Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রসঙ্গ মিম : তারহীন ভারচুয়ালের তারকাটা দুনিয়া

মণিময় মাহাতো

 

এক

ছোটবেলায় ফেসবুক ছিল না, তবে পুলিশ ছিল। ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল না তাই পুলিশের ফেসবুক পেজও ছিল না। আতঙ্কিত হওয়ার কারণটা তাহলে বলি শুনুন, আমার ছবি আঁকার দক্ষতা চিরকালই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সাথে পাল্লা দেওয়ার মতোই। কিন্তু ছোটবেলায় বাবা-মায়ের একান্ত উৎসাহে একদিন বিকেলের ক্রিকেট খেলা জলাঞ্জলি দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল আঁকার ক্লাসে। বলাবাহুল্য আঁকার অসামান্য প্রতিভাবলে মাস্টারমশাই বিশেষ কাছে ঘেঁষতেন না। ওই বয়সে যা হয় ‘দেখিয়ে দেব আম্মো পারি’ মানসিকতা নিয়ে এক ছুটির দুপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ আঁকতে বসলাম। বিকেলে আঁকার ক্লাস, আজ মাস্টারমশাই প্রশংসা না করে, আমার ছবি সবাইকে ডেকে এনে না দেখিয়ে যাবেন কোথায়, ইত্যাদি ভেবে-টেবে নিয়ে ৪ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় রবি ঠাকুরের মুখ আঁকা সম্পূর্ণ হল। ব্যাগে ড্রয়িং খাতা নিয়ে পৌঁছালাম আঁকার ক্লাসে, বুকের ছাতি ফুলিয়ে আঁকার খাতা এগিয়ে দিলাম মাস্টারমশাইয়ের মুখের সামনে। ছবি দেখতে দেখতে মাস্টারমশাইয়ের চোখ দু’টো নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তুই নিজে এঁকেছিস?” বড় বড় করে মাথা উপর নিচে করলাম আমি। তারপর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে মাথায় চুল এলোমেলো করে দিয়ে উনি বললেন, “তোর আঁকার হাত এবার খুলছে রে, রামছাগলের এত সুন্দর পোট্রেট…।” এবার ভাবুন ২০১৭ সাল, ছবি-টবি এঁকে হালকা এডিট মেরে সেই ছবিটাই পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে সাথে ক্যাপশন “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ড্রন বাই মি” তারপর দিন হয়তো ‘রহস্য রবিবার’ খ্যাত ফেসবুক পেজে জ্বলজ্বল করত “মনীষীর বিকৃত ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার অভিযোগে ধৃত কিশোর”।

দুই

এবার একটা অদ্ভুত প্রজন্মকে নিয়ে কথা বলব। সেই প্রজন্মের কাছে ‘সেকুলার’ একটি খিস্তি, সেই প্রজন্ম ‘বিগ বস’-এর কূটকাচালির খবর জানে কিন্তু নিজামুদ্দিন কে জানে না। সেই প্রজন্মের রবীন্দ্রনাথ আহত হন ফেসবুক মিমে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নয়। এই প্রজন্ম রাস্তায় হাঁটে না গায়ে রাজনৈতিক গন্ধ লেগে যাওয়ার ভয়ে, এই প্রজন্ম ‘না’ বলতে ভয় পায় উচ্ছিষ্টের লোভে। এই প্রজন্মের নেতাজী আহত হয়, ফেসবুক মিমে, আত্মকেন্দ্রিকতায় নয়। এরা রোজ রাত্রে রগরগে জোক শেয়ার করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, তারপর হানি সিং-এর গানের লাইন গুনগুন করতে করতে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে মাস পিটিশন সাইন করে। এই প্রজন্ম ‘দেবতার জন্ম’ দিতে সিদ্ধহস্ত। তবে এই প্রজন্ম প্রগতিশীল, পাথর নয়, মানুষ থেকে দেবতার জন্ম হয় এই প্রজন্মে তাই, “ফেলুদা আমার ভালো লাগে না’’ বলায় খুন-ধর্ষণের হুমকি পেতে হয় জনৈক যুবতীকে। এই প্রজন্ম দেশ বলতে বোঝে মানচিত্র কিংবা একটি রঙিন পতাকা, মানুষ নয়; ঠিক যেমন করে মনীষী বলতে বোঝে কয়েকটি ঈশ্বরতুল্য অবয়ব, তাঁদের চিন্তা নয়।

