Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নাটকের বিশ্বকাপ নাকি বিশ্বকাপের নাটক

সৌরাংশু

 

 


সাদা বল ক্রিকেটটাকে রাহুলের মতো কোনও ভারতীয় কোচই বোধহয় বোঝেননি। তাই অলরাউন্ডার না থাকা সহ বেশ কিছু ঘাটতিকে কীভাবে নিজের সুবিধা করে ফেলতে হয় এবং নিজের দেশে খেলা হওয়ার সুযোগ নিয়ে কীভাবে নিরন্তর আক্রমণের মাধ্যমে অভীষ্টের একদম কাছে পৌঁছতে হয় তা রাহুল দ্রাবিড়ের থেকেই শেখা উচিত। আর অধিনায়ক রোহিত? দলের জন্য নিজের স্বাভাবিক খেলা বিসর্জন দেওয়া গত দুবছর ধরে কোচের সঙ্গে বসে তিল তিল করে ভারতের সফলতম ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ক্যাম্পেনের অধিনায়কের ঠিক মুখের সামনে থেকে কাপ সরে গেল। কষ্ট-দুঃখ তো থাকবেই, কিন্তু এই পারফরম্যান্সে গর্বিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না

 

গত দেড় মাস ধরে ভারতের গোটা দশেক স্টেডিয়ামে আয়োজিত হল পুরুষদের ৫০ ওভার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। একটা সময় যা ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মার্কেটিং মোচ্ছব ছিল। বর্তমানে, আরও চলবে না তুলে দিতে হবে টাইপের কথাবার্তা চলছে।

তা যে জিনিসটার অস্তিত্ব সঙ্কটে, তাকে তো আরও যত্নে লালন পালন করতে হয়। পুরুষদের বিশ্বকাপ ফুটবল ছেড়ে দিন, পুরুষদের হকি বিশ্বকাপ যখন ভুবনেশ্বর ও রাউরকেল্লায় আয়োজন করা হয়, তখন ওড়িশা সরকার অন্তত যেভাবে প্রচার করেছিল, তার সিকিভাগও ছিল না এই সেপ্টেম্বর মাসেও। হাংঝাওতে এশিয়ান গেমসে ভারত ২৮টা সোনা সহ ১০৭টা পদক পাচ্ছিল, আর উন্মুক্ত হাওয়ার মতো সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমও ক্রিকেট ছেড়ে এশিয়ান গেমসে ভারতের জয়গাথা নিয়েই মেতে ছিল।

চেনা স্ক্রিপ্টের মতোই ভারতের খেলা শুরু হল এবং সকলকে অবাক করে দিয়ে ভারত ম্যাচের পর ম্যাচ জিততে শুরু করল। আর ব্যস মিডিয়ার মুখ গেল ঘুরে। হাংঝাও তো পরে হবে। কিন্তু সারা ভারত যে নীল সমুদ্রে পরিণত হচ্ছে তার ফায়দা তুলতে হবে না! অতএব এশিয়ান গেমসও শেষ হল, ভারতও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জিতল আর নটেগাছটিও মুড়োল। মিডিয়া এবারে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করল পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে।

এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে যদি হিসেব করে দেখেন তাহলে ভারতীয় ৫০ ওভারের দলে অনেক সমস্যা ছিল। মানে চার নম্বরে কে খেলবেন, ঈশান কিষাণ না কেএল রাহুল, তিন পেসার না তিন স্পিনার। সূর্য কুমার যাদব ৫০ ওভারের উপযুক্ত কি না! অশ্বিন কি সুযোগ পাবেন না! এই সব। আর ফলাফলের দিক থেকে দেখলেও যা দেখা যাচ্ছিল তা ভরসা জোগাবার জন্য যথেষ্ট নয়। বুকিরাও যে ভারতকে ফেভারিট ধরছিল তাও নয়। ইংল্যন্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পরে তারা তৃতীয় ফেভারিট হয়েছিল।

