একটি অকালমৃত্যুর কাছে স্বীকারোক্তি

অয়নেশ দাস

 


অন্যদিকে এই সুযোগে শুরু হয়ে গিয়েছে অবধারিত প্রতিক্রিয়াশীল হিংসার ডিকট্যাট। ওদের ফাঁসি দাও। শূলে চড়াও। যাদবপুর নামের সঙ্গে যে প্রতিস্বর, যে অর্জিত প্রতিস্পর্ধা লেগে রয়েছে তাকে একটানে ছিঁড়ে নেওয়ার এই তো সুযোগ। এই সেলফ-প্রোক্লেইমড কালিমাহীন এলিয়েনদের লক্ষ্য এখন যাদবপুর নামটি। যেভাবেই হোক তারা প্রমাণ করে ছাড়বে এই হত্যার জন্য দায়ী এই আর্থ-সামাজিক কাঠামো নয়, যাদবপুরের লড়িয়ে ঐতিহ্য। যা ভাঙা যাচ্ছিল না, তা প্রতিহিংসায় গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই তো সুযোগ। পুঁজ দেখিয়ে প্রতিস্পর্ধার পুরো চামড়াকেই গিলে নিতে উদ্যত নিঃশব্দ ক্যান্সার

 

একটি স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। মর্মান্তিক অকালমৃত্যু। এ নিয়ে কার-ই বা লিখতে ভাল লাগে! কিন্তু এই আমাদের সময়! সন্তানের শবের ওপর কাগজ চড়িয়ে, আঁচড় দিয়ে ভাবতে হয়— ব্যাকরণ ঠিক থাকল কিনা।

যাই হোক, যাদবপুরের ছাত্রটির মর্মান্তিক মৃত্যু বা হত্যা সকলকেই স্বাভাবিকভাবেই নাড়িয়ে চলেছে। অনেকেই বিপুল যন্ত্রণা নিয়ে লিখছেন, আলোচনা চলছে, বিভিন্নভাবে সরব হচ্ছেন। তবে আমি যা যা হাতের কাছে পড়তে পেয়েছি তাতে কয়েকটি বিষয়ই সারফেসে ঘোরাফেরা করছে। একধরনের লেখায় উঠে আসছে ক্যাম্পাস র‍্যাগিং-এর যাবতীয় পুঙ্খানুপুঙ্খ প্যাথোলজিক্যাল খুঁটিনাটি। আরেক ধরনের লেখায় উঠে আসছে নানারকমভাবে কে বা কোন ব্যক্তিবর্গ দোষী, তার পর্যালোচনা। এবং একই সঙ্গে কঠোরতম শাস্তির দাবি। সব বড় মিডিয়াই যথারীতি গোয়েন্দা গল্পের মতো হুডানিট শুরু করে দিয়েছে। দোষীদের খুঁজে বার করা চলছে। এক এক করে নাম বেরিয়েও আসছে। পাড়ার আড্ডায় কান পাতলেই শুনতে পাচ্ছি প্রবল উল্লাসের সঙ্গে হত্যাকারীর শাস্তির বিধান। কেউ কেউ আরেকটু উঠছেন। ক্যাম্পাস-সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন কেউ। তাদের মধ্যে যাঁরা আরও সিলেকটিভ, তাঁরা আঙুল তুলছেন বিশেষত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও বিশেষত্বের দিকে। ওই যে বললাম, পাড়ার আড্ডাতেও অতি সিলেকটিভ লোকজনেরা আছেন। যাঁদের মতে যাদবপুর আঁতেলপনার জায়গা, নেশাভাঙের আড্ডা। ওই জায়গাটাকেই ডিকটেটরশিপ দিয়ে গুঁড়িয়ে দাও— এইসব। প্রগতিশীলতার পিছনে আসলে অপরাধের আখড়া! আরও নানান কিছু। এমন একখানা ভাব, যেন হঠাৎ করে আমরা যারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিলের বাইরের জনতা, তারা সবাই পূত-পবিত্র সত্যসিন্ধু হয়ে উঠলাম। কালিমাহীন এলিয়েন যেন। এই পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে কোনও লেনদেন নেই। ফলে এঁদের আলোচনার সব যা কিছু, শুধুমাত্র ক্যাম্পাস র‍্যাগিং-এর পরিধিটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

