তারান্তিনো, সিজন দুই— পঁয়ত্রিশ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

—আঙুলের ফাঁক থেকে সিগারেটটা ঝুলছিল। ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল পুরো!… ওর চোখের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল দানাটা। আমরা কী করব বুঝেই উঠতে পারছিলাম না! এইসব লাফড়ায় আগে জড়াইনি। হ‍্যাঁ, বাওয়াল হয়েছে, রক্তারক্তি হয়েছে, ব্লেড ছাড়া খুর চলেছে! কিন্তু তা বলে শালা ডিরেক্ট খুন! হজমই করতে পারিনি কেসটা।
—অনেকে বলে, রাজা খুন হয়নি।

ভগার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল রাইটু।

—একটা রোববার নাকি ভোরবেলায় ওকে ছাদ টপকে বাড়ি ঢুকতে দেখেছিল পাড়ার লোক। বউয়ের সঙ্গে কিচাইন হয়েছিল, পাশের বাড়ির লোক শুনেছিল। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকত, ও বলেছিল মারদাঙ্গা-ঝামেলার পর আহ্-উহ্ও শুনেছিল। বউকে লাগিয়ে প্রেগনেন্ট করে আবার পালিয়ে গিয়েছিল। তারপরেই তো বাচ্চাটা হল।

সিগারেট টানতে টানতে নির্বিবাদে বলে চলল ভগা। গাড়িতে বসে জয়েন্ট টেনে তারপর গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট টানছে ভগা আর রাইটু। পনেরো বছরের ছেলেটা, মন্টি, বোধহয় গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে। কী আশ্চর্য চুপচাপ, নির্লিপ্ত ছেলেটা! কোনও ভয় নেই, কোথায় যাচ্ছে, সেখানে কী হবে, তাই নিয়ে ভাবনা নেই।

গাঁজাটা ভালই হিট করেছে এবার। রাতের গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া ময়দানের সবুজ মেখে এসে নাকেমুখে, চোখে লাগছে। গাড়ি থেকে নেমে এই হাওয়াটা খেতে খেতে সিগারেট টানতে অন‍্যরকম আরাম! সঙ্গে একবোতল বাংলাও আছে। নেশায় নেশা কাটছে, নেশায় নেশা বাড়ছে। ওরা পুরনো গল্পে ডুবে।

রাইটু প্রথমে ভগার কথা শুনে ফিক করে হাসল। তারপর বাংলার বোতলটা হাতে নিয়েই হো হো করে হেসে উঠল। ভগা তাকাল। একবার— যাসশালা কী হল?— বলে হাসিতে শামিল হল ভগাও! হাসতে হাসতেই বোতলটা নিয়ে চুমুক দিতে গেল এবং জোর বিষম খেল, কারণ হাসতে হাসতেই রাইটু ওর মাথায় সজোরে গাঁট্টা মেরেছে! শালা, মদ খাওয়ার সময় এমন কেউ করে! তার মধ্যে সিগারেটও ফুঁকছিল ভগা। গলা থেকে খকখক করে বেরিয়ে এল কিছুটা বাংলা, কিছুটা কফ, সম্ভবত সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা কিছুটা গাঁজার তামাক। মুখ থেকে ভক করে এই নেশার কিছুটা ছিটকে যাওয়ায় অসুস্থ লাগল ভগার। রাইটুর যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। ও এখনও হো হো করে হেসে চলেছে। ভগা এমনিতে খিস্তি দেয় না রাইটুকে, এবার না দিয়ে পারল না।

—আরে ল‍্যাওড়া! কী করছ!

বিরক্তিটা লুকোল না ভগা। ওর কালো চশমা চোখে নেই, ফলে চোখেও ভুরু কুঁচকোনোটা ধরা পড়ল।

—আরে! ওটা রাজার ছেলে নয়, আমার ছেলে!

এবার ভগা আরেক দফা বিষম খেল।

—আমার চোখের সামনে লাশ হল রাজা! আর আমি জানব না? স্বপ্নাকে ও জানোয়ারের মতো পেটাত। আমি একদিন গিয়ে দেখে ফেলে বাঁচিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তখন হালকা লাভ হয়ে গেল স্বপ্নার।

ভগা নিজেকে সামলাতে সামলাতে রাইটুর দিকে তাকিয়ে থাকল।

—ওই কিচাইন, আহ-উহ, সব আমার সঙ্গে। আমার আর রাজার চুলের কাটিং এক ছিল। তাই তোর বন্ধু বুঝতে পারেনি। আর এই বন্ধুটা কে? লাল্টু নিশ্চয়ই?

