Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: সঞ্জীব ভাট-এর কথা

প্রদীপ দত্ত

 


সঞ্জীবের মতে আমাদের রাষ্ট্র আজ কেন্দ্রীভূত এবং সংগঠিত হিংসার প্রতিরূপ। গুজরাত দাঙ্গার বিচারের দাবির ক্ষেত্রে সঞ্জীব ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। গুজরাত দাঙ্গার সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য এই হুইসলব্লোয়ারের ভূমিকার জন্যই তাঁর প্রতি নিষ্ঠুরতাও চরম। তাঁর পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে নাজেহাল করা হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তাঁর স্ত্রী শ্বেতা জানিয়েছেন, তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর স্বামীকে প্রশ্ন করতে তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা তাঁদের শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। আগে থেকে না জানিয়ে তাঁদের নিরাপত্তারক্ষী তুলে নেওয়া হয়। তাঁদের ২৩ বছরের পুরনো বাড়িতে আইনগতভাবে নির্মীত নতুন অংশকে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ‘অবৈধ নির্মাণ’ আখ্যা দিয়ে ভেঙে দেয়

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: রাহুল শর্মার কথা

১৯৯৯-এর ডিসেম্বর থেকে ২০০২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সঞ্জীব ভাট ছিলেন রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের (স্টেট ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ডেপুটি কমিশনার। মুখ্যমন্ত্রী মোদির নিরাপত্তার দায়িত্বও ছিল তাঁর। গুজরাত দাঙ্গার ন-বছর পর ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামায় সঞ্জীব জানান, ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এক মিটিঙে শীর্ষ পুলিশকর্তাদের মোদি জানিয়েছিলেন যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ক্রোধ প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। সেই মিটিঙেই ঠিক হয়েছিল সৎকারের আগে গোধরায় নিহতদের দেহ আমেদাবাদে আনা হবে। ধর্মীয় হিংসার ভয়ে সঞ্জীব তার বিরোধিতা করেন। তদানীন্তন পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল কে চক্রবর্তী এবং পুলিশ কমিশনার পিসি পান্ডেও বাহিনিতে ধর্মীয় হিংসা সামলানোর মতো সংখ্যা নেই বলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, দেহ আমেদাবাদে আনা ঠিক হবে না। কিন্তু তারপরও মোদি তাঁর কথার নড়চড় হতে দেননি, ওই সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। মিটিং শেষ হওয়ার পর সঞ্জীব ওই সিদ্ধান্ত এবং বিজেপি ও বজরং দলের সক্রিয়তা যে বেড়েছে তা জানিয়ে বড়কর্তাদের কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠান। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরের দিন ধর্মঘট ডাকে। ওদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ও বিজেপি আমেদাবাদে উত্তেজনা বাড়াতেই থাকে।

সঞ্জীব আরও জানান, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই দাঙ্গা হয়েছে। পুলিশকর্তাদের মোদি দাঙ্গাকারীদের প্রতি উদাসীন থাকতে বলেছিলেন, কারণ মুসলমানদের নাকি শিক্ষা দেওয়া দরকার। হলফনামায় তিনি ছজন সাক্ষীর উল্লেখ করেন যারা মোদির বাড়িতে সেদিনের মিটিঙে তিনি হাজির ছিলেন কিনা তা বলতে পারবেন। তিনি জানান, সেদিন মোদির বাংলোয় তিনি কে চক্রবর্তীর সরকারি গাড়িতে চড়ে গিয়েছিলেন, গাড়ি চালিয়েছিল তারাচাঁদ যাদব। কনস্টেবল কেডি পন্থ তাঁর সরকারি গাড়িটি নিয়ে পিছনে আসছিল। সঞ্জীবের হলফনামায় স্বাক্ষর করেছিলেন কেডি পন্থ।

পন্থ পরে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে এফআইআর করে যে, সঞ্জীব তাকে ভয় দেখিয়ে মিথ্যা হলফনামায় স্বাক্ষর করিয়েছে এবং তিনি বিরোধী কংগ্রেস দলের অর্জুন মোধওয়াদিয়ার কাছে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, মোধওয়াদিয়া তাকে সঞ্জীবের কথা মেনে চলতে বলেন। পন্থ এরপর সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমকে (সিট)[1] জানায়, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাঙ্গা শুরুর সময় সে ছুটিতে ছিল। চক্রবর্তীও সিট-এর কাছে সঞ্জীবের মিটিঙে উপস্থিত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

