Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধর্ম সংস্কৃতি ও রাজনীতি: ছিন্ন চিন্তার ককটেল— একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া

অপর্ণা ঘোষ

 

আবহমান ইতিহাস চেতনা একটি পাখির মতো যেন— জীবনানন্দ দাশ

গ্রন্থটির নামেই বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত রয়েছে। লেখক মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায় বইটির তেরোটি অধ্যায় জুড়ে বিভিন্ন নিবন্ধে ইতিহাসের নানা সরণি পরিভ্রমণ করেছেন। ইতিহাসের গতির মতোই তা সরলরৈখিক নয়। এই ভ্রমণে একটি পাখির লঘুতা আছে, ভারহীন স্বচ্ছ চোখে বিচিত্র বিষয়ের অন্দরে-কন্দরে আনাগোনার নিষ্ঠ প্রয়াসও আছে। বাংলা, ভারত ও বিশ্বের সঙ্কট, সমন্বয়, যৌথতা, বিচ্ছিন্নতার অনেকান্ত পাঠ নিবন্ধগুলিতে ধরা পড়ে। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যম ও নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলিকে বিষয়ের মাপকাঠির নিরিখে সঙ্কলিত করে একটি পরিব্রজনের মেজাজ নিয়ে আসা সহজ ছিল না। সহজ ছিল না বিচিত্র বিষয়তরঙ্গকে একটি পাঠাধারে সজ্জিত করে একটানা পাঠ-অভিজ্ঞতায় পাঠককে মনোযোগী করে তোলা। কিন্তু লেখকের সহজ বলার ভঙ্গি তথ্য ও পাণ্ডিত্যের সরসতাটুকু ছেঁকে নিয়ে পাঠককে তাঁর অভিযাত্রার সঙ্গী করে তোলে, ভারাক্রান্ত করে না। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ ঠিকই, কিন্তু কঠিনকে সহজ করে বলার মনোরম ভঙ্গিটি এই সঙ্কলনের উজ্জ্বল আকর্ষণ।

ধর্ম সংস্কৃতি ও রাজনীতি: ছিন্ন চিন্তার ককটেল | মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় | নবজাতক | ৫০০ টাকা

‘আমাদের যৌথ সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে এক জায়গায় লেখক লিখেছেন— “এ দেশের প্রগতিশীল পত্রিকা/সাময়িক পত্রিকাগুলো মান্ধাতা আমলের ‘কী করিতে হইবে’র ভাষায় কচকচানি চালায়, স্বকীয় চিন্তা, দেশজ গন্ধ, সরলতা, স্বাচ্ছন্দ্য কিছু নেই। তাই কেউ পড়ে না। নিজেরাই পড়ে না। অন্যকে কে পড়াবে?” বস্তুত ঠিক এই প্রবণতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে সঙ্কলনের নিবন্ধগুলি। ধর্ম সংস্কৃতি রাজনীতি এবং এই ত্রিভুজের মধ্যবর্তী জমিতে পরস্পরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বিভিন্ন পরতে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসের বিষাদ, রক্তপাত ও সম্ভাবনাকে লেখক এমন একটি ভাষা দান করেছেন যা আগ্রহ ও আশা জাগায়। তাঁর দেশ-বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, দীর্ঘ প্রবাসযাপন এই নিবন্ধগুলিতে স্পষ্ট করেছে ভূয়োদর্শনের ছাপ। তা পাঠককে ঋদ্ধ করে, পাঠের স্নিগ্ধ আনন্দ উপরিপাওনা।

‘আ মরি বাংলা ভাষা’ অংশে বাংলা ভাষা চর্চার ক্রমপতনের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে একটি বিস্তৃত পরিসরকে সংক্ষেপে আলোচনার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের একটি বিষাদবৃত্তে ধরা পড়েছে উদ্বাস্তু সমস্যা ও তার সমাধানে নেহেরু সরকারের একদেশদর্শিতা, পূর্বাঞ্চলে মাসুল সমীকরণ ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে তার ধাক্কা— বাংলা ভাষার বাজার যে ধাক্কা সামলাতে না পেরে ক্রম-অবক্ষয়ের দিকে চলে গেল, তার মর্মস্পর্শী আখ্যানটি এখানে উঠে এসেছে। হিন্দি/উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি কীভাবে ও কেন প্রতিস্থাপিত করেছে বাংলাকে, জীবিকার খোঁজে ক্রমাগত পরিযান কীভাবে ঘনীভূত করেছে এই সমস্যাকে— এ সমস্ত দিকগুলিতেই লেখক আলো ফেলেছেন। অন্যদিকে প্রমিত বাংলার চাপে বাংলার উপভাষাগুলির ত্রাহি ত্রাহি দশাও তাঁর চোখ এড়ায়নি।

