Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অ্যারন বুশনেল, রেস্ট ইন পাওয়ার

অয়নেশ দাস

 


আগুনের শিখারা ২৫ বছরের ছেলেটিকে পেড়ে ফেলেছিল। বুশনেলের ভাঙা গলা শেষবারের মতো উচ্চারণ করেছিল— 'ফ্রি প্যালেস্তাইন’। উত্তর-পশ্চিম ওয়াশিংটনের খানিকটা ট্রোপোস্ফিয়ার তখন জীবন্ত মানুষ পোড়ার গন্ধে ভারী হয়ে আসছিল; যদিও বুশনেলের নিজের কথায়— তা গাজার তুলনায়, একটা জেনোসাইডের তুলনায়, কিছুই ছিল না

 

তখন বলতে গেলে শিশুই আমি। আমাদের খেলার মাঠ শেষ হত এক ছোট দীঘিতে। এক সন্ধেবেলা, যখন পাখিরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে; তাদের নিজেদের বাসা চিনে নেওয়ার মতো ওইটুকুই আলো আছে আর আকাশে; দীঘির ওপারে চোখ গেল আমাদের। এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড ছুটে বেড়াচ্ছিল দীঘির পাড় ধরে। বাতাসে আগুনের শিখারা এত দাউদাউ করে বাড়ছিল যে সেটা যে এক নারীমূর্তি তা বোঝার উপায় ছিল না। পাশেই দীঘির ভরভরন্ত জল থাকা সত্ত্বেও সে অগ্নিময় নারীমূর্তি রাস্তাতেই ছুটে বেড়াচ্ছিল যতক্ষণ না মাটি তাকে গ্রহণ করে। আমার মনে আছে কোনও এক দাদা আমার চোখদুটো হাত দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। দীঘির অপর পাড় বেশ দূরেই ছিল তবু কীভাবে আমার নাকে এসে পৌছেছিল এক অদ্ভুত ঝাঁঝালো পোড়াগন্ধ। আমার কোনও ধারণাই ছিল না মানুষের জীবন্ত কোষ পুড়তে থাকলে তার গন্ধ কী হয়!

কিছু জীবন্ত পুড়ে যাওয়ার দগ্ধ মরগন্ধ এল সেই প্রথম আমার নাকে। এবং বাকি সারাটা জীবন সে চকিত গন্ধ এক বিশেষ ঘ্রাণজ উদ্দীপনার শিহরণ হয়ে পাকাপাকি থেকে গেল আমার ওলফ্যাক্টরি রিসেপটরে। বাকি জীবনটায় বহু শ্মশানে বহু সৎকারের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। মৃতদেহ পুড়ছে; সে গন্ধে অভ্যস্ত হয়েছি আমি। কিন্তু না। জীবন্ত প্রাণ পুড়ে যাওয়ার সে গন্ধ আর পাওয়া হয়নি। ওটা কি শরীর পোড়ার, নাকি প্রাণ পোড়ার গন্ধ? ওটা কি ফুসফুস পোড়ার, নাকি দীর্ঘশ্বাস পোড়ার গন্ধ? ওটা কি রক্ত পোড়ার, নাকি প্রবাহ পোড়ার গন্ধ? ওটা কি মস্তিষ্ক পোড়ার, নাকি স্মৃতিমালা পোড়ার গন্ধ? ওটা কি চামড়া পোড়ার, নাকি অনুভূতি পোড়ার গন্ধ? ওয়াশিংটন ডিসির রাস্তায় গায়ে আগুন দিয়ে ২৫ বছরের অ্যারন বুশনেল আমায় আবার সেই প্রশ্নগুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।

***

 

সে গন্ধ পেয়েছিলেন জেডি স্যালিঞ্জার, জার্মান ডেথ ক্যাম্পের এক প্রত্যক্ষদর্শী আমেরিকান সৈনিক ও পরবর্তীকালের এক খ্যাতিমান লেখক। তিনি তাঁর কন্যাকে বলেছিলেন— ‘যতদিন খুশি তুমি বাঁচতে পারো, কিন্তু কোনওদিনই আর তোমার নাক থেকে মানুষ পুড়ে যাওয়ার গন্ধ বার করে দিতে পারবে না।’

