Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অমৃতকালের হিসেবনিকেশ: দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর মোদিজির সাজে না

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


মোদি সরকারের দুর্নীতিবান্ধব হয়ে ওঠার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। দেশের জল-জমি-প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুটবার জন্য সদাপ্রস্তুত কর্পোরেট গ্রুপরা ছিল তার উত্থানের প্রধান শক্তি। তাই মোদি সরকার শুধু দুর্নীতির অংশ হয়নি, একই সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও পদ্ধতিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ লোকপাল পদটিকে অকার্যকরী তোলা, ইডি-সিবিআই-ইনকাম ট্যাক্সের মতো তদন্তকারী বিভাগগুলোকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ক্রমাগত ব্যবহার করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেওয়া। দুর্নীতি এ-দেশে নতুন কথা নয়, মোদি জমানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল দুর্নীতিকে আইনসিদ্ধ করার এক লজ্জাজনক ধারাবাহিক চেষ্টা

 

শ্রবণসুখকর না হলেও দুর্নীতি ভারতরাষ্ট্রের ভূষণ— এই কথাটির বাস্তবতাকে সম্ভবত অস্বীকার করা যায় না। ভারতরাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকেই দুর্নীতি জাতীয় জীবনের অনিবার্য অঙ্গ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায় বহু-আলোচিত ‘জিপ কেলেঙ্কারি’ থেকে শুরু করে অটলবিহারী বাজপেয়ির ‘কার্গিল কফিন কেলেঙ্কারি’, মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বকালের কমনওয়েলথ গেমস, টেলিকম, টু-জি, কোলব্লক থেকে মোদি জমানার ইলেকটোরাল বন্ড— দুর্নীতির অন্তহীন যাত্রার সালতামামি রাখা সত্যিই মুশকিল।

দুর্নীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি এক সামাজিক বৈধতা লাভ করেছে। সংবাদপত্রে বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে নিত্যনতুন দুর্নীতির আখ্যান জনমানসে আজ নতুন কোনও আলোড়ন তোলে না। কারণ দুর্নীতি ও রাজনীতি আজ সমার্থক। আমরা দুর্নীতিকে এক অনিবার্য ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছি। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে বহুবিজ্ঞাপিত ভারতরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ— আইনসভা, প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও মিডিয়া কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে দুর্নীতির ধরনেরও দ্রুত বদল ঘটছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় দুর্নীতি বলতে বোঝাত বিভিন্ন সরকারি টেন্ডার, চাকরি বা লাইসেন্স জোগাড়ের জন্য কমিশন দেওয়া-নেওয়া। নব্বই-পরবর্তী সময়ে যখন নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি চালু হল তখন দুর্নীতি আরও বহুমাত্রিক হল। সরকারি পলিসি হয়ে উঠল দুর্নীতির আধার। অনেকে একে ‘Policy induced Corruption’ আখ্যা দেন। এই ক্ষেত্রে দুর্নীতির টাকার অঙ্ক অকল্পনীয় এবং দেখা যেতে লাগল দুর্নীতি সংগঠিত করতে কর্পোরেট কর্তা, ব্যাঙ্কিং এজেন্সি, রাজনৈতিক দল ও নেতা, এমনকি মিডিয়া একটি চক্র হিসাবে কাজ করছে। নীরা রাডিয়া টেপের প্রকাশিত কথোপকথন এই চক্রকে বুঝতে এক আদর্শ পাঠ হতে পারে। তৃতীয়ত, মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইউএপিএ সরকার যখন বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত তখন ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’ নামে দিল্লির বুকে এক নাগরিক আন্দোলন সংগঠিত হয় যার মূল দাবি ছিল লোকপাল বিল। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বের একটা অংশ পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল গঠন করে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন হওয়ার ক্ষেত্রে এই আন্দোলন এক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। চতুর্থত, আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দুর্নীতিরোধে যে-সমস্ত কেন্দ্রীয় এজেন্সি রয়েছে তারা ২০১৪-পরবর্তী সময়ে আরও বেশি করে ক্ষমতাসীন দলের ক্রীড়নকে রূপান্তরিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দুর্নীতি বিষয়ে সিবিআই ও ইডির যা সক্রিয়তা, তার এক অংশও কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কোনও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা বা কোনও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যদি তাদের আনুগত্য বদল করে তখন আর তাদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত চলছে না। অনেকে এটাকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ এফেক্ট বলে বিদ্রূপ করছেন।

