সূর্যমুখী

দেবকুমার সোম

 

He could do without love and a wife, a home, and children; he could do without love and friendship and health; he could do without security, comfort, and food; he could even do without God. But he could not do without something which was greater than himself, which was his life— the power and ability to create.

—Lust for Life

যদি বলা হয় হলুদের দ্বিচারিতা তার নেই, তবে হয়তো সবটা বুঝিয়ে বলা যাবে না। হলুদ অবশ্যই তার প্রিয় রং, কিন্তু একমাত্র প্রিয় কীভাবে হয়? বন্ধুরা বলে সে রংকানা। আর্টিস্ট মাত্রেই রংকানা— চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রমাণিত। ভিনসেন্টের হলুদ নিয়ে পলের কম তাচ্ছিল্য ছিল না, অথচ পল নিজে তাহিতিকন্যাদের ছবি এঁকেছেন টার্শিয়ারি ইয়েলোয়। পাবলোর রংচিহ্নিত পর্বগুলো শিল্পীর রঙের সীমাবদ্ধতা নয় কি? আর সালভাদোর? উজ্জ্বল কিছু রং নিয়েই তো ছিল তাঁর যাবতীয় খ্যাপামি?

সকাল থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে— ঘ্যানঘ্যানে মেঘে আকাশের রং এখন খোসা ছাড়ানো তালশাঁস। টসটসে জলভরা। উপমাটা তার মনে এলে প্রিয়ব্রত স্যারের স্মৃতি জেঁকে আসে। জেঁকে আসে স্যারের নির্ভুল ব্যাখ্যা। সেদিন ক্লাসে প্রথম ন্যুড স্টাডি হবে— মডেল থাকবে না; কপি হবে তিশেনের ভিনাস অ্যানাডায়োমিনি। বহুবার দেখা— তাদের ঘরের মা-মাসিদের মতো স্নানশেষে ডানদিকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ভেজা চুলের গোছা থেকে জল নিংড়ে নিচ্ছে ভিনাস। সাদা আর্টপেপারে পেনসিলে ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে কপি করছিল; খানিক লজ্জাও ছিল সেইমতো। ক্লাসের জনাকয়েক সহপাঠিনীর সামনে এভাবে নগ্নবুক নায়িকার ছবি আঁকতে স্বাভাবিক তার ঘাম হচ্ছিল। হাত কাঁপছিল। প্রিয়ব্রত স্যার ঘুরেফিরে সকলের ছবি আঁকা দেখছিলেন। অনেক ছেলেরই তার দশা। কিছুতেই স্তন আঁকতে পারছে না। কল্পনায় দেখা, চেনাজানা বহু স্তনের মধ্যে, পর্ন ভিডিওতে দেখা মিলফদের মধ্যে কিছুতেই মিল খুঁজে পাচ্ছে না।

—হবে না বাপু, হবে না। ও-জিনিস যতক্ষণ না হাতে ধরে ফিল করতে পারছ, ততক্ষণ কপি ব্যর্থই হবে। তোমাদের কি মনে হয় জিনিসটা হাতে না-ধরে, না-ছুঁয়ে তিশেনের মতো আঁকা যায়? ইউ হ্যাভ টু সিল ইট।

এরপর স্যার এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটালেন। আগে থেকে সংগ্রহ করা ছিল ছানা। দুধকাটা। কাপড়ে মোড়া সেই ছানার তাল ছাত্রদের হাতে দিলেন; দেখো। ফিল করো। জিনিসটা এমন নরম অথচ আঁটোসাঁটো। সেই থেকে কোনও জিনিস আঁকতে সে ফিল করতে চায়— ছুঁতে চায়। অথচ, সব ছোঁয়া যেমন ছোঁয়া হয়ে ওঠে না, তেমন সব কি আর ছোঁয়া যায়? বোলপুর থেকে কলকাতা দুরন্ত রোদে গাড়ির পেছন-সিটে যেভাবে নিভৃতে আঙুলে আঙুলে আঙুল ছোঁয়া— বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, তেমন অলৌকিক নয় সবকিছু। সম্ভবও নয়।