আমি যুদ্ধ-ফেরত সৈনিক নই। এদিকে আমার সময় জুড়ে সারা পৃথিবীব্যাপী নানান যুদ্ধে ব্যস্ত থাকছে এই গ্রহের আধুনিক মানবপ্রজাতি। এ জীবনের শুরু সেই ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে, যার পোশাকি নাম ইরাক যুদ্ধ। ততদিনে যুদ্ধের খবর হয়ে গিয়েছে নিউজ এন্টারটেনমেন্ট। খবরের কাগজ থেকে, টেলিভিশনের পর্দা থেকে ইনফোটেনমেন্টের প্যাকেজে ভেসে আসতে পারে কি সে গন্ধ?

‘প্ল্যাটুনের নেতা হিসেবে কঠিনতম সময়েও আমি আমার সৈন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একদিন এক রাস্তার জমায়েতে এক বীভৎস হামলার পর যখন আমি সেখানে পৌঁছলাম, তখন এক বিশেষ গন্ধের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।’

জো, পুরো নাম জোসেফ মিলার। ইরাকে পোস্টেড এক মার্কিন সৈন্য। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজর্ডারে ভুগতে থাকা জো একটি ব্লগে লিখছিলেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

‘অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হলেও শুরুতে রক্ত থেকে কোনও গন্ধ আসে না; যতক্ষণ না জামাকাপড় তাতে ভিজে আসে আর সেটাও ওই মুহূর্তটুকুই স্থায়ী। সত্যি কথা বলতে কি, রাস্তার কোণাটায় ভরে ছিল ধুলোমাটির গন্ধ; বিস্ফোরণে সবকিছু আকাশে আছড়ে পড়েছিল। বাতাসে মিশে ছিল বিস্ফোরকের গন্ধ। সে গন্ধ আমার বহুচেনা। কিন্তু সারা জীবনে আমি যা যা গন্ধ পেয়েছি, তার থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা ছিল আরেকটি গন্ধ। যদিও তা ধুলোমাটির গন্ধে মিশেই ছিল। সেই ভয়ঙ্কর দিনটির মতোই উত্তর ইরাকের ওই রাস্তার কোণটি ভয়ঙ্কর দ্রুততায় ভরে উঠছিল পোড়া চুলের, পোড়া মাংসের ভারি চাপ চাপ গন্ধে।’

সেই গন্ধের সঙ্গে জো মিল খুঁজে পেয়েছিলেন বর্ষায় ট্যান করা চামড়া খানিক পচে আসার পর তাকে পোড়ালে যে গন্ধ বেরোয়, সেই গন্ধের। তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন মিশে ছিল ঘাস বা গাঁজাগাছ পোড়ানোর এক আদিম মরগন্ধ। সে গন্ধ আজীবন তাড়া করে বেড়ায় জোকে।

আমি সৈনিক নই। তবু আমার ওলফ্যাক্টরি রিসেপটরে বোধহয় চেনা আছে সেই গন্ধ।

***

 

কোনও প্রাণকে জীবন্ত পুড়তে দেখা এক ভয়ঙ্কর ভিস্যুয়াল অভিঘাত। কোনো প্রাণ দগ্ধে দগ্ধে মরছে— ভিস্যুয়ালি কতটা কল্পনা করতে পারি আমরা? শৈশবে দীঘির পাড়ে অগ্নিময় নারীমূর্তিকে কাছ থেকে দেখব এমন কোনও উপায় আমার কাছে ছিল না। কাছ থেকে দেখেছি প্রাণহীণ বড়কাকার শরীর চিতায় পুড়ছে। রিগার মরটিস অনেক ঘন্টা আগেই ঘটে গিয়েছে। আগুন নির্দ্বিধায় গ্রাস করছে অসাড় শরীর। সাড়ে ছ-ফুটের দেহ কুঁচকে ছোট হয়ে আসছে দ্রুত। আস্তে আস্তে চামড়া খসে পড়ছে। সাদা হাড়গুলো কালো হয়ে… বাঁকাচোরা হয়ে খসে পড়ছে— শব্দ করে। সারাজীবন ধরে আমি দেখে চলেছি। অজ্ঞাত দুর্ঘটনায় আশি শতাংশ পুড়ে গিয়ে বাঙুরের বার্ন ওয়ার্ডে শুয়ে আছে মেজপিসি। মৃত্যু তখনও কয়েক মুহূর্ত দূরে। কয়েক পরত ব্যান্ডেজ ফুঁড়ে ফুলে ওঠা অতিকায় ব্যাঙের ছাতার মতো বেরিয়ে আসতে চাইছে অতি গৌরবর্ণা মেজপিসির দগ্ধানো কালো মাংসের দলা। দুচোখে বয়ে নিয়ে চলেছি আমি পোড়ামাংসের সেই দগ্ধ জ্যামিতি।