এই সময় এশিয়া কাপ জয় অনেকগুলো ধাঁধার সমাধান করে দেয়।

১) পাঁচ নম্বরে কেএল রাহুলের ফর্ম। চোটের জন্য দীর্ঘদিন দল থেকে দূরে থাকার পর রাহুল ফিরে এসেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপে সেঞ্চুরি করেন। যখন ধরার ধরেছেন, যখন মারার মেরেছেন রাহুল। আদতে ওপেনার হয়েও ৫ নম্বর ব্যাট হিসাবে গত কয়েক বছরে বিশ্বের সেরা গড় তাঁর। নিজের যোগ্যতার কথাটা আবার প্রমাণ করেন।

২) রোহিত শর্মার ফর্ম। বেশ কিছুদিন ধরেই অধিনায়ক রোহিত শর্মা রান পাচ্ছিলেন না। কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ, শুরুতে দেখে খেলা এবং তারপর খোলস ছেড়ে বেরানোর পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে তিনি শুরু থেকেই চালিয়ে খেলতে শুরু করে দেখালেন যে তাঁকে নিয়ে আশঙ্কা অমূলক।

৩) বিরাট কোহলি, দীর্ঘ অফ ফর্ম পেরিয়ে আবার রান করতে শুরু করেছেন। বিরাটকে দেখে বোঝা যায় না যে উইকেটে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। যখন নোঙর ফেলার তখন ফেলছেন, এবং শেষের দিকে এসে ঝড় তুলছেন।

৪) বোলিং ও ব্যাটিং-এ যথেষ্ট অবদান রেখে ভারতীয় দলে হার্দিক পাণ্ড্য নিজের গুরুত্ব আবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

৫) কুলদীপ যাদব মাঝের অফ ফর্ম এবং দল থেকে বাদ পড়া ভুলে বলের গতি সামান্য বাড়িয়ে আবার দলে জায়গা পাকা করলেন। তবে এখন অনেক বেশি কৃপণ হয়েছেন। উইকেটের জন্য ঝুঁকি কম নিলেও উইকেট আসছে।

৬) লোয়ার মিডল অর্ডারে অক্ষর প্যাটেল ভরসা জোগাচ্ছিলেন। কিন্তু এশিয়া কাপের পরেই চোটগ্রস্ত হয়ে চিন্তা বাড়ালেন।

৭) এবং অবশ্যই শুভমন গিলের ফর্ম।

এশিয়া কাপ এবং তারপর গুরুত্বহীন অস্ট্রেলিয়া সিরিজে অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের দেখে নেওয়া গেল। এবং অস্ট্রেলিয়া সিরিজের বোলিং অনুযায়ী, শেষ মুহূর্তে চোটপ্রাপ্ত অক্ষরের জায়গায় ঢুকলেন অশ্বিন। তিনি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচও খেললেন এবং মিডল ওভারে কুলদীপ ও হার্দিকের সঙ্গে মিলে এমন ফাঁস লাগালেন যে অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডার সেই ফাঁস থেকে বেরোতে পারল না। শুরুতেই তিন উইকেট হারিয়েও বিরাট ও রাহুলের ধৈর্য ধরে ব্যাটিং করে প্রায় নয় ওভার বাকি থাকতেই জিতিয়ে দিলেন।

ভারতের জয়ের টেমপ্লেট তৈরি হয়ে গেল। চার ব্যাটার, এক উইকেটকিপার ব্যাটার, এক পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক, এক স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার জাদেজা, আট নম্বরে হয় পেস বোলিং অলরাউন্ডার শার্দূল ঠাকুর অথবা স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার অশ্বিন, তিন বোলার কুলদীপ, বুমরাহ এবং সিরাজ। মহম্মদ শামি বাইরে বসে রইলেন।

আফগানিস্তানের স্পিনারদের সামলানোর জন্য দিল্লি পাটা উইকেট বেছে নিয়েছিল ভারত। তারপর আহমেদাবাদে পাকিস্তান এবং পুনেতে বাংলাদেশ। উভয় ক্ষেত্রেই রান তাড়া করে সহজেই জিতল ভারত। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘটল একটা দুর্ঘটনা। নিজের বলে একটা শট বাঁচাতে গিয়ে হার্দিক পাণ্ড্য ডান পা মচকালেন। বিরাট কোহলি তাঁর ৪৯তম সেঞ্চুরি করলেন।

