নিঃসঙ্গতার শিল্পরূপ

নিঃসঙ্গতার শিল্পরূপ | ভগীরথ মিশ্র

ভগীরথ মিশ্র

 

১.

গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়, স্টিলের আলমারিটার গায়ে কেউ যেন অতি সন্তর্পণে ঘা মারছে। আওয়াজটা এতটাই মৃদু আর সাবধানী, দিনের বেলায় হাজারো শব্দের মধ্যে ডুবে যেত। রাতের নিস্তব্ধতায় আওয়াজটা বেশি বেশি হয়ে বাজছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আওয়াজটাকে শুনতে থাকে দীপঙ্কর। ভয় পেয়ে যায়। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে আলমারির পাশটিতে একটা ছায়ামূর্তিকে যখন আঁতিপাতি খুঁজছে ওর চোখ দুটো, তখনই মানসী ঘুমজড়ানো গলায় বলে ওঠে, কিছু নয়, আলমারির পেছনে একটা মাদি টিকটিকি সংসার পেতেছে, রাতের বেলায় ওর মনে পুলক জাগে। একটু বাদেই থেমে যাবে।

দীপঙ্কর বিরক্তিমাখানো গলায় বলে, পুলক যখন জেগেইছে, অত জলদি কি থামবে? জ্‌বালাল! ঘুমটাই মাটি।

–ভেবো না, থেমে যাবে। মানসী জড়ানো গলায় বলে, আমাদের বিয়ের ফটোর পেছনে থাকে মর্দাটা। আলমারির গায়ে ঢাকের বাদ্যি শুনে এতক্ষণে সে রওনা দিয়েছে। ও পৌঁছে গেলেই মাদিটা শান্ত হয়ে যাবে।

আর, কী অবাক কাণ্ড, একটু বাদেই থেমে গেল আলমারির গায়ের বাদ্যি!

একটু বাদেই আশেপাশে কোথাও টুংটাং বাজনা। কাচের চুড়ি পরা হাত দুটো নাড়াচাড়া করলে এমন মিষ্টি আওয়াজ ওঠে। কিন্তু এই গভীর রাতে ঘরের মধ্যে চুড়ির আওয়াজ কেন! মানসী তো কাচের চুড়ি পরে না! তবে? দীপঙ্কর পুনরায় উৎকর্ণ হয়। অন্ধকারের মধ্যে কান চারিয়ে বাজনাটার উৎস সন্ধানে রত হয় সে।

ঘরের মধ্যেই বাজছে চুড়িগুলো। একবার মনে হয় আলনাটার আশেপাশে, পরমুহূর্তে মনে হয়, ড্রেসিং টেবিলের কাছাকাছি। কাচের চুড়ি না পরলেও মানসী যখন আলনার পাশে দাঁড়িয়ে কাপড় গোছায়, কিংবা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়ায় কিংবা প্রসাধন সারে, ওর হাতের শাঁখা-পলা, সোনার চুড়িগুলো একজাতের রিনিঝিনি আওয়াজ তোলে। আর, তার থেকে শোবার ঘরের বাইরে থেকেও টের পাওয়া যায়, মানসী রয়েছে ওই ঘরে। আর যাই হোক, মানসী নিশ্চয়ই এত রাতে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আলনার পাশে কাপড় গুছোচ্ছে না, কিংবা ড্রেসিং টেবিলের সামনে প্রসাধন করছে না। অথচ আওয়াজটা আসছেই। সেটা একেবারে অসম্ভব মনে হলেও দীপঙ্কর অন্ধকারে আলতো হাতে একটিবার পাশে শুয়ে থাকা মানসীকে ছোঁয়। দীপঙ্করের থেকে প্রায় ইঞ্চি ছয়েক দূরে নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে মানসী। তবে এত রাতে আলনা কিংবা ড্রেসিং টেবিলের আশেপাশে টুংটাং চুড়ির আওয়াজ তুলছে কে?