হিন্দি বা ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে নয়, ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তজ্জাত বাজারের বিরুদ্ধে, পাঠক হিসাবে, আগামী প্রজন্মের অভিভাবক হিসাবে কোন জীবনচর্যায় নিজেদের দাঁড় করাতে হবে তারই অনুসন্ধান চলে অধ্যায়টি জুড়ে। এর সঙ্গে হিন্দি/উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে দূরদর্শনের (প্রসার ভারতী) সন্দেহাতীত ভূমিকাটি আলোচিত হলে বোধকরি বৃত্ত সম্পূর্ণ হত।

‘আমাদের যৌথ সংস্কৃতি’ অংশে বাংলার মানসভূমি মহাকাব্য, শিল্প, সাহিত্য, থিয়েটার ও সিনেমার দ্বারা কীভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে তারই আলোচনা রয়েছে বড় অংশ জুড়ে। তলস্তয়, পিকাসো, আর্কাদি গায়দার, দস্তয়েভস্কি, মার্কেজ, নাগিব মাহফুজ, কায়রো ট্রিলজি— এসব বিষয়ও এসেছে। বাঙালি মননে ও অবচেতনে, তার সংস্কৃতি নির্মাণে এ উপাদানগুলি নিঃসন্দেহে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কিন্তু অধ্যায়ের শেষে উপসংহারে শুধু ভারতীয়দের কথাই উল্লিখিত হয়েছে। উপসংহারটি সঙ্কলনের সঙ্গে আরেকটু সাযুজ্যপূর্ণ হলে ভাল হত।

‘সময়ের সেতুপথে বাঙালি সংস্কৃতি’ অংশে বাঙালির সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও অভিযোজন লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও নস্টালজিয়ার সঙ্গে জারিয়ে এক বিষাদমধুর আখ্যান হাজির করে। ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব একসময় ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ের রূপ নেয়। হালকা চালে লেখা এই অংশটি সৌন্দর্যস্নাত হয়ে ওঠে উপসংহারে মণীশ ঘটকের কবিতার অনিবার্য উপস্থিতিতে:

স্ফীত নাসারন্ধ্র, দু’টি ঠোঁট ফোলে রোষে,
নয়নে আগুন জ্বলে। তর্জিলা আক্রোশে
অষ্টবর্ষীয়া গৌরী ঘাড় বাঁকাইয়া,
‘খট্টাইশ, বান্দর, তরে করুম না বিয়া।’

সঙ্কলনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায় বর্তমান সময়ের নিরিখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে হন্তারক সময়ে দীর্ঘকাল লালিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে খুন হয়ে যান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, একটি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশের কোথাও কোথাও সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ভাবাবেগের অজুহাতে কোনও খাদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের মনেও হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে অন্ধকার জাতিদ্বেষ ও অপরায়ন প্রক্রিয়া— যার শুরুটাই হয় সেই অপরের খাদ্যকে ঘৃণা করে— সেই তামসিক সময়ে ‘আপরুচি খানা’র নিবন্ধগুলি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অসীম।

হরপ্পা সভ্যতা থেকে শুরু করে প্রাগাধুনিক কাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতের প্রায় সকল অঞ্চলের খাদ্যাভাসের পূর্ণাঙ্গ একটি বিবরণ সংক্ষিপ্ত পরিসরে হাজির করেছেন লেখক। সহজভাবে বুঝিয়েছেন এই হাজার হাজার বছরের খাদ্যাভাসগুলিকে চিহ্নিত করতে, আবিষ্কার করতে কী কী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে প্রত্নবৈজ্ঞানিকদের। এই সূত্রে গ্রথিত করেছেন খাদ্যাভাসে বর্ণবাদের প্রভাব, পরিযান, বৈদেশিক আক্রমণ, সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের দুঃখময় দিনতিপাত। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তন পরিক্রমায় তুলে এনেছেন চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্যের ছোট ছোট পাঠ। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ধর্মীয় চাপকে অস্বীকার করে বাঙালির মাছবিহীন নিরামিষ ভোজনে তীব্র আপত্তির ইতিহাস। বৈষ্ণবধর্মও শেষমেশ হার মেনে নিদান দিয়েছিল ‘ইল্লিশ, খল্লিশ, ভেটকি, মদগুর এবচ/ রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা নিরামিষা।’ সঙ্গে জুড়ে গেল কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে সব মাছই নিরামিষ।