এঁদের অনেকেই যে কোনও কিছুই সঠিক বলছেন না, তা তো কখনওই নয়। কিন্তু এঁরা যতটুকু নিয়ে কথা বলছেন বা মতামত রাখছেন সেটা যেদিকে শুধুমাত্র দৃষ্টিকে আবদ্ধ রাখছে তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কারণ তাঁরা কেউই এলিয়েন নন। অর্থাৎ তাঁরা পুরোটা দেখবেন না বা দেখাবেন না। যদিও তাঁরা সম্যক জানেন যে, সার্বিক হিংসার সর্বাত্মক ভয়ঙ্কর বৃত্তটিকে এইসব দিয়ে কিছুতেই আটকানো যাবে না। কারণ এই সব কিছুই আসলে সেই বৃত্তেরই উপজাত এবং পর্যায়ক্রমে সেই বৃত্তেই আত্মস্থ। সেইজন্যই একটি মর্মন্তুদ হত্যা ঘটছে, আমরা খানিক হইচই করছি; আবার শান্তিকল্যাণ; আবার আরেকটি হত্যা, আবার খানিক হইচই— এই বৃত্তই ঘুরে চলেছে। আমাদের যাবতীয় হইচই-এর বিস্তার কেবলমাত্র হিমশৈলের চূড়ার মতো ডিরেক্ট ভায়োলেন্স বা প্রত্যক্ষ হিংসাটুকুর (তাৎক্ষণিক) প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ। আমরা কখনওই পুরোটা দেখতে চাই না বা পাই না। আসলে আমাদের তা দেখতে দেওয়া হয় না। র‍্যাগিংকে আমরা একটি বিচ্ছিন্ন বিষয়— এই ভাবনার আত্মপ্রবঞ্চনাতেই স্বচ্ছন্দ। যে মুহূর্তে আমরা র‍্যাগিং-এ যুক্ত কয়েকটি সিনিয়র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অবহেলা বা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হই, সেই মুহূর্তেই আমরা আসলে কনভেনিয়েন্টলি ভুলে যাই র‍্যাগিং-ও আসলে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতার অজস্র অভিব্যক্তির (এক্সপ্রেশন অফ পাওয়ার) মধ্যে একটি।

এই বিপুলভাবে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অসাম্য-ই নিয়ম। ক্ষমতা সবসময়ই ক্ষমতার বাইরে যারা, তাদের নগ্ন-ন্যুব্জ করে দেওয়ার মধ্যে বিচিত্র আনন্দ পায়। এই হল ক্ষমতার অভিব্যক্তি। হিংসা যার আধার। এই হিংসায় অঙ্গীভূত কমবেশি আমরা সকলেই। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এই ঘা নিঃশব্দ ঘুন-ক্যানসারের মতো বেড়েই চলেছে। হিমশৈলের জলের তলার যে অধিকাংশ অংশটা, তা হল স্ট্রাকচারাল হিংসার এই নিঃশব্দ ক্যান্সার। এবং তা আমাদের চোখে সহজে দৃশ্যমান নয়। তাকে আড়াল করা সহজ। ঘা থেকে যখন গলগলে পুঁজ বাইরে বেরিয়ে আসে কেবলমাত্র যেন তখনই তা দৃশ্যমান হয়। কিন্তু তা কেবল হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আমাদের শরীরটাই যে ক্যান্সারে আক্রান্ত, সেটা থেকে আমাদের চোখ সরিয়ে রাখার যাবতীয় কাঠামোগত আর্থ-সামাজিক মেকানিজম প্রবলভাবে চলতেই থাকে। একসময় আমরা অনায়াসে বিস্মৃত হই যে আমরা নিজেদের প্রত্যেকের শরীরেই এই আড়াল করা নিঃশব্দ ক্যান্সার বয়ে নিয়ে চলেছি। ফলে ক্যান্সার আক্রান্ত শরীরটাকেই আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিই বা ধরে নিতে বাধ্য হই। পুঁজ বেরিয়ে পড়লে কেবলমাত্র তখনই চামড়ার ওপরে লাগানোর মলম খোঁজার উত্তেজনা চড়ে। র‍্যাগিং বন্ধের টোটকা হিসেবে যাঁরা কড়া আইনের ওপরে নির্ভর করেই সমাধান খুঁজতে চান, তাঁদের ব্যাপারটাও ওই চামড়ার মলম খোঁজার মতো।