তবে তারাচাঁদ যাদব সঞ্জীবকে সমর্থন করে বলেন, তিনি গাড়ি চালিয়ে সঞ্জীবকে মোদির বাংলোয় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কে চক্রবর্তী ও পন্থ ছিলেন। বিবিসি-র এক সাংবাদিকও বলেন সঞ্জীব মিটিং-এ ছিলেন। সঞ্জীবকে প্রশ্ন করা হয় সে-কথা আগে বলেননি কেন? উত্তরে বলেন, ২০০৪ সাল থেকে গুজরাত সরকার গঠিত নানাবতী-মেহতা কমিশনের[2] জেরায় হাজির হতে চেয়ে তিনি বারবার জানিয়েছেন, কমিশন তাঁকে ডাকেনি। শেষে কমিশনে যাওয়ার আগে পুলিশ, স্টেট ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং সিটের শুনানির নথিপত্র, প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন। ওইসব কাগজপত্র সরকারি কাজে লাগবে জানিয়ে ডিসেম্বর মাসেও তিনি একই চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর অভিযোগ, মোদি সরকার চায়নি বলেই নথিপত্র ও প্রমাণ তাঁকে দেওয়া হয়নি, সরকার সবকিছু ধামাচাপা দিতে চাইছিল।

শেষে সিট জানায়, সঞ্জীব ২৭ ফেব্রুয়ারির মিটিঙে ছিলেন না। সিট এ-কথা বলায় মোদি দাঙ্গার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। ২০১১ সালে সিট সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দেয়। পরে মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দৃষ্টিকটুভাবে সিটের প্রধান রাঘবনকে সাইপ্রাসের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন।[3] ওদিকে সঞ্জীব ততদিনে জেলে। নানাবতী-মেহতা কমিশনও ২০১৪ সালের এপ্রিলে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। কমিশনও সিটের মতো মোদি এবং তাঁর মন্ত্রীদের ও পুলিশকে গুজরাত দাঙ্গার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পিবি সায়ন্ত গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে সিসিটি প্যানেলে ছিলেন। ওই প্যানেলের রিপোর্টে দাঙ্গার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করা হয়েছিল। সায়ন্ত বলেন সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের (সিট) রিপোর্টের সঙ্গে তিনি একমত নন। অভিযোগ অনুযায়ী মোদির বিরুদ্ধে বিচার করা উচিত কি না তা সিটকে খতিয়ে দেখতে বলা হয়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে গুজরাত হাইকোর্টে জমা দেওয়া সিটের রিপোর্ট বলা হয়, মোদির বিরুদ্ধে বিচারযোগ্য কোনও প্রমাণ নেই। ওই বছর মে মাসে বিচারপতি সায়ন্ত এনডিটিভিকে বলেন, আমি সিটের সঙ্গে একমত নই। তিনি বলেন সিসিটি এবং সিটের রিপোর্ট— দুটিই মানুষ তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। সিসিটি প্যানেলের রিপোর্টে গণহত্যার জন্য মোদিকে দায়ী করে তাঁর বিচার চাওয়া হয়েছিল।

দাঙ্গায় মোদির যোগ বুঝতে সিট ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী রাজু রামচন্দ্রনকে তদন্ত করতে বলেছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন অ্যামিকাস কুরি বা এই মামলায় আদালতের সাহায্যকারী। তাঁর পর্যবেক্ষণ সিটের সঙ্গে মেলেনি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দেন। তিনি জানান মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রিপোর্টে তিনি জানান, এই প্রাথমিক স্তরে শ্রীমোদির বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা যায় তা হল, ধর্মের ভিত্তিতে নানা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শত্রুতা তৈরি করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক কাজ করা। রামচন্দ্রন জানিয়েছিলেন, পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাটের দাবির প্রতি আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ওদিকে সিট মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সঞ্জীবের অভিযোগকে আমল দেয়নি। সিট এবং রামচন্দ্রন উভয়ই আদালতে জাকিয়া জাফরির অভিযোগ অনুযায়ী মোদির ভূমিকা ক্ষতিয়ে দেখতে বলে। জাকিয়া জাফরি বলেছিলেন, গুলবার্গ সোসাইটিতে দাঙ্গাকারীরা এহসান জাফরি-সহ ৭০ জনকে মেরে ফেললেও মোদি ও তাঁর প্রশাসন তাঁদের বাঁচাতে কিছুই করেনি। জাফরি এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকেও ফোন করেছিলেন।