কথা হচ্ছিল হলুদের দ্বিচারিতা নিয়ে, তার মধ্যে কোথা থেকে জুড়ে গেল পুরনো প্রসঙ্গ; অস্পৃশ্যতা। ছোঁয়াছুঁয়ি। না এ-বৃষ্টি আজ আর থামবে না। নিম্নচাপ ছাড়া এ-শহরে মেঘউৎপাত আর কোথায়? এমন টানা বৃষ্টি মানেই অজিত স্যারের ইংরেজি ট্রন্সলেশন: দুইদিন ধরিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন মাসে একবার এই বাক্যটা ট্রান্সলেট হবে। এর পরেরটা অবধারিত: স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বে ট্রেন ছাড়িয়া গেল। স্কুলজীবনে ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কজনের হয়? এমন দুদ্দাড় বৃষ্টি অথচ পৃথাদের বাড়ি আজ না গেলেই নয়। মাইনে না পেলে মেসের ভাড়া বাকি পড়ে যাবে; কাল আর মালিকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারব না। আত্মসম্মানের চেয়ে দুনিয়ায় অন্য কিছু মূল্যবান নয়। কিন্তু হলুদ? তার কী হবে? ক্যানভাসের অনেকটা জুড়ে লেমন ইয়েলো টেনেছে— মোটা ব্রাশ। তার পাশেই চাপিয়েছে ক্রোম ইয়েলো; সেই মুহূর্তে দ্বিচারিতা শব্দটা তার মাথায় গেঁথে গেল। যে-হলুদটা সে চাইছে সেটা গাঢ়— উজ্জ্বল; সেজানের আপেল। মনের লিলি। ভিনসেন্টের বিবর্ণতায় সে কীভাবে আক্রান্ত হল? ওহ, বৃষ্টিটা আজ বেজায় জ্বালাচ্ছে তো।

ভিডিও কলে ক্লাস নেওয়া দ্বিচারিতা। গন্ধ আর ছোঁয়া ছাড়া ছবি ছবি হয়ে ওঠে না। টাকাটাও অনলাইনে চাওয়া যায়। সে চাইতে জানে না। অধিকারবোধ কীভাবে জন্মায় তার জানা নেই। ফলে ভালবাসাও কেমন দূরে কোথাও দূরে— দূরে। ক্যানভাসের খাপছাড়া তেলরঙের ওপর ঘোলাটে আলো যেমন, তার স্বপ্নগুলোও তেমন ভ্যানগঘ সিনড্রোম। ‘গাঁয়ের ছেলে’ সাইনবোর্ডখানা নিঃশব্দে পিঠে বয়ে বেড়ানো ক্লান্তিকর। ক্লান্তিকর শহরময় চষে ফেলা ছবির ভাবনায়; কিংবা একটা এক্সট্রা টিউশন, এইসব। ছেলেবেলায় শুনেছিল এই শহরে হাওয়ায় টাকা ওড়ে; শুধু ধরতে জানলেই চলবে। তার সামান্য চাহিদা। ব্যক্তিগত। গোপন। ভাতকাপড়ঠাঁই নিয়ে সামান্য অর্থের আয়োজন তবু শহরে জোটে না। জোটাতে পারার সক্ষমতা তার হয়তো নেই। অর্পিতাদি বোলপুর থেকে ফেরার সময়ে বলেছিল; যারা সফল, তাদের কাছে আদর্শবাদ নির্বুদ্ধিতার অন্য নাম। যারা করেকম্মে খায়, তারা সকলেই কমবেশি দ্বিচারী। আমি সফলতা চাই না— জীবনের সার্থকতা খুঁজে চলেছি। জানলার দিক থেকে গাড়ির ভেতরে মুখটা ঘুরিয়ে এই সামান্য স্পষ্টতাটুকু বড় দরকার ছিল তার। অর্পিতাদি হেসেছিল। ম্লান। বিষণ্ণ। তারপর কিছুটা যেন স্বগতসংলাপ— তবে দুঃখও তো মধুর হয়। বিশেষত চেনাজানা দুঃখগুলো? আমি যখন জানি আমার এই-এই দোষে আমার এমন দুঃখ, তখন দুঃখ আর দুঃখ থাকে না; রমণীয় হয়ে ওঠে। আর সেই মুহূর্তেই ঈশ্বর ঠিক হাতটা বাড়িয়ে দেন প্রলয়; কারণ ইয়োর সাফারিংস আর নো মোর পার্সোনাল। ওটা তাঁরও যে। সংলাপে অধ্যাপনার মেজাজ অটুট থাকে।