পাণ্ড্য প্রায় এক মাসের জন্য বাইরে, দল পরিচালন সমিতি জানাল যে পাণ্ড্য হয় গ্রুপের শেষ নেদারল্যান্ডস ম্যাচ অথবা সেমিফাইনালে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁর জায়গায় কে খেলবেন?

পরের ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধর্মশালায় মহম্মদ শামি ৫ উইকেট পেলেন এবং ডারেল মিচেলের শতরান এবং রাচিন রবীন্দ্রর ৭৫-এর পরেও নিউজিল্যান্ড ২৭৫-ও করতে পারল না। বিরাট কোহলির ৯৫-এর উপর ভর করে ভারত জিতে গেল।

ভারত এখন থেকে আগের চার অলরাউন্ডার (রাহুল সমেত)-এর ছকের বাইরে গিয়ে পাঁচ ব্যাটার, রাহুল ও জাদেজা দুই অলরাউন্ডার এবং চার বোলার নিয়ে খেলতে নামল। আট নম্বরে মহম্মদ শামি। শামির সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নতুন ছকটাই নির্ধারিত হয়ে গেল। এবং বলা যেতে পারে পাণ্ড্যর সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বিন অথবা শার্দূল ঠাকুরের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য হয়ে গেল।

পরের ম্যাচ ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ভারতীয় ব্যাটিং বেকায়দায় পড়ল, তাদের লম্বা ল্যাজ বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু বোলিঙের জন্য মাত্র ২২৯ করেও ১০০ রানে জিতে গেল ভারত।

তার পরের ম্যাচ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে গিল এবং শ্রেয়স আয়ারও রান পেয়ে গেলেন। শ্রেয়স এই দলের একজন বিশেষ সদস্য যিনি শুরু থেকেই একদম আধুনিকতম ছকে সীমিত ওভারের ব্যাটিংটা করেন। কখনওই তিনি ঝুঁকি নেওয়া কমাবেন না। দরকারে আকাশে বল খেলবেন। টপ পর্ডারে যেই খেলাটা রোহিত খেলছেন, সেটাই রোহিত আউট হওয়ার পর গিল বা শ্রেয়স খেলছেন। কোহলি নোঙরের ভূমিকা পালন করবেন। পাঁচে রাহুল প্রয়োজনে ধরবেন এবং প্রয়োজনে মারবেন। সূর্য এসে ফিনিশ করবেন। শ্রীলঙ্কা অলআউট হল মাত্র ৫৫-য়। ইডেনে দক্ষিণ আফ্রিকা মাত্র ৮৩-তে। বোলিং-এ শুরুতে সিরাজ স্যুইং-এর জন্য যাচ্ছেন, বুমরাহ ফাঁস বসাচ্ছেন, শামি এসে সামান্য পুরনো বলে স্যুইং করছেন, একদম সিম সোজা রেখে। তারপর কুলদীপ এবং জাদেজা সামান্য জোরের উপর বল স্পিন করাচ্ছেন। মিডল ওভারে শার্দূল ও হার্দিকের অনুপস্থিতিতে সিরাজ ক্রস সিমে বল করছেন। রিভার্সের জন্য বল তৈরি করছেন। শামি বুমরাহ ফিরছেন। রিভার্স ও ইয়র্কার নিয়ে। বুমরাহ স্লোয়ার বা স্লোয়ার বাউন্সারও নিয়ে আসছেন। কুলদীপ খান দুই-তিন ওভার ৪০ ওভারের পরে করছেন। এই হল ভারতের ছক। একটাই ছক। কিন্তু যখন এগারোজনের মধ্যে সাড়ে নয়জনই বিধ্বংসী ফর্মে, তখন চিন্তা কিস বাত কি! দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কোহলি ৫০তম সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ড করলেন নিজের জন্মদিনে।