না আমার পিটিএসডি হয়নি। জো-এর যা হয়েছিল। যা হয়েছিল নোয়ার।

ইরাকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জো। দগ্ধানো মানুষের দৃশ্য, গন্ধ মাল্টিপ্লাই হয়ে চলেছে। জো দেখছিলেন। মাল্টিপ্লায়েড মরগন্ধ ভেসে আসছে অবসন্ন সৈনিকের নাকে। জেনোসাইডে তাই হয়। ইরাকে… আফগানিস্তানে…

এক ইন্টারভিউ-এর মাঝখানে নোয়া হারিয়ে গিয়েছিলেন দুঃসহ স্মৃতিভারে। আফগানিস্তানের হেলমন্দ পরগণার এক বিস্তারিত উপত্যকায়। যেখানে শেলের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ গ্রামগুলি ভরে উঠেছে আফিমক্ষেতে— সেখানে মরগন্ধ জীবিতদের তাড়া করে বেড়াত অবিরত। চারিদিকে রক্তাক্ত-দগ্ধ-ছিন্নবিচ্ছিন্ন নিরপরাধ সিভিলিয়ান আর নিষ্পাপ শিশুদের দেহ। দেহ নয়— টুকরো টুকরো দেহাংশ। প্রায় দুই বছর ধরে নোয়া এক ভয়াল জিগ-স পাজলের মধ্যে ক্রিয়ারত এক অটোমেটিক বেলচার মতো সেই সব টুকরোগুলি বডিব্যাগে বস্তাবন্দি করে যাচ্ছিলেন প্রত্যেক দিন আর প্রত্যেক রাত। প্রতিটি এয়ার স্ট্রাইকের পর কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো এক দুঃসহ নিস্তব্ধতা; তারপরেই মর্মভেদী আর্তনাদের পালা; তারও পরে উপত্যকায় নেমে আসত নোয়াদের মতো সৈন্যরা। বডিব্যাগ হাতে নিয়ে। দগ্ধ মরগন্ধে তখন উপচে পড়ছে উপত্যকা। জেনোসাইডে এমনই হত, এমনই হয়।

ইন্টারভিউটিতে নোয়া বলছিলেন— ‘ফিজিতে আমরা সুচারুভাবে কাটা গোমাংসখণ্ডগুলিকে গ্রিলে চাপাতাম। তারপরে সবাই মিলে গ্রিলের চারপাশে গোল করে বসতাম আর আর গ্রিলে মাংস পুড়তে থাকার গন্ধ আমাদের মাতাল করে তুলত। সেটা ছিল জীবনের সুগন্ধ। আর আফগানিস্তানে? মানুষের মাংস পোড়া মরগন্ধে আমার নাক বন্ধ হয়ে আসত। এর কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত সত্যিই আমি জানতাম না। আজ দশ বছর পরেও আমার নাক সেই মরগন্ধে ভারী হয়ে আছে।’

নোয়া ছিলেন ফিজি থেকে রিক্রুট হওয়া ব্রিটিশ সৈন্য। বাকি সারাটা জীবন ভয়ঙ্কর পিটিএসডির রুগী। নোয়ার ওলফ্যাক্টরি রিসেপটরে পাকাপাকি থেকে গিয়েছে জীবন্ত মানুষ পোড়া গন্ধ।

***

 

