Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নীলমণি অ্যাপার্টমেন্ট অথবা নবরংপুরা বাস টার্মিনাস থেকে কিছুক্ষণ

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নবরংপুরা, গুজরাত, আমেদাবাদ। গুজরাত ইউনিভার্সিটি থেকে কমবেশি আড়াই কিলোমিটার। নবরংপুরা বাস টার্মিনাস থেকে কমার্স রোড ধরে খানিক এগোলেই গণেশ বাসুদেব মভলঙ্কর চৌক। সেখান থেকে বামদিকে এগোলে বিশ্ববিদ্যালয়। নীলমণি অ্যাপার্টমেন্টের অবস্থান এই কমার্স রোডের উপর। আজকের আমেদাবাদ আর সবরমতীর সময়ের আমেদাবাদ, এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক খুব। আজকের আমেদাবাদ একদিকে যেমন আধুনিক, তেমনই সেই আধুনিকতার উল্টো পিঠ জুড়েই রয়েছে ঘন অন্ধকার। যে অন্ধকার সহস্রাব্দ পেরিয়ে ২০০২ সাল মনে পড়ায়।

কমার্স রোড ধরে চলতে চলতে কেউ যদি কখনও নীলমণি অ্যাপার্টমেন্টের দিকে তাকায়, আলাদা করে তিন নম্বর টাওয়ারের দোতলার সামনের দিকের ফ্ল্যাটখানি তার নজরে আসবে। ফ্ল্যাটের চেয়েও বলা ভাল, সেই ফ্ল্যাটের বারান্দাটুকুই সবার প্রথমে নজর কাড়বে তার। দেখলেই আন্দাজ করা যায় এ যেন এক জন্ম-বিদ্রোহীর বাসস্থান। বাকি সবকটি টাওয়ারেরই দেওয়ালের রং ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। জায়গায় জায়গায় চটা উঠে গিয়ে পলেস্তারার ধ্বংসাবশেষ ঝুলে রয়েছে। অ্যাপার্টমেন্টের প্রাচীনত্বকে খুব সহজেই যা থেকে উপলব্ধি করা যায়। অথচ সেই তিন নম্বরি টাওয়ারের দোতলার সামনের যে ফ্ল্যাট, বোঝাই যাচ্ছে আলাদা করে ফ্ল্যাটমালিকের তরফে তার দেওয়ালের চারপাশে একাধিকবারে নতুন রং করানো হয়েছে। এখনও স্পষ্ট তার উজ্জ্বলতা বোঝা যায়। উজ্জ্বলতার চেয়েও যেন পরিপাটি এক শান্তি। চারপাশেকার একঘেয়েমিকে ছাপিয়ে হঠাৎ যেন এক পশলা উন্মুক্ততা। তাছাড়া বারান্দার রেলিংয়ের উপর বেশ কয়েকটি সুদৃশ গাছের টব। তাতেও যে এককালে বেশ কিছু ঘর-সাজানো পাতাবাহারি গাছের অস্তিত্ব ছিল, তাও অনায়াসেই বলে দেওয়া চলে। শুকিয়ে যাওয়া বেশ কিছু গাছের অবশেষ রাস্তা থেকেই যে কারও চোখে পড়বে। অথচ বাড়িটা যে বেশ কিছুদিন ধরেই খালি পড়ে রয়েছে তাও বুঝতে অসুবিধে হয় না। কেবল গাছগুলি শুকিয়ে আসাই নয়, বারান্দার আরও যে কয়েকটি টুকিটাকি জিনিস, হেলান দিয়ে রাখা একখানি মই, কাপড় মেলার দড়ি, কার্নিশের উপর উলটিয়ে রাখা একখানি ছোট বালতি ইত্যাদি— সবকিছুতেই কেমন যেন একটা অগোছালো ভাব। অর্থাৎ রঙিন হতে গিয়েও কোনওভাবে যেন আবারও পুরনো হয়ে পড়া। অযত্ন এসে বাসা বেঁধেছে অবলীলায়।