এক অদ্ভুত কঠিন প্রতিযোগিতামূলক আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় আমাদের যাপন; যেখানে সমাজের সর্বস্তরে অসাম্যের মূল গভীরে প্রোথিত। আর যে মেকানিজম দিয়ে ক্ষমতা এই কাঠামোকে যুগ যুগ ধরে অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে তা হল হিংসা। সর্বব্যাপী অতলান্ত হিংসা। হিংসা একদম স্ট্রাকচারালি ছড়িয়ে আছে সমস্ত অসাম্যের নির্মাণে। শ্রেণি-অসাম্যে, বিত্ত-দারিদ্র্যে, শক্তি-দৌর্বল্যে, জাতিগত অসাম্যে, লিঙ্গগত অসাম্যে, ভৌগোলিক অবস্থানের বিভিন্নতায়, চামড়ার রঙের বিভিন্নতায়, সামাজিক হায়ারার্কিতে, পারিবারিক হায়ারার্কিতে, যাবতীয় মেজরিটি-মাইনরিটিতে, সভ্যতার নিরিখে, মানুষ ও পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কে এমনকি ইংরেজি বলতে পারা ও না-পারাতে…। প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি মুহূর্তের খণ্ড ভগ্নাংশেও এই হিংসা প্রবলভাবে সার্বত্রিক ক্রীয়াশীল। এবং আমাদের যাপনচক্র এই সার্বত্রিক হিংসার আবর্তেই আচ্ছন্ন ছন্দোবদ্ধের মতো ঘূর্ণায়মান। একমাত্র মাঝেমধ্যেই কেবল এই আচ্ছন্ন আত্মঘাতী ঘূর্ণনে সামান্য কাঁপন ধরে, যখন সুইসাইড, হোমিসাইড, যুদ্ধ, জেনোসাইডের মতো প্রত্যক্ষ হিংসা সারফেসের ছিদ্র বেয়ে পুঁজ উদ্গিরণ করে। অন্তর্গত বিশাল বাকিটায় আমাদের আচ্ছন্ন, দিনগত কালাতিপাত এবং তাতেই নিজেদের অভ্যস্ত করে নেওয়া। প্রত্যেকটি দিন এই কাঠামোয় নিজেদের ‘ফিট’ বানিয়ে নেওয়ার কী অসহায় প্রাণান্ত চেষ্টা। স্ট্রাকচারাল হিংসাকে নিজের মধ্যে অঙ্গীভূত করে নেওয়ার মধ্যেই সেই ফিট হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র যে! নাহলে তো তুমি খিল্লি হয়ে যাবে… হয়ে যাবে এমটিভি বকরা! হয়ে যাবে ‘লুজার’ (যা কিনা সভ্য মানুষ ব্যবহৃত কুৎসিততম অপমানজনক গালাগাল)। বেশিরভাগ র‍্যাগিং-এর সাফাই হল এই— জুনিয়রটিকে এই হিংস্র পৃথিবী অনুযায়ী ‘ফিট’ করে তোলা। এই সাফাই-টাই চলমান আর্থ-সামাজিক হিংসার প্রকরণগুলিকে বুঝে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

