Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বইমেলায় ছোটা-‘ছুটি’র দিন

 দেবব্রত কর-বিশ্বাস

–আর কটা বই কিনবি বল তো আজ?

–কেন বল তো? আর কিছু খাবি তো খা। আয়াম রিচ নাউ। কাল স্যালারি ঢুকেছে।

–যেটা জানতে চাইছি বল।

–ঠিক নেই। যেকটা ভালো লাগবে কিনব।

–খাটে সাজিয়ে ছবি তুলে আমাকে দিবি। পোস্ট করব। হিহি!

ফুডকোর্টে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন এক তরুণ-তরুণী। মেয়েটির কথা শুনে নির্বিকার মুখে মুরগীর ঠ্যাং চিবোচ্ছিলেন ছেলেটি। বইমেলার আনাচকানাচ এক করে ঘুরে ফেললে বেশ বোঝা যাচ্ছে বইমেলা আসলে দুটো জায়গায় হচ্ছে। একটা মাঠে, আরেকটা সোশ্যাল মিডিয়ায়। যারা আর একটু আগের প্রজন্মের তারা নিশ্চই খেয়াল করেছেন, প্রতিটি পাড়ায় একজন করে ‘সাংস্কৃতিক কাকু-কাকিমা’ থাকতেন। যাদের পড়ার ঘরের শোকেসে কাচের পেছনে সারি দিয়ে সাজানো থাকত রচনাবলিরা। শরৎ থেকে বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ। বইগুলো তাঁরা সহজে কাউকে দিতে চাইতেন না। কিন্তু কখনও যদি কাচের আড়াল ভেদ করে বইগুলোর কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত তাহলে বেশ বোঝা যেত বইয়ের পাতাগুলো কোনওদিন মানুষের হাতের ছোঁয়া পায়নি। হাতের ছোঁয়া পেলে বইয়ের পাতা সজীব হয়, আর পাঠের অনুভবে পৌঁছে যেতে পারলে তারা মনে মনে পাঠকের প্রেমিকা হয়ে যায়। কিন্তু সাজানো শোকেসে রাখা বইগুলো যেন কাগজের পুতুল, গৃহকর্তার রুচির শোভাবর্ধন করে। এখন দিনকাল পাল্টেছে। এখন শোকেস নয়, ফেসবুকের অ্যালবামই আসল। লাইক না পেলে মানসম্মান থাকে না। ‘ওয়াও’ কমেন্ট না পেলে জাতনষ্ট হয়। তা এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মায়াবী সময়ে কেমন আছে আমাদের বইমেলা? এমনিতেই সে প্রায়-যাযাবর। ময়দান-স্টেডিয়াম-মিলনমেলা হয়ে এবার সেন্ট্রাল পার্ক। যে গতিতে সে এগোচ্ছে, কোনও এক বছর পলাশীর আমবাগানে কলকাতা বইমেলা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আজ আবার প্রথম রবিবার। কলকাতা বইমেলার ভাগ্যে দুটো রবিবার থাকে। এই দুটো দিনই সব থেকে ভালো বিক্রিবাট্টা হয়। আজকেও ভিড় কম ছিল না। দুপুর নাগাদ মাইকে সুমন বাজছিলেন: “বন্ধু কী খবর বল? কতদিন দেখা হয়নি!” কী আশ্চর্য এই মিলে যাওয়া। বহুদিনের পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার এ যেন এক প্ল্যাটফর্ম। শুধু কি ‘কতদিন দেখা হয়নি’? সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ‘কোনওদিন দেখা হয়নি’র সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়: “আপনি ওমুক না? আমি তমুক। চিনতে পেরেছেন আমাকে? আমি কিন্তু আপনাকে বেশ চিনেছি। ফেসবুকে যেমন, সামনাসামনি আপনি ঠিক তেমনই।” এসব কানে এলে থম মেরে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আমরা এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে আমাদের চরিত্র দুরকম। একটা ভার্চুয়াল, আরেকটা মুখোমুখি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল এসব বুঝতে পারার আগেই দেখা হয়ে যায়। যার সঙ্গে চুপিচুপি রাত জেগে কত গল্প হয়, মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে তাকে অচেনা লাগে কি? এসব দৃশ্যরা জন্ম নেয় ছুটির দিন। বই সেখানে উপলক্ষ মাত্র। পাঠক সেখানে কিছুটা হলেও ব্রাত্য। ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজনের মতো সাইট, স্টারমার্কের মতো দোকান, সর্বোপরি কলেজ স্ট্রিটের মতো রাস্তার দৌলতে সারাবছর বইমেলা চালানো যায় নিজের মতো করে। তাহলে কেন এত দূর দূর থেকে ছোটাছুটি? কারণ, কলকাতা বইমেলার রবিবার মানেই গেট টুগেদার। বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া লিটল ম্যাগের কবিবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনার গেট টুগেদার। ফেসবুকে যে কলেজপড়ুয়ার ছবি দেখে মনে মনে প্রেমে পড়েছে সংসারী মহিলাটি, তাকে মুখোমুখি খুঁজে পাওয়ার সুখের গেট টুগেদার। যে লেখকের গল্প পড়ে নিজের জীবনের মানেটাই বারবার বদলে যায়, তাকে দেখতে পাওয়ার তৃপ্তির গেট টুগেদার। যে কবির লেখা তীরের মতো ভেদ করে দেয় হৃদয়, তার হাত ছুঁয়ে শিউড়ে ওঠার গেট টুগেদার। এগুলোই সার্থকতা। এসব দৃশ্যরা প্রত্যক্ষ করেন স্বয়ং সময়। দেখতে দেখতে সন্ধে হয়। সময় ফুরিয়ে আসে রবিবারের। গেট টুগেদার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর গোটা বাংলা নদী হয়ে যায় সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের গেটে।