বারান্দার দেওয়ালে অফ ওয়াইট রঙের উপর কালো অথবা আরও কিছু গাঢ় রঙের সাহায্যে ছোট ছোট ছবি আঁকা রয়েছে। Snippets যেমন হয়। কিছু বা ক্যালিগ্রাফি। লতা-পাতা-পাখি। সব মিলিয়ে যেন এক সুরুচির উৎসব। এ বাড়ির বারান্দাতেই এক কাপ চা অথবা কফি হাতে নিয়ে বসে দিব্য সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকক্ষণ। ভিতরে নিশ্চয়ই বইও আছে অনেক।

নীলমণি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সবরমতী আশ্রমের দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার। সবরমতী রিভারফ্রন্ট রোড অথবা আশ্রম রোড, যে কোনও রাস্তা ধরেই যাওয়া যায়। আশ্রম রোড ধরে এগোলে এক সময়ে পড়বে ডান্ডিকুচ সার্কল। সেই মোড় থেকে ডানদিকে এগোলেই ডান্ডি ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে আরও খানিক এগোলেই ডানহাতে সবরমতী আশ্রম, ট্যুরিস্ট স্পট। এখন এই ডান্ডি ব্রিজ ধরে সবরমতীর দিকে এগোলে, বামদিকে আরও পড়বে পরীক্ষিত নগর। এখানেই নিউ সপ্রু কার গ্যারাজ, অথবা অল্পেশ ভাম্ব্রে-র ব্যান্ড কোম্পানি। ঘিঞ্জি বস্তি অঞ্চল। ঝাঁ চকচকে আমেদাবাদ শহর, যা কিনা এতক্ষণ ধরে কেউ এই পথে আসতে আসতে দেখে এসেছে, এই পরীক্ষিত নগরে এসেই প্রথম ভুল ভাঙবে তার। সবরমতী নদীর এই অংশে একটি নালা এসে পড়েছে। এই নালার চরেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অ্যাসবেস্টসের ছাদ, খাপরার ছাউনি। দরমার ঘর। স্তূপ করে রাখা জঞ্জাল, আর তার পাশেপাশেই ফুটপাথে বসে থাকা ধূলিধূসরিত পরিবার, কোলের বাচ্চাদের চিৎকার। মায়েদের হাঁড়িখুন্তি-উপকরণ। কেউ বিশ্বাসই করবে না বোধহয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়া যে সবরমতী আশ্রম, তার থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বেই প্রকাশ্যে এমন উন্মুক্ত আকাশের তলায় এমনও ভারতের সহাবস্থান। সেই সরু বয়ে যাওয়া নালাটির উপরেই ডান্ডি ব্রিজ। এরই উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে, নির্বাচিত সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে নিয়ে ডান্ডি অভিযানে রওয়ানা হয়েছিলেন মোহনদাস। সেও আজ থেকে প্রায় কত বছরের ইতিহাস। সেই সবরমতীও এখন পুরনো হয়ে এসেছে।

সবিতাবেন ফুটপাথের উপর এসে দাঁড়ান। দেখতে দেখতে অনেকগুলি বসন্ত পেরোল। সবিতার মাথার চুল সব পেকে গিয়েছে। নিউ সপ্রু কার গ্যারাজের অবিসংবাদী মালকিন তিনি। সবিতারানি সপ্রু, নিবাস পরীক্ষিত নগর, আমেদাবাদ। বয়স ৭১। পারভেজ আরও একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ডিসেম্বর মাস হলেও ঠিক শীতের সকাল বলা চলে না। এই শহরে শীত পড়তে এখনও দেরি অনেক। কেবল ভোরের সময় দূষিত, সরু হয়ে আসা নালার উপর অল্প অল্প করে ধোঁয়াশা জমতে শুরু করেছে।

পারভেজ বলে, আজই তিনি আসছেন দাদি। পাকা খবর আছে।

গ্যারাজের কর্মী বুড়ো হীরালালও এসে দাঁড়িয়েছে, হ্যাঁ মালকিন। দশটায় গাড়ি আসবে শুনলাম।

সবিতার মুখে যেন একটা ছায়া পড়ে। আবারও সরে যায়। তিনি বলেন, দশটায়? এবারে কতদিন?

