Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রোবসন-কথা : প্রথম ভাগ

দেবাশিস মৈত্র

 

গত ৮ই এপ্রিল, পল রোবসনের ১২০তম জন্মদিনের প্রাক্কালে, কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই ঠিক করেছিলাম যে, এই বিস্মৃতপ্রায় মানুষটিকে ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু পাঠকের কাছে একটু পরিচিত করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

এমন একটা সময়ে আমরা বাস করছি যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মৌলবাদ ডালপালা ছড়াচ্ছে। সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর আক্রমণ– কখনও তার ভিত্তি ধর্ম, কখনও মানুষের গায়ের রঙ, কখনও বা জাতিসত্তার ভেদাভেদ-– ক্রমশ ফ্যাসিবাদের চেহারা নিচ্ছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা এখন বাস করছি, এবং যে ভয়ানক পরিণতির দিকে হয়তো এগিয়ে চলেছি, সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল যে পল রোবসনের জীবনকথা, এবং তাঁকে কেন্দ্র করে আরও অনেক প্রগতিশীল গায়ক-লেখক-চিত্রশিল্পী-চিত্রনির্মাতার কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত, হয়তো আমাদের কিছু দিশা দেখাতে পারে; বিশেষত বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক এবং সুপরিকল্পিত অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।

পল রোবসনের জীবনের এই সংক্ষিপ্ত রূপরেখাটি শেষ পর্যন্ত ১৩ কিস্তিতে সমাপ্ত হয়েছিল। ‘৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ ওয়েবম্যাগের অনুরোধে সমগ্র আলেখ্যটি পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত আকারে এখানে পেশ করছি।

মুখবন্ধ

The tallest tree? উচ্চতম বৃক্ষ?

কে যেন দিয়েছিলেন এই অভীধাটি, অনেক বছর আগে।

উচ্চতম কি না আমার জানা নেই, কিন্তু মানবসভ্যতার সব যুগের আর সব দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এটি জনারণ্যের সবচেয়ে উঁচু কয়েকটি বৃক্ষের অন্যতম তো বটেই। এই একটি বৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল আরও যে কত মহীরুহ।

অথচ মানুষ নির্মমভাবে ফুল-ফল ছিঁড়ে, ডালপালা ছেঁটে বৃক্ষটিকে নিয়ে গেল মৃত্যুর দোরগোড়ায়, যদিও হাজার চেষ্টাতেও তার মাথা নোয়াতে পারল না এক ইঞ্চিও!

প্রকৃতির নিয়মে একদিন মরেও গেল বৃক্ষটি, মানুষ তার মৃত্যুকে একটু ত্বরান্বিত করল মাত্র। আরও অনেক ফুলের সম্ভার, ফলের ভাণ্ডার দেওয়ার কথা ছিল বৃক্ষটির। আমরা, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষরা, চিরকালের মতো বঞ্চিত হলাম।

বৃক্ষটি দেশজ নয়, আদ্যন্ত বিদেশি। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় এই বৃক্ষের জীবনকাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। হয়তো সে কাহিনী আমাদের কিছুটা সাহস, কিছুটা অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।

সমস্যা হল এই যে, বৃক্ষটির মাপ সমগ্র ফেসবুকের চেয়েও অনেক বড়। ফেসবুকের বহু লক্ষ টেরাবাইটের স্টোরেজ এর জীবনকাহিনী ধারণ করার পক্ষে নিতান্তই অপ্রতুল। যতই হাস্যকর শোনাক, আমার ধারণা এরকমই।

আমি সে চেষ্টাও করছি না। এই প্রতীকী বৃক্ষটির জীবনকাহিনীর মাত্র এক শতাংশকে ধরার চেষ্টা করছি শুধু।

পল রোবসন # ১

আজ ৯ই এপ্রিল, পল রোবসনের জন্মদিন।

এই প্রজন্মের বাঙালি তরুণ-তরুণীরা পল রোবসনের নাম শুনেছে কি না (তাঁর গান শোনা তো পরের কথা) আমার জানা নেই। আমাদের প্রজন্ম বড় হয়ে উঠেছিল বাংলা অনুবাদে নাজিম হিকমতের লেখা গান শুনতে শুনতে— ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো ভাই আমার পল রোবসন।’ কিন্তু সে সময়েও অধিকাংশ মানুষের কাছে ওই গানটিই ছিল পল রোবসনের একমাত্র পরিচয়; তার চেয়ে বেশি কিছু রোবসনের সম্পর্কে অনেকেরই জানা ছিল না।