অশোক নারায়ণ ছিলেন গুজরাতের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (স্বরাষ্ট্র)। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সেই মিটিঙে ছিলেন। তিনি নানাবতী কমিশনকে বলেন যে, নির্দেশ ছিল যে গোধরা ট্রেনের আগুন লাগায় যারা মারা গেছে তাদের দেহ আমেদাবাদে নিয়ে আসতে দিতে হবে। একই কথা সঞ্জীব ভাটও তার হলফনামায় বলেছিলেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি মোদি দুটো মিটিং ডেকেছিলেন। প্রথমটা ছিল বড় পুলিশ অফিসার ও সেক্রেটারিদের, যেখানে সঞ্জীব ভাটও উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয়টা ছিল মন্ত্রিসভার। সাংবাদিক আশিস খেতানকে হরেন পান্ড্য বলেছিলেন, ওই মিটিঙে কয়েকজন মন্ত্রী বলেন গোধরা গণহত্যায় যারা মৃত তাদের দেহ আমেদাবাদে নিয়ে আসতে হবে। হরেন ওই কথায় আপত্তি করেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সেক্ষেত্রে মানুষের যে আবেগ তৈরি হবে তা থেকে আইনশৃঙ্খলায় বড়সড় সমস্যা দেখা দেবে। পান্ড্য বলেন, মিটিঙে চিৎকার করে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়। একজন মন্ত্রী বলেন এটাই তো আমরা চাইছি। আমাদের দলের শক্তির কেন্দ্র আমেদাবাদ, আমরা চাই এখানেই সবকিছু হোক। তাতে আমাদের দলকে সাহায্য করা হবে।

সিট জানায়, গোধরায় ট্রেনে করসেবকদের মৃত্যুর জন্য মোদি যদি পুলিশকে বলে থাকেন, হিন্দুদের ক্রোধ প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে তাহলেও তা ঘরের মধ্যে বসে বিবৃতি দেওয়া হিসাবেই দেখতে হবে।

সঞ্জীব ২০০২ সালে দাঙ্গার আগের দিন মোদির ডাকা মিটিঙে ছিলেন বলে ২০১১ সালে হলফনামা দিয়ে জানানোর পর থেকেই প্রতিশোধ হিসাবে চাকরিজীবনে অননুমোদিত অনুপস্থিতির অভিযোগে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর আগে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে অননুমোদিত অনুপস্থিতির অভিযোগে তাঁকে অস্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সঞ্জীব জানান গুজরাত সরকার প্রতিষ্ঠিত নানাবতী-মেহতা কমিশন-সহ নানা আইনি ও তদন্তমূলক শুনানিতে উপস্থিত থাকতে হয়েছে বলে তিনি কাজে যেতে পারেননি। প্রাক্তন আইএএস হর্ষ মন্দর জানিয়েছেন: ছুটি যদি অননুমোদিতও হত, সঞ্জীব যার প্রতিবাদ করেছেন, সে-ক্ষেত্রেও অসন্তুষ্টির চিঠি বা অননুমোদিত সময়ের জন্য বেতন কাটা হলেই তা হত ওই অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি। অননুমোদিত ছুটি নেওয়ার মতো তুলনামূলক মামুলি অপকর্মের দায়ে সঞ্জীবকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করায় সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে ইউপিএসসির ভূমিকা খুবই লজ্জার। কাউকে বরখাস্ত করা হল চরম প্রশাসনিক শাস্তি, যা সরকারি কর্মচারিদের ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেই খাটে। আমি এমন কয়েকজন আইএএস অফিসারকে জানি যারা কেউ কেউ বছরের পর বছর অননুমোদিত ছুটি নিয়ে বিদেশে বা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে, তারপরও বরখাস্ত দূরে থাক, কোনওরকম শাস্তিই হয়নি।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