পারভেজ মাথা নাড়ে। তার কাছে কোনও খবর নেই।

হীরালাল বলে, এবারে বোধহয় খুব বেশিদিনের জন্য নয়। উন্মেষও আসছে শুনেছি। তবে জানি না থাকবে কিনা।

সবিতা শ্বাস ফেলেন।

—চায়ের দোকান খুলেছে?
—হ্যাঁ মালকিন।

পারভেজ, সপ্রু গ্যারাজের কেউ নয়। তবুও সবিতাকে সে মালকিন বলে ডাকে।

—নিয়ে আসছি এখুনি, চা খাবে চাচা? পারভেজ হীরালালকে জিজ্ঞেস করে। সম্মতি পেয়ে সে চা আনতে চলে যায়।

সবিতা ফুটপাথের পাশে যে গাছগুলি রয়েছে, তারই মধ্যে একটির গোড়া বাঁধিয়ে দেওয়া জায়গার উপর বসেন। হীরালাল দাঁড়িয়ে থাকে। কুড়ি বছর বয়স থেকে সে সবিতাকে দেখে আসছে। মালকিনের মনের রহস্য সে কোনও দিনও ভেদ করতে পারেনি। একথা সত্যি, লোকায়ত সবকিছুকেই সবিতাবেন ছাপিয়ে যেতে পারেননি। তবুও হীরালাল মনে মনে তাঁকে শ্রদ্ধা করে। অনেক মানুষের চেয়েই মালকিনকে অনেক সোজা মানুষ বলে মনে হয় তার। সবিতা জিজ্ঞেস করেন,

—সুপ্রিয়াজির কাজ হয়ে গেছে বোধহয়, তাই না হীরালাল?
—আজ্ঞে মালকিন, হীরালাল বলে।

সবিতাবেন আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।

—আমরা সাড়ে নটা করে বেরুব। কেমন?
—তাই হবে মালকিন, মাথা নাড়ে হীরা, আমি কিষেণকে বলে রাখছি। অটো নিয়ে চলে আসবে।

সবিতা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান। পারভেজ চা নিয়ে এসেছে। গান্ধি আশ্রম থেকে গানের সুর শোনা যায়। কেউ আসবেন বোধহয়। সবিতাবেন চোখ বোজেন। কংক্রিটে ঢেকে যাওয়া সবরমতী-পাড়। কোথাও আর ঢেউ জাগছে না।

নীলমণি অ্যাপার্টমেন্ট। কিষেণের সিএনজি-চালিত অটোটা উলটো-ফুটে এসে দাঁড়ায়। তাতে সওয়ারি তিনজন। সবিতাবেন, হীরা আর পারভেজ। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। পিছনে জাল দেওয়া প্রিজন ভ্যান। আজকাল সাংবাদিকদের দাপাদাপিও কমে গেছে অনেক। বাকি সমস্ত পরিবেশটাকেই চেনেন সবিতাবেন। চাইলেও তিনি চট করে এখন আনন্দজির সঙ্গে দেখা করতে পারেন না আর। অথচ একসময় কত সহজেই না অ্যাপার্টমেন্টের গেট পেরিয়ে আনন্দজির বাড়িতে চলে যাওয়া যেত। আনন্দমোহন উপাধ্যায়, গুজরাত ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক, আদ্যন্ত গান্ধিবাদী সজ্জন মানুষ। পরীক্ষিত নগর অনেকদিক থেকেই তাঁর কাছে ঋণী। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধ করার মতো কাউকেই আর পাওয়া যায় না। একা সবিতা, হীরালাল, অথবা পারভেজেরই মতো দু-একজন এখনও আনন্দজির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান। রাস্তা পেরিয়ে সবিতাবেন চারপাশে জরিপ করতে চেষ্টা করেন। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে যে তিনজন কনস্টেবল এসেছে তাদের মধ্যে একজনকে মাত্র তিনি চেনেন। তিনি হীরালালের দিকে তাকান। হীরালাল হাত তুলে আশ্বস্ত করে। অর্থাৎ চিন্তার কারণ নেই। সবিতাবেন হাতব্যাগ খুলে হীরালালকে কাছে ডাকেন। কয়েকটি সবুজ নোট হাতবদল হয়। দরজা খুলে গিয়েছে।

***

 

২০০২, ১৮ অক্টোবর। দাঙ্গার আগুন নিভলেও আমেদাবাদ তখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। রাত এগারোটা। পরীক্ষিত নগর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে উসমানপুরার দিকে ছুটে চলেছিল অ্যাম্বুলেন্স। মেয়ের হাত আঁকড়ে ধরে সবিতাবেন ঠাকুরকে ডাকছিলেন।