ভগা কাশতে কাশতেই মাথা নাড়ল।

—এক নম্বরের শুয়োরের বাচ্চা! স্বপ্নার বাথরুমের ঘুলঘুলিতে উঁকি মারত। কান পেতে শুনত সব কথা। তখন জানলে কানে, চোখে দানা পুরে দিতাম।
—হ‍্যাঁ, ও হারামি ছেলে! আরেক দফা কিংসাইজ কাশি ঝেড়ে বলল, এভাবে মাথায় মারে কেউ? তুমি মাইরি…

রাইটু কানেই তুলল না যেন কথাটা। ও আবার গম্ভীর।

—তারপর? কেউ জানে না?

ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল ভগা।

—কে জানবে? স্বপ্না কাউকে বলেনি। তুই জানলি। তুই বলবি কাউকে?
—আরে বাল বোকো না! বলো না, বাচ্চাটা জানে?

রাইটুর মুখ শক্ত হল বোধহয়। রাতের অন্ধকারে বোঝা মুশকিল।

—স্বপ্নাই কোনওদিন স্বীকার করেনি। বলেছিলাম, বাচ্চা মানুষ করব একসঙ্গে, বিয়ে করব। ও বলল, বাচ্চা পয়দা ও একাই করেছে। ওর আর কাউকে লাগবে না।

ভগা একটু চুপ করল। তারপর অস্ফুটে, নিজের কিছুটা অজান্তেই সাপের মৃদু শিসের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ভালবাসো স্বপ্নাকে?

রাইটু ওর আশ্চর্য শূন্য দৃষ্টি ফেলল ভগার মুখের ওপর, টর্চের আলোর মতো তীব্র, অথচ অন্ধকার।

—তুই রিনিকে ভালবাসিস?

ভগার সারা শরীরে যেন বিদ‍্যুৎ খেলে গেল! ব্রহ্মতালু থেকে উড়ে গেল নেশাটা। ফাঁকা লাগল মাথাটা এক সেকেন্ডের জন্য।

—রিনি… রিনির কথা তুমি কী করে…

রাইটু হঠাৎই চিৎকার করে উঠল!

—খানকির ছেলে! পালিয়েছে!

গাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকারটা!

ছেলেটা নেই!

ভগা, রাইটু দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য নড়ে গেল। নেশা ছুটে তো গেলই, কী একটা অন্ধ রাগ আর ভয়ে দুজনেই উদ্বেল হয়ে উঠল। ছেলেটা ওদের নেশার সুযোগ নিয়ে হাত ফসকে পালাল, এটা ভেবে রাগটা উসকে উঠছে। অন‍্যদিকে ভয়টা কীসের, সেটা ঠিক জানে না ওরাও। ছেলেটার দৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরেই চাপে রাখছিল ওদের।

রাত এমন কিছুও হয়নি। খিদিরপুরগামী রেড রোডের এই অংশটা আপাতত ফাঁকাই থাকে। কিন্তু পুলিশ তাও টহলদারি করে মাঝেমধ্যেই।

সেসব রিস্ক মাথায় নিয়েই অটোমেটিক রিভলভারটা বেরিয়ে এল ভগার প‍্যান্টের পেছনের খাঁজ থেকে।

রাইটু খেয়াল করেনি সেটা প্রথমে। ছেলেটাকে খুঁজতে গিয়ে। তারপর ওটা চোখে পড়তেই ধমকাল চাপা গলায়।

—পাগলাচোদা! ওটা ঢোকা!

সঙ্গে সঙ্গে একটা পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই ফিরে তাকাল অতর্কিতে।

মন্টি।

নির্লিপ্ত গলায় বলল, হিসি করতে গিয়েছিলাম।

—জন্মের মতো মোতা বন্ধ করে দেব তোমার চুতমারানি! রাইটু তেড়ে যাচ্ছিল, ভগা ঠেকাল।

মন্টি উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে পড়ল।

ভগা, রাইটু দুজনেই হতভম্ব হয়ে রইল।

 

বন্ধ চোখের পাতার ভেতর মণিটা যেন ব‍্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। বনি বুঝতে পারছে আধোঘুমে আধোচৈতন‍্যে, ও হাত-পা ছুড়ছে প্রাণপণ। যেন ঘুমটা এক্ষুনি ভাঙতে চায়। ঘুম ভাঙা আর জেগে ওঠার স্বপ্নই ও বারবার দেখে চলেছে। একই সঙ্গে বুঝছে, ঘুমটা ওর আসলে ভাঙেনি।

এবার যেন কিছুটা অস্থির হয়েই চোখের পাতা খুলল বনি। জাগল। পুরোপুরি। অজিত ডাক্তার বলছিল, চোখের পাতা বেশি নাচলে বুঝতে হবে সমস্যা হচ্ছে। তাহলে কি সত্যিই বনির সমস্যা হচ্ছে কোনও? শরীরে তো কিছুই অনুভব করছে না ও।