তো এই ক্যাম্পাস র‍্যাগিং কি একটি ইউনিক সংজ্ঞাবিশিষ্ট অপরাধ? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও তো আসলে এই সমাজের ক্ষুদ্র আয়না— এক মাইক্রোকসমিক সোসাইটি। বৃহত্তর সমাজের মতোই সেই ক্ষুদ্র এককেও বিবিধ ইন্টারসেক্টিং ফ্যাক্টর বিদ্যমান। যেমন— সামাজিক শ্রেণি, লিঙ্গ, এথনিসিটি, ভাষা, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক উৎস ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিলের বাইরের সমাজটার মতোই সেখানেও স্ট্রাকচারাল হিংসা এই ফ্যাক্টরগুলিকে উপজীব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজজীবনে সেঁটে থাকে। বৃহত্তর সমাজের আয়নার মতোই সেই সমাজেও প্রতিনিয়ত ক্ষমতার হায়ারার্কির নির্মাণ ঘটে চলে। সেখান থেকেই তৈরি হয় ক্ষমতার বিভিন্ন গ্রুপ। আর সোসাল ডমিন্যান্সের চরিত্র অনুযায়ী ক্ষমতা সমাজকে ইনগ্রুপ আর আউটগ্রুপে বিভক্ত করে ফেলে। এবং ইনগ্রুপ নিয়ন্ত্রিত স্ট্রাকচারাল হিংসায় প্রতিনিয়ত দীর্ণ হতে থাকে। আবার এই আউটগ্রুপ যখন ইনগ্রুপ হয়ে উঠতে পারে, তখন তার হাতে চলে আসে স্ট্রাকচারাল হিংসার রাশ। একদা র‍্যাগিং-এর শিকার পরে নিজেই র‍্যাগিং-এর হোতা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এতেই এই সমাজের মান্যতা। যখন এই সর্বৈব অনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক শ্রেণিতে-শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজটাকেই আমরা মান্যতা দিয়ে ফেলছি, তখন আমরা যদিবা আউটগ্রুপ হই; তবুও আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা থাকবে নিজেদের ইনগ্রুপের নির্মিত হায়ারার্কির নিরিখে ‘ফিট’ করে তোলায়— স্মার্ট করে তোলায়। স্মার্ট ছাত্র, স্মার্ট শিক্ষক, স্মার্ট স্কুল, স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট কেরানি, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট সিটি… মায় স্মার্ট প্ল্যানেট পর্যন্ত। পড়তে হবে, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে। এই হল ডিকট্যাট। ক্ষমতার ডিকট্যাট। এই ডিকট্যাট আসলে স্ট্রাকচারাল হিংসার ডিরেকশনাল আগুন। এই আগুনে আলোকিত হওয়ার লোভ কিন্তু আমাদের ষোলোআনা। সেইজন্যই তো মান্যতা! কনসেন্ট।

আর এই আগুনের বাড়াবাড়িতে হাত পুড়িয়ে ফেললেই খানিক হইচই। ধিকিধিকি পুড়িয়ে ফেলার আগুন জ্বালিয়ে রাখার পেট্রল এ-হাত থেকে ও-হাতে সরবরাহের শৃঙ্খল অক্ষুণ্ণ থাকবে। কোনও অতি উৎসাহী হাত থেকে পেট্রল চলকে একটু বেশি পড়লেই মার শালা… ওই চলকে ফেলা হাতটাকেই কেটে ফ্যাল! এক নির্লজ্জ ভান যেন ওতেই আগুন নিভে যাবে! যাদবপুরের ছাত্রটিকে হত্যার দায়ে যারা ধৃত, তাদের উৎসমুখের সামাজিক অবস্থানও কিন্তু সেই ছাত্রটির থেকে আলাদা কিছু না। একই রকম আউটগ্রুপ। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোকসমিক সমাজে ছাত্রটির ও ধৃত ছাত্রদের কিঞ্চিন্মাত্র হায়ারার্কিয়াল ব্যবধান ঘটে গিয়েছে। সেটা হল সিনিয়রিটি এবং স্ট্রাকচারাল হিংসাকে নিজেদের ওপর ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা থেকেই আত্মস্থ করে নেওয়ার মান্যতা। যেখান থেকে তারা পৌঁছে যায় প্রত্যক্ষ হিংসার প্রণোদনায়। আবার এই মুহূর্তে বৃহত্তর সমাজের ক্ষমতাসীন ইনগ্রুপের সামনে ওই চারটি ছাত্রই এখন অসহায় ক্ষমতাহীন আউটগ্রুপ। ক্ষমতার চলাচল। যে স্ট্রাকচারাল হিংসা থেকে তাদেরই উদ্ভব, এখন সেই স্ট্রাকচারাল হিংসার সামনেই নতজানু বকরা তারা। কী অসামান্য এই কাঠামোর মেকানিজম।