তবে চর্যাপদের সময়কার সামাজিক বিশ্লেষণ আরেকটু বিশদ হলে পাঠকের লাভ হত কারণ চর্যাপদে বৌদ্ধ-হিন্দু দ্বন্দ্বের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে।

পূর্বভারতে আমিষভোজনের বিষয়টি হিন্দুধর্মের নাভিকেন্দ্র থেকে দূরে বলে সম্ভবপর হয়েছিল বললে বোধহয় সরলীকরণ হয়ে যায়। পূর্বভারতে বর্ণবাদ তার বিশুদ্ধ কাঠামোটি চাপিয়ে দিতে না পারার পেছনে আঞ্চলিক জনজাতির ভূমিকা বিশ্লেষণ এখানে জরুরি ছিল। সেদিক থেকে দেখলে দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও উচ্চবর্ণের নিরামিষ ভক্ষণের কঠোরতা দূরত্বের সূত্র মানেনি। আর্যায়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্নতা দূরত্ব নয়, আঞ্চলিক জনজাতির গ্রহণ ও প্রতিরোধের দ্বন্দ্বের মধ্যেই নিহিত আছে। এই অধ্যায়ে আব্রাহামিক ধর্মগুলির খাদ্যাখাদ্য বিচার, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জলদস্যু ও ভাইকিংদের জীবনচর্যাও বাদ পড়েনি, নিজের প্রিয় গ্রিক কেবাবের বর্ণনা দিয়েছেন যত্নে, উঠে এসেছে লেখকের গ্রিক-সাইপ্রাস বাসের স্মৃতি।

মোদ্দা কথা, বড় যত্নে ও পরিশীলনে এই নিবন্ধগুলি রচিত। পড়া দরকার। লেখকের কথাই তুলে দিই—

এখানে আরেকটা কথা প্রণিধানযোগ্য। হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়ের সময় থেকে, অথবা হয়তো আরও আগে থেকেই সিন্ধু অঞ্চলের মানুষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা সারা ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে। সেই প্রাচীন মানুষের জিন আপামর ভারতবাসী আজও বহন করছে। আজকে প্রমাণিত যে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে যদি কোনও তিনটি জিন সর্বব্যাপী হয় সেই তিনটি হল আন্দামানের ওঙ্গে জনজাতির জিন (মাতৃক্রমে) আর হরপ্পীয় এবং স্তেপভূমির যাযাবর ও পশুপালকদের জিন (পিতৃক্রমে)। আমাদের পূর্বজরা মাছমাংস খেতেন, খেতে ভালবাসতেন। পালাবার পথ নেই, ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়া যায় না।

বিশ্বজুড়ে জাতিবৈরিতার বীভৎস রাজনীতি ও সংস্কৃতির আবহে ‘ভারতবর্ষ এক মিলনভূমি’র নিবন্ধগুলি ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ। জাতিবৈরিতার ঘৃণা সঞ্চারে, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়কে নির্বিষ লিবারেল শব্দবন্ধে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষ বিশ্বগুরুর আসন লাভ করেছে। ভারতবর্ষের মতো বহু জাতি-সংস্কৃতি-ভাষার দেশে এই বিপদ আজ চোরাগলি ছেড়ে প্রকাশ্য রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে। আশার কথা ঠিক এই সময়েই গত দুটি দশক ধরে জিনবিদ্যার সাহায্যে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পূর্বপুরুষ বা নারীর খোঁজ পাওয়ার চর্চাও বিকাশলাভ করেছে দ্রুত। এই অধ্যায়ের বিভিন্ন নিবন্ধে ভারতবর্ষে মুসলমান-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতি সম্প্রদায়ের জেনোমিক প্রোফাইল গবেষণার একটি রূপরেখা এঁকেছেন লেখক। তাতে যে সত্যিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল মাতৃক্রমের দিক থেকে ভারতের যে-কোনও ধর্ম-বর্ণের মানুষ পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে আগত নারীদের থেকে উদ্ভূত। সুতরাং মুসলিমদের সম্পর্কে যে বহিরাগত তত্ত্ব ও অপরায়ণের রাজনীতি— এই গবেষণা তার মূলে কুঠারাঘাত করে। লেখক বলছেন—