—আর যার ঈশ্বর নেই? ঈশ্বরচেতনা নেই?
—চেতনা শব্দটা খুব ভারী; অর্থ না-জেনেই আমরা অনেকবার উচ্চারণ করি। ট্রাই টু ফাইন্ড সোলাস।
—কীভাবে? জিজ্ঞাসা নয়, তার দুই ভ্রূর মাঝে ছিল প্রশ্নচিহ্ন।
—ঘনিষ্ঠ হতে হয়; কোনও একজন মানুষকে ভরসা করতে হয়— পৃথিবীতে গাছের মতো আপনজনের সংখ্যাও পড়তির দিকে প্রলয়। বেঁচে থাকার ছোটখাটো কাটাছেঁড়ায় সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম তোমার আপনজন।

অর্পিতাদির কথায় প্রচ্ছন্নতা ছিল। সে বুঝে উঠতে পারেনি। তার বিহ্বলতায় অর্পিতাদি হেসে উঠেছিল— যার ঈশ্বর নেই, তার আমি আছি। হাসিটা মজার ছলেই; রসিকতা যেমন। ফলে কিছুটা চমক লাগিয়েছিল তার মনে। পৃথা এতটা রাস্তা আসার মধ্যে কখন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হাসির আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে বিরক্ত হয়। ড্রাইভার পেছনে ফেরে— ম্যাডাম, কিছু বলছেন? হাসির দমক হাওয়ার সঙ্গে ভেতরে টেনে নিয়ে অর্পিতাদির ঘনঘন ঘাড় নাড়া— সবটা মিলিয়ে আবহাওয়ায় পারিবারিক একটা ঘ্রাণ সে টের পেয়েছিল।

সম্পর্ককে সময়ের গজফিতেয় মাপতে গিয়ে প্রায়শ আমরা গরমিল করে ফেলি। খেয়াল থাকে না সম্পর্ক সময়ে নয় গভীরতায় মাপা সুবিধের। আর সেটা পরস্পর মাপতে পারে। কোনও তৃতীয়জন নয়। পৃথাদের সঙ্গে চেনাজানা দু-বছর পার হয়নি। একটা বাচ্চাকে আলাদাভাবে আঁকা শেখাতে হবে। আর পাঁচজন যেমন ক্লাসের পরীক্ষার জন্য শেখে, তেমন নয়; অঙ্ক-ইংরেজির চাইতে আঁকাজোকায় অভিভাবকের উচ্চাশা বেশি। তখন পৃথা সাত পেরিয়েছে। আঁকার স্কুলগুলো যে সাধারণ স্কুলের মতো আরও একটা খাঁচা, সেটা তার বাড়ির লোকেরা কীভাবে যেন জেনেছে। লোকেরা বলতে মা-মেয়ের সংসার। বাড়িতে যত্ন নিয়ে মায়ের সামনে মেয়েকে আঁকা শেখানো চ্যালেঞ্জ বই-কি। আঁকা মানে কেবল আঁকা নয়। আঁকার গল্প। কাহিনি। কথা। ছবি দেখা, দেখে চেনা; এইসব নিয়ে ক্রমে জড়িয়েমড়িয়ে যাওয়া। তার সঞ্চিত ছেলেবেলার দ্য গ্রেট আর্টিস্ট সিরিজ দিয়েছে পৃথাকে। মেয়েটার মনে প্রশ্নের শেষ নেই— বহুদিন কথায়-আলাপে ছাত্রী-শিক্ষকের সময় চলে যেতে থাকে। পৃথা তার বাচালতা, প্রগলভতা আর ছেলেমানুষি দিয়েও শিক্ষকের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিতে ব্যর্থ হয়। ঘরের বিছানায় উপুড়চুপুড় বই-রং এইসব, জানলার বাইরে ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টের আলো— পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ছিটকে আসা কর্কশ টেলিভিশন কিংবা পারিবারিক ঝগড়া। ড্রয়িংরুমের ক্ষীণ আলোয় হলুদ ফুলেল কাফতান পরা এক নারীমূর্তি বারবার তার মনোযোগের পরীক্ষা নিতে থাকে; সে চলকে ওঠে। পিছলে যায়। শিক্ষকের এমন অমনোযোগ পৃথাই বা মানবে কেন? সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কানকাটা সেলফ-পোর্ট্রেটের ওপর। গণেশজননী; সেও কাঁচাহলুদ মুখ। টার্নারের দৃশ্যকল্প— সব ওলটপালট করে দেয়। হ্যান্ডমেড পেপারে ক্রেয়ন ঘষে তখনই যে তাকে ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। দুচ্ছাই একটা ছবি।