আমারও বয়স থেমে নেই। সমাজতন্ত্রের পতন, ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান পার করে অবাক চোখে এখনও গুনে চলেছি নিরবচ্ছিন্ন জেনোসাইডের পঞ্জিকা। পাঁজি মেনে নিয়মমতো জেনোসাইডে যেমন হয়; জেনোসাইডে যেমন হত; তেমনি হয়ে চলেছে গাজার ভূখণ্ডে। এখনও অবধি মৃতের সংখ্যা ৩১৩০০ ছাড়িয়েছে (তাও আসল সংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে, কেউ জানে না)। যার এক বড় অংশ শিশু। ইউএন-এর হিসেব অনুযায়ী যদি ১২৩০০ শিশুর হত্যা হয়ে থাকে তাহলে পাঠক কল্পনা করুন আসল সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে! জেনোসাইডে তো এমনই হয়! গাজার রাস্তায় রাস্তায়, ধ্বংসস্তুপে মরগন্ধে দমবন্ধ হয়ে বডিব্যাগ পিঠে এখন কারা ঘুরে বেড়াচ্ছে? হেলমন্দের নোয়ার মতো? ইজরায়েলি শেলে ১২৩০০ দগ্ধ শিশুর মরগন্ধে কতটা ভারী হয়ে আসতে পারে গাজার ট্রোপোস্ফিয়ার?

***

 

জীবন্ত-দগ্ধ মৃত্যুর মতো ভয়াবহ বোধহয় আর কোনও মৃত্যু নয়। ইংরেজিতে এই ফ্রেজটির প্রচলন এই কারণেই হয়েছিল; ‘burned at the stake’… প্রায় প্রতিটি ধর্মের কল্পনার নরকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে থেকেছে পাপীর জীবন্ত দহন। তা হলে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেই সিদ্ধান্ত যখন একজন শুধু প্রতিবাদের রাস্তা হিসেবে বেছে নেয় আগুনে দগ্ধে দগ্ধে আত্মহনন?

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ একটি রবিবার। সারা পৃথিবীর সুখী গৃহকোণ নরম বিকেলে তখন আরামে ব্যস্ত। সেই সব গৃহকোণের দামী টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিওতে, গরম খবরের কাগজে, হাতের মুঠোয় ধরা সেলফোনের স্ক্রিনে সারা পৃথিবীর নামী দামী মিডিয়া হাউসেরা লাক্সারি লিভিং-এর চকচকে কমার্শিয়ালের মাঝে মাঝে, হলিউডি-বলিউডি-আমাজনীয় প্রোমোর ছোট বিরতিতে, ফ্ল্যাট-বাড়ি-চাকরি-পাত্র-পাত্রী-লিঙ্গবর্ধক যন্ত্রের ছাপা বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে, তখনো গাজায় ঘটে চলা জেনোসাইডকে ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। সেই হল্লার মধ্যে অতি সামান্য মানুষের কানেই পৌঁছতে পেরেছিল একটি ব্যতিক্রমী সেলফোনের লাইভস্ট্রিম…

My name is Aaron Bushnell. I am an active-duty member of the United States Air Force, and I will no longer be complicit in genocide.

২৫ বছরের অ্যারন বুশনেল এগিয়ে চলছিল ওয়াশিংটন ডিসির ইজরায়েলি এমব্যাসির দিকে। সঙ্গে চলছিল তার লাইভস্ট্রিম…

I’m about to engage in an extreme act of protest. But compared to what people have been experiencing in Palestine at the hands of their colonizers, it’s not extreme at all. This is what our ruling class has decided will be normal.

এমব্যাসির সামনে পৌঁছে বুশনেল ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। অপর হাতের থারমোস থেকে তার শরীরে নেমে আসে দাহ্য তরলের স্রোত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের শরীর আগুনে জ্বালিয়ে নেয় সে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠা স্লোগানের মতো দুটি শব্দ সেই লেলিহান আগুন চিরে বারংবার বেরিয়ে আসতে থাকে— ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’…