শুধু বরখাস্তই নয়, তাঁকে আরও নানাভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৪ অক্টোবর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য বিহারে লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা বন্ধ করে তাঁকে আটক করা হলে গুজরাতের জামযোধপুর শহরে দাঙ্গা বাঁধে। সঞ্জীব তখন জামনগর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তাঁকে আরও দুই পুলিশ ডিভিশনের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেখানকার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসাররা ছুটিতে ছিলেন। ওদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি ৩০ অক্টোবর ভারত বনধের ডাক দিলে জামনগরে কার্ফু জারি করা হয়। জামনগর জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে সঞ্জীব জামযোধপুরে গিয়েছিলেন। জামযোধপুর পুলিশ স্টেশনের সার্কেল ইন্সপেক্টর ভবনাদ জানান, সাম্প্রদায়িক হিংসা ও আগুন লাগানোর জন্য ১৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে অবশ্য সবাই ছাড়া পায়। যারা গ্রেফতার হয়েছিল তারা সঞ্জীবের হেফাজতে ছিল না। তিনি বা তাঁর কোনও স্টাফ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। পরেরদিন তাদের আদালতে পেশ করা হলে বা জামিন পাওয়ার পরেও কেউ নির্যাতনের কথা বলেনি। প্রভুদাদ মাধবজি বৈষনানি ছাড়া পাওয়ার ১২ দিন পর, ১২ নভেম্বর অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে গিয়েও নির্যাতনের কথা বলেনি। ভর্তি হওয়ার ছ-দিন পরে, অর্থাৎ পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার ১৮ দিন পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হলে পোস্টমর্টেমে কোনও অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন ছিল না। এরপর প্রভুদাদের দাদা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সক্রিয় কর্মী অম্রুতলাল মাধবজি বৈষনানি অভিযোগ করে, হেফাজতে পুলিশ নির্যাতন করেছিল বলেই প্রভুদাদের মৃত্যু হয়েছে। বিভাগীয় তদন্তে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

১৯৯৫ সালে তা নিয়ে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে মামলা চালু হলে গুজরাত হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১১ সাল পর্যন্ত মামলাটি স্থগিত ছিল। সরকার এক সময় মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য আবেদনও করেছিল। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের হলফনামায় সঞ্জীব দাঙ্গার জন্য মোদিকে দায়ী করার পর ওই বছরই সরকার আগের আবেদন তুলে নেয় এবং সেই বছরই ওই মামলায় তাঁকে চার্জশিট দেয়।

মামলাটি আদালতে উঠলে শুনানির সময়ে কথাপ্রসঙ্গে সঞ্জীব বলেন, মোদি ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হরেন পান্ড্য হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য নষ্ট করে ফেলার জন্য তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন। পরে নতুন এক হলফনামায় মোদি এবং শাহর বিরুদ্ধে বিস্তারিতভাবে তিনি সেই অভিযোগ করেন।[4]

মামলা চলাকালীন ৩০০ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। সঞ্জীবের পক্ষের কোনও সাক্ষীকে ডাকা হয়নি। সঞ্জীব পরে সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিলেন, ওই মামলায় প্রায় ৩০০ সাক্ষীর তালিকা থেকে মাত্র ৩২ জনকে ডাকা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে ডাকাই হয়নি, বিশেষ করে তিনজন পুলিশ যাঁরা ওই মামলাটির তদন্ত-দলে ছিলেন। শেষে ২০১৯ সালের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্ট সঞ্জীবের পক্ষের ১১ জন সাক্ষীকে ডেকে প্রশ্ন করার আবেদন নাকচ করে দেয়। শেষে জামনগর দায়রা আদালত ৩০ বছর আগে হেফাজতে মৃত্যুর দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৯ সালের ২০ জুন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সঞ্জীব গুজরাত হাইকোর্টে আবেদন করলে সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কোর্ট আবেদন অগ্রাহ্য করে।

সেই সময় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য উল্লেখ করে ‘দ্য ওয়ার’ জানায়, ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গুজরাতে ১৮০টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও একটির জন্যও কারও শাস্তি হয়নি। ওইসব মৃত্যুর তদন্ত হলে, খুনের জন্য পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হলে, হয়তো বলা যেত সঞ্জীবের ক্ষেত্রে অন্যায় হয়নি। কিন্তু ৩০ বছর আগে, ছাড়া পাওয়ার ১৮ দিন পরে কারও মৃত্যুর জন্য সঞ্জীব ও আর এক পুলিশ অফিসারের শাস্তি হওয়ায় বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বিচার প্রহসনে পরিণত হয়।

সঞ্জীবের স্ত্রী শ্বেতা জানান, কোনওরকম অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক আঘাত অথবা অসুস্থতা ছাড়াই একজনের পুলিশ হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া, তার আঠেরো দিন পরে মারা যাওয়ার পর ফরেন্সিক রিপোর্টে কোনওরকম নির্যাতনের ইঙ্গিত ছাড়াই তাকে হত্যা বলে ঘোষণা করা হল! তিনি বলেন, এই রায় একজন নির্দোষ, পরিশ্রমী দায়িত্ব পালনকারীর উপর নির্মম অত্যাচার ও প্রতিশোধমূলক নিপীড়নের নির্লজ্জ উদাহরণ।