সবরমতী আমেদাবাদ শহরকে মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করেছে। নদীর পশ্চিমকূলে রয়েছে গান্ধি আশ্রম, আধুনিক আমেদাবাদ শহর। পুরনো আমেদাবাদকে পেতে হলে নদী পেরিয়ে যেতে হবে পূর্ব-দিকের অংশে, যদিও আমেদাবাদ বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশন সবই সেইদিকেই।  ১৮ অক্টোবর। রোজকার মতো সেদিনও নিজের নাইটস্কুলে, পরীক্ষিত নগরে ক্লাস নিতে এসেছিলেন আনন্দ উপাধ্যায়। সঙ্গে মেয়ে সুখলতা। ছেলে উন্মেষ তখনও ছোট বয়সে। সে বোধহয় মায়ের কাছেই ছিল সেদিন। আনন্দজির স্পষ্ট মনে পড়ে, ক্লাস শেষ হওয়ার কিছু আগেই একটি মেয়ে দৌড়ে দৌড়ে এসে খবর দিয়ে গেল নন্দিনীর ব্যথা শুরু হয়েছে। সবিতাবেনের মেয়ে নন্দিনী। সবিতারানি সপ্রু, রাজকুমার সপ্রুর বিধবা স্ত্রী। সাতাত্তর কি আটাত্তর সাল নাগাদ যুবক রাজকুমার সুদূর হিমাচল থেকে গুজরাতের এই পরীক্ষিত নগরে এসে থাকতে শুরু করে। কোনও দেশোয়ালি ভাইয়েরই পরামর্শে এখানে তৈরি হয় সপ্রু গ্যারাজ। একাশিতে এই পরীক্ষিত নগরেরই মেয়ে সবিতারানিকে বিয়ে করে রাজকুমার। বিরাশিতে জন্ম হয় নন্দিনীর। পঁচাশিতে সবিতার পিতৃবিয়োগ হয়। মা আগেই চলে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ের হাতেই বাবার সব সম্পত্তির ভার এসে পড়ে। সেই মূলধন থেকেই নতুন করে নিজের গ্যারাজ-ব্যবসা ঢেলে সাজায় রাজকুমার। নাম হয় নিউ সপ্রু কার গ্যারাজ। সুখ বেশিদিন থাকে না। বিরানব্বইতে হঠাৎই হৃদযন্ত্রে গড়বড়, রাজকুমারের মৃত্যু। সেই সময় থেকেই একা হাতে গ্যারাজের কাজ সামলিয়েছেন সবিতাবেন। একাজে তাঁর ডান হাত ছিল হীরালাল গুপ্তা। রাজকুমারের প্রথম অ্যাসিস্ট্যান্ট। কার গ্যারাজের সেদিনের কর্মচারী সংখ্যা তিন থেকে ক্রমশ বাড়তে বাড়তে আজ সাতে এসে দাঁড়িয়েছে।

সেই সবিতারই মেয়ে নন্দিনী আজ গর্ভবতী। আনন্দ উপাধ্যায় ভাবেন। কি প্রচণ্ড ঝড়-আপত্তি-আন্দোলনকেই না সামলাতে হয়েছিল নন্দিনীর বিয়ের সময়। গ্যারাজ চালানো থেকে শুরু করে আরও কত বিষয়েই না সবিতাবেনের একরোখা মনোভাবকে সমর্থন করে এসেছেন আনন্দমোহন। কিন্তু নন্দিনীর প্রেমের ব্যাপারে এহেন সবিতা একেবারেই বেঁকে বসেছিলেন। সেই রোখ শোধরাতে পারেননি আনন্দ অথবা সুখলতা-সুপ্রিয়াও। সবিতাবেনের সেই এক বক্তব্য, কী করে এক মুসলমানকে তাঁর মেয়ে হৃদয় দিতে পারে? এই বিয়ে তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। সবিতা জানিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক ঝড়-জল সামলিয়ে শেষমেশ সেলিম-নন্দিনীর চারহাত এক করাতে পেরেছিলেন আনন্দ উপাধ্যায়।