তখনই জানা গেল যে যে হার্দিককে ভাবা হচ্ছিল সেমিফাইনালে খেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন, তিনি নাকি ত্রিশ দিনের জন্য দলের বাইরে। ব্যাটিং-এর পরিবর্ত আছেন ঈশান কিষাণ, স্পিনে অশ্বিন, কিন্তু পেস বোলার কারও চোট হলে কে আসবে? শার্দূলকে তো হার্দিকের অবর্তমানে আর ধরা হচ্ছে না। তাই প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে হার্দিকের পরিবর্তে দলে নেওয়া হল।

যদিও নিন্দুকেরা বলেন যে হার্দিকের ফ্র্যাঞ্চাইজি গুজরাট টাইটান্স আসন্ন আইপিএল নিলামের কথা চিন্তা করে হার্দিককে যাতে ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সে নেহাতই কানাঘুষো।

তেমনই নিন্দুকেরা বলতে শুরু করল যে এ একেবারে হিন্দুস্তানের শাসক দলের তৈরি করা স্ক্রিপ্ট। কিন্তু নিন্দুকের কথা শুনলে কি চলে? যেখানে সারা ভারত এক অদ্ভুত পৌরুষোদ্দীপক কস্টিক জিঙ্গোইজমে বাস্তব ভুলে রয়েছে। সারা দেশে নীল রক্তের ক্ষরণে মুছে যাচ্ছে ভারতের ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ রূপ। বিশেষত পাকিস্তানের সাংবাদিক, দর্শক এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিচ ব্যবহার করা হচ্ছে। মেকমাইট্রিপ তো পাকিস্তানের হারের ব্যবধান যত বেশি হবে পাকিস্তানি দর্শকদের তত বেশি ছাড় দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনও দিয়ে দিল। নোংরামোর চূড়ান্ত। আধুনিক ভারতের রক্তলোলুপ, কর্পোরেটচর্চিত সিংহবিক্রম।

শেষ ম্যাচে অবশ্য নেদারল্যান্ডস সাধ্যাতীত লড়াই করল। শিশির পড়ায় স্যুইং করল না বলে শামি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। অবশ্য শ্রেয়স আর রাহুলের সেঞ্চুরিতে রানও হল বেশ।

সেমিফাইনাল ওয়াংখেড়েতে, আবার নিউজিল্যান্ড। দর্শক-আসন আলো করে ওয়াংখেড়ের নয়নমণি সচিন, বিশ্ববিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার এবং রাষ্ট্রসংঘের দূত ডেভিড বেকহ্যাম। দুজনকে দুধারে নিয়ে বসে আছেন বোর্ড সচিব জয় শাহ। ভিআইপি গ্যালারি জুড়ে ফিল্মস্টার এবং শিল্পপতিদের ভিড়। নিউজিল্যান্ড একটা চেষ্টা করেছিল, বিশেষ করে শিশির পড়ায় স্যুইং করা বন্ধ হয়ে গেলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভারতের সেই রোহিতের মারা, বিরাটের ধরা, গিলের ধরতাই, শ্রেয়সের ঘোড়দৌড়, রাহুলের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিং-এর দৌলতে প্রায় চারশো তাড়া করে ৭০ রান আগেই নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে গেল।

অপর দিকে বর্ষণসিক্ত ইডেনে, টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েও তাড়াহুড়ো করে দক্ষিণ আফ্রিকা অসুবিধায় পড়ল। যদিও স্পিনারদের ভরসায় লড়াই করল, কিন্তু ২১২ বেশ কম রানই ছিল। অস্ট্রেলিয়া কষ্ট করে হলেও ম্যাচ জিতে ভারতের মুখোমুখি।