ড্রয়িংরুম থেকে নারীমূর্তির গলা ভেসে আসে— মিষ্টি, আঙ্কেলকে এবার ছেড়ে দাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।

মেয়ে শুনলে তো! চা আসে। খাবার। কোনওদিন রাত আরও ঘন হয়, ততক্ষণ আঁকার জিনিস বিছানায় ছত্রাকার; ছাত্রী ঘুমে কাদা। সে একে-একে রংতুলিকাগজবই সাজিয়ে রাখে। হলুদফুল কাফতান নিঃশব্দে সহযোগিতায়। তার শরীরের তাপ, শ্বাস দেওয়া-নেওয়ায় যে ছন্দোবদ্ধতা— খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

—অনেক রাত হল। কিছু একটা বলা ভদ্রতা।
—হুম…
—বাস পাবে?
—না পেলে সমস্যা নেই। কিছু একটা পেয়ে যাই।
—রাতে ফেরা বুঝি তোমার অভ্যাস?
—না তেমন নয়… সন্ধ্যার মুখেই মেসে ফিরতে হয়।
—নিয়ম?
—খানিকটা নিয়ম। খানিকটা বাধ্যতা।
—একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমার রাতের খাবার দিয়ে দিই।
—না না, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার অভ্যেস আছে…
—এই যে বললে বেশি রাত হয় না?
—রাতের খাবার… ও আমি ম্যানেজ করে নিই। আচ্ছা আসি। আপনাদের সিকিউরিটি গার্ড এবার ঘুমাবে হয়তো…

শান্তিনিকেতনের গল্পটা সে বলেছিল; পৃথার ঝোঁক চেপেছিল। খোলা মাঠে অমন ভাস্কর্য দেখার আনন্দ তেওমন কোথায়? যে-কোনও উইকেন্ডে যাওয়া যায়। তবু শেষমেশ যাওয়াটা ঘটে উঠতে মাস ছয়েক পেরিয়ে গিয়েছিল। নির্বান্ধব শহরে সেই প্রথম সে পারিবারিক একটা ঘেরাটোপের নিশ্চয়তা যেন পেয়েছিল। পৃথার উৎসাহ, সারাক্ষণ তার মনোযোগ দাবি— এসব ছেলেমানুষির সঙ্গে অর্পিতাদিও মুদ্রাদোষের মতো প্রগলভ হয়ে উঠেছিল; তার ভাল লাগছিল। আর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলুদ। অর্পিতাদির ব্যক্তিগত হলুদ। গোপন হলুদ— সে জেনেছিল। এই শহরে একা হয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কিছু কম নয়। এক ছাদের নিচে— মেট্রোরেলে, অফিসে, সিনেমা হলে একা-একা মানুষগুলো একা হয়ে থাকে। ঝুমকোলতা ফুলের মতো নিতান্ত অসংলগ্নতায় থাকা। থাকতে হয়, তাই। অর্পিতাদিকে কাছ থেকে দেখে সামান্য বুঝেছে। তবে সে স্বীকার করতে পারে খুব নিরাপদ নয় সে-বোঝা। দুজন একলা মানুষ, তাদের স্বভাবধর্ম মেনেই একা; সেখানে গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়কের ফর্মুলা খাটে না। শান্তিনিকেতন সফরে পৃথার অধিকার পাকাপোক্ত হয়েছে তার ওপর।