ফেসবুকের পাতা পল রোবসনের জীবনী লেখার জায়গা নয়। আমি সেই বাতুলতা করবও না। কিন্তু, রোবসনের জীবনব্যাপী লড়াই এই মুহূর্তে যেহেতু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে খুব প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হচ্ছে, তাই তাঁর সম্বন্ধে কিছু তথ্য শুধু আমার বন্ধুদের কাছে তুলে ধরতে চাই। টুকরো টুকরো লেখায় ধারাবাহিকতাহীন কিছু কথা-– জনারণ্যের উচ্চতম একটি বৃক্ষ সম্পর্কে…..

পল রোবসন # ২

পল রোবসনের জন্ম ১৮৯৮ সালে, এক ক্রীতদাস পরিবারে। আফ্রিকার কোন দেশ থেকে তাঁর পূর্বপুরুষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাস হিসাবে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন, রোবসনদের মাতৃভূমি ছিল নাইজেরিয়া।

ক্রীতদাসপ্রথার অবলুপ্তিকে কেন্দ্র করে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ চলেছিল ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধে ক্রীতদাসপ্রথার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন আমার বড় প্রিয় লেখক অ্যামব্রোজ বিয়ার্স, সমস্ত জাগতিক হিসাব বহির্ভূত এক সাহিত্যিক, যাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যতে কিছু লেখার ইচ্ছা রয়ে গেল।

গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে, ১৮৬০ সালে, পল রোবসনের বাবা উইলিয়াম এবং তাঁর ভাই ইজেকিয়েল তাঁদের মালিকের তুলোর খামার থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। উইলিয়ামের বয়স তখন ১৬। নর্থ ক্যারোলিনা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছন ক্রীতদাসপ্রথা-বিরোধী পেনসিলভানিয়া স্টেটে। সেখানে কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে নতুন জীবন শুরু করে, ইস্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে, লিঙ্কন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে, শেষ পর্যন্ত তিনি প্রিন্সটনে একটি ছোট্ট গির্জার যাজক নিযুক্ত হন। সেখানেই কেটেছে পলের প্রথম জীবন।

পল রোবসন নিজে পড়াশোনা করেছিলেন রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে (সেখানকার ইতিহাসে তৃতীয় কালো চামড়ার ছাত্র)। কলেজজীবনে তিনি ছিলেন ওস্তাদ খেলোয়াড়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাগবি দলের নিয়মিত সদস্য, এবং ১৫টি বিভিন্ন ইভেন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন পল, নাটকে অভিনয়ও করতেন। কিন্তু পেশাদার গায়ক বা অভিনেতা হওয়ার চিন্তা ঘুণাক্ষরেও তাঁর মাথায় তখন আসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে অতঃপর কলম্বিয়া ল’স্কুল। সেখান থেকে আইনে স্নাতক হওয়ার পর পল একটি ল’ফার্মে চাকরি নেন। সেই কোম্পানির এক নাম-না-জানা সাদা চামড়ার কর্মচারীর কাছে আমাদের চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। নিগ্রো রোবসনের কাছ থেকে ডিকটেশন নিতে লোকটি অস্বীকার করেছিল। সেই মুহূর্তে পল রোবসন চাকরিতে ইস্তফা দেন এবং ঠিক করেন যে, আর কোনওদিন তিনি চাকরি করবেন না।

এর অল্পদিনের মধ্যেই যুগপৎ গায়ক এবং অভিনেতারূপে পল রোবসনের আত্মপ্রকাশ। ততদিনে তিনি ঠিক করে নিয়েছেন তাঁর পথ। নিজের আফ্রিকান এবং আফ্রো-আমেরিকান ঘরানার সংস্কৃতিকে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁর স্বপ্ন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাসপ্রথার অবলুপ্তির পর ততদিনে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে বটে, কিন্তু নিগ্রো, চিনা এবং অন্যান্য অশ্বেতকায় অভিবাসীদের অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি ঘটেনি। শ্বেতাঙ্গরা তাদের ক্রীতদাস হিসাবে রাখার অধিকার খুইয়েছে ঠিকই, কিন্তু গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ করা তখনও আইনসিদ্ধ। Lynching (দলবদ্ধভাবে পাথর ছুঁড়ে কোনো অসহায় সংখ্যালঘুকে তিলে তিলে হত্যা করা) সমাজে একটি প্রচলিত এবং আদৃত পদ্ধতি। নিউ ইয়র্কের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁতে পল রোবসনের তখন খাওয়ার অধিকার ছিল না। নাটক বা কনসার্ট দেখতে গেলে তাঁকে বসতে হত নিগ্রোদের জন্য পৃথক করে রাখা সস্তা আসনে।