তবে এই রায়ের আগে, ২০১৮-র সেপ্টেম্বর মাসেই সঞ্জীবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, তিনি এক আইনজীবীর ব্যাগে মাদক ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৯৬ সালে সঞ্জীবের নেতৃত্বে বনসকান্ত জেলার পুলিশের হাতে এক কেজি আফিং-সহ রাজস্থানের আইনজীবী সুমারসিং রাজপুরোহিত ধরা পড়ে। আদালতে পুলিশ জানিয়েছিল, আফিং পাওয়া গিয়েছিল পালানপুরে সুমারসিং-এর হোটেলের ঘরে। তার আইনজীবী জানায়, গুজরাত হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির বোনের বাড়িতে (রাজস্থানে) ভাড়ায় থাকা সুমারসিং-এর পরিবারকে উৎখাত করতেই এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। জামিনের আবেদনে সঞ্জীব বলেছিলেন, এ বিষয়ে আগে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনও বৈধ সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া বিষয়টির তদন্তে যথেষ্ট দেরি হয়েছে। দায়রা আদালত জামিনের আবেদন নাকচ করে।

সঞ্জীব-সহ ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বিচার চলাকালীন, ৩ অক্টোবর (২০২৩) সুপ্রিমকোর্ট, ১৯৯৬ সালের মাদক উদ্ধার মামলা থেকে সঞ্জীবের অব্যাহতি চাওয়ার আবদন খারিজ করে তাঁর বিরুদ্ধে ৩ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করে। এর আগে ২০২৩ সালের মে এবং আগস্ট মাসে তিনি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন, তাঁর মামলাটি যেন অন্য আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়, কারণ বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট। ১৯ জন সাক্ষীকে ডাকার আবেদনও আদালত মানেনি, আগেকার শুনানির অডিও, ভিডিও রেকর্ডিং দিতে অস্বীকার করেছে। হাইকোর্ট সেই আবেদন অগ্রাহ্য করেছে।

সঞ্জীবের মতে আমাদের রাষ্ট্র আজ কেন্দ্রীভূত এবং সংগঠিত হিংসার প্রতিরূপ। গুজরাত দাঙ্গার বিচারের দাবির ক্ষেত্রে সঞ্জীব ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। গুজরাত দাঙ্গার সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য এই হুইসলব্লোয়ারের ভূমিকার জন্যই তাঁর প্রতি নিষ্ঠুরতাও চরম। তাঁর পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে নাজেহাল করা হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তাঁর স্ত্রী শ্বেতা জানিয়েছেন, তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর স্বামীকে প্রশ্ন করতে তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা তাঁদের শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। আগে থেকে না জানিয়ে তাঁদের নিরাপত্তারক্ষী তুলে নেওয়া হয়। তাঁদের ২৩ বছরের পুরনো বাড়িতে আইনগতভাবে নির্মীত নতুন অংশকে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ‘অবৈধ নির্মাণ’ আখ্যা দিয়ে ভেঙে দেয়।

সঞ্জীব জেল থেকে লিখেছেন: ভারত আজ বড় পরিবর্তনের মুখোমুখি রয়েছে। আমরা আজ যা করব আগামী কয়েক দশকে তাই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আমরা কেউই নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না, লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে। রাজনীতি দাঁড়িয়ে দেখার খেলা নয়। আমরা রাজনীতি এড়িয়ে যেতে পারি, কিন্তু রাজনীতি আমাদের ছেড়ে দেবে না। এই সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে সব ক্ষেত্রেই আমাদের লড়াইয়ের সঙ্কল্প নিতে হবে।

তাঁর মতে: আমি আপনি যা বিশ্বাস করি তার জন্য যদি ঝুঁকি না নেই, কখনওই কোনও পরিবর্তন হবে না… অশুভ এবং অবিচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক নয়, গণতন্ত্রের বেঁচে থাকাটাও তাই। আশা করি আমাদের জ্ঞান ও সাহস সঠিক পথটা বেছে নেবে।

শুধু সঞ্জীবই নন, যে-সব পুলিশ অফিসার গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে সরকারের সুরে সুর মেলাননি অথবা পরে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে তদন্ত করেছিলেন সরকার তাদের নাজেহাল করে ছেড়েছে।

 

Reference:

 

[পরের পর্ব- আরবি শ্রীকুমারের প্রতিবাদ]