আজকাল ছবিতে তার মন বসে না। ছাত্রদের শেখানোয় উদ্দীপনা খুঁজে পায় না। মন পড়ে থাকে কোথায়, আর সে কোনখানে। সোলাস শব্দটার মানে সে জানত না, পরে জেনেছে; ইঙ্গিতে কিছু বুঝেছে। তবে ইঙ্গিত-ইশারার সমস্যা এই, ঠিকমতো পড়তে না-পারলে রহস্যটাই মাটি। কার দুঃখ? কে সহায়? পরিপূরক? নাকি স্নেহ যেমন নিম্নদিকে ধায়, তেমন? তবে অর্পিতাদি স্যাডনেসকে বিশেষ পাত্তা দেওয়ার মেয়ে নয়। তিরিশের মাঝরাস্তায় নিজস্ব পুরুষকে হারিয়ে তীব্র চোরাটানের মধ্যেও স্থবির থাকতে জানে। ফলে মেয়ের দখলদারি মিটলে; দূরের স্মৃতি কিছুটা ভাগ করে নিয়েছিল। দুঃখ এই, সেই ভাগ করে নেওয়ায় আনন্দও ছিল।

আর একবার কি বিয়ে করা যেত না? এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মেয়েরাই কেন যন্ত্রণাটা আজীবন বয়ে বেড়াবে? কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো এমন স্থূল প্রশ্নটা সে করেই ফেলে।

—এদেশ সেদেশ নয় প্রলয়, ছেলেরা পারে কারণ তাদের দুঃখগুলো গর্ভযন্ত্রণার সঙ্গে মিলমিশ নয়। আমার মেয়েটা আমাদের দুজনের যৌথতার অবয়ব; দ্বিতীয় কেউ তেমন এখনও পাইনি যার মধ্যে তেমন নির্বুদ্ধিতা আছে। তোমার দেবকুমারদা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বটে, মেয়েটাকে রেখে গেছে। আজ সেই মেয়ের অমর্যাদা হলে তারও যে সম্মান থাকবে না প্রলয়। আর যদি স্বাধীনতার কথা বলো? এমন স্বাধীনতা কজনের জীবনে জোটে? সম্পর্কের রজত বা সুবর্ণজয়ন্তীর ন্যাকামিতে আমার কোনও সায় নেই।

সে জীবন দেখেছে আলগোছে; দাম্পত্য দেখা হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। এ-পর্যন্ত তেমন টানও অনুভব করল না। অথচ, ঘরে-বাইরে প্রলোভন কিছু কম নয়। আজ দশ বছর সে বাড়িছাড়া। পারিবারিক বন্ধন সেখানে নেই। সহপাঠিনীদের চোখের ইশারা, শরীরভঙ্গি চেনা-অচেনার বেড়া টপকে তাকে ছুঁতে পারেনি। তার বহু সহপাঠী আজ স্বীকৃত শিল্পী এবং সংসারী। অর্পিতাদির অনুভূতিগুলো সে আঁচ করতে চায়, তবে ওই যে বলা হল? ইশারা, রহস্য, প্রহেলিকা, ধাঁধা এসব ভেঙে শাঁস বের করতে চাওয়াটাও খুব অশ্লীল। খুবই অশ্লীল এক খেলা।