অস্ট্রেলিয়া, প্রথম দুটো ম্যাচ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পরাজিত হওয়ার পরে পরপর আটটি ম্যাচ জিতে ফাইনালে। কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়া তো সেই অস্ট্রেলিয়া নয়। ব্যাটাররা অধিকাংশই ফর্মে নেই, একটা ম্যাক্সওয়েল বা উপরে ট্র্যাভিস হেড ও ওয়ার্নারের ঝড়ঝাপটা দিয়ে কি ভরসার মতো ব্যাটিং হয়? স্পিন খেলতে বিশেষত ম্যাক্সওয়েল ছাড়া কেউই তেমন পটু নন। বোলিং-এও অ্যাডাম জাম্পা ছাড়া উইকেটের মধ্যে বিশেষ কেউ নেই। মিচেল স্টার্ক বা জশ হ্যাজেলউডকে আর আগের মতো ভয়ঙ্কর লাগছে না। প্যাট কামিন্সও সেমিফাইনালে স্লোয়ার বাউন্সারের দুর্দান্ত ব্যবহার করেছেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বোলিং ততটা ভাল হয়নি। শুধু দরকারের সময় কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে কোনওরকমে হলেও অস্ট্রেলিয়াকে বৈতরণী পার করে দিচ্ছেন। কোনওদিন ম্যাক্সওয়েল, তো কোনওদিন মার্শ বা কোনওদিন ওয়ার্নার, হেড।

কিন্তু ক্ষেত্র প্রস্তুত। ‘ভারত মাতা কি জয়’ আর বিপক্ষ মুর্দাবাদে আকাশ বাতাস মুখরিত। এ এক নতুন ভারত। তার পরিচয় সে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ইন্ডিয়া’ নয়, প্রাচীন ইতিহ্যের প্রতিভূ। যে নাকি গণতন্ত্রের গর্ভগৃহ, সমানাধিকারের আকরস্থান। অবশ্য সমানাধিকার নিয়ে সরকারিভাবে অন্য ব্যাপার সামনে চলে আসে। জাতি, ধর্ম, স্থানিকতা তো ছেড়ে দিলাম। লিঙ্গবৈষম্যের প্রমাণ হিসাবে উভলিঙ্গ মানুষ বা সমলৈঙ্গিক সম্পর্ককে ভারত পারলে অস্বীকার করে। প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় দীক্ষিত নতুন ভারতে এগুলি মানসিক বা শারীরিক রোগের নামান্তর।

নবীন ভারতে স্বাধীনতা ২০১৪-য় এসেছে এবং ভরকেন্দ্র আর নতুন দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা বা চেন্নাইয়ের মতো মহানগর নয়। নবীন ভারতের প্রশাসনিক এবং সামাজিক মডেল তৈরি হয় গুজরাট থেকে অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে, গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদ থেকে।

সেই আহমেদাবাদের বুকে নবীন ভারতের বাস্তবোত্তর ছাতির মাপে এক স্টেডিয়াম গঠন করা হয় আগের মোতেরা বা সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়াম ধ্বংস করে আনুমানিক আটশো কোটি টাকা ব্যয়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে নামকরণ। এবং কোনওরকম ক্রীড়াঐতিহ্য না থাকলেও ২০২৩-এর পুরুষদের ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল স্থির করা হয় এই স্টেডিয়ামেই।

ভারতকে চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। তাই পিচে জল দেওয়া হল না, আইসিসির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। লক্ষ্য ভারত আগে ব্যাট নেবে টসে জিতে। তারপর রানের পাহাড় চাপাবে আর শিশির পড়ে ম্যাচে প্রভাব ফেলার আগেই শুকনো পিচে ম্যাচ জিতে যাবে ভারত। সহজ স্ক্রিপ্ট।

অথচ যে টিমের সাড়ে নয়জন সেরা ফর্মে তারা বিপক্ষ, যাদের হাতে গোনা ব্যাটার ও বোলার সামান্য হলেও ফর্মে রয়েছেন, তাদের হারাতে পিচের সাহায্য কেন নেবে? যে ফর্মে রোহিত, শ্রেয়স, বিরাট, রাহুলরা রয়েছেন তাতে ব্যাটিং উইকেটে চারশো রান করা কঠিন নয়। আবার পরে ব্যাট করলে যাই রান থাকুক না কেন তাড়া করার সমস্যা নেই। অপরদিকে বোলাররা বারবার বিপক্ষকে অলআউট করে ফেলছেন, তাদের আলাদা করে পিচের সাহায্য কেন লাগবে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে তাঁর উপস্থিতিতে কাপ জিততে গেলে কোনও ঝুঁকিই রাখার সুযোগ নেই।