বর্তমান নিবন্ধটি গত ৭৫ বছরের দুর্নীতির ইতিহাসের সারসঙ্কলন করতে লেখা হয়নি। এই নিবন্ধ গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতিবিরোধী বাগাড়ম্বরকে তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। এই বাগাড়ম্বরের কেন্দ্রে রয়েছে একটি স্লোগান: ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন অবিজেপি দলগুলোর পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির কারণে দেশ তথা জনগণের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। এই নিবন্ধে তাই যেমন গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারে কার্যকলাপ আলোচিত হয়েছে তেমনি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলির কাজকর্মকে আতসকাচের আওতায় আনা হয়েছে।

 

ইলেকটোরাল বন্ড— এক পাহাড়প্রমাণ কেলেঙ্কারি

আমরা আলোচনা শুরু করব অবশ্যই ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ আর্থিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি। এক্ষেত্রে টাকার অঙ্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই দুর্নীতির বহুমাত্রিকতা। এই বন্ডের মূল কথা হল দুর্নীতির আইনসিদ্ধ রূপকে প্রতিষ্ঠা করা। এই বন্ডের শর্তাবলি, কার্যপদ্ধতি, সুপ্রিম কোর্টের রায় বহু-আলোচিত।[1] আমরা বরং স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে বন্ড-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের পর দুর্নীতির চালচিত্রটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে ইলেকটোরাল বন্ড কেনা ও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে তা দেওয়ার ক্ষেত্রে চারটি ধরন কাজ করেছে: এক, বরাত পাওয়ার বা কর্পোরেট-স্বার্থে কোনও নীতি বদলের আগে দেওয়া অনুদান। দুই, বরাত পাওয়ার পরের অনুদান। তিন, তদন্তকারী সংস্থার হানার পর চাপ দিয়ে নেওয়া অনুদান। চার, ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে অনুদান। আলোচনার সুবিধার জন্য ফলিত ক্ষেত্রে কীভাবে বিষয়টা হয়েছে তা কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হবে।

এ-কথা সবার জানা যে প্রাপ্ত অনুদানের সিংহভাগই বিজেপির কোষাগারে গেছে কিন্তু টাকার গতিপথটা দেখা জরুরি। সরকারি বরাত (মূলত পরিকাঠামো ক্ষেত্র), যার মোট মূল্য ৩.৮ লক্ষ কোটি টাকা, পাওয়ার জন্য ৩৮টি কর্পোরেট কোম্পানি খরচ করেছে ২০০৪ কোটি টাকা। ৪১টি কর্পোরেট সংস্থায় ৫৬ বার ইডি, সিবিআই ও আয়কর দপ্তর হানা দিয়েছে। এই কোম্পানিগুলো বিজেপিকে বন্ডের মাধ্যমে ২,৫৯২ কোটি টাকা দিয়েছে, এর মধ্যে ১,৮৫৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা হানা দেওয়ার পর। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থার চাঁদা। টাকার পরিমাণ ৫৪৩ কোটি টাকা যার মধ্যে একা বিজেপি পেয়েছে ৪১৯ কোটি টাকা।

নির্বাচনী বন্ড কীভাবে ওয়াশিং মেশিনের কাজ করে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নিকেশ করে তা বুঝতে অরবিন্দ ফার্মার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। হায়াদ্রাবাদের মদ্যসংক্রান্ত ব্যবসার কোম্পানি অরবিন্দ ফার্মার ডিরেক্টর শরৎচন্দ্র রেড্ডিকে ইডি ১০ নভেম্বর (২০২২) গ্রেফতার করে। ১৫ নভেম্বর (২০২২) ফার্মা কোম্পানিটি ৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপিকে দেয়। ২১ নভেম্বর বিজেপি টাকাটা ক্যাশ করে। ২৮ জানুয়ারি (২০২৩) শরৎ রেড্ডির অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর হয়। ৮ মে (২০২৩) নিঃশর্ত জামিন, ১ জুন (২০২৩) শরৎ রেড্ডি দিল্লি আবগারি মামলায় রাজসাক্ষী। ৮ জুন (২০২৩) অরবিন্দ ফার্মা ৫০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপিকে দেয়। ঘটনাক্রম অনুসারে তেলেঙ্গানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা কে কবিতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি।

ইলেকটোরাল বন্ডের তথ্য নিয়ে ‘আপ’-এর সাংবাদিক সম্মেলন

ওষুধসংস্থা, বেসরকারি হাসপাতালরা কীভাবে ইলেকটোরাল বন্ড কিনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে ও জনগণের জীবনকে বিপন্ন করছে তা দেখা যেতে পারে। তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে ৩৭টি ওষুধকোম্পানি ও স্বাস্থ্যসংস্থা প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল সাতটি সংস্থার কোনও-না-কোনও ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি এবং দেশের নিয়ম অনুসারে এদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত। এই সংস্থাগুলো হল হেটেরো ল্যাবস অ্যান্ড হেটেরো হেলথ কেয়ার, টরেন্ট ফার্মা, জাইডাস, সিপলা, ইপকা ল্যাবরেটরিজ, গ্লেনমার্ক, ইনটাস ফার্মাসিউটিক্যালস। আবার দেখা যাচ্ছে যে সরকারের সঙ্গে ওষুধকোম্পানিগুলোর বোঝাপড়ার ফলে প্রতিবছর ওষুধের দাম ১০ শতাংশ বাড়ানো যাবে এবং ১৫ শতাংশ খুচরো ও পাইকারি বিক্রেতাদের জন্য বাড়তি খরচ যুক্ত করা যাবে— এই নিয়ম চালু হওয়ার পর ফার্মা কোম্পানিগুলো প্রচুর টাকার বন্ড কিনছে। এছাড়া ২০২০ সালে যশোদা হাসপাতালে আয়কর দপ্তরের হানার পরবর্তী তিনবছরে তারা কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনেছে ও প্রায় সবটাই গেছে বিজেপির ঘরে।

পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্থা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড[2] ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল ১৪০ কোটি টাকার বন্ড কিনে বিজেপিকে দেয়। ঠিক এক মাস পরে মহারাষ্ট্রের থানে-বরভিল টুইন টানেল প্রোজেক্ট (১৪,৪০০ কোটি টাকা) তারা বরাত পায়।

কুইক সাপ্লাই চেন লিমিটেডের মূলধন ১৩০ কোটি টাকা অথচ তারা নির্বাচনী বন্ড কিনেছে ৪১০ কোটি টাকা।

ভারতী এয়ারটেলের গত ৫ বছরে ক্ষতি হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার, অথচ বিজেপিকে বন্ডের মাধ্যমে তারা চাঁদা দিয়েছে ৩৩০ কোটি টাকা।

অ্যাভন সাইকেল, মাইক্রো ল্যাবস, হিরো মোটরকর্প, ফিউচার গেমিং-এর মতো সংস্থার বিরুদ্ধে ইডি ও আয়কর হানার ১০-১৫ দিনের মধ্যে তারা কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের জন্য কুখ্যাত নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং দুটো বরাত পাওয়ার আগে ৫৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

রিয়েল এস্টেট প্রোমেটার ডিএলএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধির স্বামী রবার্ট বঢরার সঙ্গে যুক্তভাবে তারা হরিয়ানার গুরুগ্রামে কয়েকশো কোটি টাকার জমি কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। দেখা যাচ্ছে ডিএলএফ ১৭০ কোটি টাকার বন্ড কেনার পর হরিয়ানার বিজেপি সরকার আর তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও প্রমাণ পাচ্ছে না!

বিজেপি ইলেকটোরাল বন্ডের সিংহভাগ পেলেও এই আইনসিদ্ধ দুর্নীতির খেলায় আঞ্চলিক দলগুলোও যথেষ্ট লাভবান হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই নাম আসে তৃণমূল কংগ্রেসের, যাদের স্থান ঠিক বিজেপির পরে। এ-ক্ষেত্রে মূল দাতা সান্টিয়াগো ফিউচার গেমিং (ডিয়ার লটারি) যারা তৃণমূলকে ৫৪২ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। ফিউচার গেমিং-এর আরেক বড় প্রাপক তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকার। তৃণমূলকে হলদিয়া এনার্জি[3] দিয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। আবার ওডিশার বিজু জনতা দল বিভিন্ন মাইনিং ও স্টিল সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পেয়েছে ৭৭৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা।