বৃষ্টির রকমসকম আজ ঠিক ধরা যাচ্ছে না; সে জাঁক করে বলে আকাশ চেনে। বলে মেঘ দেখে বলতে পারে তার গর্জন আর বর্ষণ-সম্ভাবনা। আজ কী এমন হল যে ধারাপাতের ধরনগুলো পড়তে পারছে না? রংতুলির মধ্যেই মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে অর্পিতাদি।

—হ্যালো?
—আঙ্কেল, তুমি কখন আসবে? পৃথার গলা উপচে ওঠে ক্ষোভে। কর্তৃত্ব।
—যাব বাবু, একটু বৃষ্টিটা ধরুক।
—তোমার ছাতা কই?

মেয়েটাকে বলা হয় না সে ছত্রধর নয়— বৃষ্টিতে ভিজতে তার আনন্দ।

—কী হল কখন আসবে? আমি নদীর ছবি এঁকেছি। বৃষ্টি কীভাবে আঁকব? কখন আসবে… কখন…?

সে এমন শিশুতোষ দর্শনে কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।

—বৃষ্টিকে আঁজলা ভরে ধরে খাতায় ছড়িয়ে দাও।
—সত্যি? কিন্তু মা যে বকবে। তুমি একটু বলে দাও না…
—না, মিষ্টি। তোমার মা রেগে যাবেন। বৃষ্টিটা একটু ধরুক, আমি আসছি।
—ধুর ছাই, ভাল লাগে না।

পৃথা ফোন কেটে দেয়। আজকাল কথায়-কথায় ধুর ছাই বলে। আর বলে ভাল লাগে না। নাক ফুলিয়ে যখন ভাল লাগে না বলে, তখন নাকটা কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিংবা ঠোঁট ফুলিয়ে যখন আবদারকে জেদের জায়গায় পৌঁছে দেয়। আজকাল পৃথা জেদ করে— অধিকার ফলায়। অস্বস্তি হয় বড়দের। শূন্যস্থানগুলো বড় বেয়াড়া— আকাঙ্ক্ষাও কিছু কম বেয়াড়া নয়। নির্বোধ চাওয়াগুলোও এমন নিম্নচাপের মতো একঘেয়ে।

হিসেবমতো সপ্তাহে দুদিন তার যাওয়া ধার্য। রোববার আর বেস্পতিবার সন্ধেতে। তবে হিসেবের কড়ায়গণ্ডায় কে কবে আবেগ বেঁধে রাখতে পারে? ফলে মিষ্টির চাওয়াটা বাড়ে। এখন তিনদিন। রোববারে বিকেল হলে। মন্দ লাগে না। যদিও আসা-যাওয়ায় বাস-অটো নিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা হিসেব আছে। সপ্তাহে দেড়শো টাকা। তবু ভেতর থেকে একটা না-জানা টান, চোরাটান অনুভব করে। আরও তো ছাত্রছাত্রী আছে, তাদের সঙ্গে এমন নিবিড়তা সে পায় কই?

—একী! এমন বেড়ালের মতো সপসপে ভিজে কেউ আসে? পৃথার মা দরজা খুলে চমকে ওঠে। তখন তার চুল থেকে, চোখের পাতা থেকে জল ঝরিতেছে।
—আজ না এলে সেই মঙ্গলবার হয়ে যাবে। ওকে বৃষ্টিটা আঁকা শেখাতে হবে।

