Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ড

প্রদীপ দত্ত

 


প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি এবং অন্য কয়েকজন দোতলার একটি ঘরে ভিতর থেকে নিজেদের বন্ধ করে রেখেছিলেন বলে কোনওক্রমে বেঁচে যান। ওই সোসাইটিতে ৭০ জনকে হয় কেটে নয়তো পুড়িয়ে খুন করা হয়েছিল। ১০-১২ জন মহিলা ও তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। মোদি পরে বলেছিলেন, ঘটনার সময় গুলবার্গ সোসাইটির ঘটনা তিনি জানতেনই না, সন্ধ্যার সময় পুলিশ অফিসাররা তাঁকে সে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জীব ভাট জানান, মোদি মিথ্যা বলেছেন

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: সিসিটি গোধরা থেকে ঘুরে আসার পর যা জানিয়েছিল

গুজরাত দাঙ্গার সময়কার বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের একটি আমেদাবাদের চমনপুরায় গুলবার্গ সোসাইটির গণহত্যা। ওই সোসাইটি ছিল উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবারের দোতলা বাড়ির কলোনি। ৭২ বছরের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি সেখানেই থাকতেন। কলোনির গেটের কাছেই ছিল তাঁর বাড়ি। প্রবল উত্তেজনার সময় প্রতিবেশী ও পাশের বস্তির মুসলমান পরিবারের লোকজন এহসানের কাছে থাকা নিরাপদ মনে করে সেখানে চলে এসেছিল। ততক্ষণে সোসাইটির চারপাশে প্রায় ২০ হাজার কট্টর হিন্দু জনতার ভিড় জমা হয়েছে। মুসলমানদের কেটে ফেলা, প্রতিশোধ নেওয়ার স্লোগান দিচ্ছে। তা দেখে এহসান প্রশাসনের সর্বস্তরে, পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল, আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার, মুখ্যসচিব, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার পিসি পান্ডে সকাল ১০-৩০ মিনিটে এহসানের বাড়িতে এসে তাঁকে পুলিশি সাহায্যের আশ্বাস দেন। আশ্বাসের পরও পুলিশ আসেনি। পরবর্তীকালে দিল্লিতে আদবানির কাছে উপস্থিত এক বিজেপি নেতা জানিয়েছিলেন, আদবানি নরেন্দ্র মোদির অফিসে ফোন করে এহসান জাফরির নিরাপত্তার কথা বলেছিলেন। এক ভুক্তভোগী পরে আদালতে জানান, তিনিও মোদিকে ফোন করেছিলেন। মোদি কী বললেন এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সাহায্যের প্রশ্নই নেই, বরং গালিগালাজ করেন।

শেষে কোনওরকম সাহায্য আসবে না বুঝে পরিবার ও অন্যান্যদের বাঁচাতে এহসান বাড়ির বাইরে চলে আসেন, যেন তাঁকে খুনের বিনিময়ে বাকিরা বেঁচে যায়। সাংবাদিক বিনোদ কে জোস জানিয়েছেন, আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী এহসান বাইরে এলে তাঁকে নগ্ন প্যারেড করানো হয়, তারপর হাতের আঙুল ও পা দুটো কেটে, শরীর টেনে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ফেলা হয়। চার ঘন্টা ধরে বাড়িতে মহিলাদের ধর্ষণ করে শেষে পুড়িয়ে মারা হয়। পুরুষদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করার পর কেটে টুকরো করা হয়, বাচ্চারাও বাদ যায়নি। তাঁর পরিবারের মোট দশজনকে হত্যা করা হয়।

গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির ডকুমেন্টারির[1] প্রথম পর্বে এ বিষয়ে ইমতিয়াজ পাঠানের সাক্ষ্য রয়েছে। এহসান জাফরি পরিবারের দশজনকে খুন হতে দেখেছিলেন ইমতিয়াজ। শুধু পাঠানই নয় পরবর্তীকালে আরও অনেকে এহসানকে যে নানাজনকে ফোন করতে দেখেছেন সে-কথা তাঁদের সাক্ষ্যে বলেছেন। তবে গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডের মামলাটির বিচার শুরু হলে রাজ্য সরকার এহসানের ফোন কলের কথা অস্বীকার করে।[2]

এহসানের স্ত্রী জাকিয়া জাফরি এবং অন্য কয়েকজন দোতলার একটি ঘরে ভিতর থেকে নিজেদের বন্ধ করে রেখেছিলেন বলে কোনওক্রমে বেঁচে যান। ওই সোসাইটিতে ৭০ জনকে হয় কেটে নয়তো পুড়িয়ে খুন করা হয়েছিল। ১০-১২ জন মহিলা ও তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। পরেরদিন শুধু গুলবার্গই নয়, নানা জায়গা থেকে মানুষের পোড়া হাড় এবং দেহের না-পোড়া অংশ ট্রাকে করে দুধের সর কবরস্থানে নিয়ে আসা হয়। বিশাল কবর খুঁড়ে ১৭৯ জনের পোড়া এবং না-পোড়া অংশ কবর দেওয়া হয়।