কিন্তু তাই হল আর অস্ট্রেলিয়া এরই সুযোগ নিল। ছক তৈরি হল, টসে জিতে ব্যাট করতে পাঠাবে ভারতকে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া বুঝেই গেছিল যে তাদের হারাবার কিছু নেই এবং টসে জিতলে ভারতও ব্যাটই করবে। যা খেলার প্রথম কুড়ি-পঁচিশ ওভারই। তারপর আউটফিল্ড থেকে বল ছোড়ার সময় মূল পিচ ছাড়া অন্যপিচে ড্রপ দিয়ে উইকেটকিপারের কাছে পাঠাতে হবে, যাতে রিভার্স স্যুইং-এর জন্য বল তৈরি হতে থাকে। কুড়ি-পঁচিশের পর রিভার্স আর পঁয়ত্রিশ ওভারের পর বল নরম ও কালচে হয়ে গেলে মারার অসুবিধা হবে, তখন যতটা সম্ভব বলের পেস না রেখে বল ঠুকে ব্যাটারকে নিজের শক্তি প্রয়োগ করে মারতে বাধ্য করা।

ফলত, প্রথম ১০ ওভারে আশির উপরে উঠলেও দশম ওভারে ট্র্যাভিস হেডের দুর্দান্ত কপিলোচিত বা তার থেকেও ভাল ক্যাচে রোহিত শর্মাকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানো, শ্রেয়স আয়ার দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটু নিচু হয়ে যাওয়া বলে খোঁচা দিয়ে আউট হওয়ায় সুবিধা হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার। বিরাট ও রাহুলের উপর চাপ সৃষ্টি করা হতে লাগল। কামিন্স সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। স্লোয়ার বল, ক্রস সিমে ঠুকে ঠাকে বলের পেস একদম শূন্য করে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হল। ভারতীয় ব্যাটাররা তখন অতিরিক্ত সতর্ক হতে গিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক খেলা ভুলে অনেক বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে গেলেন। তারপর বল রিভার্স করতে শুরু করল। বিরাটকে একটা স্লোয়ার শর্ট বলে তুললেন কামিন্স। শেষ চল্লিশ ওভারে মাত্র চারটে বাউন্ডারি, রাহুলের খোলসে ঢুকে যাওয়া, সূর্য কুমার যাদব বলের পেস না পাওয়ায় কার্যকারিতা কমে যাওয়া এবং জাদেজাকে রিভার্সে তোলা। ভারত অন্তত তিরিশটা রান কম করল।