ঠিক সেই মুহূর্তে পাশ ফিরে শোয় মানসী। ঘুমঘুম গলায় বলে, কিছু নয়, ড্রেসিং টেবিলের পাশের তাকে রাখা বাহারি বোতলের ঢাকনাটা হাওয়ায় নড়ছে।

ছুটির দিনে ঠা ঠা দুপুরে বাগানের এক কোণে চাষবাসের সরঞ্জাম রাখার কুঠুরি থেকে একটা বিজাতীয় আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে উৎকর্ণ হয় দীপঙ্কর। দুপুরবেলায় কাগজকুড়ুনিগুলো খুব দৌরাত্ম চালায়। খুব দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ে। বাসন মাজবার ভীম-বার, স্কর্চ-বাইট থেকে বাগানের ছুরি-কাঁচি, এমনকি ছাই রাখবার অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটা অবধি নিয়ে যায়। দীপঙ্কর উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।

শুকনো কাপড়গুলো আলনায় গোছাতে গোছাতে খুব নিরাসক্ত গলায় মানসী বলে ওঠে, পাড়া-বেড়ানো সাঙ্গ করে হুলো বেড়ালটা আমাদের বাগানের কুঠুরির ভেতরে রেস্ট নিচ্ছে। বিকেল পাঁচটা অবধি ওর রেস্ট।

রাতের বেলায় বাগানে কীসের যেন আওয়াজ। শুকনো পাতার ওপরে সাবধানে হাঁটাচলা করলে এমন আওয়াজ ওঠে। ইদানিং খুব ফুল চুরি হচ্ছে। কিছু সহায়সম্বলহীন বুড়ি একেবারে নিরুপায় হয়ে ধরেছে এই পথ। ঝুঁকি নিয়ে বেরোয় রাতের বেলায়। ফুলওয়ালা বাগানগুলোয় খুব ঝুঁকি নিয়ে ঢোকে। রাত পোহালে চুরি করা ফুলগুলোকে নিয়ে বাজারের এক কোণে বসে। ধর্মপরায়ণের দল ওই চুরি করা ফুল কিনে ঠাকুরের পায়ে দেয়। এতদ্বারা ওরা স্বর্গে যাবার সিঁড়ি বানায়। তাতে করে ওই অসহায় বিধবাদের জীবনটা বাঁচে।

কিন্তু ওই পায়ের আওয়াজটা যে ওদের মধ্যেই কারও, তার তো কোনও মানে নেই। আরও কোনও চরম সর্বনাশ করবার ষড়যন্ত্র রচনা করে কোনও দুষ্কৃতী যে বাগানে ঢোকেনি, তার কোনও গ্যারান্টি আছে!

ভাবতে ভাবতে বিছানার ওপর উঠে বসে জানলা দিয়ে চোখ চারাবার চেষ্টা করে দীপঙ্কর। পাশ থেকে জড়ানো গলায় মানসী বলে ওঠে, ওই হুলো বেড়ালটা।

–হুলো বেড়াল! ও অ্যাতো রাতে কী করছে বাগানে?
–কামিনী গাছের চুড়োয় একজোড়া টুনটুনি বাসা বেঁধেছে। ডিম ফুটিয়ে কদিন আগেই বাচ্চা হয়েছে ওটার। তিনটে। বেড়ালটা ওই লোভেই জুটেছে।
–সর্বনাশ! আঁতকে ওঠে দীপঙ্কর, তাড়াতে হয় তো বেড়ালটাকে।
–দরকার নেই। ও বাসা অবধি পৌঁছতে পারবে না। টুনটুনি দুটো বেজায় সেয়ানা। গাছের চুড়োর দিকে একেবারে লিকলিকে ডাল দেখে বাসাটা বানিয়েছে। রোজ রাতেই বেড়ালটা ওই ডাল অবধি পৌঁছবার আগেই ধুপ করে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে।

বলতে বলতে ধুপ করে আওয়াজ হল বাগানে।

–ওই, পড়ল। বলতে বলতে পাশ ফিরে শোয় মানসী।
–তার গোছের কিছু পুড়ছে। হাওয়ায় গন্ধ।

মানসী বলে, রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানের সামনে বুড়ো ভিখিরিটা টায়ার পোড়াচ্ছে মশা তাড়াবার জন্য।

পাশের বাড়ির দোতলার জানলায় ধাক্কা মারবার আওয়াজ হল। মানসী বলে, পাশের বাড়ির বুল্টন ফিরল এতক্ষণে। নিজের ঘরের জানলা খুলছে।