রাষ্ট্র তখন পাশেই এক পুলিশ অফিসারের আত্মায় ভর করেছিল। জ্বলন্ত বুশনেলকে গানপয়েন্টে রেখে সে চিৎকার করছিল— গেট ডাউন!!! পাশেই তার এক সহকর্মী তখন চিৎকার করছিল— ‘আমার বন্দুক চাই না, আমার ফায়ার এক্সটিংগুইশার চাই।’ কিন্তু তবুও রাষ্ট্রের বন্দুক বুশনেলকে তাক করেছিল। রাষ্ট্রের বন্দুকের নল প্রত্যাশা করে এককের ‘টোটাল ডমিনেশন’। আগুনের শিখারা ২৫ বছরের ছেলেটিকে পেড়ে ফেলেছিল। বুশনেলের ভাঙা গলা শেষবারের মতো উচ্চারণ করেছিল— ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’। উত্তর-পশ্চিম ওয়াশিংটনের খানিকটা ট্রোপোস্ফিয়ার তখন জীবন্ত মানুষ পোড়ার গন্ধে ভারী হয়ে আসছিল; যদিও বুশনেলের নিজের কথায়— তা গাজার তুলনায়, একটা জেনোসাইডের তুলনায়, কিছুই ছিল না।

***

 

আমাদের, যাদের ওই তিনটে বাঁদরের মতো বোবা, কালা আর কানা বানিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের নিয়ে এখনও কীসের চিন্তা জেনোসাইডের কারবারীদের? কারণ হয়তো আমাদের নাকটা এখনও খোলা। ওয়াশিংটন ডিসির খোলা রাস্তা তো আর প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা গাজা স্ট্রিপ নয়! সভ্যতার খোলা নাকে পৌঁছে যেতেই পারে বুশনেলের জীবন্ত মরগন্ধ। সেই মরগন্ধের নিহিত বার্তাটিকে চেনা ছকেই অপ্রাসঙ্গিক ফেলার যাবতীয় চেষ্টা চালাল পরের দিনের নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর হেডলাইন— “Man Dies After Setting Himself on Fire Outside Israeli Embassy in Washington, Police Say”! CNN আর রয়টার চালাল একই হেডলাইন— “US airman sets himself on fire outside Israeli Embassy in Washington.” দ্য ওয়াশিংটন পোস্টেরও একই ব্যাপার, শুধু শব্দের এদিক-ওদিক— “Active-duty airman sets himself on fire outside Israeli Embassy in Washington.”

প্রাণ পুড়ে যাওয়ার, হৃদয় পুড়ে যাওয়ার, যাবতীয় সংবেদন পুড়ে যাওয়ার সে অসম্ভব গন্ধ চেপে দেওয়ার চেষ্টায় খামতি রাখেনি মার্কিন নর্মাটিভ অর্ডার। NPR লিখতে থাকে— “As of Monday morning, NPR was not able to independently verify the man’s motives.”

জেনোসাইডের কারবারীরা কী আড়াল করতে চায়? ঠিক কোন উদ্দেশ্যে টাইমস ম্যাগাজিন বুশনেল-কে নিয়ে প্রকাশিত আর্টিকেলের নিচে রাখে এই সতর্কীকরণ— “If you or someone you know may be experiencing a mental-health crisis or contemplating suicide, call or text 988”?

বুশনেল নামের ২৫ বছরের ছেলেটির ‘এক্সট্রিম’ সিদ্ধান্ত কী ‘মোটিভ’ রাখতে পারে পৃথিবীর যাবতীয় ‘নর্ম্যাল’ সুখসাগরে! ২৫ ফেব্রুয়ারির সোনালি বিকেলে যাবতীয় নাগরিক সুগন্ধ ছাপিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির নাক ভারী হয়ে আসে এক ২৫ বছরের জীবন্ত যুবকের দগ্ধ মরগন্ধভারে। অন্যদিকে স্বাভাবিক দ্রুততায় জেনোসাইডের কারবারীদের বন্দোবস্তে মানুষের চেতনায় নির্মিত হতে থাকে অ্যারন বুশনেলের ‘এক্সট্রিমিজম’, অ্যারন বুশনেলের ‘অ্যাবনর্মালিটি’। ‘মানসিক অসুস্থতা’র গারদে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অ্যারন বুশনেল নামের একটি ফুল, যার সংবেদনশীল পাপড়ি যন্ত্রণায় এমনি ঝরে যায়নি; আগে জ্বলে উঠে তবে ঝরেছে। নিজের দেহেই ক্ষমতা-আঁতাতের ভয়াবহ বর্বরতার এক স্যাম্পল ইন্সটলেশান নির্মাণ করে এস্থেটিক দৃশ্য আর এস্থেটিক গন্ধের যাবতীয় ক্ষমতাতান্ত্রিক প্রতারণাকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে অ্যারন বুশনেল। আধুনিক ক্ষমতাকেন্দ্রের সদর দুয়ারেই! আমরা যারা সুখী ঘরের কোণ থেকে, কার-এসির আরাম থেকে, অফিসের মোটা গদির আর্মচেয়ার থেকে বুশনেলের ‘এক্সট্রিম’ ভিডিও দেখে ‘হাউ শকিং’ বলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি, আমরা তারাই— যারা অবলীলায় খবরের পাতায়, স্ক্রিনে যুদ্ধ আর জেনোসাইডের ভয়াবহতাকে ‘স্বাভাবিক’ করে নিয়েছি, যাদের কখনও প্রিয়জনের পোড়া-দগ্ধ দেহ বোমা-বিদ্ধস্ত ধ্বংসস্তুপের গভীর থেকে খুঁজে বের করে আনতে হয়নি।