ভারত না বুঝতে পারলেও অস্ট্রেলিয়া জানত ম্যাচ তিরিশ ওভারের। তাই শুরু থেকেই আক্রমণে গেল। ওয়ার্নার, মার্শ আর স্মিথকে দ্রুত হারালেও রান রেট প্রায় ৯। এখান থেকে মিডল ওভারে খেলাটা ধরলেন হেড, সঙ্গত করলেন লাবুশানে। ভারত বোধহয় অতিরিক্ত টেনশনে ছিল। নিজের চেনা ছক ভেঙে শামিকে ওপেন করানো হল সিরাজের জায়গায়। কারণ শামি বাঁ হাতিদের বিরুদ্ধে দারুণ বল করেন। ওয়ার্নারকে তুললেন বটে, কিন্তু নতুন বলে স্যুইং-এর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওয়াইড দিতে শুরু করলেন। এতদিন ধরে দুর্দান্ত কিপিং করা রাহুলও বল পায়ের তলা দিয়ে গলাতে শুরু করলেন। তারপর ছ-ওভারের পর থেকে স্যুইং বন্ধ হয়ে গেলে শামির কার্যকারিতাও বন্ধ হয়ে গেল। স্পিনার ডাকা হল তড়িঘড়ি যাতে শিশির পড়ার আগেই কাজ হয়। কিন্তু কুলদীপই হোক বা জাদেজা। যতটা ধীরে বল করলে এই উইকেটে বল লাফাবে তার থেকে জোরে করতে শুরু করলেন। হেড শুরু করলেন বলের লেগসাইডে নিজেকে রেখে খেলা। একবার-দুবার যে খুব বাঁচান বাঁচেননি তা নয়। কিন্তু হিসাব করে ধীরে ধীরে ঝুঁকি নিয়ে বাউন্ডারি মারতে শুরু করলেন, যেটা বিরাট বা রাহুলরা করেননি। একবার ছন্দে এসে গেলে কাউকে ছাড়লেন না। সিরাজ যখন ১৭তম ওভারে এলেন বল করতে তখন তাঁর ছন্দই তৈরি হল না। সিরাজ, শামি, বুমরাহ, কুলদীপ বা জাদেজা। কেউই ছাড় পেলেন না। পনেরোটা চার এবং চারটে ছয় মেরে ১২০ বলে ১৩৭ করে ডিপ মিড উইকেটে যখন আউট হচ্ছেন তখন জয়ের থেকে দুই রান দূরে অস্ট্রেলিয়া।

সেই মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার ইনফিনিটি ওয়র বা এন্ডগেম মনে আছে? থানোসকে হারাবার জন্য টাইম স্টোনে ভর করে ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ভবিষ্যৎ দেখে এসে বুঝলেন প্রায় দেড় হাজার পারমুটেশন কম্বিনেশনে মাত্র একবার থানোসকে হারানো যাচ্ছে। আর এন্ডগেমের শেষে সেই একবারের সুযোগটাও এসে গেল। অস্ট্রেলিয়ার কাছে এই একটাই সুযোগ ছিল থানোস থুড়ি ভারতকে হারাবার। আর ফাইনালের দিন স্নায়ু না হারিয়ে তারা সেই একটাই পন্থা মন দিয়ে মেনে চলল। শুরুর থেকে দেখলে হার্দিক যাওয়ার পর ভারতের একটাই জেতার পন্থা ছিল। নিজের শক্তি অনুযায়ী খেলে ফাইনাল জেতা।

কিন্তু জেতার জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করতে গিয়েই ভারত ডুবল। বিশেষ করে পিচ নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনাচিন্তা। ব্রিসবেনের শেষ টেস্টটা মনে আছে। ভগ্নপ্রায় ভারত শেষ টেস্টে ব্রিসবেনের মতো অস্ট্রেলিয়ার গুহায়, পেসারদের স্বর্গে সিরাজ, নটরাজন আর শার্দূল ঠাকুরের বোলিং লাইনআপকে যদি সাধারণ হার্ড বাউন্সি উইকেট দেওয়া হত তাহলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া ধারে ভারে কাটত।

কিন্তু তা না করে পেস বোলারের উপযোগী পিচ দেওয়া হল। তাতে কামিন্স, স্টার্ক, হ্যাজেলউডদের সুবিধা হল বটে কিন্তু ভারতের অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন বোলাররা এক-একজন ডেল স্টেন-ওয়াসিম আক্রম হয়ে উঠলেন। আর শেষে ঋষভ পন্থের বিধ্বংসী ব্যাটিং। ঠিক একইভাবে ধুলো হয়ে যাওয়া পিচে, স্লোয়ার বল বা বলের গতিবেগের হেরফের করে, স্লো বাউন্সার দিয়ে অস্ট্রেলিয়া ভারতীয় ব্যাটিঙকে আটকে দিল এবং তারপর মনোযোগ দিয়ে ঝুঁকি নিয়েও সামলেসুমলে খেলে ম্যাচ নিয়ে চলে গেল। সেই অস্ট্রেলিয়া, ফাইনাল খেলা অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যে পারফরম্যান্সের দিক থেকে যা নিকৃষ্টতম ছিল। তারা কাদের হারাল? না, দশে দশটা ম্যাচ বিপক্ষকে দুরমুশ করা, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা পারফর্মকারী ভারতীয় দলকে।