২০০১ সাল। রামমন্দির আন্দোলন, বাবরি-ধ্বংসের পর থেকেই গুজরাত পালটাতে শুরু করেছিল। তারই মধ্যে নতুন মুখ্যমন্ত্রীর আমলে ক্রমশই বাড়ছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা। তলায় তলায় ধোঁয়াতে শুরু করেছিল অসন্তোষ। ২০০২ সালের দাঙ্গার সময় নন্দিনীর গর্ভাবস্থার খবর জানা যায়। পূর্ব-পশ্চিম আমেদাবাদের দুই অংশের মাঝে সবরমতী যেন তখন এক অলিখিত সীমানা হিসেবেই অবস্থান করছিল। সেলিমদের বাড়ি ছিল নদীর পূবদিকের অংশে, রাজপুর-হীরপুর অঞ্চলে। কাছেই ঝুলতা মিনার, বিবিজি মসজিদ। দাঙ্গার সময় কেটে যেতেই কোনও মতে সবিতাবেনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেকটা নরম করার চেষ্টা করেন আনন্দ ও তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া। তাঁদের বোঝানোতেই ক্রমশ নরম হয়ে মে মাসে নন্দিনীকে পরীক্ষিত নগরে নিয়ে আসেন সবিতাবেন। তারপর ১৮ অক্টোবর।

একটি গাড়িও সেদিন হীরপুর যেতে রাজি হচ্ছিল না। পরীক্ষিত নগরের বাসিন্দা যারা, তাদেরও অনেকেই নন্দিনী-সেলিমের সম্পর্ক ভাল চোখে দেখতে পারেনি। মুখ বুজে সেই সম্পর্ককে উপরে উপরে মেনে নিলেও নন্দিনীর বিপদের সময় আনন্দ উপাধ্যায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়নি কেউ। অত রাত্তিরে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার বিপদ রয়েছে। এই বলে সকলেই আনন্দজিকে এড়িয়ে গিয়েছিল সেদিন। অসহায়ভাবে গান্ধি আশ্রমের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অধ্যাপক।

অক্টোবর, ১৯৪৬। অসম্ভবকে সম্ভব করতে সেদিন পথে নেমেছিলেন মোহনদাস। ছাপ্পান্ন বছর পর সেই মোহনদাসেরই বাসস্থান থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে অসহায় দর্শক হয়ে নয়া-গুজরাতকে চিনেছিলেন আনন্দ উপাধ্যায়। তবু কোনওভাবে গাড়ি জোগাড় হয়েছিল। মোবাইলের যুগ তখনও আসেনি। গাড়ি নিয়েই বিবিজি মসজিদের দিকে ছুটেছিলেন আনন্দমোহন। ততক্ষণে সবিতা-নন্দিনীকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের পথে সুপ্রিয়াও। রাজপুর-হীরপুর পৌঁছে আনন্দজি শুনেছিলেন কোনওভাবে খবর পেয়ে ভাঙা এক স্কুটারে সওয়ার হয়ে সেলিমও নাকি ততক্ষণে উসমানপুরা রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটেছিল কালুপুর ব্রিজের উপর। সরসপুর সার্কল থেকে বামদিকে ঘুরে কালুপুর ব্রিজে উঠবার মুখেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে গিয়েছিল সেলিমের স্কুটার। সেলিম বাঁচেনি।

১৯ অক্টোবর। ভোররাতে অপারেশন হয়েছিল নন্দিনীর। প্রবল রক্তক্ষরণে শেষ অবধি তাকেও বাঁচানো যায়নি। কেবল বেঁচেছিল শিশু পারভেজ। মৃত্যুর আগে সবিতার হাত আঁকড়ে এই নামই রাখতে বলে গিয়েছিল নন্দিনী। কিন্তু, পারভেজেরও লড়াই বাকি ছিল তখন। এক বিভাজিত গুজরাতে দাঁড়িয়ে সেদিন আনন্দ উপাধ্যায় দেখেছিলেন, দাঙ্গার আগুনে সেলিমেরও পরিবার বলতে আর কিছুই বাকি নেই। উদ্বাস্তু শিবির আর অন্ধকার মহল্লা-ঘরগুলোয় ঠাঁই হত না পারভেজের। এতিমখানায় পাঠাতে বলেছিল একেকজন। মেয়েকে হারিয়ে এক অদ্ভুত রাগ অথবা শোক সবিতাকেও গ্রাস করেছিল। তিনিও পারভেজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। আবারও আনন্দ-সুপ্রিয়ার তরফে শুরু হয় তাঁকে বোঝানোর পালা। কিন্তু তখনও অল্পেশ ভাম্ব্রের ব্যান্ড কোম্পানির বিষয়ে জানা ছিল না কারও।