তার উত্তর খানিক অজুহাতের মতো ফাঁকা। এমন আপাদমস্তক ভিজে আসাটা বেশ বোকামি হয়ে গেল। সে অঙ্কের মাস্টারমশাই নয়। আগেকার দিনের, তাদের বাপ-দাদার কালে এমন মাস্টারমশাই কিছু ছিলেন; পাগল কিংবা ডাইনোসর। সামান্য একজন আঁকার মাস্টারের এমন আচরণ সন্দেহজনক। অর্পিতাদির কাছে এমনভাবে ধরা পড়ে সে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তার মাইনেটা খুব দরকার; না হলে কাল মেসমালিকের সামনে মুখ লুকাতে হবে। সে তো এতটা ভেবে আসেনি। তার সমস্যা হলুদের সমস্যা। ইয়েলো পাজল। ক্যানভাসে কিছুতেই সেই ফুল— হলুদ কিংবা বোলপুরের বাসন্তী হলুদ সালোয়ার-কামিজ ধরা যাচ্ছে না। ফলে সেই মরণবাঁচন সমস্যাটা নিয়েই তো তার এতদূর ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি মাথায় ছুটে আসা। এখন কি তবে র‍্যাচেল— প্রত্যাখ্যান? সে ভয়ে ভয়ে কানের লতিতে হাত দেয়। ভিজে কানের লতি থেকেও জল ঝরিতেছে।

—তা বলে দুর্যোগ নিয়ে এভাবে কেউ আসে? নিশ্চয়ই মিষ্টি তোমায় ফোন করেছিল? আগে বাথরুমে গিয়ে জামাপ্যান্ট ছেড়ে এসো। আমি তোমাকে কাপড় দিচ্ছি।
—মিষ্টি কোথায়?
—ঘ্যানঘ্যান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি যাও। আমি ডেকে দিচ্ছি।

সত্যিই সে ভিজে বেড়ালের মতো টুক করে অচেনা বাথরুমে ঢুকে পড়ে। মহিলার ব্যক্তিগত বাথরুম। শ্যাম্পু। ফেসওয়াশ। টুথপেস্ট। বাচ্চা-বড় টুথব্রাশ। সাবান। কমোডের পাশে বাথরুম ক্লিনার। বড় হাতলওলা ব্রাশ। আরও বহু কিছুর সঙ্গে বন্ধ হাওয়ায় তীব্র মেয়েগন্ধ। মাথা টলে ওঠে তার। আয়নায় দ্রুত নিজেকে দেখে; এখন কান দুটো বাড়তি মনে হলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাকে পৃথার বাবা হলুদ ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরতে হল। এমন হলুদই তো সে সকাল থেকে খুঁজে চলেছে! তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। কেঁপে ওঠে। পৃথার বাবার ছবি সে দেখেছে। টাই-স্যুটের কেতাদুরস্ত মানুষ। স্মার্ট লুক। সে ঠিক ততটা স্মার্ট নয়। তবে তাঁর মতো ক্লিন-শেভড। ভদ্রলোকের পোশাক হুবহু তার শরীরের মাপে। বহুদিন আলমারিবন্ধ থাকায় ন্যাপথালিনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। এমন পোশাকে সে বিব্রত বোধ করে। ড্রয়িংরুমের চেয়ারে বসে। অর্পিতাদি এক কাপ চা নিয়ে আসে। নতমাথা, সে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। রং আবিষ্কারে ভেতরের দরজাকপাট পটাপট খুলে যেতে থাকে। ভেতরে হু-হু হাওয়া বয়। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথার প্রবেশ। বাবাকে হারিয়েছে বছর তিনেক আগে; তবুও বাবার স্মৃতি কুট্টুসের মতো তার ছায়ার চারপাশে ঘুরঘুর করে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে সে থমকে যায়। ঘুমচোখে তরাসে কেঁপে ওঠে। অনেকটা সেই দিনগুলোর মতো। ‘বাপি’ এই শব্দটা উচ্চারণ করতে চেয়ে সে বিস্ময়ে ফের একবার তাকায়, আর সেই মুহূর্তে আঁকার মাস্টারমশাইকে দেখে সে আঁতকে ওঠে। আঙ্কেল তুমি!

সুস্বাদু স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ ভেঙে গেলে মুখের ভেতর যেমন কষা বিষাদ জন্মায়, পৃথার মনের অবস্থা কি এখন কতক তেমন? সে মুখ গুজে ভেতরের ঘরে চলে যায়; বৃষ্টিটা বোধহয় এখন সে নিজেই আঁকতে পারবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...