অঘটন ঘটে, কিন্তু অঘটন ঘটাবার জন্য কলজের দরকার হয়। ছবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার সেখানে খামতি আছে বলে তো মনে হয় না।

পরিশেষে ফাইনালের স্টেডিয়াম। ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লৌহপুরুষ বল্লভ ভাই প্যাটেলের নামাঙ্কিত স্টেডিয়াম ভেঙে একশো কুড়ি হাজার দর্শকাসন সম্বলিত স্টেডিয়াম বানালেই তো আর বিশ্ববিজয় হয় না। তাই খেলা চলাকালীন দর্শকরা মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, আম্পায়ারদের নাম ঘোষণার সময় দুয়ো দিলেন এবং ‘ভারত মাতা’র বন্দনায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে খেলোয়াড়োচিত মনোভাবের ভারতের স্বযত্নে লালিত ঐতিহ্যকে ধূলায় লুটিয়ে স্লোগান আর জিঙ্গোইজমে ক্রিকেট আহরণের এক নির্লজ্জ পন্থার হদিশ দিলেন।

আর দেশের প্রধান ব্যক্তি? জিতে কাপ নিয়ে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের প্রচার করতে এসেছিলেন। দল হারার সময়ও তাই দাঁত বার করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু হেরে যাওয়ার পর কামিন্সের হাতে ট্রফি দিয়ে অপেক্ষা না করে মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রায় দু-বছরের পরিকল্পনা এবং প্রাণপাত পরিশ্রমের পর তীরে এসে তরী ডোবার বেদনাকে হৃদয়ঙ্গম করার আগেই, শোকের আবহে জোর করে ক্যামেরা নিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করে, ‘মুস্কুরাইয়ে, দেশ দেখ রাহা হ্যায়!’ ‘আরে অ্যায়সা হোতা হ্যায়!’ ইত্যাদি বলে জোর করে করমর্দন করে মাথা বুকে টেনে নিয়ে যে আপাত পাশে দাঁড়াবার নাটকের মধ্যে প্রচারের তূরীয় মার্গের নিদর্শন যে রাখলেন তার তুলনা হয়তো ১৯৩৬-এর অলিম্পিক হকির ফাইনাল।

আবার ভারতীয় দলে ফিরে আসি। সাদা বল ক্রিকেটটাকে রাহুলের মতো কোনও ভারতীয় কোচই বোধহয় বোঝেননি। তাই অলরাউন্ডার না থাকা সহ বেশ কিছু ঘাটতিকে কীভাবে নিজের সুবিধা করে ফেলতে হয় এবং নিজের দেশে খেলা হওয়ার সুযোগ নিয়ে কীভাবে নিরন্তর আক্রমণের মাধ্যমে অভীষ্টের একদম কাছে পৌঁছতে হয় তা রাহুল দ্রাবিড়ের থেকেই শেখা উচিত। এরপর হয়তো উনি ভারতীয় দলের কোচ থাকবেন না। কিন্তু যে পথ উনি দেখিয়ে গেলেন, সাফল্য আসতে সময় লাগার কথা নয়।

আর অধিনায়ক রোহিত? দলের জন্য নিজের স্বাভাবিক খেলা বিসর্জন দেওয়া গত দুবছর ধরে কোচের সঙ্গে বসে তিল তিল করে ভারতের সফলতম ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ক্যাম্পেনের অধিনায়কের ঠিক মুখের সামনে থেকে কাপ সরে গেল। কষ্ট-দুঃখ তো থাকবেই, কিন্তু এই পারফরম্যান্সে গর্বিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সব্যসাচী সরকার ও সৌভাগ্য চ্যাটার্জি

*মতামত ব্যক্তিগত।