ব্যান্ডমাস্টার অল্পেশ ভাম্ব্রে, তখনই অনেক বয়স তার। পাগলা অল্পেশ নিজের ছেলেরও একই নাম রেখেছিল। সে বলত আমি ফুরোলেও এই অল্পেশ নামেই ব্যান্ড বাজতে থাকবে। পরীক্ষিত নগরের বাসিন্দা অল্পেশ, সেও সেদিন রাত থেকেই উসমানপুরার হাসপাতালে হাজির ছিল সারাক্ষণ। পারভেজকে শেষ অবধি জিম্মায় নেয় অল্পেশ। বলে আমার ছেলের মতোই থাকবে পারভেজ। সবিতা রাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন যা প্রয়োজন লাগে, লেখাপড়া, জামাকাপড়— তিনি দেবেন। কিন্তু পারভেজকে বড় হতে হবে এক্কেবারে একা। পরিবার বলে তার কিছুই থাকবে না। অদ্ভুত এক গোঁ ধরে বসেছিলেন সবিতাবেন। আনন্দ উপাধ্যায় ভাবছিলেন, এতখানি সময় লেগে যায় মানুষের মন থেকে ধর্মান্ধতা দূর করতে। তিনি হেরে গেছেন। হেরে গেছেন তাঁর গুরু মোহনদাস। এদেশে সর্বধর্ম সমন্বয় গড়ে উঠতে পারেনি। তিনি সুপ্রিয়ার হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেদিন হাসপাতালে হাজির ছিলেন সবিতা, অল্পেশ আর হীরালালই কেবল। অল্পেশ সেইদিনই বেশ কিছুদিনের জন্য শিশু পারভেজকে সঙ্গে নিয়ে রাজকোটের কাছে তার দেশগ্রামে গিয়ে ওঠে। সেখানেই পারভেজের বড় হওয়া। অল্পেশের কোনও এক খুড়তুতো বা জ্যাঠতুতো দাদার আশ্রয়ে। পরীক্ষিত নগরের সবাই জেনেছিল শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে নন্দিনী ও তার সন্তান উভয়েই মারা গিয়েছে। সেলিমের মৃত্যুর খবরও জানাজানি হয়েছিল ভালভাবেই। ষোলো বছর পর, ব্যান্ডমাস্টার জুনিয়র অল্পেশের ফ্লুটিস্ট হিসেবে পরীক্ষিত নগরে এসে কাজে যোগ দেয় কিশোর পারভেজ। এরই মধ্যে সিনিয়র অল্পেশেরও সময় ফুরিয়েছে। মরার আগে পারভেজকে সে তার ব্যান্ডের দলে ক্ল্যারিওনেট বাজাতে দেখে গিয়েছিল। এটুকুই শান্তি তার। আনন্দ উপাধ্যায় এর চেয়ে ভাল সমাধান আশা করেননি। সময়ে সময়ে সবিতাকে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারই মধ্যে এসে পড়ল ২০১৪ সাল। দেশে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হল। পারভেজের পরীক্ষিত নগরে আসতে তখনও বাকি বছর দুই।

মুক্তচিন্তার উপাসক ও সৎ সমালোচক হিসেবে রাজরোষের আওতায় পড়লেন অধ্যাপক। ২০১৮ সাল। জানুয়ারি মাস। দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে আনন্দমোহন উপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হল। সেই মামলা ধোপে টিকল না। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একের পর এক মিথ্যে মামলা সাজিয়ে আনন্দজিকে জেলেই ধরে রাখা হল। চাকরিও বাতিল হল তাঁর। ২০২০ সাল। সুপ্রিয়াদেবীর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ল। অনেক লড়াই চালিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর, সুপ্রিয়াদেবীর মৃত্যু। সেই কারণেই প্যারোলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ছাড়া পেয়েছেন আনন্দ উপাধ্যায়।

