Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনাত্মা

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

 

দীপঙ্কর দেরিতে ওঠে। সকালে ব্রাশ করে, খায়, অফিস খায়। গরমে চান করে রোজ, শীতে একদিন অন্তর। কখনও কখনও ভুলে গিয়ে দুদিন পরপর করে নেয়। তারপর সেকি লজ্জা। দীপঙ্কর জানে, এসব সে করে না, তাকে করিয়ে নেয়। ব্রেন। মিত্রা বলেছিল, থ্যালামাস কোথায় বাবা? মিত্রা, মানে স্কুলের খাতায় সংঘমিত্রা। স্লিপে যেতে ভয় পেত। উঁচু কোনও রাইডে চড়তে ভয়। একেকদিন ফ্ল্যাটের লিফট খারাপ হলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেও ভয়। ছাদে যাওয়া তো বন্ধই করে দিল। এই বয়সেই এসব? কাটিয়ে উঠেছিল। রেজাল্ট। হায়ার এডুকেশন। ব্রাসেলসে পিএইচডি। ওখানেই কোথায় একটা কলেজে পার্ট টাইম। পোস্ট ডক। তারপর একটা ছেলের কথা এল। কলিগ। যেদিন বাড়ি এল, চোখে কালি, গর্ত। বলল কিছু খেতে দাও বাবা। শরীর কাঠির মতো। সারাদিন ঘরে বসে ভাবে। ‘এরপরে কী করবি ভেবেছিস?’ চুপ। ‘পড়াশুনোটা ছাড়লি কেন?’ চুপ। দীপঙ্কর ওর মধ্যে সেই পুরনো আমিটাকে খুঁজতে যায়। পায় না। দীপঙ্কর জানে, ও উচ্চতা থেকে পড়ে গেছে। পাগল হয়ে গেল মেয়েটা? ব্রেন। ভুল ও করেনি, ব্রেন ওকে করিয়ে নিয়েছে। এই বয়সে এত খ্যাতি, সাক্সেস। পারে আর? দীপঙ্কর অফিসে ট্যাক্সের হিসেব করে। স্যালারির। পুরনো রেজিস্টার শেষ হয়ে গেলে নতুন একটা। ‘আমিও পুরনো হয়ে যাব?’ সুজাতা জিজ্ঞেস করত। চোখে। দীপঙ্কর জানে এসবের কোনও মানে নেই। মায়ার বাড়ি বেশি যাতায়াত করলেই ও ক্ষুণ্ণ হত। সিনক্রিয়েট। অথচ কুণাল হঠাৎ চলে যাওয়ার পর মায়ার আর কেউ ছিল না। বাচ্চাটা একা। অফিসের আর কেউ কিচ্ছু করল না। সুজাতা এসব জেনেই প্রথমদিকে মদত দিত। পরে, অসম্ভব বিষাক্ত কথা। বুঝতে পেরে অসম্ভব শীতল হয়ে গেল মায়া। ‘আপনি আর আসবেন না এখানে’। দীপঙ্কর সরে এসেছিল। দুজনের থেকেই। মাথার ভেতর বৃদ্ধি। ম্যালিগন্যান্ট। সুজাতা অসুখ বাঁধাল। ‘আর আমি তোমায় বলব না কিছু, আমায় বাঁচাও’। স্বভাববিরোধী কথা। তবু, যখন বলেছিল, টার্মিনাল। বাকি অর্গানগুলোও বিকল হচ্ছিল। ব্রেন। দীপঙ্কর ধরে নিয়েছে, সন্দেহ আর তারপর অনুশোচনা, সুজাতা নিজে এর কোনওটাই করেনি। ওর ভেতর পুজো ছিল, কুলদেবতা ছিল, ঘর ছিল, কেবলটিভির লোককে মনে করে করে পয়সা দেওয়া ছিল, শুধু, আমিটুকু ছিল না। ব্রেন। ব্রেনই ওকে করিয়ে নিয়েছিল। দীপঙ্করের প্রোমোশন হয়নি। একবার প্রায় নিশ্চিত শুনেও তারপর হল না। টাকাটা বাড়লে ভাল হত। বাবা খেলা দেখতে গিয়ে পড়ে গেল। মাঠের রেলিঙের কাছে রক্তারক্তি কাণ্ড। থার্ড স্ট্রোক। উঠতে বসতে আয়া লাগে। কাপ ডিশে ঠকঠক শব্দ করে ডাকে। কান ঠোঁটের কাছে এনে শুনতে হয়। জড়ানো গলা। পায়খানা পেচ্ছাপ ইচ্ছে করে নাকি কে জানে, বলে না। এই নিয়ে তিননম্বর আয়া। বাবা। ঘাটশিলার বুরুন্ডি লেকের কাছে খারাপ রাস্তা। রেগে গিয়ে বলেছিল দীপঙ্কর, ‘এরম রাস্তায় কেন আনলে?’ –‘জেনেশুনে কেউ খারাপ রাস্তায় আনে না দীপু। আশা ভরসায় এসে শেষমেশ আটকা পড়ে যায়।’ শালা ঢপবাজ। বিয়েটায় ইচ্ছে ছিল না। জোর করে করাল। ‘আমার বয়স হচ্ছে’। সেন্টিমেন্ট। নিজেও গাড্ডায় পড়ল। আমাকেও। দীপঙ্কর জানে ব্রেন। করিয়ে দিয়েছে। বাবা নিজে কিছু করেনি। লোকটার আমিত্ব বলে কিছু ছিল না। একটা সন্দেশও কোনওদিন একা খায়নি। দীপঙ্কর দেরি করে অফিস থেকে ফেরে। জানে, মিত্রা বারান্দায় বসে থাকবে। ভেতরের ঘর থেকে খুটখাট। আয়া মেয়েটা সিরিয়াল দেখবে হয়ত। দীপঙ্কর ঘরে ঢুকলে মিউট করবে। দীপঙ্কর জানে এসব একটা খেলা। না থাকার খেলা। যে খাওয়াটা অফিস ফেরত খাবে সেটা মিত্রা বানালেও ওর মধ্যে মিত্রা নিজে থাকবে না। স্বাদ থাকবে না। নুন থাকবে না। শাড়িতে কী একটা খুঁজবে, চোখ এপাশে ওপাশে ঘুরবে। দীপঙ্কর যে বাড়িটায় ফিরবে তার মধ্যে ওই বৃদ্ধ থাকবে না। নেমপ্লেটেও। কী হবে বাড়ির নাম? ছোট্ট দীপুর পছন্দ হয়নি। বাবার খেয়াল। বাদ দিলেই হয়। মার চোখে সেই প্রথম জল দেখেছিল। কিছু বলতে পারেনি। নামটা থেকে গেছিল। সেই নেমপ্লেট। দীপঙ্কর জানে, মিত্রার রান্নার মতো, বাড়িটার মতো, নেমপ্লেটেও কোনও আমি থাকবে না। ওখানে কোনও আমি নেই। কালোর ওপর সাদা দিয়ে বড় করে লেখা ‘আমরা’।