কোত্থেকে একচিলতে আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। মানসী বলে, বুল্টনের ঘরের থেকেই আসছে। এক্ষুনি নিভে যাবে। বুল্টন এবার ঘুমোবে তো। সত্যি সত্যি একটু বাদেই আলোটা নিভে গেল।

শেষ রাতে একটা কুকুরের বাচ্চার কান্না শুনে ঘুম ভেঙে যায় দীপঙ্করের। মানসী বলে, মধু ডাক্তারের ছোট ছেলেটা একটা কুকুরের বাচ্চা এনেছে কদিন হল। দিনের বেলায় বেঁধে রাখে। সেইসঙ্গে ট্রেনিংও চলছে ওর। রাতের বেলায় গ্রিলঘেরা বারান্দায় আটকে রাখে। ওটাই কান্না জুড়েছে।

–কিন্তু অন্য সময় তো কাঁদে না। এখন কেন কাঁদছে?
–রাতভর আটকানো রয়েছে তো, ওর হিসি পেয়েছে।
–হিসি পেয়েছে তো করে ফেললেই পারে, কাঁদছে কেন?
–বা-রে, বাড়ির মধ্যে হিসি না করবার ট্রেনিং পেয়েছে যে। বাইরে না বের করলে হিসিই করবে না। মরে গেলেও না।

প্রথম প্রথম অবাক হয়ে যেত দীপঙ্কর, কেমন করে এতসব জানতে পারে মানসী! অত বড় বাড়ির প্রতিটি ঘর, সিঁড়ির তলা, টয়লেট, বাথরুম, কিচেন, সিঁড়িঘর, ছাদ, আলসে, এবং চারপাশের গোটা চৌহদ্দির যাবতীয় শব্দ, আলো, গন্ধ, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য— কেমন করে পারে? ও তো আর হাত গুনতে জানে না। তবে?

বাস্তবিক, মানসী এই বাড়িটাকে, গোটা চৌহদ্দিটাকে একেবারে হাতের তালুর মতো চেনে। এই বাড়ির কোন সুইচটা কোন আলো কিংবা পাখার জন্য, কোনটা সামান্য ডিফেক্টিভ, কোনটার বিকল্প সুইচ কোথায় রয়েছে, সবই তার মুখস্থ। দেয়ালের কোন অংশে কটা টিকটিকি বাস করে, বাগানের কোন খোদলে একটা কুনোব্যাং থাকে, বাড়ির কোন দরজার পাল্লা একটু ঠেলে বন্ধ করতে হয়, কোন জানলার পাল্লা খুলতে গেলেই একটু ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়, সবই সে জানে।

আসলে, দিনভর এই বাড়িটাতে একা একা কাটায় মানসী। রোজ সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে আটটা পঁচিশের লোকাল ধরে দীপঙ্কর। দিনভর আলিপুর কোর্টে ওকালতি করে, সন্ধেয় যায় শেয়ালদার ভাড়া করা চেম্বারে। সেখানে রাত নটা অবধি মক্কেলদের সঙ্গে পরের দিনের মামলা নিয়ে আলোচনা সেরে-টেরে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা। মাঝে মাঝে মক্কেলের মামলা নিয়ে দূরবর্তী জেলা আদালতেও যেতে হয় ওকে। দু এক রাত্তির বাইরেও থাকতে হয়। মানসী ওই দিনগুলোতে একা একা থাকে। প্রথম প্রথম ভয় করত, এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন একা একা কাটাতে কাটাতে মানসীর এই বাড়ি ও তার চারপাশের অন্ধিসন্ধি যেন মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এমনকি, ঘরের দেয়ালে, আলমারির পেছনে, আনাচে কানাচে কারা থাকে, কী করে, সবই তার নখদর্পণে।

মানসীর এই নিঃসঙ্গতা নিয়ে এক ধরনের অপরাধবোধ নিঃশব্দে কাজ করে দীপঙ্করের মনে। সুযোগ পেলে সেটা প্রকাশও করে মানসীর কাছে। আত্মসমর্থনের ভঙ্গিতে বলে, বুঝতে পারছ তো, এটাই উন্নতির সময়। এখন পরিশ্রম না করলে—।

মানসী খুব নরম করে হাসে, শরীরটার দিকে নজর দিও।

এককালে খুব চাকরি করবার সাধ জেগেছিল মানসীর মনে। কিন্তু দীপঙ্করই বড় একটা গা করেনি। তখন তার প্র্যাকটিস সবে জমছে। আয়-উপায়ও ভালো হচ্ছে। দীপঙ্করই নানাভাবে নিরস্ত করেছে মানসীকে, কিনা, রোজদিন সকাল সকাল নাকেমুখে গুঁজে চাকরির জায়গায় দৌড়বার কী দরকার! আমার এখনই যা রোজগার, প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত। আসলে, তখন আরও একটা সম্ভাবনার কথা মনে হয়েছিল দীপঙ্করের। দুদিন বাদেই যখন বাচ্চা আসবে মানসীর কোল জুড়ে, তখন চাকরি আর বাচ্চা দুদিক সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাবে মানসী। বাচ্চাটারও অযত্ন হবে। আর, একটা স্থায়ী চাকরি, একবার পেলে ছেড়ে দেওয়া বড়ই কঠিন। দীপঙ্করের বিশ্বাস, মায়েরা চাকরি করলে বাচ্চারা ঠিকঠাক মানুষ হয় না। বন্ধুদের তো দেখছে।

কিন্তু দীপঙ্করের দেখা সেই স্বপ্নটি বাস্তবে রূপ পেল না এতদিনেও। আর, এখন তো ডাক্তারেরা বলেই দিয়েছে, সেই সম্ভাবনা আর নেই। কাজেই, নিঃসঙ্গতাই এখন মানসীর দিনরাতের সঙ্গী।

চাকরি না করলেও মানসীকে অন্য কোনওভাবে ব্যস্ত রাখবার কথাটা মনে হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। একদিন দীপঙ্কর সেই কথাটাই পাড়ে মানসীর কাছে।

–তুমি তো এককালে খুব ভালো ছবি আঁকতে। একাদেমি অফ ফাইন আর্টসে ডিপ্লোমাও করেছ এককালে। ছবি এঁকে কত কত পুরস্কারও পেয়েছ। তো, ওটাই আবার শুরু করো না।

দু চারদিন চুপ করে থাকে মানসী। ভাবে। একদিন বলে, আবার ছবি আঁকাটা ধরলে মন্দ হয় না।

ওই হপ্তাতেই দুজনে গিয়ে ইজেল, ক্যানভাস, রং-তুলি সব কিছু কিনে এনেছে। মানসী নতুন করে শুরু করেছে ছবি আঁকা। দোতলার একটা ঘরে একটা স্টুডিওমতো বানিয়ে নিয়েছে। দীপঙ্কর বেরিয়ে গেলে ওই ঘরটাই হয় মানসীর সারাদিনের আশ্রয়।

এর ফলে দীপঙ্করের ঝকমারিটা অবশ্য একটুখানি বেড়েছে। সারা দিন ধরে মক্কেলদের সঙ্গে বকবক করে যখন বাড়ি ফেরে, শরীর আর বয় না তখন। কিন্তু দিনভর শুয়েবসে থাকা মানসী দীপঙ্কর ফেরামাত্রই সাড়ম্বরে দেখাতে চায় কী কী আঁকল সেদিন, কেমন এঁকেছে, আরও কী কী আঁকবার কথা ভেবেছে। প্রথম প্রথম মানসীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে স্টুডিওতে নিয়ে যেত দীপঙ্কর। বুঁজে আসা চোখদুটোকে বহু কষ্টে মেলে ধরে দেখত ছবিগুলো, শুনত মানসীর পরবর্তী পরিকল্পনার কথা। কিন্তু বেশিদিন ওর সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি সে। মানসীও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, দীপঙ্কর একেবারে ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কেবল মানসীর মন রাখতেই করে ওটা। একসময় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সেও। এখন সে একা একা ছবি আঁকে। নিজেই আঁকে, নিজেই দেখে, নিজেই ওগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে। দীপঙ্কর ওর ছবি আঁকার খবরাখবর রাখতে পারেনি অনেকদিন।

ইতিমধ্যে দীপঙ্করের পসার আরও বেড়ে গিয়েছে ঢের। দু হাতে টাকা আয় করতে গিয়ে এখন তার দিন-রাত একাকার। এখন ছুটির দিনগুলোতেও হাজার ব্যস্ততায় কেটে যায় ওর। সংসারে প্রাচুর্য বেড়েছে ঢের, কিন্তু মানসীর সঙ্গে ওই এক মধ্যরাত ছাড়া ওর আর দেখাই হয় না। মানসী মেনে নিয়েছে। বরং দীপঙ্করই মাঝে মাঝে অপরাধীর মতো আত্মসমর্পণ করে মানসীর কাছে। বলে, কী যে খারাপ লাগে আমার!