***

 

নীলমণি অ্যাপার্টমেন্টের ৩/১এ নম্বর ফ্ল্যাটটিকে স্বামীর গ্রেফতারির পরেও সাজিয়ে-গুছিয়ে ঝকঝকে রেখেছিলেন সুপ্রিয়া উপাধ্যায়। ছেলে মেয়ে দুজনেই চাকরিসূত্রে পাড়ি দিয়েছিল বম্বে, ব্যাঙ্গালোর। একজন গিয়েছিল সাংবাদিকতায়। অন্যজন অধ্যাপক। বাবার লড়াইকে কুর্নিশ জানাতে কারও কুণ্ঠা ছিল না। তিন-চারমাসে একবার করে মামলার তারিখ পড়ত। সুখলতা অথবা উন্মেষের মধ্যে যে একজন কেউ ঠিকই এসে পড়ত সেই সময়। উকিলের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে, সুপ্রিয়াকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া— সবকিছুরই ব্যবস্থা হয়ে যেত। লড়াইটা লড়ে গিয়েছিলেন সব কজন। কিন্তু স্ত্রীর প্রয়াণের পরেও আনন্দজিকে প্যারোল দেওয়া হয়নি। সবিতাবেন জানেন এক সপ্তাহ আগেই শেষকৃত্য হয়ে গিয়েছে সুপ্রিয়ার। চেনা বৈঠকখানা ঘরে মুখোমুখি বসে আছেন আনন্দ ও উন্মেষ। সবিতাবেন, হীরালাল আর পারভেজকে সঙ্গে নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ান। ভিতরে পাহারায় আরও একজন কনস্টেবল।

আনন্দজি সবিতার দিকে তাকান। পারভেজ তাঁকে প্রণাম করে। হীরালাল এর আগে আনন্দজির সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় পারভেজকে বলেছিল, এই মাস্টারমশায়ই তোমায় উদ্ধার করে রাজকোট পাঠিয়েছিলেন। আনন্দজির পরিচয় হিসেবে পারভেজ কেবল সেইটুকুই জেনেছিল সেদিন। সবিতা পারভেজকে স্নেহ করলেও এখনও তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় বলে মনে হয়। আনন্দ উপাধ্যায় সবাইকে বসতে বলেন।

অনেক রোগা হয়ে গিয়েছেন অধ্যাপক। তবুও তাঁর কলম সচল। প্যারোলে যখনই তিনি ছাড়া পান, অথবা যখনই মেয়ে সুখলতা অথবা ছেলে উন্মেষ কারাগারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, একটা না একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ অথবা আরও কোনও লেখা তাদের হাতে তুলে দেন অধ্যাপক। দেশের মুক্ত-চিন্তার সংবাদপত্র, পত্রিকাগুলোয় সেই বক্তব্য প্রকাশিত হয়, আর তার ঠিক পরেপরেই মামলার ভার আরও বাড়ে অধ্যাপকের উপর।

দু-চারটি কথা হয়। সবিতাবেন কিছু যেন বলতে চান উপাধ্যায়মশাইকে। বলতে পারেন না। বেরিয়ে আসার সময় হয়ে যায়। অধ্যাপককেও আজ সূর্যাস্তের আগেই জেলে ফেরত যেতে হবে। সকলে উঠে বেরিয়ে আসেন। হীরালাল ও পারভেজ খানিক সামনে এগিয়ে যায়। উন্মেষ ঘরের ভিতরে কনস্টেবলটির সঙ্গে কিছু কথা বলছে। আনন্দ উপাধ্যায় সবিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— তোমার মেয়ে যেদিন মা হয়েছিল সবিতা, তারিখটার গুরুত্ব একদিন আমি বলেছিলাম তোমায়। সে-কথা মনে পড়ে?