[1] ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই অধিকর্তা আরকে রাঘবনের নেতৃত্বে সিট গঠিত হয়েছিল।
[2] ২০০২ গোধরার ট্রেন জ্বালানোর পর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জিটি নানাবতীঁ এবং গুজরাত হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অক্ষয় মেহতাকে নিয়ে নানাবতী-মেহতা কমিশন গঠিত হয়েছিল। পরে কমিশনকে গুজরাত দাঙ্গা নিয়েও তদন্ত করতে বলা হয়। কমিশন পর্যায়ক্রমে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম রিপোর্ট এবং ২০১৪ সালের নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী আনন্দিবেন পটেলের হাতে দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। সরকার ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর কমিশনের রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করে। রিপোর্টে বলা হয় তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ক্যাবিনেটের সহকর্মীরা ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দোষী নন।

নয় খণ্ডের তিন হাজার পৃষ্ঠার রিপোর্টে বলা হয়, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পিছনে কোনও পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল না। তবে দাঙ্গার পিছনে পুলিশ অফিসার আরবি শ্রীকুমার এবং রাহুল শর্মার (দুজনেই অবসর নিয়েছেন) ভূমিকার দিকে ওই রিপোর্ট সন্দেহের আঙুল তুলেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ানোর বিষয়ে সাসপেন্ড হওয়া আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটের ভূমিকার তদন্ত হওয়া উচিত বলে জানিয়েছে। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, কিছু কিছু অঞ্চলে উপযুক্ত সংখ্যায় এবং উপযুক্ত অস্ত্র নিয়ে তৈরি ছিল না বলে পুলিশ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
[3] অপরাধের সাক্ষী থেকে তা স্বীকার না করে, অপরাধ ঘটতে দিয়ে, কমিশনে বা কোর্টে অপরাধের কথা বলে হলফনামা না দিয়ে যে সমস্ত আমলা ও পুলিশকর্তারা দাঙ্গার পর মোদি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, বেআইনি নীতি মেনে নিয়েছেন, অন্যকে মানতে বাধ্য করেছেন— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার তাঁদের নানাভাবে পুরস্কৃত করেছে। যেমন দাঙ্গার সময় যিনি গুজরাতের মুখ্যসচিব ছিলেন সেই জি সুব্বারাও অবসর নিয়ে ২০০৩ সাল থেকেই ছ-বছরের জন্য গুজরাত ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (স্বরাষ্ট্র) অশোক নারায়ন অবসরের পর দু-বছরের জন্য গুজরাত স্টেট ভিজিলেন্স কমিশনার হয়েছিলেন। ২০০২ সালে যিনি আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার ছিলেন কেন্দ্রে এনডিএ-র আমলে (২০০৪) সেই পিপি পান্ডে সিবিআই-এর অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর নির্বাচিত হন। পরে তা নিয়ে কথা উঠলে ২০০৪ সালে তাঁকে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার সিকিওরিট ফোর্সের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল পদে বসানো হয়। ২০০৬ সালে পান্ডে ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ হয়ে গুজরাতে ফিরে আসেন। ওই পদে ছিলেন ২০০৯ পর্যন্ত। ২০০৯ সালে অবসর নিলে তিনি গুজরাত স্টেট পুলিশ হাউজিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। একইভাবে ডিজি বানজারাও অনেক সুবিধাজনক পোস্টিং এবং ক্ষমতা ভোগ করেছেন।
[4] সঞ্জীব ভাট ২০০৩ সালে যখন সবরমতি জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন, হরেন পান্ড্য হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসগর আলির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। আলি তাঁকে জানায় হরেন পান্ড্যকে হত্যা করেছে তুলসিরাম প্রজাপতি (তুলসিরাম ২০০৬ সালে জাল এনকাউন্টারে নিহত হয়)। সে-কথা জানার পরই তিনি গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে তা জানান। শাহ তাঁকে এ বিষয়ের যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে ফেলতে বলেন। তিনি সে কথা শোনেননি বলে তাঁকে ওই জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদ থেকে সারানো হয়।

সঞ্জীব বন্দিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। জেলের মেনুতে খাবার শেষে তিনি গাজরের হালুয়া দেওয়ার রীতি চালু করেন। বন্দিদের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন অভিযোগে ২ মাস পরে তাঁকে জেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় জেলের ৪০০০ জন বন্দির অর্ধেক ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের অনশন ধর্মঘট করে, ৬ বন্দি কব্জি কেটে প্রতিবাদ জানায়।