Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নাটক ‘আক্রমণ’ — সময়ের স্বর

আক্রমণ

রৌহিন ব্যানার্জী

 

১৯৯২-এর ৬ই ডিসেম্বর ধ্বংস করা হয় বাবরি মসজিদ। সেই ধ্বংস শুধু একটা মসজিদের ভাঙন ছিল না -– আরও অনেক বিশ্বাস, অবিশ্বাসের মোড়ক, সন্দেহের মোড়ক, সবই ধসে পড়েছিল সেইসঙ্গে -– দেশকে ঠেলে দিয়েছিল এক সর্বব্যাপী দাঙ্গার মুখে -– স্বাধীনতার পরে যেমন দাঙ্গা আমরা এর আগে আর দেখিনি। দেশজুড়ে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামতে না থামতেই ৯৩-এর জানুয়ারিতে বম্বে (মুম্বাই)-তে আবার শুরু হয় নতুন করে দাঙ্গা। শিবসেনা-প্রধান বালাসাহেব ঠাকরের প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ মদতে মহল্লার পর মহল্লা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বেছে বেছে খুন করা হয়। সমাজবিরোধীরা দাঙ্গাকারী সেজে করে যায় একের পর এক খুন এবং অপহরণ।

ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই বিজয়গড় মেঘদূত প্রযোজিত এবং শুভাশিস চ্যাটার্জী নির্দেশিত নাটক “আক্রমণ” প্রদর্শিত হল নিরঞ্জন সদনে, গত ১০ই ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে। এই নাটকের এটিই প্রথম প্রদর্শনী — সেই হিসাবে প্রযোজনাগত ত্রুটি নেই বললেই চলে। পুরো প্রযোজনাটিতে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। মঞ্চসজ্জা এবং পোশাক পরিকল্পনায় সমসাময়িকতার দাবীগুলি মোটামুটি যথাযথভাবেই মানা হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় আলোর ব্যবহার একটু একঘেয়ে এবং প্রেডিক্টেবল লেগেছে। আর শব্দ এমনিতে বেশ পরিষ্কার হলেও কবিতাগুলি শুনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। অভিনয় প্রত্যেকেরই যথাযথ — বিশেষ করে গুণ্ডাদলের নেতা মনোহরের অভিনয়ে দাপট চোখে পড়ল। কিন্তু এই নাটকের মূল জোর অবশ্যই তার কন্টেন্টে — যেখানে সেই অশান্ত সময়কে সরাসরি, কোনওরকম ভণিতা ছাড়াই ধরতে চেয়েছেন এবং তা পেরেছেন নাট্যকার ও পরিচালক। হিন্দুত্ববাদের হুঙ্কার, সাধারণ মানুষের অসহায়তা, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকসুলভ গা বাঁচিয়ে চলার মানসিকতা এবং তার সঙ্কট, তথাকথিত “অরাজনৈতিকতা”র অন্তঃসারশূন্যতা — এসবই এই নাটকে উঠে আসে সরাসরি, কোনওরকম রাখঢাক, ভণিতা না করে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই স্পষ্ট বক্তব্যের প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করি।

“আক্রমণ” শুধু একটা নাটকের নাম নয় — আক্রমণ একইসঙ্গে একটা স্টেটমেন্ট এবং একটা অনুভূতিও বটে। এবং একটা অস্বস্তিও যা সহজে পিছু ছাড়তে চায় না। কারণ এটা কোনও গল্প নয় — এটা এক খণ্ডিত সময়ের মূর্ততা — যে খণ্ডকাল আমাদের অবচেতনে একটা দগদগে ঘা-এর মতো স্থায়ী হয়ে রয়েছে। পরিচালক এবং নাট্যকার এই খণ্ডকালকে ফিরে দেখার সময়ে কোনও তথাকথিত “নিরপেক্ষ” দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন অনুভব করেননি -– কারণ তাঁরা ভালোই জানতেন প্রথম থেকেই যে তাঁরা কোন পক্ষে এবং কেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কারা লাগায় এবং কেন লাগায়, তাতে কার কাঁধে বন্দুক এবং কার হাতে ট্রিগার থাকে সে অঙ্ক আমাদের অজানা নয় -– মুম্বাই দাঙ্গাও সেই ছকের ব্যতিক্রম নয়। এই কাঁধ আর হাতের তফাৎটা নাট্যকার খুব সূক্ষ্মভাবে ধরেছেন -– তাই গুণ্ডার দল, যারা আদতে সেই লুম্পেন প্রলেতারিয়েত শ্রেণিরই প্রতিভূ, শেষ অবধি “ভদ্রলোক” গৃহকর্তাকে তেমন মারধোর করেন না -– বাড়ির কর্ত্রী, এই গল্পের অন্যতম প্রোটাগনিস্টও তাই তাদের ওপর ততটা “রেগে যেতে” পারেন না। রাগের অভিমুখ স্থিরই থাকে।

অন্যদিকে বাড়ির কর্তা, যিনি উচ্চ-মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী, কিন্তু তবুও শেষ অবধি অসহায়। নবারুণ যেমন বলেছিলেন -– “বাঙালি শুধুই খচ্চর নহে, তদুপরি অসহায়” -– সেই শ্রেণিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন নিজের কথায়, বার্তায়, ব্যবহারে, ভয়ে, রাগে এবং তর্কে। তথাকথিত “শিক্ষিত, উদারমনস্ক, আধুনিক” হয়েও তার যুক্তিপরম্পরা শেষ অবধি সেই “আমরা-ওরা”তেই গিয়ে ঠেকে। অপরের গণ্ডি ডিঙাতে পারে না -– যেমন পারলেন তার স্ত্রী। আর যাদের সঙ্কট ঘিরে এই কাহিনীর মূল চলন, সেই প্রোফেসর ইকবাল এবং তার স্ত্রী মেহের, তাঁরাও মধ্যবিত্ত, স্বচ্ছল, কিন্তু শেষ অবধি সুবিধাভোগী শ্রেণির পরিচিত গণ্ডির থেকে বেরিয়ে আসতে হওয়ায় তারা কেমন যেন দিশাহারা। এই শ্রেণিচরিত্রগুলি নাটকে খুব সরাসরি দেখানো হয়নি কারণ কাহিনীর মূল চলন অন্য পথে -– কিন্তু তাকে আড়াল করার কোনও চেষ্টাও নাট্যকার করেননি। নিজের চরিত্রগুলির প্রতি সৎ থাকার এই নিষ্ঠার জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।