–কেন? মানসী অস্থির চোখে তাকায়।
–লাগবে না? তোমাকে একটুও সময় দিতে পারছি আমি?

মানসী নিঃশব্দে হাসে। বলে, আমাকে সময় দিলে তোমার মক্কেলরা ছেড়ে কথা কইবে? তারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিচ্ছে না?

–সেই কথাই তো বলছি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করতে গিয়ে…

মানসী আবারও হাসে। সেই হাসিতে কোনও অসূয়া থাকে না। বলে, ওকালতি করে এত কম সময়ের মধ্যে কজনের এমন পসার হয় বলো?

–সেটা ঠিক। তাই বলে তোমাকে একেবারে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে…
–তাই? আর পসারটা না জমলে সেটা ভালো লাগত আমার? তোমাদের বয়েসি কতজনই তো প্র্যাকটিস শুরু করেছিল তোমারই সঙ্গে, তাদের মধ্যে অনেকেই তো কোট কাচবার পয়সাটুকুও আয় করতে পারে না। তাদের বউয়েরা তাদের কী চোখে দেখে, আন্দাজ করতে পারো তুমি? আমি পারি।

মানসীর এমন সব কথায় খানিক সান্ত্বনা পায় বটে দীপঙ্কর, কিন্তু তাও বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করতেই থাকে।

ইদানিং বড়ই কম কথা বলে মানসী। কেমন জানি উচ্ছ্বাস থেমে গিয়েছে ওর। খুবই শান্ত হয়ে গেছে সে। দীপঙ্কর, এমনই ব্যস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ, মানসীর এই মৌনতাটাকেও খেয়াল করবার সময় পায় না। ক্বচিৎ কদাচিৎ তার হঠাৎ হঠাৎ খেয়াল হয়, গেল এক হপ্তায় দু একটা মামুলি কথা ছাড়া মানসীর সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি ওর।

মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়ে যায় মানসীর ওপর। এতখানি চুপচাপ না থেকে সে যদি একটুখানি চোটপাট করত দীপঙ্করের ওপর, যদি জবরদস্তি খানিকটা সময় কেড়ে নিত নিজের জন্য, তাহলেও বুঝি ভালো ছিল।

 

২.

কোর্টে বেরোবার মুখে মানসী ক্ষীণ গলায় বলে, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফেরার সময় হবে তোমার?

বেরোবার মুখে এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান দীপঙ্করের কাছে। ঘড়িতে সাতটা চল্লিশ। আটটা পঁচিশের লোকালটা ধরতে পারলে হয়।

খুব ব্যস্ত হয়ে শুধোয়, কেন, কী আছে আজ?

খুব নিরাসক্ত গলায় মানসী বলে, আজ আমাদের বিয়ের দিন তো, তাই…

সত্যিই তো! আজ তো ওদের বিয়ের দিন! কথাটা মনেই ছিল না দীপঙ্করের।

মনে মনে খুবই অপ্রস্তুত বোধ করে দীপঙ্কর। বলে, ইস্‌, ভাগ্যিস তুমি বললে! বলতে বলতেই সহসা মনে পড়ে যায় দীপঙ্করের, আজ কোর্টের পর ব্যারিস্টার সান্যালের বাড়িতে যাওয়ার কথা তার। একটা জটিল কেস নিয়ে আলোচনার জন্য সে নিজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে সান্যাল-সাহেবের থেকে। কিন্তু কথাটা কিছুতেই মানসীকে বলতে পারে না দীপঙ্কর। ঢোঁক গিলে বলে, ঠিক আছে, দেখি, কত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি।