স্কুলে উৎপলস‍্যার একদিন ঘুম নিয়ে কথা বলছিলেন ক্লাসে। সিলেবাসের বাইরের কথা। উৎপলস‍্যার বলতেন। সেদিন বলেছিলেন, ঘুমের মধ্যে এক পর্যায়ে র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট হয়। চোখের মণি নাচে। আসলে তখন মাথা কাজ করে জেগে থাকা সময়ের মতোই। কিন্তু তাও, মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।

ওইদিন ক্লাসে আরও একটা কথা উৎপলস‍্যার বলেছিলেন। বলেছিলেন, ঘুমের মধ্যে হঠাৎ প‍্যান্ট ভিজে যাওয়ার কথা। না, হিসিতে নয়। একটা বিশেষ কিছু বেরিয়ে আসে শরীর থেকে। উৎপলস‍্যার হেসে হেসে বলেছিলেন, এমনটা হয়। বনির ভয় সেদিন একটু কমেছিল। ক্লাস এইট থেকে ঘটত ব‍্যাপারটা। সেদিন শুনে বুঝেছিল, ব‍্যাপারটা সহজ আর স্বাভাবিক।

তারপর অবশ্য বনি এ-ব‍্যাপারে আরও কিছু শিখেছে। তাতে ওর ভয় আর অপরাধবোধ বেড়েছে, কিন্তু বিষয়টার আনন্দই বা ও এড়িয়ে যায় কী করে? এখন আর অজান্তে ঘটে না ঘটনাটা, তাই অপরাধবোধ, কিন্তু আনন্দটা তো ফেলনা নয়!

সে যাই হোক, আজ ঘুমের মধ্যে যা ঘটছে, সেটা ঘুমেরই অঙ্গ বোধহয়।

তাও বনির মাথায় ঘুরছে সেদিন বিকেলের কথাই। ওই আধবুড়ো লোকটা আর সাহেবদারই বা কীসের গোলমাল আছে? কেন দাদা বারণ করল ওদের সঙ্গে মিশতে? আজ অজিত ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হঠাৎ সতর্ক হয়ে পড়ল কেন ওরা? কাদের দেখে সতর্ক হল? ওরা কার বা কাদের লোক?

বনি উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে।

সত্যিই, গোয়েন্দা গল্প পড়া আর হাবিজাবি সিনেমা দেখা কমাতে হবে। ও বড় হচ্ছে। এসব কী যে ভাবছে? সেদিন বিকেলে বোধহয় ও ঘুমিয়েই পড়েছিল। অনেক সময় কিছু স্বপ্ন আসল মনে হয়।

বনি নিজের মাথা হালকা করতে ছাদে উঠল। চুপিসারে দরজার খিল নামিয়ে। যাতে কেউ শুনতে না পায়। এমনিতেই ঘুমের মধ্যে দুবার বাবা-মা এসে দেখে গেছে। ওকে আজ একা শুতে দিতে চাইছিলই না ওরা। দাদাও চেয়েছিল ওর সঙ্গে থাকতে রাতে। ওইই হতে দেয়নি। এত রাতে ছাদে উঠছে জানতে পারলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না।

ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে তারা দেখছিল বনি। কতরকমের তারা। জ্বলছে, নিভছে। আচ্ছা, তারাখসা কি চোখে সত্যিই দেখা যায় না?

হঠাৎ উল্টোদিকের ছাদে আওয়াজটা হল।

ঝুপ করে একটা আওয়াজ।

চাঁদনি রাতে অস্পষ্ট লাগছে না কিছুই।

উঁচু একটা জলছাদ থেকে লাফ মারল একটা মেয়ে। মেয়েটাকে চেনে বনি।

বাবলি, ওরফে দেবদত্তা। ওদের প্রতিবেশী। ঠিক ওরই বয়সি।

অত উঁচু থেকে ও লাফাল? অবাক হয়ে চাইল বনি।

দেবদত্তা ওরফে বাবলিও দেখেছে বনিকে।

দুদিকের ছাদ থেকে দুজন দুজনকে বিস্ময়ে দেখছিল। জ‍্যোৎস্না ওদের ছেলেভুলোনো মায়ের মতো স্নান করাচ্ছিল। আর তখনই আকাশে একটা ঝিলিক খেলে গেল। ছাদের খুব কাছেই, যেন ওদের দুজনের মাঝের আকাশে। ওরা কেউই সেটা খেয়াল করল না।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. তারান্তিনো, সিজন দুই— ছত্রিশ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...