আনন্দ উপাধ্যায়ই কোনও এক সময় সবিতাকে নোয়াখালির গল্প শুনিয়েছিলেন। তখনও পারভেজ সম্পর্কে নরম হননি সবিতা। আনন্দজি বলেছিলেন, যেদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে জীবনের অন্তিম লড়াইতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন গান্ধি-মহারাজ, সেইদিন তোমার নাতির জন্ম। ওকে দূরে ঠেলো না আর। সবিতা শুনেছিলেন। কোনও জবাব দেননি। এরই কিছুদিন পর গ্রেফতার হন অধ্যাপক। আজ সে-কথা শুনে সবিতা ঘাড় নাড়েন।

—এবার ওকে ফিরিয়ে নাও সবিতা। এ-দেশ এক ভয়ানক অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে, অধ্যাপক ফিসফিস করে বলেন, ফিরিয়ে নাও। গান্ধিজির নোয়াখালি যাত্রার দিন জন্ম যার, আর তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ঠেলে রেখো না। প্লিজ সবিতা। কথা রেখো আমার।

সবিতাবেন জবাব দিতে পারেন না। পিছনের কনস্টেবলটি সামনে এগিয়ে এসেছে।

 

১৭ ডিসেম্বর। ২০২৩। দুপুর ১টা। সবরমতী আশ্রম।

হীরালাল মহানন্দে কিষেণকে সঙ্গে নিয়ে মিষ্টি আনতে গিয়েছে। নতুন সংগ্রহশালার পিছনে, মাগন-নিবাসের ডানদিকে যে সবরমতী নদীর ঘাট, যার ঠিক ডানপাশেই গান্ধিজির উপাসনাস্থল, ও আরও একটু ডানদিকে, পিছনে গান্ধি-কস্তুরবার বাসস্থান ‘হৃদয়কুঞ্জ’, সেই নদীঘাটের উপরেই বসে ছিলেন পারভেজ ও সবিতা। পারভেজ জানে না ঠিক কী কারণে সবিতাবেন ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

অধ্যাপকের মুখে বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথের কথা শুনেছিলেন সবিতা। পরীক্ষিত নগরের নাইটক্লাসগুলোয় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন অধ্যাপক। বলতেন, কী অসম্ভব শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল কবির সঙ্গে মহাত্মার। সবরমতী আশ্রমেও নাকি কবি এসেছিলেন। নন্দিনীকে কবিতা আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন অধ্যাপক। পরে তার মানেও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সবিতাকে কান ঝালাপালা করে সেই কবিতা শোনাত মেয়ে। একেকসময়ে সত্যিই অসহ্য লাগত তাঁর। কিন্তু সেই কবিতারই কী অসাধারণ সুন্দর এক অর্থ ছিল। পরের দিকে মেয়ের মুখে, ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণে, নিজেই সবিতাবেন সেই কবিতা শুনতে চাইতেন। তখনও মেয়ের ‘মা’ হয়ে উঠতে বাকি কয়েক মাস। কিন্তু আবারও, একের পর এক আঘাত। নিজের গোঁড়ামিকে তখনও সবিতা ছাপিয়ে উঠতে পারেননি। আজ সেই আবৃত্তিকেই বড় বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর। সবিতাবেন পারভেজের দিকে তাকান। তাঁর কানে স্পষ্ট শুনতে পান তখন, আধো গলায় প্রথম আবৃত্তি নন্দিনীর,

…অনেক দূরের দেশ
আমার           চোখে লাগায় রেশ,
যখন              তোমায় দেখি পথে।

দেখতে পায় যে মন
যেন              নাম-না-জানা বন
কোন্             পথহারা পর্বতে…

সবিতারানি নিজেও ফিসফিস করে আবৃত্তি করেন,

… মন সদা যার চলে

যত               ঘরছাড়াদের দলে
তারে             ঘরে কেন বসায়?

কও তো আমায়, ভাই,
তোমার          গুরুমশায় নাই?
আমি            যখন দেখি ভেবে

বুঝতে পারি খাঁটি,
তোমার          বুকের একতারাটি,
তোমায়          ঐ তো পড়া দেবে…

পারভেজ অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকায়। সবিতাবেন পারভেজের হাতের উপর নিজের হাতখানি রাখেন। কুলকুল করে সবরমতীর জল, বাঁধানো কংক্রিট পেরিয়ে বয়ে চলতে থাকে।


*১৯ অক্টোবর, ১৯৪৬। মহাত্মা মোহনদাস গান্ধি নোয়াখালি সফরের সিদ্ধান্ত নিলেন। গুজরাতের নবরংপুরার ঘটনা তার অনেককাল পরের। ততদিনে গান্ধির শব জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে।