Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তারান্তিনো, সিজন দুই— ছত্রিশ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সাপের লকেটটার দিকে চেয়েছিল রিনি। একদৃষ্টে। ভগা দিয়েছিল।

রিনি হাতটা মাথার ওপর তুলে শুয়েছিল। শরীরে একটা সুতোও নেই। ভগারও তাই। ভগা লকেটটা পরিয়ে গলায় একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, দেবা এটা দেখলে বাওয়াল দেবে?

রিনি চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিল খাটের রট আয়রনের ওপর। বলেছিল, সাহস নেই।

রিনির বাহুমূল বেয়ে স্তনভাঁজ, নাভি বেয়ে আরও নিচে তখন নেমে যাচ্ছে ভগার ঠোঁট। ভগা মগ্ন।

রিনি শীৎকার করে উঠত আনন্দে। ভগা আরও মগ্ন হত। দেবার একটা বিঘৎ ছবি টাঙানো ছিল ঘরের দেওয়ালে। সেই ছবি থেকে হাঁ করে যেন গিলত ওদের দেবা।

রিনির ঘোর কাটল আবার। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজছে। রাত।

 

—রাজার খুনের পরেই কি বসের সঙ্গে ভিড়লে?
—উপায় ছিল না। নইলে গ‍্যাংয়ের সবাইকে মারত।
—অনুজ পাণ্ডেরই লোক?

মৃদু স্বরে জানতে চাইল ভগা।

রাইটু একটা হাই তুলল।

—কে জানে! আমার তো মনে হয়েছিল রমেন হালদারই মারিয়েছে। বস কোনও দিন মানতে চাইত না।

বজবজে ঢুকে গেছে গাড়ি। পেছনের ছেলেটা কী করছে? আর-একবার রিয়ারভিউতে চোখ রাখল ভগা‌।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরে।

—কবে থেকে কাজ করছিস রে অনুজ পাণ্ডের সঙ্গে?

রাইটু আবার বিরক্ত হয়ে তাকাল ভগার দিকে।

মন্টি, ছেলেটা, জানলা থেকে চোখ না ফিরিয়েই এককথায় উত্তর দিল, চিনি না।

—শুধু বঙ্কাদাকে চিনিস?

প্রশ্ন করে ভগা। আবারও। ও বেপরোয়া। যেন রোখ চেপে গেছে সাংঘাতিক।

রাইটু আরও বিরক্ত হয়।

ছেলেটা মাথা নাড়ে কেবল। তারপর অস্ফুটে বলল, আর পার্লারের মালিককে।

তড়িৎগতিতে রাইটু তাকাল ভগার দিকে। ভগার চোয়াল শক্ত।

—কোন পার্লার?
—কবিতা।

ঘ‍্যাঁচ করে ব্রেক কষল ভগা।

 

মার্চ মাসের চাঁদটা টগবগ করছে আকাশে। আদিনাথ দেখছিল ওর ঘরের খুপরি জানলাটা দিয়ে। আদিনাথের চোখ যেন আর বোজে না। ঘুম আসতেই চায় না কিছুতে। এই নির্ঘুমটা সেই বেপাত্তা থাকার দিনগুলো থেকেই অভ‍্যেস হয়ে রয়েছে। সতর্ক থাকার, সচকিত থাকার অভ‍্যেস ওর আর গেল না। পরিস্থিতিও পাল্টাল না।

কাল রোহিতাশ্বর পিছু নিয়েছিল দুজন। লক্ষ করেছিল আদিনাথ। কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না ও। নিজের অবস্থানটা নিরাপদ রাখতে ও কোনওদিন পারেনি, চায়ওনি। বিপদের ঠিক মাঝে আদিনাথের বসবাস। চিরকালই। ও কবে শেষ নিস্তেজ থেকেছে? কবে চারপাশ ঘুরে তাকাতে হয়নি ওকে, মনে পড়ে না। অতর্কিতে কেটে যাওয়া এই জীবনে হঠাৎ যদি কোনওদিন শান্তি আসে? ভয় করে আদিনাথের! আদিনাথের বারংবার মনে হয়, কেবলই রাজনীতি নয়, কেবলই আদর্শ নয়। পালিয়ে বেড়ানোর জীবন ওকে কোথাও না কোথাও টেনেছিল। তা ও কোনওমতে এড়াতে পারেনি।

রাজনীতির জীবন ওর শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই তখনই। সেই সত্তরে। পালিয়ে যাওয়ার পরেই। সুন্দরবনে সাধুবাবা সেজে দশ বছর কাটিয়েছিল তারপর আদিনাথ। জটাজুটের আড়ালে জঙ্গুলে ঝুল জমে, প্রায় বটগাছের ঝুড়ি নেমেছিল। শুধু হাতে ছিল আংটিটা। আর আংটির মাঝে ওই আকাশি রঙের হিরেটা। যা তার জীবন বদলে দিয়েছিল।