যাদবপুর অসংখ্য আন্দোলনের সাক্ষী। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী স্বর হিসেবে বারবার উঠে এসেছে যাদবপুর। এবং সেই অনন্য দিকটিতেও শয়তানের আঙুল ছড়িয়ে দিতে থাকে ক্যান্সারের বিষাক্ত সেল। সেটা কিন্তু তাদেরও গভীরে অনুধাবন করতে হবে। কাঠামোগত স্ট্রাকচারাল হিংসার ধিকধিকি আগুনের গর্ভশালা হয়ে ওঠার যাবতীয় প্রকরণ বৃহত্তর সমাজ থেকে প্রতি মুহূর্তে সরবরাহ হতেই থাকবে। সেখান থেকে বেঁচে থাকা খুব কঠিন, কিন্তু উপায় কী আর?

আবার অন্যদিকে এই সুযোগে শুরু হয়ে গিয়েছে অবধারিত প্রতিক্রিয়াশীল হিংসার ডিকট্যাট। ওদের ফাঁসি দাও। শূলে চড়াও। যাদবপুর নামের সঙ্গে যে প্রতিস্বর, যে অর্জিত প্রতিস্পর্ধা লেগে রয়েছে তাকে একটানে ছিঁড়ে নেওয়ার এই তো সুযোগ। পাড়ার আড্ডা সরগরম। এই সেলফ-প্রোক্লেইমড কালিমাহীন এলিয়েনদের লক্ষ্য এখন যাদবপুর এই নামটি। যেভাবেই হোক তারা প্রমাণ করে ছাড়বে এই হত্যার জন্য দায়ী এই আর্থ-সামাজিক কাঠামো নয়, যাদবপুরের লড়িয়ে ঐতিহ্য। যা ভাঙা যাচ্ছিল না, তা প্রতিহিংসায় গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই তো সুযোগ। পুঁজ দেখিয়ে প্রতিস্পর্ধার পুরো চামড়াকেই গিলে নিতে উদ্যত নিঃশব্দ ক্যান্সার। জেনে অথবা না-জেনে আমরা লালন করে চলেছি যে স্ট্রাকচারাল হিংসার অন্তর্লীন সর্বাত্মক লাভাস্রোতটিকে, এইবার এক অবাধ্য ‘অপর’কে দুরমুশ করার সামাজিক লাইসেন্স পেয়ে যাবে সে। সেখান থেকেও আমাদের মুক্তি নেই। কারণ আমরাই উপহার দেব সেই কনসেন্ট।

না, আমরা মফস্বল থেকে… মায়ের কোল থেকে উজিয়ে আসা একটি স্বপ্নের মর্মন্তুদ অপমৃত্যুকে, একটি হত্যাকে আটকাতে পারিনি। আমাদের নিজেদের আর্থ-সামাজিক তথা আত্মিক অবস্থানের কাঁটাছেঁড়া করলে দেখা যাবে সেটা পারার কথাও নয়। যাদবপুরের ছাত্রটির মতো আরও হাজার হাজার চুনি কোটালের, রোহিত ভেমুলার সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য আমাদের অবিরত প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে যদি না আমরা এবার আমাদের নিজেদেরকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। ওই চারটে ছাত্রকে শূলে চড়ালেও আমাদের মুক্তি নেই। কারণ সেই মুক্তির অন্তরায় আমাদেরই অন্তর্লীন সত্তা। তাকে ক্লিনচিট দেওয়ার এই চারদিকের অনৈতিক নাটক বন্ধ হওয়ার নয়। জানি না, কবে দম হবে সেই স্বীকারোক্তির— এই সমাজে্র ক্ষমতা-কাঠামোয় নিজেকে আত্মস্থ করে নিলেই কোনও না কোনও মুহূর্তে আমরা সবাই এক-একেকজন একেকটি নির্ভেজাল ক্ষমতামগ্ন ফ্যাসিস্ট! অপরাধী শুধুই ওই চারটে ছাত্র নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি করে আমরা সবাই। ওদের তৈরি করার কারখানার যে আমরাই একনিষ্ঠ চেতনাহীন ইঞ্জিনিয়ার। মৃত ছাত্রটির মতো কেউ কেউ সেটা জানত না। বা এখনও জানে না। আমাদের সবার খোলা গলায় এই সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়ার মুহূর্তও কিন্তু এটাই।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...