পাঁচ মাস ধরে জেনোসাইডের আগুনে জ্বলছে প্যালেস্তাইন। পুড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পৃথিবীর চোখের সামনেই। অথচ ভিস্যুয়াল ইম্প্যাক্ট শূন্য। পুড়ে যাচ্ছে মানুষ-মানুষী-শিশু, পোড়া মাংসপিণ্ডের মতো ঝলসে যাচ্ছে বাবা-মা-পুত্র-কন্যা-প্রেমিক-প্রেমিকা। বুশনেলের মতোই ভেঙে আসা স্বরে চিৎকার উঠছে গাজার আকাশে। তারপর গলার স্বর, ফুসফুসের দম, ভালবাসার প্রবাহ-স্মৃতিমালা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে— শিকড়ের ইতিহাস লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠছে— বুশনেলের মতো বোতল উপুড় করা দাহ্য তরলে নয়, ইজরায়েলি আর্টিলারি পোজিশন থেকে উৎক্ষিপ্ত মার্কিন প্রযুক্তিতে তৈরি ফসফরাস বোমায়। পাঁচ মাস এভাবেই কেটে গেছে। জেনোসাইডে যেমন হয়। আমাদের কাছে সবই ‘স্বাভাবিক’। নিজের ভেজা গায়ে আগুন দেওয়ার আগেই ইউএস এয়ারম্যান অ্যারন বুশনেল তার মোটিভ স্পষ্ট করে দিয়েছিল।

I’m about to engage in an extreme act of protest. But compared to what people have been experiencing in Palestine at the hands of their colonizers, it’s not extreme at all. This is what our ruling class has decided will be normal.

শেষ লাইনে আজকের পৃথিবীর ক্ষমতাতন্ত্রের সারসত্যটুকু এককথায় প্রকাশ করে দিয়ে গেছে ২৫ বছরের যুবক এয়ারম্যান। আধুনিক ব্যাবস্থার ‘মেন্টাল হেলথ’ অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের পশ্চিমি ডিসকোর্সটিকে পশ্চিমি ক্ষমতাতন্ত্র তার যাবতীয় অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে উঠে আসা প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে ব্যবহার করে। ক্ষমতার হেজেমনি সেই সমস্ত সিম্বলকে ‘নর্ম্যাল’ বানিয়ে নেয় যা তার অন্যায় প্রসারের সঙ্গে যুক্ত। যুদ্ধ… জেনোসাইড… এভাবেই, এভাবে চলতে থাকে, বাড়তে থাকে। নর্ম্যাল হয়ে যেতে থাকে জেনোসাইডের পক্ষেকার যুক্তি।

এই অশ্লীল-দমবন্ধ ‘নর্ম্যালসি’র শান্তি-শীতলতায় বন্য আঁচড়ের মতো বুশনেলের সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ের সেনা উর্দিটিও যখন জ্বলে ওঠে, কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও পুড়ে খাক হয়ে যায় শাসকের হেজিমনির নির্মাণ, হেজিমনির সিম্বল। এক সামান্য সেনা যুবকের প্রতিস্পর্ধার দগ্ধ মরগন্ধে পৃথিবীর যত খোলা নাক বন্ধ হয়ে আসে। কোন ফ্র্যাগর‍্যান্সে তাকে চাপা দেবে পশ্চিমি খুনের দল? যদি দিয়েও দেয় তবুও অন্তত কিছু মানুষের চোখে সে সিম্বল পুড়ে ছারখার হবে।