আসলে এই ইলেকটোরাল বন্ড দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে এবং টাকার জোরে বিজেপি অন্যান্য সংসদীয় দলগুলো থেকে কয়েকশো মাইল এগিয়ে গেছে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় (২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ১০ মে) ইলেকটোরাল বন্ড বিক্রি হয়েছিল ২৯২০ কোটি টাকার যার মধ্যে ২৭১৯ কোটি টাকা একাই পেয়েছিল বিজেপি। গত ৫ বছরে একের পর এক রাজ্যে বিধায়ক কেনাবেচা করে যেভাবে বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যগুলিকে দখল করেছে সেখানে এই বন্ডের টাকা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

 

পিএম কেয়ার্স— স্বচ্ছ ভারতের আসল চেহারা

ইলেকটোরাল বন্ডের পর্দা ফাঁসের মধ্যেই নতুন করে সামনে আসছে পিএম কেয়ার্স নিয়ে তথ্য প্রকাশ ও তদন্তের দাবি। চরিত্রগতভাবে বন্ড ও পিএম কেয়ার্স ফান্ডের মধ্যে মিল হল গোপনীয়তা এবং অস্বচ্ছতা। কোভিড পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এই ফান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম দিন থেকেই উঠেছে। কিন্তু মোদি সরকার তথ্যের অধিকার আইন ও ক্যাগের আওতার বাইরে থাকার জন্য একটি অসরকারি ট্রাস্ট হিসাবে একে গঠন করে। প্রথম কথা হল, ট্রাস্ট কথাটার আইনি অর্থ ‘Historically a trust as a legal entity is used by private actors to benefit the public’। জনগণের কল্যাণের জন্য এই ট্রাস্ট তৈরির কথা বলা হলেও এর পরিচালকদের সঙ্গে জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের মতো এতদিনকার বিশ্বাসযোগ্য একটি তহবিল থাকা সত্ত্বেও কেন আলাদা করে পিএম কেয়ার্স তৈরি করা হল! এই ফান্ডের ঘোষণায় বলা হয়েছে এখানে টাকা দিলে তা ‘কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি’ (সিএসআর) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হবে। সরকারি ফান্ডে টাকা দিলে তাতে সিএসআর ছাড় পাওয়া যায় না। পিএম কেয়ার্স কি তাহলে কর্পোরেট অনুদানকে একটি অসরকারি ফান্ডে এনে তা নিজস্বার্থে ব্যবহার করার নীল নকশা?

এইরকম একটি সরকারি ছাপ মারা ‘অসরকারি’ ফান্ডে কারা টাকা দিয়েছে, কত টাকা ফান্ডে আছে, সেই টাকা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে— কোনও তথ্যই সুলভ নয়। মোটের উপর মনে করা হচ্ছে ১২,৭০০ কোটি টাকা[4] ফান্ডে আছে। বিভিন্ন কর্পোরেট-ঘোষণা থেকে জানা যাচ্ছে রিলায়েন্স (৫০০ কোটি), আদানি (১০০ কোটি), পেটিএম (৫০০ কোটি), জিন্দাল গ্রুপ (১০০ কোটি), টিকটক (৩০ কোটি), জিওমি (১০ কোটি), হুয়াই (৭ কোটি), ওয়ানপ্লাস (১ কোটি) টাকা দিয়েছে। ৩৮টি সরকারি সংস্থা মোট দিয়েছে ২,১০৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীরা দিয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এই টাকার উপর অধিকারী একটি ট্রাস্টি বোর্ড যার অছি হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ শাসকদলের কর্তাব্যক্তিরা। কারা টাকা দিচ্ছে, সেই টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সে-সম্পর্কে জনগণের জানার কোনও অধিকার নেই। এটাই আজ মোদি সরকারের স্বচ্ছ ভারতের আসল চেহারা।

 

রাফাল— ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে সরকারি স্তরে দুর্নীতির প্রশ্নে প্রতিরক্ষা বিষয়ক স্ক্যাম মূল বিষয় থেকেছে। কংগ্রেসের বোফর্স কামান, সাবমেরিন থেকে অটল বাজপেয়ির সময়কার সামরিক পোষাক, কফিন— কোনওটাই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ভারত যেহেতু সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে অগ্রগণ্য ক্রেতা তাই বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কিছু কেনার সময় মোটা অঙ্কের কমিশন এক বহুচর্চিত বিষয়। কিন্তু এই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গেছে রাফাল বিমানক্রয়-সংক্রান্ত স্ক্যাম।

রাফাল-দুর্নীতি নিয়ে কংগ্রেসের বিক্ষোভ, ২০১৮

ভারতে আধুনিক যুদ্ধবিমানের চাহিদা মেটানোর জন্য পূর্বতন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে ফ্রান্সের দাসাউ বিমান সংস্থার বহু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এক চুক্তি চূড়ান্ত হয়। এতে বলা হয় ভারত এই সংস্থার কাছ থেকে রাফাল আধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয় করবে। দরপত্রে বলা হয়েছিল ১৮টি বিমান আনা হবে সরাসরি বিদেশ থেকে (fly away) এবং বাকি ১০৮টি হস্তান্তরিত প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি হবে। দাসাউ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তাদের কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতের মাটিতে বিমান তৈরি করবে। ছবিটা পাল্টে গেল ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। ফ্রান্স সফরে (২০১৫) প্রধানমন্ত্রী জানান ভারত সরকার প্রথমে ৩৬টি রাফাল কিনবে এবং ১২৬টি বিমান কেনার পূর্ববর্তী আলোচনা বাতিল। এই ৩৬টি বিমান কেনার দাম স্থির হয় ৫৯,০০০ কোটি টাকা। সরকার দাম কমানো হয়েছে, এ-কথা দাবি করলেও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা রীতিমতো হিসেব কষে দেখায় যে আগের তুলনায় দাম ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও ভয়ঙ্কর বিষয় হল এতদিন দেশের যুদ্ধবিমান তৈরির একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় অনিল আম্বানির রিলায়েন্স এরোস্ট্রাকচার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হল। অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর বিমান তৈরি করার অভিজ্ঞতা শূন্য শুধু তা-ই নয়, আদতে নরেন্দ্র মোদির ঘোষণার পর এই কোম্পানিটি গঠিত হয়। এই চুক্তি যখন হচ্ছে তখন অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর বাজারে দেনার পরিমাণ ১,২০,০০০ কোটি টাকা। একটি দেউলিয়া হতে চলা কোম্পানিকে দাসাউ-এর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থা তাদের অফসেট সঙ্গী নির্বাচন করল কীভাবে! এই উত্তর আমরা পেয়ে যাই যখন ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে আম্বানিদের সহযোগী হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কারণ তারা ছিল ভারত সরকারের পছন্দ। আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে যে পূর্ববর্তী প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত দুর্নীতির আখ্যানগুলির সঙ্গে রাফাল চুক্তির একটা মূলগত পার্থক্য রয়েছে। এতদিনকার চুক্তিগুলোর দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্রটি ছিল কাটমানি ও কমিশন এজেন্ট-কেন্দ্রিক। কিন্তু রাফাল দুর্নীতি চরিত্রগতভাবে ক্রোনি ক্যাপিটালাজিমের গল্প। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলাতন্ত্র ও নির্দিষ্ট কর্পোরেট গোষ্ঠীর দেওয়ানেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিদ্যমান নিয়মাবলিকে লঙ্ঘন করে কোনও একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হয়। আদানি-আম্বানিদের লীলাক্ষেত্রে তাই রাফাল দুর্নীতি অনিবার্য ছিল।

 