তিন

ওনারা এখন নিয়ম করে গল্প লেখেন। রেডিও মির্চির ‘সানডে সাসপেন্স’কে কম্পিটিশনের মুখে ফেলে দেন ওনারা। রবিবারের মাংসের দোকান থেকে সোজ্জা রহস্য গল্প। তা বেশ ভালো কথা, ওনাদের আরও অনেক কাজ… এই ধরুন পুরসভার ভোটে মুখে গামছা বাঁধা বহিরাগতরা ভোট লুট করতে ঢুকছে, ওনারা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন। তারপর ধরুন মিছিলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেখলে এরা মনের সুখে লাঠিপেটা করে থাকেন, মাঝে মাঝে কলেজে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রী পিটিয়ে এনারা স্বাদবদল করে থাকেন। তারপর লাইকের লোভে বিচারাধীন বন্দিদের ছবি প্রকাশ করেন। ওনারা মাঝে মাঝে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, সেই সুযোগে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মীয় দাঙ্গার উস্কানিমূলক ভিডিও। ওনারা মাঝে মাঝে কম্পিউটার গেম খেলেন তখন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ভুঁয়ো খবর। ওনারা মাঝে মধ্যে কাঁদুনি গান। তারপর শহরের ধর্ষক-নারী নির্যাতনকারী-জমি মাফিয়া-সিন্ডিকেট-তোলাবাজ-ড্রাগ পেডলারদের বুকে ত্রাসের সঞ্চার করে গ্রেপ্তার করেন তৃতীয় বর্ষের পেছনপাকা কলেজ পড়ুয়াকে। তারপর ফেসবুকে তার ছবি প্রকাশ করে দেন যাতে ভবিষ্যতে সে সংশোধিত হতে পারে এবং কোনওভাবেই মনীষ্যানুভূতিতে আঘাত লাগা জনগণের জনরোষের স্বীকার না হতে পারে।

চার

কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের মন ও মনন’ বিষয়ক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, আচমকা হাতে হাতকড়া পড়াতে পুলিশ হাজির। লোকটা যাওয়ার আগে বড্ড চেঁচাচ্ছিল ‘আমি তো বই লিখেছি, মিম বানাইনি’। তারপর ফেসবুকের সব মিম আর ট্রল পেজের অ্যাডমিন গ্রেপ্তার। সবাই গরাদের ভিতর কান্নাকাটি করছে আমরা তো কোনও মনীষীকে নিয়ে কিছু বানাইনি! হঠাৎ গরাদের ওপার থেকে পুলিশের ড্রেস পরিহিত মহানায়কের এন্ট্রি। তারপর সেই ভরাট ব্যারিটোন ভয়েসে সুস্পষ্ট ডায়লগ, “রাজকুমার নেতাজী হতে পারলে আমি কি বিবেকানন্দ নই? বল তোরা আমায় নিয়ে খিল্লি করিসনি?” সবাই চুপ কিন্তু তখনও একজন ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে, ‘আমি তো তাও করিনি, কোনও মনীষীকে নিয়ে কিছু বলিনি, তাহলে আমাকে ধরে নিয়ে আসা হল কেন?” এবার যেন আকাশ থেকে ভগবানের গলার স্বর শুনতে পেলাম, “ওরে পাগল, উনি বই লেখেন, ছবি আঁকেন, গান গান, শ্রুতিনাটক করেন, মর্নিং ওয়াক করেন, গুণ্ডা কন্ট্রোল করেন, উনি মনীষী না হলে আর কে মনীষী?” গরাদের ভিতরটা পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেল।

পাঁচ

এবার কিছু জবাবদিহির পালা?

–মিমগুলো দেখেছেন?

–কয়েকটা দেখেছি।

–ভালো লেগেছে?

–জঘন্য লেগেছে। ওগুলো ‘হিউমার’ হলে শিব্রাম চকোত্তি ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন।

–তাহলে এত ফাটছে কেন?

–উপরের ৪টি প্যারা আরেকবার মন দিয়ে পড়ুন।

–ফেসবুকে যা খুশি নোংরামো করে যাবে আর কেউ কিছু বলবে না? এই যে মহিলাদের সম্পর্কে এই সব জঘন্য কথাবার্তা…

–ধরুন, আপনার ভাইকে খুন করা হয়েছিল…

–মানে??

–আহা! ‘ধরুন’ বললাম যে… সাপোজ…

–অ…

–হ্যাঁ, তা সেই খুনি কে সেটা পুলিশ জানে। কিন্তু ধরে না। কিছুদিন আগে দেখলেন তাকে ধরেছে, ধরে প্রেস কনফারেন্স করে বলছে ও একটা পকেটমারি করেছিল বলে ধরা হল… ভালো লাগবে?

–এটা ভালো লাগার মতো কথা!

–ঠিক! সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য! মিমগুলোর কদর্যতা ঠিক ওইখানেই। কিন্তু পুলিশ বুঝিয়ে দিচ্ছে সেটা নিয়ে তারা ভাবিত নয়! অদ্ভুত না?

–হুম… কিন্তু ওই ছেলেটা? বিকৃতমনস্ক ওই ছেলেটা… ওকেও দু’হাত তুলে সাপোর্ট করবে?

–কে তৈরি করল এই ছেলেগুলোকে? ওদের খেলার মাঠ কেড়ে নিয়ে যখন ফ্ল্যাট উঠল তখন মনে প্রশ্ন ওঠেনি, এরপর কী হবে? যখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির চিন্তা করলেন তখন প্রশ্ন আসেনি? যখন বিশ্বায়নে গা ভাসালেন? যখন মুক্ত বাজারকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন? এখন শুধু ভাবুন অপরাধী বানাবেন না শোধরাবার চেষ্টা করবেন!