বলতে বলতে রিক্সোয় চড়ে বসে দীপঙ্কর। বলে, একটুখানি জোরে চলো ভাই, দেরি হয়ে গেছে।

শেষ অবধি মিঃ সান্যালের সঙ্গে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা একদিন পিছিয়ে দিতে পেরেছে দীপঙ্কর। তাও কতকগুলো খুবই জরুরি কেস-রেকর্ড নিয়ে চেম্বারে একটুখানি বসতেই হল। উপায় ছিল না। রাত পোহালেই ওগুলোর সওয়াল রয়েছে কোর্টে। সব মিলিয়ে আটটার আগে উঠতে পারল না দীপঙ্কর।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে দীপঙ্কর। ঘড়ির ডায়ালে চোখ রেখে মনে মনে ভাবছিল, আটটা বারোর লোকালটা ধরতে পারলে, তাও পৌঁছতে পৌঁছতে নটা বেজে যাবেই। তাও রোজদিনের চেয়ে পৌনে দু ঘণ্টা আগে।

স্টেশনের বাইরে এসেই সহসা দীপঙ্করের মনে হয়, আজকের দিনে এক্কেবারে খালি হাতে ঘরে ঢোকাটা ঠিক মানায় না। স্টেশন চত্বরের বাইরেই পরপর তিনখানা ফুলের গুমটি। দীপঙ্কর দেখেশুনে একগোছা টাটকা রজনীগন্ধার স্টিক আর একজোড়া গোড়ের মালা কিনল। সহসা সামনের দিকে তাকিয়ে ওর চোখদুটো আটকে যায় সামান্য দূরে ‘রায় জুয়েলার্সে’র সাইনবোর্ডের দিকে।

–ভালো করে বেঁধে প্যাক করো ভাই, আমি আসছি। বলেই হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে দীপঙ্কর। মিনিটখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যায় ‘রায় জুয়েলার্সে’র সামনে।

দীপঙ্কর ওদের পরিচিত খদ্দের। ওকে দেখেই প্রবীণ কর্মচারীটি কান এঁটো করে হাসে, অনেকদিন বাদে যে!

–কানের একটা কিছু দেখান তো, বেশ ভালো দেখে। খুব ব্যস্তসমস্ত মুখে বলে ওঠে দীপঙ্কর।

শেষ অবধি একটা সুন্দর পেন্ডেন্ট পেয়ে যায় দীপঙ্কর। বেশ ভারী এবং লেটেস্ট ডিজাইনের। বলে, এইটেই দিন।

‘রায় জুয়েলার্স’ থেকে ফিরে ফুলগুলো ডেলিভারি নিয়ে রিক্সোস্ট্যান্ডের দিকে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে দীপঙ্কর। ঘড়িতে তখন নটা দশ। একটা চেনা রিক্সো পেয়েই চড়ে বসে তাতে।

রিক্সোর ভাড়া মিটিয়ে পাঁচিলের গ্রিল-দরজায় হাত ছোঁয়ায় দীপঙ্কর। বাড়ির একাধিক ঘরে আলো জ্বলছিল। কোন ঘরে মানসী রয়েছে বুঝতে পারে না দীপঙ্কর। ঘড়ির ডায়ালে চোখ রেখে দেখে নটা পঁচিশমতো। এটা তো দীপঙ্করের বাড়ি ফেরার সময় নয়। এমনি সময় কোন ঘরে থাকে মানসী, কী করে, জানে না সে!

দীপঙ্কর একসময় কলিং বেলে হাত ছোঁয়ায়।

একটু বাদেই দরজা খোলে মানসী। দীপঙ্করের হাতে ফুল দেখে খুশিই হয় সে। ওই চিলতে খুশিটুকু দেখেই দীপঙ্করের প্রাণ নেচে ওঠে আনন্দে। এরপর যখন পেন্ডেন্টের কৌটোটা ওর হাতে ধরিয়ে দেবে সে, মানসীর মুখে নির্ঘাত ফুটে উঠবে থোকা থোকা কুন্দ-কামিনী।

সিঁড়িঘর এবং ব্যালকনি, দুদিক দিয়েই ঢোকার ব্যবস্থা রেখেছে দীপঙ্কর। তবে, সিঁড়িঘর দিয়েই প্রায় সময় যাতায়াত করে ওরা। মানসীও সিঁড়িঘরেরই দরজা খুলেছে।