আদানি গোষ্ঠীর উত্থান— ক্রোনি ক্যাপিটালিজম যখন নগ্ন

এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বিস্তারের গল্পের এই অমৃতকালে সবচেয়ে বড় চরিত্র অবশ্যই গৌতম আদানি গোষ্ঠী এবং তাদের চমকপ্রদ উত্থান। ভারতের প্রত্যেক অংশে ছড়িয়ে আছে আদানি সাম্রাজ্য। বন্দর, বিমানবন্দর, কয়লাখনি, পরিকাঠামো, গ্রিন এনার্জি, সিমেন্ট, ডাটা স্টোরেজ, মিডিয়া সব ক্ষেত্রে তাদের অনিবার্য উপস্থিতি। এই উত্থানের গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অনৈতিক ও অস্বচ্ছ ব্যবসানীতি যা সম্ভব হয়েছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের দাক্ষিণ্যে। গৌতম আদানি ও নরেন্দ্র মোদি জুটির রসায়ন শুরু হয় গুজরাত থেকে মুন্দ্রা বন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (সেজ) সাফল্যের মাধ্যমে। ২০০৩ সালে গুজরাতে নরমেধ যজ্ঞের পর দেশীয় রাজনীতিতে কোনঠাসা নরেন্দ্র মোদিকে ভাইব্রান্ট গুজরাতের মাধ্যমে কর্পোরেট মহলের সেরা বাজি করে তোলার ক্ষেত্রে সূত্রধরের ভূমিকা পালন করেন গৌতম আদানি। পরিবর্তে আর্থিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির মাধ্যমে আদানি গ্রুপকে পৃথিবীর অন্যতম কর্পোরেট গ্রুপ করে তোলার দায়িত্ব নেয় মোদি সরকার।

এই দুর্নীতির প্যাটার্নটা বহুমুখী। একদিকে রয়েছে সরকারের দাক্ষিণ্যে নিয়ম বদল। কোনওরকম পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়া আদানির হাতে দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর তুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে নতুন দরপত্রের মডেল প্রস্তুত করা হয়। কয়লাখনির ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ম ছিল কোনও খনি নিলামের প্রক্রিয়ায় যদি একটিমাত্র কোম্পানি অংশগ্রহণ করে তবে সেই নিলাম বাতিল হবে। রাতারাতি সরকারের তরফে ‘হাই পাওয়ার কমিটি’ গঠন করে সিঙ্গেল বিডারদের হাতে ১১টি কোলব্লক তুলে দেওয়া হয়েছে যার বেশ কয়েকটি পেয়েছে আদানিরা। লন্ডনের ফিনানসিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী আদানি গোষ্ঠী বিদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করেছিল বাজারদরের তুলনায় দ্বিগুণ দামে। ওয়াকিবহাল সূত্র প্রমাণ করেছে স্বাধীন ভারতে এটা অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারি যেখানে দুর্নীতির পরিমাণ ১২,০০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে আছে সরকারের সহায়তায় প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাকে অধিগ্রহণ। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি যেমন ইডি, সিবিআই বা এই ধরনের সংস্থার অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ।

সাংঘি সিমেন্ট কোম্পানি কিনতে আগ্রহী শ্রীসিমেন্ট (বাঙ্গুর গ্রুপ)-এর অফিসে অধিগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার ঠিক আগে তাদের অফিসে আয়কর হানা হয়। এরপর জানা যায় আদানি অম্বুজা সাংঘি সিমেন্ট কিনে নিয়েছে। একই অভিযোগ আছে অম্বুজা-এসিসি সিমেন্ট, এনডিটিভি, জিভি গ্রুপ পরিচালিত মুম্বাই বিমানবন্দর আদানিদের দ্বারা অধিগ্রহণের ঘটনায়। এছাড়া রয়েছে কর ফাঁকি, শেল কোম্পানির মাধ্যমে বাইরে টাকা পাচার, ওভারইনভয়েসিং, ইনহাউস ট্রেডিং, শেয়ার দুর্নীতির অসংখ্য ঘটনা। মোদি সরকার এইসমস্ত আর্থিক অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করলেও দুটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট (হিন্ডেনবার্গ ও ওসিসিআরপি) এই দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে।[5] আদানিদের উত্থান আজ চৌকিদারদের সততার দাবিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলেছে।

 

নোটবন্দি: যা নিজেই এক দুর্নীতি

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি টেলিভিশনে এক অগ্নিবর্ষী ভাষণের মধ্যে দিয়ে নোটবন্দির কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে এক ধাক্কায় বাজার চলতি নোটের ৮৬ শতাংশ[6] অবৈধ হয়ে যায়। বলা হয়েছিল নোট অবৈধ ঘোষণার কারণ আসলে দুটো:

  1. জাল নোট, যা দেশের অর্থনীতির ক্ষতিসাধক এবং বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপের (প্রধানত তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ) পৃষ্ঠপোষক।
  2. হিসাববহির্ভূত আয় সম্পদ, যা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অনুসারে ব্ল্যাক মানি বা কালা ধন।