২০১০ সালে ফের গবেষণা করে দেখা যায় যে ভারতীয় মুসলিমদের জিনোমিক প্রোফাইল ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী অমুসলিমদের সঙ্গেই মেলে তবে অতি সামান্য পরিমাণে আফ্রিকা, আরব ও পশ্চিম এশিয়া থেকেও এসেছে। শেষ পর্যন্ত এখানেও একই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে ভারতবর্ষে ইসলাম কোনও ব্যাপক বহিরাগত জিনপ্রবাহ নিয়ে প্রবেশ করেনি।

এছাড়াও এই অধ্যায়ে দেহবর্ণভিত্তিক বিভাজন বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক পুনরায় স্মরণ করিয়েছেন যে পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব আফ্রিকা থেকে, প্রাকৃতিকভাবে যাদের বর্ণ কৃষ্ণ হওয়াই স্বাভাবিক।  শ্বেতবর্ণ নিয়ে যে ‘কাতরতা’ তার উৎস এবং একে ঘিরে বর্ণরাজনীতি ও ‘কসমেটিক’ পণ্যের বিশাল বাজারের বিবর্তন উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।

‘হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুধর্ম’ অধ্যায়ে হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের দিকটি জেনোমিক প্রোফাইল বিশ্লেষণের আলোয় আলোচিত হয়েছে। পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে আরএসএস-নিস্পন্ন হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা।

‘মৌলবাদ ও নারী’ নিবন্ধগুলিতে নারীর ইচ্ছা ও পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা প্রসঙ্গে তুরস্ক, আফগানিস্তান ও ইরানের মেয়েদের লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ভারতীয় নারীদের কথা, বেগম রোকেয়ার অবিশ্বাস্য লড়াই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও নারীর চিরবৈরী সম্পর্কের রূপকল্প।

‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যে’র নিবন্ধগুলিতে খুব সুক্ষ ডিটেইলে আলোচনা করা হয়েছে মহামতি অশোক ও তার ধর্ম-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি— ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে দীর্ঘ সময় ধরে যার ধারাবাহিক একটি অনুরণন থেকে গেছে। ইনক্লুসিভ আদর্শের (ইতি ও নেতি সহ) এই প্রাচীন পাঠ ফিরে পড়া দরকার, মনে রাখা দরকার সংসদ ভবনের অশোকস্তম্ভের সিংহগুলির সৌম্যগম্ভীর মুখশ্রীর হিংস্র পরিবর্তন ঘটে গেছে।

ধর্ম ও সংস্কৃতির ককটেল আধুনিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যুদ্ধ, ধ্বংস, মানবতার ক্লিষ্ট পরাজয়, দারিদ্র ও বৈষম্য, এই উত্তরাধুনিক সমাজে নানাধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। শেষ অধ্যায়গুলোতে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে এই নিয়ে। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন নিয়ে রয়েছে আলাদা নিবন্ধ। লেখক স্বয়ং বিজ্ঞানের অধ্যাপক, ফলে ইতিহাস ও সমাজের মিথষ্ক্রিয়ায় বিজ্ঞানের সদর্থক ভূমিকা কী হতে পারে বা তার গুরুত্ব কতটা তার অভিব্যক্তিও রয়েছে নিবন্ধগুলিতে।

সঙ্কলনটিতে রয়েছে বহু বিষয়ক চর্চা। সমস্ত নিবন্ধগুলিকে নিয়ে আলোচনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিটিই আলোচনার দাবি রাখে, চিন্তা উস্কে দেয়।

সুমুদ্রিত গ্রন্থটিতে কয়েকটি ছোটখাট মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে, কিন্তু ব্লার্বে এই প্রমাদ বেশ পীড়াদায়ক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছে, হয়তো সেই কারণেই বেশ কিছু তথ্য বিভিন্ন লেখায় পুনরুক্ত হয়েছে। অনেক লেখাই গ্রন্থসঙ্কলনকালে আরেকটু বিশ্লেষক, আরেকটু পরিবর্ধিত হলে পাঠকের লাভ হত।

ইতিহাসের পথটি বিপর্যয়-ধ্বংস ও নব-উন্মেষের জোয়ারভাটায় আবর্তিত হয়, সেই পথটি লেখক খোলা চোখে অনুসরণ করেছেন। শেষাবধি মানবেতিহাসে ধুকপুক করতে থাকা জায়মান আশা ও আবহমানের দিকে লেখক প্রসন্ন দৃষ্টিতে চাইতে পেরেছেন। সেই অবগাহন সকলের হোক।