***

 

বুশনেলের শরীর পুড়ে যায়। বুশনেল পুড়তে পুড়তে আবারও দেখিয়ে যায় মানুষ আসলে কত তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়— ছেলেবেলার দীঘির পাড়ে— গাজায়— আফগানিস্তানে— ইরাকে— ভিয়েতনামে— নাৎসিক্যাম্পে…

জোনাথান গ্লেজারের ‘দ্য জোন অফ ইন্টারেস্ট’ ছবি আমাদের নিয়ে চলে এক নাৎসি ডেথক্যাম্পে। নিরবচ্ছিন্ন ভেসে আসছে মানুষ পোড়া মরগন্ধ। ‘স্বাভাবিক’ জার্মান অফিসারেরা সন্ধের আরামে বাখ শুনছে, তাদের ছেলেমেয়েরা নরম সোনা রোদ পোহাচ্ছে, মেয়েরা নিয়মানুযায়ী প্রাত্যহিক কাজ সারছে। সব ছিমছাম, ছবির মতো টিপটপ। আমরাও। অথচ নিরবচ্ছিন্ন ভেসে আসছে মানুষ পোড়া মরগন্ধ। গাজা স্ট্রিপ থেকে। বর্ষায় ট্যান করা চামড়া খানিক পচে আসার পর তাকে পোড়ালে যে গন্ধ বেরোয়, সেই গন্ধের। তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন মিশে ছিল ঘাস বা গাঁজাগাছ পোড়ানোর এক আদিম মরগন্ধ। জো যেমন ইরাকে পেয়েছিল। আমি জো নই। ঘটমান জেনোসাইডের প্রত্যক্ষতার বাইরে নিরাপদ আমার অস্তিত্বের আবাসন। রাষ্ট্রের অবধানে আমার মানসিক স্বাস্থ্য অটুট। যেমন জেনোসাইডের বাইরে হয়। স্বাভাবিক দুনিয়ায় আমরা একেকজন জার্মান অফিসারের মতো নির্বিকার ‘স্বাভাবিক’। না, বুশনেল ওই নির্লিপ্ত জার্মান অফিসার হয়ে উঠতে পারেনি। গাজার দগ্ধ মৃতদেহের স্তূপ থেকে আসা মরগন্ধের কুয়াশায় সে ওই জার্মান নারীদের মতো নির্বিকার ফ্লাওয়ার ভাসে ফুল সাজিয়ে যেতে পারেনি।

প্যালেস্তাইনের নিরন্তর মরগন্ধের স্রোত বুশনেলের জ্বলন্ত, গলন্ত শরীরে ধাক্কা খেয়ে আমার ওলফ্যাক্টরি রিসেপটরের এক চেনা গন্ধের সঙ্গে মিলে যায়। অ্যারন বুশনেলের জীবন্ত শরীর পুড়ে যায়। আমি সে গন্ধ আবার পেতে থাকি। অ্যারন বুশনেলের লাইভস্ট্রিম থেকে… গাজার ধ্বংসস্তূপের গভীর থেকে… আমার হাতে নোয়ার মতো বডিব্যাগ নেই। আমার কাছে নেই বুশনেলের একক অমর প্রতিস্পর্ধা। তবুও…

***

 

জেনোসাইডের সঙ্গে আঁতাত ছিন্ন করতে চাওয়ার ‘মানসিক অসুস্থতা’ নিয়ে অ্যারন বুশনেলের শরীর পুড়ে যায়। কী বা করত সে? কী বা করার ছিল? ঝাঁকের কই ঝাঁকেই মিশে যেতে পারত! সম্মানের সঙ্গে শেষ করতে পারত সেনাজীবন! তথ্য-প্রযুক্তিতে মন দিয়ে কামাতে পারত ঢের! নিশ্চিন্তে, নির্বিকারে ঢুকে যেতে পারত ‘জোন অফ ইন্টারেস্ট’-এ! যেমন এক সোনালি বিকেলে সে পুড়ছিল, তেমনি এক বিকেলে সে চোখ বন্ধ করে শুনতে পারত নাইন্থ সিম্ফনি! গাজার ধ্বংসস্তূপের গভীর থেকে দগ্ধ মরগন্ধ ভেসে এলে, গায়ে পেট্রোলের বদলে ঢেলে নিতে পারত কারোন পইভারের দুর্মূল্য সুবাস!