সাধু বেশটা কেবলই ছদ্মবেশ ছিল আদিনাথের কাছে। আর কোনও উদ্দেশ্যে সে থান গেড়ে বসেনি অমন পাণ্ডববর্জিত এলাকায়। কিন্তু ওর অভিনয়ক্ষমতা, কথা বলতে পারার কৌশল ওকে সত্যিই বাবাজি বানিয়ে ছাড়ল। গরিব মানুষকে বোকা বানাতে ভাল লাগত না আদিনাথের। কিন্তু ভালমন্দর হিসেব ততদিনে গুলিয়ে গিয়েছে আদিনাথের। পারিবারিক ইতিহাস ব‍্যবহার করে সত‍্যেনকে ঘুঁটি করেছিল ও, সেটা ও ভুলবে কী করে। সত‍্যেন যে জেলেই মরেছে, এই খবর অনেক পরে, অনেক কষ্ট করে জানতে পেরেছিল আদিনাথ। তবে এমনি এমনি মরেনি, জেলের মধ্যে পুলিশকে মেরে মরেছিল। তাই এই জঙ্গলগাঁয়ে এসে মানুষকে এভাবে বোকা বানিয়ে রাখতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল। তীব্র, তীব্র অসুবিধে হচ্ছিল‌। কিন্তু একই সঙ্গে এই ধর্মের বেসাতিটা চালাতে ওর খারাপও লাগছিল না। আশ্রয় আর সামান্য খাওয়াদাওয়া ছাড়া তো ওর কিছুই জোটেনি। ও তো এদের থেকে নজরানা নিচ্ছে না। বরং সেই বিখ্যাত, মার্ক্সকথিত ‘হার্ট অফ দ‍্য অপ্রেসড’-কে সে যেন জলহাওয়ায় পুষ্ট করছে। মন্দ কী?

যখন মামলা উঠেছে দেখতে পেল খবরের কাগজে, হঠাৎই এক ভক্তর বাড়িতে, তখন সেই সাজগোজ ছেড়ে ও চলে যাবে ভেবেছিল, ফিরে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না ওর। বন‍্যা এল সেই বছরেই। বিধ্বংসী বন‍্যা। ভেসে গেল সুন্দরবন। অথচ, কী এক অলৌকিকে সেই বন‍্যায় বেঁচে গেল কেবল ও যে গ্রামে ছিল, সেখানকার বসতিটুকু। দণ্ডকারণ‍্য থেকে চলে আসা রিফিউজিদের পরিবাররাই তো বাসা বেঁধেছিল এই গ্রামে। কাছেই যখন মরিচঝাঁপির আগুন জ্বলছে, তখন বেঁচে গেল এই কটা পরিবার। আদিনাথ নিজের অজান্তেই এদের মেসিহা হয়ে উঠল। ওর জন্য নতুন করে থান গড়ে দেওয়া হল। ওকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। আদিনাথ কোনওদিন ভাবেনি, এমনটা হতে পারে।

কিন্তু এমন থিতু এবং মিথ‍্যে জীবন বাঁচবে কী করে আদিনাথ? ও ক্রমশ অনেক উঁচুতে একা, ক্রমশ ভগবান হওয়ার জ্বালায় ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল।

এমন একটা সময়ই ঘটনাটা ঘটল।

এক আশ্চর্য চাঁদনি রাত সেটা! নিজের থানে বসে একমনে একখানা ছিলিম টানছিল আদিনাথ। দেখছিল তারাভরা আকাশ। হাতের আংটিতে জ‍্যোৎস্না পড়ে ঝকমক করছিল। এই আংটিই ওর সবচেয়ে বড় সম্বল। ওর অলীক ক্ষমতার উৎস। অন্তত, গ্রামের লোক তাই জানে। এই আংটির মাঝে যে হিরে, তা এই গরিবগুর্বোরা বোঝে না। তা নিয়ে এদের মাথাব‍্যথাও নেই, লোভও নেই। এরা শুধু জানে, ওই জমকালো আংটিই বাবাজিকে জোর দেয়।

এই সময় হঠাৎ ওর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস পড়তে চমকে উঠল আদিনাথ।

রতন।

রতন চোর। গ্রামের সবাই ওকে চেনে। থাকে জঙ্গলের ধারে। গ্রামে কখনও চুরি করেনি, তাই কেউ কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে কিছুদিন বেপাত্তা থেকে ফিরে আসে রতন। ওর থানেও এসেছে রতন। বেশ কয়েকবার। বিড়ি টানতে টানতে তাকিয়ে থাকত আদিনাথের দিকে, লক্ষ করত আদিনাথ। ও বুঝতেও পারত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে, ওর আঙুলেই যেন চোখ রতনের।

রতনকে দেখে চোখ লাল করে কড়া কণ্ঠস্বরে কিছু বলতে যাচ্ছিল আদিনাথ, হঠাৎই একটা ধুলোজাতীয় কিছু আদিনাথের চোখে ছুড়ল রতন। আদিনাথ ছটফট করে উঠল নিমেষেই। বেয়াদব! পাষণ্ড!— চিৎকার করে যাচ্ছিল আদিনাথ ওরফে বাবাজি। রতন খিকখিক করে হেসে উঠল। বাহ! বাবাজির চোখে দেখছি জ‍্যোতি নেই আর। হাত বাড়িয়ে চেপে ধরেছিল আংটিসমেত আঙুল। নিজের গায়ের জোরটা কোনও মতে প্রয়োগ করতে যাচ্ছিল আদিনাথ, কিন্তু তার আগেই ঘটল দুর্বিপাকটা।

একটা বাজ। হ‍্যাঁ। পরিষ্কার আকাশ থেকে বাজ পড়ল একটা। নীল হয়ে গেল রতনের শরীর। চোখ বিস্ফারিত। আদিনাথের চোখের ধুলোও লহমায় হাপিস। রতন অস্ফুটে কেবল বলতে পারল একটাই শব্দ, বাবাজি!

আকাশে তারা আবার ঝিকমিক করছে। রতন নিথর।

আদিনাথ তাকাল আংটির দিকে। বিস্মিত, স্তব্ধবাক।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]