এই দুটো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য মোদির যুদ্ধ ঘোষণা যা পূরণ হলে খতম হবে দারিদ্র্য, অভাব, বঞ্চনা ও কালোবাজারি। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে জাল টাকা ও কালাধনের বিরুদ্ধে রণদামামার আওয়াজ কমতে লাগল। গোলপোস্ট সরিয়ে নতুন কথা এল ক্যাশলেস ইকোনমি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট-নির্ভর নগদবিহীন অর্থনীতি হয়ে উঠবে আমাদের যাবতীয় মুশকিল আসান।

বাস্তবে পুরো নাটকটা মুখ থুবড়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি। ২০১৬-র ৮ নভেম্বর বাজারে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট মিলিয়ে ১৫.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা ছিল। তার মধ্যে জমা পড়েছে ১৫.২৮ লক্ষ কোটি টাকা, এর অর্থ ৯৯.৮ শতাংশ নোট ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে। পুরনো ১০০০ টাকার নোটের মধ্যে ০.০০০৭ শতাংশ নোট ও ৫০০ টাকার নোটের মধ্যে ০.০০২ শতাংশ জাল বেরিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাপ্তি হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা, অথচ নোট ছাপাতে খরচ হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এমনটাই যে হবে তা জানাই ছিল কারণ কলকাতাস্থিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউট এবং ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির সমীক্ষায় প্রমাণ হয়েছিল বাজারে চালু প্রতি দশ লক্ষ নোটের মধ্যে জালের সংখ্যা আড়াইশো মাত্র। আবার বেশিরভাগ টাকা ব্যাঙ্কে ফেরত আসার কারণে কালো টাকা উদ্ধারের গল্পটাও মাঠে মারা গেল।

এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে কালো টাকা কীভাবে থাকে তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। পুরনো হিন্দি সিনেমার কিম্ভূতকিমাকার খলনায়ক ছাড়া কেউ বালিশের ওয়াড়ে বা তোষকের তলায় কালো ধন রাখে না। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়কর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাদের তল্লাশির মধ্যে দিয়ে যত কালাধন বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তার মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ রয়েছে নগদে। বাকি সম্পদ জমি, সোনা বা শেয়ারে সঞ্চিত আছে। কালো টাকা স্টক নয়, আদতে চলমান। তাই কালো টাকা তৈরির পথটা না বন্ধ করে এক হুকুমে নোটবন্দি করে কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার কল্পনা নির্বোধের দিবাস্বপ্ন বা কুশলী চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়।

অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ডিজিটাল অর্থনীতি প্রসারিত হয়, জোর করে হয় না। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর অর্থনীতিতে নগদের জোগান ছিল ১৭.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা। নোটবন্দির পরে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তা কমে হয় ৮.৭ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু নোটের জোগান স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আবার পাল্টে যায়। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পরিমাণটা বেড়ে হয় ২৬.১৯ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ সরল পাটিগণিতের হিসাবে ২০১৬ সালের তুলনায় ৮.২২ লক্ষ কোটি টাকা (৪৭ শতাংশ) বেশি। জাল নোট, কালো টাকা, ক্যাশলেশ ইকোনমির মতো বহুকথিত উদ্দেশ্যগুলি পূরণে চূড়ান্ত ব্যর্থ হলেও নোটবন্দি দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোটি চুরমার করে দিতে একশো শতাংশ সফল। কর্মসংস্থান, শিল্প উৎপাদন সবকিছুতে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলা এই নোটবন্দির আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্যাঙ্কে টাকা ফিরিয়ে এনে তা আবার কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। তাই এটাও এক আর্থিক অপরাধ। বিশিষ্ট জার্মান সাংবাদিক ডঃ নরবার্ট হেইরিং বলেছিলেন, “Demonetisation itself may be an act of corruption.” আমরা এ-কথাকে সমর্থন করি।

 

এক নতুন ‘ভারত ছাড়ো’

