায় ভুলেই গেছি আমরা। এ পথ অতিক্রম করলে, শিল্প শিল্পীর হৃদয়ের প্রতিফলন হয়ে ওঠে। না করলে, যতই চমক বা ঐশ্বর্য থাক সেই শিল্পে, হৃদয় থাকে না।

ক্লিকবেটের যুগে আজ শিল্প শুরু হয় এক বিকৃত ভোগবাদী ধারণা থেকে। শিল্প এখন পণ্য। বিকোলেই তার সার্থকতা। ইউটিউব নেটফ্লিক্সের দাপটে তাই সে এখন ভণ্ড ও ক্ষণস্থায়ী। এ শিল্প ভেঙে চুরমার করে ফেললেও, খুঁজে পাওয়া যায় না শিল্পীর মন। পড়ে থাকে শুধু এক মেকি ব্যবসায়িক চেষ্টা ও সস্তা খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা। শুধু এই কারণেই ঋত্বিকের ছবি কালজয়ী। সময়ের সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্প পাল্টেছে। শুধু শিল্প হিসেবে বিচার করলে এখন হয়তো অতটা প্রয়োজনীয় নাও মনে হতে পারে ঋত্বিক-এর ছবি। কিন্তু যে শিল্প হৃদয় থেকে আসে, যা করতে শিল্পী পেটের চিন্তা করেন না, পরোয়া করেন না বাজারে তার শিল্পের দাম, সেই শিল্প পুরনো হলেও তাতে থেকে যায় শিল্পীর মনের রঙ। ঋত্বিকের ছবি ছলনাহীন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র শঙ্কর থেকে ‘অযান্ত্রিক’-এর বিমল, পর্দার চরিত্র কখনও আবরণ সৃষ্টি করে না, দর্শক আর ঋত্বিকের দর্শনের মাঝে। যেমন নাগরিকের শেষ দৃশ্য। রামু চিৎকার করে তার বোনকে বলছে ‘সীতা কাঁদিস না। আমরা আর কাঁদব না। দাঁতে দাঁত চিপে অপেক্ষা করব শুধু। একদিন না একদিন আসবেই সেই নতুন কিছু। যার পথ তৈরি হচ্ছে আজ।’ আমরা যেন দেখতে পাই না পর্দার চরিত্রকে। তাকে ভেদ করে দেখা যায়, এলোমেলো চুলে অন্তরালে দাঁড়িয়ে এক শীর্ণকায় বিদ্রোহী শিল্পী– ঋত্বিক ঘটক।