সঙ্গীতকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার পর থেকেই পল রোবসনের জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত বাড়তে থাকে। তাঁর প্রতিটি গানের অনুষ্ঠানে তখন শ্রোতাদের ভিড় উপচে পড়ছে। কিন্তু তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাদা চামড়ার লুম্পেনদের হুমকি আর ব্যারাকিং। প্রতি পদে পলকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে-– এই দেশে তাঁর এবং তাঁর মতো আরও লক্ষ লক্ষ কালো, হলুদ অথবা বাদামি চামড়ার মানুষদের কোনো জায়গা নেই। এই দেশটা শুধুই সাদা চামড়ার সাহেবদের।

পল রোবসন কিন্তু থেমে নেই। পাল্লা দিয়ে চলছে তাঁর গান এবং থিয়েটার। ‘ওথেলো’র নামভূমিকায় তাঁর অভিনয় স্তব্ধ করেছে দর্শকদের। আমেরিকার পেশাদার রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করল কোনও অশ্বেতকায় মানুষ। রোবসনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে মুক্তমনা লেখকদের সাথে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন আরনেস্ট হেমিংওয়ে এবং জেমস জয়েস। ‘Showboat’ নাটকে স্টেজে পলের গাওয়া গান ‘Old man river’ (যে গানের নিদারুণ অক্ষম এক অনুবাদ করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা, ‘বিস্তীর্ণ দু’পারে…’ গানটিতে) প্রচলিত লোকগীতি না হয়েও চিরকালের সেরা এক লোকগানের মর্যাদা পেয়েছে। নাটকের পাশাপাশি ফিল্মেও অভিনয় করছেন তিনি। যাবতীয় বাধা এবং বিদ্বেষকে ফুৎকারে উড়িয়ে পল রোবসন তখন খোদ বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকাতেই এক সুপারস্টার। শুধু কৃষ্ণাঙ্গরা নয়, বহু সাধারণ শ্বেতকায় মানুষও রয়েছে তাঁর ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে। তাঁর জীবনে ভয়ঙ্কর যে দুর্বিপাক ঘনিয়ে আসতে চলেছে অচিরাৎ, তার আভাসটুকুও তখনও পাওয়া যাচ্ছে না।

ডাক আসছে বিদেশ থেকেও। লন্ডনে ‘ওথেলো’-তে পলের অভিনয় তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। ‘ওথেলো’ ছাড়াও লন্ডনে তিনি অভিনয় করেছেন ইউজিন ও’নিলের ‘Emperor Jones’ এবং ‘All God’s Chillun Got Wings’ নাটকে।

পল রোবসনের পাশাপাশি আরও একজন অভিবাসী শিল্পী তখন আমেরিকায় বসে ঠিক পলেরই মতো দুনিয়া কাঁপাচ্ছেন। আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অলক্ষ্যে তাঁদের দু’জনেরই বিরুদ্ধে অস্ত্রে শান দিচ্ছে। দ্বিতীয় এই শিল্পীটি হলেন চার্লি চ্যাপলিন।

চ্যাপলিন পরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, আর রোবসন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন আমেরিকাতেই, যদিও গান-নাটক-সিনেমা-– সবই তাঁর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শোনা যায়, রোবসনের দীর্ঘদিনের বন্ধু নাট্যকার ইউজিন ও’নিল নাকি চ্যাপলিনকে দেশছাড়া করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

অবশ্য চ্যাপলিনের ওপর তাঁর শ্বশুর ও’নিলের আক্রোশের কারণ ছিল একান্তই ব্যক্তিগত।

(দ্বিতীয় ভাগ এখানে)