তার বদলে একদিন আগেই বুশনেল তার লাইভস্ট্রিমে একটি ক্যাপশন লিখেছিল—

Many of us like to ask ourselves, ‘What would I do if I was alive during slavery? Or the Jim Crow South? Or apartheid? What would I do if my country was committing genocide?’ The answer is, you’re doing it. Right now.

পাঁচ মাসে ফসফরাস বোমায় জ্বলে গেছে ৩১৩০০ প্রাণ। আমাদের এইটুকু মনে করাতে নিজেকে আগুনে ঝলসে দিল ২৫ বছরের অ্যারন বুশনেল। ১২৩০০ শিশুর দগ্ধ মরগন্ধ নিজের শরীরে মেখে নিজেকে আগুনে ঝলসে দিল ২৫ বছরের অ্যারন বুশনেল। আমরা যারা উপচে ওঠা জীবন্ত মরগন্ধে নাক ডুবিয়েও জেনোসাইডের মতো অন্যায়কে ধীরে ধীরে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ‘নর্ম্যাল’ করে তুলছি, তাদের নাকে ঝামা ঘষে দিতে নিজেকে আগুনে ঝলসে দিল ২৫ বছরের অ্যারন বুশনেল। সংগঠিত হিংসার পশ্চিমি নর্মাটিভ স্ট্যান্ডার্ডের হেজিমনির বিপরীতে প্রতিস্পর্ধায় আবারও চোখ তুলে দাঁড়াল একক মানুষের আত্মাহুতির হিংসা, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যাকে বলেছিলেন— ‘ডিভাইন ভায়োলেন্স’; যা আসলে— the fact of vibrant humanity.

১৯৬৯ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইনভেশনের প্রতিবাদে ওয়েন্সলেস স্কোয়ারে পেট্রোল ঢেলে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল ২০ বছরের সদ্য যুবক জান পালাক। পালাকের সেদিনের ‘এক্সট্রিম’ সিদ্ধান্ত বৃথা যায়নি। বিশ বছর বাদে যখন চেকোশ্লোভাকিয়া সোভিয়েতমুক্ত হল, প্রাগের সমস্ত দেওয়াল ভরে গিয়েছিল পালাকের মুখাবয়বের পোস্টারে। হাজারে হাজারে মানুষ মার্চ করে এসেছিল রেড আর্মি স্কোয়ারে যার নাম বদলে তারা ভালবেসে রেখেছিল জান পালাক স্কোয়ার। একদিন প্যালেস্তাইন এই ইজরায়েল নামের বর্ণবৈষম্যবাদী কর্পোরেট রাষ্ট্রের নির্মম জেনোসাইড পার করে উঠে দাঁড়াবে। ক্ষমতার সমস্ত আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাবে পৃথিবী। বডিব্যাগে ঝলসানো দেহাংশ সংগ্রহ করতে হবে না আর কোনও নোয়ার মতো সদ্যযুবককে। গাজার ধ্বংসস্তূপের গভীর থেকে উঠে আসবে না ঝলসানো শিশুদের দগ্ধ মরগন্ধ। উঠে আসবে না আর প্রাণ পোড়ার গন্ধ… দীর্ঘশ্বাস পোড়ার গন্ধ… স্মৃতিমালা পোড়ার গন্ধ… সেদিন প্যালেস্তাইনের রাস্তায় রাস্তায় দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা থাকবে অ্যারন বুশনেল, তোমার ছবি। আঁকা থাকবে আমার মতো অসহায় বুকে— তোমার নাম, অ্যারন বুশনেল, রেস্ট ইন পাওয়ার।

 

তথ্যসূত্র:

১। টাইম ম্যাগাজিন ২। আল জাজিরা ৩। দ্য ক্রিস হেজেস রিপোর্ট ৪। democracynow.org ৫। truthout.org ৬। কালচার শক ৭। ক্রিটিক অফ ভায়োলেন্স – ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ৮। নিউ ইয়র্ক টাইমস ৯। ওয়াশিংটন পোস্ট ১০। independent.co.uk


*মতামত ব্যক্তিগত