একটা নিবন্ধের মধ্যে এক দশকের দুর্নীতির সালতামামি সম্ভব নয়। তবুও এটা মনে করিয়ে দরকার যে মোদি সরকারের জমানায় দেশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপিদের জন্য স্বর্গরাজ্য হয়েছে। বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসিরা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এক নতুন ‘ভারত ছাড়ো’ অভিযান শুরু করেছে সরকারের মদতে। এই সরকারের জমানায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের টেম্পল এন্টারপ্রাইজেসের ব্যবসা এক বছরে ১৬,০০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।[7] এই বিশ্বরেকর্ডের আজ পর্যন্ত কোনও তদন্ত হল না। নোটবন্দির সেই সময়ে আমেদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে[8] মাত্র ৫ দিনে জমা পড়েছিল ৭৪৫.৫৯ কোটি টাকা। একটা জেলাস্তরের সমবায় ব্যাঙ্কে এত পরিমাণ টাকা জমা কীভাবে হল তা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনও তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি দুর্নীতির নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি বহু-আলোচিত এবং টাকার বিচারে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-দুর্নীতি হল মধ্যপ্রদেশর মেডিক্যাল এনট্রান্স পরীক্ষা সংক্রান্ত ‘ব্যাপম’ কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারিকে চাপা দিতে খুন করা হয়েছে অন্তত বারোজন মানুষকে। প্রাথমিক হিসাবে জানা যাচ্ছে ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ২,০০০ কোটি টাকা। শুধু ব্যাপম নয়, আরটিও কেলেঙ্কারি, মদ কেলেঙ্কারি, অবৈধ খনন, ই টেন্ডার-সহ হাজারো কারণে মধ্যপ্রদেশ আজ ঘোটালা রাজ্যে পরিণত। বিজেপিশাসিত কর্নাটকের নাম হয়েছিল ২৫% সরকার। তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই, শুধু বলার বিজেপি আর দুর্নীতি সমার্থক।

 

চৌকিদার হি চোর হ্যায়

মোদি সরকারের এই দুর্নীতিবান্ধব হয়ে ওঠার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। এ-কথা সত্যি যে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইকে ব্যবহার করে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন। আবার অন্যদিকে দেশের জল-জমি-প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুটবার জন্য সদা প্রস্তুত কর্পোরেট গ্রুপরা ছিল তার প্রধান শক্তি। তাই মোদি সরকার শুধু দুর্নীতির অংশ হয়নি, একই সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও পদ্ধতিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ লোকপাল পদটিকে অকার্যকরী তোলা। The prevention of corruption act এ ২০১৮ সালে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে কোনও বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত করতে হলে সরকারের অনুমতি আবশ্যক। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের সক্রিয়তাকে সীমাবদ্ধ করতে Whistleblower Prevention Act-কে সংশোধন করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্সের মতো তদন্তকারী বিভাগগুলোকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ক্রমাগত ব্যবহার করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি এ দেশে নতুন কথা নয়, মোদি জমানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল দুর্নীতিকে আইনসিদ্ধ করার এক লজ্জাজনক ধারাবাহিক চেষ্টা। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ থেকে ‘চৌকিদার হি চোর হ্যায়’— এই বিবর্তনই বোধহয় এই জমানাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে।


[1] মৌলিক, সুমন কল্যাণ। নির্বাচনী বন্ড: আইনসিদ্ধ দুর্নীতির সাতকাহন। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪।
[2] তথ্য অনুসারে এরা বন্ড কেনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে আছে, ক্রয়মূল্য ৯৬৬ কোটি টাকা।
[3] আরপি গোয়েঙ্কা গ্রুপ। যাদের সৌজন্যে দেশের মধ্যে বিদ্যুৎের দাম পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি।
[4] অসমর্থিত সূত্রে টাকার পরিমাণ এর দ্বিগুণ।
[5] মৌলিক, সুমন কল্যাণ। লগ্নিপুঁজি, নয়া উদারবাদ ও হিন্দুত্বের আলোকে আদানি সাম্রাজ্য। কলকাতা: সারা বাংলা কর্পোরেট আগ্রাসন বিরোধী উদ্যোগ প্রকাশনা। ২০২৪।
[6] নগদ অর্থমূল্য ১৫.৪৬ লক্ষ কোটি টাকা।
[7] ২০১৪-১৫ সালে যা ছিল ৫০,০০০ টাকা তা ২০১৫-১৬ সালের আর্থিক বর্ষে হয় ৮০.৫ কোটি টাকা।
[8] অন্যতম ডিরেক্টর অমিত শাহ।