মানসীকে সামান্য পাশ কাটিয়ে বসবার ঘরের দিকে এগোতে গিয়েই ওর চোখদুটো ধাক্কা খায় সিঁড়িঘরের দেয়ালে। দীপঙ্কর চোখ চারিয়ে দেখে, সিঁড়িঘরের তিনটে দেয়ালেই সারবন্দি ছবি টাঙানো। মানসীর আঁকা ছবি।

দেখতে দেখতে দীপঙ্করের মনে হয়, আঁকার হাতটা সত্যিই ভালো মানসীর। অল্পক্ষণ ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দীপঙ্কর চোখ ফেরায় মানসীর মুখের দিকে, ওইটুকু সিঁড়িঘরে অতগুলো ছবি টাঙিয়েছ কেন? এত ছোট ঘরে এতগুলো ছবি, ঠিক খুলছে না। ঘিঞ্জি লাগছে। ছবিগুলোকে গোটা বাড়িময় ছড়িয়ে দিলে ভালো দেখাত। ছবিগুলোও পরিসর পেলে খুলত।

বলতে বলতে প্যাসেজের দিকে পা বাড়ায় দীপঙ্কর। দু পা এগিয়েই প্যাসেজে পৌঁছে যায়। বিস্মিত নয়নে দেখে, প্যাসেজের দু দেয়ালেও সারবন্দি ছবি।

এতক্ষণে ভুরুতে ঈষৎ ভাঁজ পড়েছে দীপঙ্করের। ওই অবস্থায় ড্রইং রুমে ঢুকেই ভুরুর ভাঁজগুলি প্রকট হয়। গোটা ড্রইং রুমের সবগুলি দেয়াল জুড়ে তিন সারিতে সাজানো খান তিরিশেক ছবি।

মানসীর মুখের দিকে তাকায় দীপঙ্কর। বলে, করেছ কী! সিঁড়িঘর থেকে ড্রইং রুম অবধি একটা টানা একজিবিশন হল বানিয়ে ফেলেছ যে!

ততক্ষণে দীপঙ্করের মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছে। ওই অবস্থায়, কী ভেবে সে ফুলগুলোকে টিপয়ের ওপর নামিয়ে রেখে গোটা বাড়িটাতেই পরিক্রমা শুরু করে। এবং বিস্ফারিত নয়নে দেখতে থাকে, সিঁড়িঘর থেকে শুরু করে, প্যাসেজ, ড্রইং রুম, একতলা ও দোতলার ব্যালকনি, সবগুলো বেডরুম, গেস্টরুম, কিচেন, ডাইনিং, মায় টয়লেটগুলোতেও মানসী টাঙিয়ে রেখেছে সারি সারি ছবি।

যেদিকে চোখ যায়, শুধু ছবি…। দেয়ালে, থামে, সিলিংয়ে, রেলিংয়ে রাশি রাশি ছবি। নির্জন সৈকত, গভীর অরণ্য, হা-হা শ্মশান, দরজা-জানলাহীন বাড়ি, পাঁচিল, গরাদ, খাঁচার টিয়া, জলভরা বন্দি আকাশ, হাত-পা বাঁধা পুতুল…।

সারা বাড়িময় গিজগিজ করছে, কিলবিল করছে ছবিগুলো। দেখতে দেখতে চোখ দুটো ধাঁধিয়ে যায় দীপঙ্করের। সারা বাড়িখানা যেন ছবির এক আস্ত ভাগাড়।

দেখতে দেখতে গা গুলোতে থাকে দীপঙ্করের। বমি আসে। একসময় মাথাটা সামান্য ঘুরতে থাকে ওর।

একসময় মানসীর মুখের দিকে তাকায় দীপঙ্কর। বলে, এসব কী? চতুর্দিকে অ্যাতো অ্যাতো ছবি কেন? উহ্‌, তাকানো যায় না!

মানসী শিল্পিত হাসে। খুব অলৌকিক গলায় বলে, এসব তো ছবি নয়! এ তো তোমারই দেওয়া উপহার, অখণ্ড অবসর। তিলতিল নিরেট নিঃসঙ্গতা। শিল্পকর্ম হয়ে ঝুলছে তোমারই বাড়ির দেয়ালে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...