সূত্র: ইকোনমিক টাইমস

মোদি পরে বলেছিলেন, ঘটনার সময় গুলবার্গ সোসাইটির ঘটনা তিনি জানতেনই না, সন্ধ্যার সময় পুলিশ অফিসাররা তাঁকে সে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জীব ভাট জানান, মোদি মিথ্যা বলেছেন। সঞ্জীব পরে সাংবাদিক জোসকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মোদি সে-সময়ে স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বেও ছিলেন, তাই সারাদিন ধরে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। চারিদিকে কী ঘটছে সে-সম্বন্ধে ভালই জানতেন। তিনি আরও বলেন, বেলা ২টোর আগে তিনি কয়েকবার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁকে জানিয়েছেন, উগ্র হিন্দু জনতা গুলবার্গ সোসাইটি ঘিরে ফেলেছে। বিকেলে তাঁর অফিসে গিয়েও বলেন, এখনই হস্তক্ষেপ করা দরকার। সেকথা শুনে মোদি বলেন— ‘সঞ্জীব, জাফরির গুলি চালানোর অভ্যাস ছিল কি না খোঁজ করে দেখো তো!’

ওই আপাত অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনে সঞ্জীব অবাক হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরের করিডরে আচমকা কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরসিংহ চৌধরী ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরেশ রাওয়ালের সঙ্গে সঞ্জীবের দেখা হয়। নরেশ আগে তাঁর মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা বলেন, গুলবার্গের এহসানভাই পাগলের মতো ফোন করছেন, তাই তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে সে-কথা বলতে এসেছেন। সঞ্জীব বলেন, আমি সিএমকে বলেছি, আপনারাও বলুন। এরপরই তাঁর সেলফোন বেজে ওঠে, গুলবার্গ অঞ্চলের এক ইনফর্মার জানায়, জাফরি গুলি চালিয়েছে। শুনে তিনি অবাক হয়ে যান। পরে অফিসে পৌঁছে দেখেন টেবিলে এক সংক্ষিপ্ত নোট পড়ে রয়েছে— জাফরি আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। তখনই বুঝেছিলেন, তিনি জানার আগেই গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডের সবকিছু মোদি জানতেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত গুজরাতের ২৪টি জেলার মধ্যে ১৬টিতে অতি-সংগঠিত দাঙ্গা হয়েছিল। গুলবার্গ হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরে, ৩ মার্চ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২১ বছরের বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করা হয়, যার জেরে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। অপরাধীরা হয়তো বোঝেনি যে তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর তিন বছরের মেয়ে-সহ পরিবারের ১৪ জনকে খুন করা হয়। পরবর্তীকালে আদালতে অনেক টানাপড়েনের পর ২০০৮ সালে ১১ জন অপরাধীর যাবজ্জীবন কারদণ্ড হয়। শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সম্মতি নিয়ে গুজরাত সরকার তাদের মুক্তি দেয়। জেল থেকে বেরোনোর পরই বিজেপির নেতা-কর্মীরা তাদের গলায় মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেয়। বলা হয়, দোষীরা ব্রাহ্মণ, তারা কোনও খারাপ কাজ করতে পারে না। অবশ্য কিছুদিন পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ফের তাদের জেলে যেতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, অপরাধীদের মুক্তির আদেশ দেওয়ার কোনও এক্তিয়ার গুজরাত সরকারের ছিল না। কারণ মামলার বিচার হয়েছিল মহারাষ্ট্রে।

 

Reference:

 

[পরের পর্ব- নারোদা পাটিয়া হত্যাকাণ্ড]


[1] ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন।
[2] মোদি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন যে বিভাজন ও বিদ্বেষের চাষ করছেন তা হল গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় পর্বের বিষয়। সেখানে রয়েছে— তরোয়াল হাতে উন্মত্ত উগ্র হিন্দু জনতার ভিড়, গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী নিয়ম করে মুসলমানদের গণহত্যা এবং মহিলাদের গণধর্ষণ করতে বলছে। হিন্দুরা মুসলমানদের রাস্তায় পিটিয়ে মারলে কোনও শাস্তি হয় না। পিটিয়ে মারার ভিডিও তৈরি করে সমাজমাধ্যমে ছড়ালেও পার পেয়ে যায়। এই পর্বে মোদির পুরনো সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাক্ষাৎকারও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট মোদিকে ক্লিনচিট দেওয়ার পর তাঁকে তিনি ভগবান শিবের সঙ্গে তুলনা করেন, যিনি বহু বছর ধরে গলায় বিষ ধরে রেখেছিলেন।